আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদ্রোহ জাগে পিঠ ও দেয়ালের মিলনে

সুখীমানুষ পরের জায়গা পরের জমি ঘর বানাইয়া আমি রই / আমিতো সেই ঘরের মালিক নই। হাসনের এই জায়গা জমির মালিক সৃষ্টিকর্তা। এত আধ্যাত্মিক না হয়ে বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে বলুনতো, আপনি কি আপনার জমির মালিক? অবশ্যই না। জমির মালিক হচ্ছে সরকার। তাহলে পাহাড়ী দুর্গম অঞ্চলে যখন সরকার গিয়ে সরকারগিরি শুরু করেন নাই তখন সেখানে জমির মালিক কে ছিলো? হ্যাঁ পাহাড়ীদের নিয়ম ছিলো যে যতটুকু জঙ্গল পরিস্কার করে আবাদ / বসবাস এর জন্য তৈরী করতে পারবে ততটুকুর মালিক সে।

আর এই নিয়মে চলছিলোও সুখে স্বচ্ছন্দে। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে সাঁওতালরা দামনে কোহ (রাজমহল পাহারতলী) এলাকায় জীবিকার তাগিদে বসবাস শুরু করে। সেখানের উর্বর পাহাড়ী জমি চাষে তারা ধীরে ধীরে দক্ষতার ছাপ রাখে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় সাঁওতালরা ছিলো সবচেয়ে বড় উপজাতি। তাদের মধ্যে আধুনিক মূদ্রা বা অর্থনীতরি প্রচলন ছিলো না।

এরা চাষাবাদ করতো এবং পণ্য বিনিময় করেই চাহিদা মেটাতো। ধীরে ধীরে ব্যাপরীরা এসে নানান চমকপ্রদ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রী করতে শুরু করলো। আর শুরু থেকেই ব্যাপরীরা বুঝে গেলো এই পাহাড়ীরা বুদ্ধিতে বড়ই সরল। তাই অনেক ফসল নিযে বিনিময়ে সামান্যই দিতো লবন, তেল ইত্যাদি। শুধুকি তাই! পণ্য কিনার সময় মাপা হতো বড় পাথর বা কেনারাম (নাম ছিলো বড়বৌ) আর বিক্রির সময় মাপা হতো ছোট পাথর বা বেচরারম (নাম ছিলো ছোটবৌ)।

নতুন কোন পরিবার এলাকায় এসে চাষাবাদ শুরু করলে শুরুতে তাদের খাবার বাবদ ধান ধার দিতো ব্যাবসায়ীরা। পরে সাঁওতালরা জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি চাষ করার পর এর দখলদারী দিতো ব্যাবসায়ীরা। ব্যাপারীদের জুলুম সহ্য করতে না পেরে কেউ যদি জঙ্গলে গা ঢাকা দিতো তাহলে ব্যাপারীরা আদালতে ঘুষ দিয়ে তার বিরুদ্ধে ডিক্র জারি করতো। এবং তার গবাদী পশু সহ সব কিছু ছিনিয়ে নিতো। এমনকি সাঁওতালদের স্ত্রীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় বাধন যে হাতে লোহার বালা তাও ছিনিয়ে নেওয়া হতো।

এই এলাকায় ইংরেজদের যে জজ নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো সে শুধু রাজস্ব আদায় নিয়েই ব্যাস্ত থাকতো। অন্য কিছু দেখার তার মানসিকতা ছিলো না। এই সুযোগে সরকারী পুলিশ, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই যথেচ্ছা দুর্নীতি করা শুরু করেছিলো। ১৮৪৮ সালে প্রচুর সাঁওতাল অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গহীন জঙ্গলে চলে যায় জীবনের মাযা না করে। আর যারা রয়ে গেলো তারা হয়ে গেলো ব্যাবসায়ীদের গোলাম।

এদের কেউ মারা গেলে সৎকার করার জন্য যে সামান্য দু একটি টাকা লাগতো তা ঋণ নেওয়া হতো মহাজনের কাছ থেকে। এই টাকা যেন শোধ করতে না পারে তাই সমস্ত দিন এদেরকে নিজের সেবায় ব্যাস্ত রাখতো মহাজনরা। আর সৎকারে যাওয়া দু’একটি টাকা শতকরা প্রায় ৫০০ ভাগ হারে চক্রবৃদ্ধিতে বেড়ে দাড়াতো মহীরূহে। এই টাকা কোনবাবেই বংশানুক্রমে এরা শোধ করতে পারতো না। আবার নিকটাত্মীযের মৃত্যু মানে আবারো সৎকার, আবারো ঋনের খনি।

১৮১১, ১৮২০, ১৮৩১ ইত্যাদি সালে সাওতালদের খন্ড খন্ড বিদ্রোহ হয়েছে এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অত্যাচারের মাত্রা যখন ফসল থেকে ঘরের নারী ও শিশুদের দিকেও পৌছালো তখন নিরিহ সাঁওতালদের সামনে বিদ্রোহ ছাড়া আর কোন পথ রইলোনা। ১৮৫৫ সালোর ৩০ জুন ভাগনাদিহির মাঠে ১০ হাজার সাঁওতাল একত্র হলো দুই নির্ভীক ভ্রাতা সিধু ও কানুর নেত্রীত্বে। এই বিদ্রোহে হাজার হাজার সাঁওতাল যোগ দিলো। বন্ধ হয়ে গেলো সরকারের ডাক যোগাযোগ।

ভয়ে পলিয়ে গেলো জমিদার, মেজিস্ট্রেট। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ থামাতে গেলে তাতে আগুনে ঘি এর মত ফল হয়। এই বিদ্রোহে সহযাত্রী হন তেলী, চর্মকার, ডোম ও মুসলমানরা। সাঁওতালদের তীর ও অন্যান্য অস্ত্রের মুখে পিছু হটেন ইংরেজ সরকার। পরে সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করা হয় বিদ্রোহ দমনে।

অশ্বারোহী, হস্তিবাহিনী, কামান ও পদাতিকের মত অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে কঠোরভাবে দমন করা হয় এই বিদ্রোহ। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরবের মত বিদ্রোহী নেতা প্রাণ দিয়ে বীজ বুনে যান স্বাধীনতার। আজ বিনম্র , সশ্রদ্ধ চিত্তে ঐ বীরদের স্মরণ করছি। Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।