ভূমিকা: সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। তবে বিশেষ নিরাপত্তার কারণে চরিত্রের নামগুলি এবং স্থান-কাল কাল্পনিক।
শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পরের সময়টা আবুল হোসেন সাহেবের সবচাইতে প্রিয়। নামাজ পরার পর এমনিতেই মনটা প্রশান্ত ও প্রফুল্ল থাকে, তার পর আবার ছুটির দিন। কাজের কোন ব্যস্ততা নেই।
জুম্মার নামাজ পরার পর, চার রাকাত ছুন্নত, তার পর আরও দুই রাকাত ছুন্নত পরেও আবুল হোসেন সাহেব মসজিদে বসে দোয়া দরুদ পড়তে থাকেন। আবার কিছুক্ষণ এক নাশা প্রাণায়াম করেন। দিনে পাঁচ বার এক নাশা প্রাণায়াম করতে পারলে ভাল। কিন্তু সময়ের অভাবে তা হয়ে উঠে না। তাই আবুল হোসেন সাহেব নামাজের পর পরই এক নাশা প্রাণায়ামটা করে নেন।
প্রায় সব মুসল্লি চলে যাওয়ার পর, আবুল হোসেন সাহেব ধীরে ধীরে মসজিদ থেকে বের হন। তার পর হেয়ার (Hare Road) রোড ধরে ৮ মিনিটের হাটা পথ, ১১/১২ মিনিটে অতিক্রম করে বাসায় ফেরেন। চীফ জাস্টিসের বাসা থেকে শুরু হয়ে অফিসার্স ক্লাব পর্যন্ত ঐ সময়টা হেয়ার রোড নীরব-নিঝুম থাকে। জায়গাটা এমনিতেই তুলনামূলক ভাবে নীরব। অনেক জায়গা নিয়ে চীফ জাস্টিসের বাসা, তার পর বেশ দূরে দূরে মন্ত্রীদের বাসা, সরকারি বড় অফিসারদের বাসা।
রাস্তার অপর দিকে, জাজেস কমপ্লেক্স, অফিসারদের বাসা। পুরা জায়গাটা গাছগাছালিতে ভরপুর। এই নীরবতা, এই নির্জনতা আবুল হোসেন সাহেব খুব উপভোগ করেন। এই শান্ত নীরব রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে তিনি ধ্যানাবস্থায় চলে যান। মন আনন্দে নাচতে থাকে।
কিন্তু আজ বাসার কাছাকাছি আসতেই, আবুল হোসেন সাহেবে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মন খারাপ হওয়ার একমাত্র কারণ, আবুল হোসেন সাহেবের প্রিয় মুচি। সে বিষণ্ণ মনে শূন্য দৃষ্টিতে দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। যে মুচির সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আবুল হোসেন কে আনন্দ দেয়। আজ সেই মুচির এমন কি দুঃখের ঘটনা ঘটল যে এত বিষণ্ণ হয়ে হাতের কাজ ফেলে বসে আছে? অনেকগুলি কারণে, এই মুচি, আবুল হোসেন সাহেবের প্রিয় মুচি।
প্রথম কারণ, তার সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। তারা চেহারা দেখলে কখনই মনে হবে না, তার কোন অভাব আছে, বা তার কোন দুঃখ আছে। প্রশান্তিময় তার আত্মা। দ্বিতীয় কারণ, তার বাড়ী ময়মনসিংহে। যখন সে ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলে, আবুল হোসেন সাহেবের মনে হয়, তিনি ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের পার দিয়ে হাঁটছেন।
তৃতীয় কারণটাও একটা বড় করন, তাকে ভাল লাগার। কাজের ব্যাপারে সে অসম্ভব আন্তরিক। খুব যত্ন করে কাজ করে।
আবুল হোসেন সাহেব প্রথমে মনে করলেন, সরাসরি তার বিষণ্ণতার কথা জিজ্ঞাসা করবেন। পরে আবার চিন্তা করলেন, না, সরাসরি জিজ্ঞাস করলে, "না কিছু না" বলে এড়িয়ে যেতে পারে।
আর কেউ যদি ব্যক্তিগত কথা বলতে না চায়, জোড় করে শুনাও তো ঠিক না। আবুল হোসেন সাহেব, তার প্রিয় মুচির মন ভাল করার জন্য গতানুগতিক কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। যেমন, ঈদে বাড়ী গিয়েছিল কিনা? রোজার মাসে বেচাকেনা কেমন হয়েছে? ব্যবসাটাকে আরও বড় করা যায় কিনা? ইত্যাদি। প্রিয় মুচি এই সব কথার মামুলি ধরনের কিছু জবাব দেয়ার পর, হঠাৎ প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল, "আমার মেয়েটা ক্লাস নাইনে পড়ে। " কেউ যদি তার মেয়ের কোন কথা বলে, আবুল হোসেন সাহেবের অবধারিত ভাবেই তার নিজের মেয়ের কথা মনে হয়ে যায়।
মনটা মমতায় ভরে উঠে। আবুল হোসেন সাহেবর মনে হল, এই মেয়েটার জন্যই হয় তো তার প্রিয় মুচির আজ এত মন খারাপ। হয় তো, মেয়েটা কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী, টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না। অথবা বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, যৌতুকের অভাবে বিয়ে দিতে পারছে না।
আবুল হোসেন সাহেবের অনুমানকে মিথ্যা করে দিয়ে, প্রিয় মুচি আর্তনাদ করে উঠল, "আমার মেয়েকে স্কুলে ফেল (fail) করিয়ে দিয়েছে।
" ফেল করিয়ে দিয়েছে কথাটার অর্থ আবুল হোসেন সাহেব বুঝতে পারলেন না। তার ধারনা, কথাটা হবে, ফেল করেছে।
প্রিয় মুচি বলল, "আজকেই ক্লাস টিচারের সাথে দেখা করেছি। "
টিচার বলেছেন, "তোমার মেয়েকে, স্কুলের কোন টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়াও নাই। স্কুলের কোন টিচারের কাছে প্রাইভেট না পড়ালে, পাশ করানো হবে না।
মাসে ৫ হাজার টাকা করে প্রাইভেট টিচারকে দিতে হবে। "
আবুল হোসেন সাহেবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হল। তিনি বললেন, "তুমি বল নাই, তুমি রাস্তায় মানুষের জুতা সেলাই কর। তোমার কাছে এত টাকা নাই"
"টিচারের পা জড়িয়ে ধরে বলেছি। "
তিনি বলেছেন, "জুতা সেলাই করে, আবার মেয়েকে পড়ানোর এত শখ কেন।
আজকাল কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না। কোন বাসায় কাজে দেও। মেয়ের পিছে টাকা তো খরচ হবেই না বরং কিছু আয় হবে। শেষ পর্যন্ত ৪ হাজার টাকায় রাজি হয়েছেন। "
টিচার বলেছেন, "এটা শুধু তোমার জন্য কমানো হল।
এটা বাইরে কাউকে বলা যাবে না। এর চাইতে আর কমানো সম্ভব না। কারণ, স্কুলের কমিটি এটা ঠিক করে দিয়েছে। এই টাকা, সব টিচার, হেড মাষ্টার, স্কুল কমিটি এমনকি স্কুলের স্টাফদের মধ্যেও ভাগ হবে। "
ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রিয় মুচি বলল, "স্যার, এটা কাউকে বলবেন না।
আমার মেয়ের ক্ষতি করবে। "
আবুল হোসেন সাহেব তো অনেক আগেই বাক রুদ্ধ হয়ে আছেন। কি বলবেন? হঠাৎ করে গাড়ীর হেডলাইটের মত প্রিয় মুচির চোখ দু'টি জ্বলে উঠল, সে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল, "নাইন পর্যন্ত যখন পড়িয়েছি, স্যার আমার মেয়েকে ম্যাট্রিক পাশ করাবোই। এতে যত টাকাই লাগুক। "
আবুল হোসেন সাহেব পকেট থেকে আতর-মাখা রুমাল বের করে, ঘাম মোছার ভান করে চোখের কোন মুছে নিলেন।
দ্রুত বাসার গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, "কোন কিছু লাগলে বলবা। "
নৈতিক উপদেশ (moral): (১) মাছের পচন শুরু হয়, মাথা থেকে।
(২) রাষ্ট্রের পচন শুরু হয়, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে।
(৩) শিক্ষা ব্যবস্থার পচন শুরু হয়, শিক্ষক থেকে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।