আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পবিত্র আশুরার শিক্ষা ও তাত্পর্য

সুন্নি মুসলিম, ছালেহ্‌ মহররম মাসের দশম তারিখ ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে অভিহিত। প্রাচীনকালের নানা জনগোষ্ঠীর কাছে আশুরা ছিল পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। ইহুদিদের কাছে আশুরা জাতীয় মুক্তি দিবস হিসেবে পরিচিত। আশুরার মর্যাদা ইসলামেও স্বীকৃত। মুসলমানরা রোজা পালনের মাধ্যমে আশুরার মাহাত্ম্য স্মরণ করে থাকেন।

আশুরার দিনে পৃথিবীতে বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়। আসমান-জমিন, আরশ-কুরসি ও আদিপিতা আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, ধরাপৃষ্ঠে প্রথম বারিবর্ষণ, হজরত নুহ (আ.)-এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ, ফেরাউনের নির্যাতন থেকে হজরত মুসা (আ.) কর্তৃক ইহুদিদের উদ্ধার, দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে হজরত আয়ুব (আ.)-এর সুস্থতা লাভ, মত্স্য-উদর থেকে হজরত ইউনুস (আ.)-এর নির্গমন, হজরত সুলায়মান (আ.)-কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রদান, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর নিষ্কৃতি, হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর চক্ষুজ্যোতি পুনঃপ্রাপ্তি, কূপ থেকে হজরত ইউসূফ (আ.)-কে উদ্ধার, হজরত ইদরিস (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উত্তোলন, কারবালায় হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতসহ বিপুল ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী আশুরা (মুফতি আশফাক আলম কাসেমী, ফাযায়েলে মহররম, পৃ. ৩৫-৩৬)। মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) লক্ষ্য করেন, ইহুদিরা আশুরা দিবসে রোজা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোজা রেখেছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস। এদিন আল্লাহ তায়ালা হজরত মুসা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে মুক্তি প্রদান করেছিলেন, ফেরাউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন।

তাই হজরত মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এদিন রোজা রাখেন। এজন্য আমরাও রোজা রাখি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা (আ.)-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন। ’ (সহিহ মুসলিম, ১/৩৫৯)।

হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর সব রোজার (নফল) মধ্যে আশুরার রোজা সর্বশ্রেষ্ঠ’ (জামে তিরমিজি ১/১৫৬)। পবিত্র আশুরার দিন রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘আমি আশা করি যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তার এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা (ক্ষমা) হয়ে যাবে। ’ (মুসলিম, ১/৩৬৭)। আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তার আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দেন (মুসনাদ আহমদ)। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর (৬০ হিজরির ১০ মহররম) কারবালা প্রান্তরে মহানবীর দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক শাহাদাত আশুরাকে তাত্পর্যমণ্ডিত করে।

খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জীবন ছিল হজরত হোসাইন (রা.)-এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। হজরত হোসাইন (রা.)-এর গৃহীত পদক্ষেপ ছিল বীরত্বপূর্ণ। মদিনার পরিবর্তে দামেস্কে রাজধানী স্থানান্তর, উমাইয়াদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ, কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা সর্বোপরি ইহুদি আবদুল্লাহ ইব্ন সাবার ষড়যন্ত্র কারবালা হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয়। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে কুফাবাসীর সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে হজরত হোসাইন (রা.) স্ত্রী, ছেলে, বোন ও ঘনিষ্ঠ ২০০ অনুচরসহ ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কুফার উদ্দেশে রওনা হন।

ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালায় পৌঁছলে কুফার গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইব্ন জিয়াদ তাঁকে বাধা প্রদান করে। রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে ইমাম হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন। প্রথমত, তাঁকে মদিনায় ফিরে যেতে দেয়া হোক। না হলে, দ্বিতীয়ত, তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেয়া হোক। তৃতীয়ত, অথবা ইয়াজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে পাঠানো হোক।

কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইব্ন জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। হজরত হোসাইন (রা.) ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, ‘এ অনুরোধ যদি মেনে নেয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য তা মঙ্গল বয়ে আনত। ’ (Well had it been for the Umayyad house, if the prayer had been agreed to.) । অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইব্ন জিয়াদের চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়।

হজরত হোসাইন (রা.)-এর শিবিরে পানির হাহাকার ওঠে। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি। এমনকি নিছক ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়। খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার আমার কাম্য। ১০ মহররম ইয়াজিদ বাহিনী তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সংঘটিত এ অসম যুদ্ধে একমাত্র ছেলে ইমাম জায়নুল আবেদীন ছাড়া ৭০ পুরুষ শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.) মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান। অবশেষে শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ছিন্ন মস্তক বর্ষাফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে পাঠানো হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যার্পণ করলে কারবালায় পবিত্র দেহসহ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

ইতিহাসবিদ গিবন বলেন, ‘সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে হজরত হোসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে সমবেদনার সঞ্চার করবে’ (In a distant age and climate the tragic scene of the death of Husayn will awaken the sympathy of the coldest reader.) । ইতিহাস সাক্ষী ইমাম হোসাইন (রা.)-কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে করুণ পন্থায় (আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.)। কারবালার যুদ্ধে জয়লাভ ইয়াজিদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল পরাজয়ের নামান্তর। এ বিয়োগান্তক ঘটনা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। পারস্যে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায় তা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য সমূহ বিপর্যয় ডেকে আনে।

কারবালার শোকাবহ হত্যাকাণ্ড মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শিহরন জাগিয়ে তোলে। ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায় ও অসাধুতার সঙ্গে আপস করেননি। তাঁর এ শাহাদাত গৌরবোজ্জ্বল আদর্শরূপে পরিগণিত হয়। তাই আশুরা মুসলমানদের আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করে। স্মর্তব্য, আশুরাকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে এমন কিছু কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়, যা শরিয়ত-সমর্থিত নয়।

আলোকসজ্জা, আতশবাজি, হালুয়া-রুটি বিতরণ, দুটি কবুতর জবাই, ‘সত্তর দানাভাত’ পাকানো, কালো কাপড় পরিধান, জারিগান, বক্ষে-পিঠে ছুরিকাঘাতের সঙ্গে আশুরার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এসব বিদআতি কর্মকাণ্ড আশুরার ঐতিহাসিক তাত্পর্যকে ম্লান করে দেয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.