জীবন বদলায়, রূপকথা বদলায় না...... “হেসে নে। যত পারিস ভালো করে হেসে নে। পরে তো আর পারবি না। “
“ক্যান? পরে পারবোনা ক্যান?”
“এতো ক্যান ক্যান করিস ক্যান?”
“একশো বার করবো, হাজার বার করবো। বল।
“
“মরে যাবো তাই। “ তিতিরের কথা শুনেই হে হে করে হেসে ওঠে তনয়।
“আমি হাসির কিছু বলি নাই যে এভাবে হাসতে হবে। “
“সে তো সবাই একদিন মরবে...”
“হুমম...তবে আমি সময়ের আগে মরবো। “
“(কিছুটা চিন্তিত হয়ে) সুইসাইড করবি নাকি?”
“আরে নাহ।
আমি প্রতিদিন নামাজ পড়ে দোয়া করি যাতে আমি তাড়াতাড়ি মরে যাই। “
“ও...গুড। তা হঠাৎ এমন মহৎ ইচ্ছে পোষণের কারণ কি?“
“এমনি। যত তাড়াতাড়ি মরে যাবো, পাপ তত কম হবে। আর পাপ যত কম হবে, তত তাড়াতাড়ি বেহেশতে যেতে পারবো।
“
তিতিরকে জব্দ করার মতো কোন ভাষা আর খুঁজে পায় না তনয়। কথার খেই হারিয়ে ফেলে যেন। নিচ থেকে মায়ের ডাক শুনে সংবিৎ ফিরে পায়। তিতিরকে ডাকছে।
“আসছি ফুপি।
“ বলে প্রায় লাফাতে লাফাতে তিতির নিচে নামে। পিছন থেকে তনয় বলে ওঠে, “দেখে নাম। আবার পড়িস না যেন। “
তিতির, বাবা-মায়ের বড় ও একমাত্র মেয়ে। ওর ছোট ভাইটা কলেজে পড়ে।
বাবা ম্যাজিস্ট্রেট। তাই ছোটবেলা থেকেই বাবার চাকরির কল্যাণে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে সে। বুঝ হবার পর থেকে কোন জায়গায় দুবছরের বেশি থেকেছে বলে তিতিরের মনে পড়েনা। আপাতত ওর বাবা-মা খুলনায় আছে আর তিতির পড়ালেখার জন্য ঢাকায়। প্রথম দুবছর হোস্টেলেই ছিল।
কিন্তু হঠাৎ করে মাস ছয়েক আগে চরম অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওর ফুপি মিসেস নাজিম ওকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। সেই যে এনেছেন আর ওকে যেতে দেয়ার নাম নেই ওনার। ঢাকায় আত্মীয় বলতে ঐ একমাত্র ফুপিই আছে তিতিরের। তাই অভিভাবকও বলতে গেলে উনি-ই। প্রথম থেকেই ভাইয়ের মেয়েকে নিজের কাছে রাখার জন্য প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা।
কিন্তু তিতিরের ঘোর আপত্তির মুখে তা আর সম্ভব হয়নি। তিতির যে কেন এমন করেছিল তা এখনো ওনার কাছে অস্পষ্ট।
তনয়, মিসেস নাজিমের ছোট ছেলে। একমাত্র মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। কানাডায় থাকে।
বড় ছেলের বউ এর সাথে তেমন বনিবনা না হওয়ায় তারাও আলাদা থাকে। তাই বিশাল বাড়িখানায় প্রানী বলতে তারা মা-ছেলে মাত্র দুজন। সারাদিন খালি বাড়িতে মা একা পড়ে থাকেন। তনয়ের পক্ষেও ঠিকমতো সময় দেয়া সম্ভব হয় না। মনে মনে খারাপ লাগে কিন্তু কিছুই করার নেই তনয়ের।
তিতির আসাতে এদিক থেকে তাই ভীষন স্বস্তি পায় ও।
প্রথম থেকেই তিতিরকে বড্ড অদ্ভুত লাগতো তনয়ের। এখনো যে লাগেনা তা নয়। তবে তা সয়ে গেছে অনেকটা। মেয়েটা একটু বেশি পরিমানে উচ্ছল।
সারাক্ষণ হাসি-ঠাট্টা আর দুষ্টুমিতে ঘর মাতিয়ে রাখে। খারাপ লাগে না তনয়ের। বরং গত ছ’মাসে এটাতেই যেন ও অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এইতো গত মাসেই সপ্তাহ খানেকের জন্য তিতির বাড়ি গিয়েছিল। বাড়িটা তখন বড্ড বেশি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিটা মুহুর্তেই তিতিরকে খুব মিস করতো ও।
তনয়ের বন্ধু মহলেও তিতিরের ভীষন জনপ্রিয়তা। সবাই এক নামেই তিতিরকে চেনে। তনয়ের এক বন্ধু তো ওকে একদিন ধরেই বসেছিল তিতিরের সাথে ওর রিলেশান সেট আপ করিয়ে দেয়ার জন্য। আর সেই থেকে তনয় ঐ বন্ধুকে দুচোখে দেখতে পারেনা।
আর এরপর থেকেই সবাই যা বুঝার বুঝে গিয়ে ওকে ক্ষেপাতে থাকে। প্রথম প্রথম ভীষণ ক্ষেপে যেতো তনয়। এখন আর তেমন রিএকশান দেখায় না। হয়তো সত্যিটা ওর নিজের কাছেও এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।
যাইহোক যা বলছিলাম।
নিচে নেমে তনয় দেখে তিতির ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলো। তনয় ও গেলো ওর পিছু পিছু। দেখে তিতির আলমারি থেকে জামা-কাপড় নিয়ে গুছাচ্ছে।
“কোথায় যচ্ছিস তুই?”
“চলে যাচ্ছি। “
“চলে যাচ্ছিস মানে? কোথায় যাচ্ছিস?”
তনয়ের পাশে এসে বসে তিতির।
বলে, “আমি তো আর সারাজীবন এ বাড়িতে পড়ে থাকবো না। যেতে তো একদিন হবেই, তাই না?”
“কিন্তু তোর তো পড়া এখনো শেষ হয়নি। আরো অন্তত দুবছর বাকি আছে। এখনি চলে যাবি ক্যান? তাছাড়া গত মাসেই তো বাড়ি গেলি। “ বলে মুখখানা বাংলা পাঁচের মতো করে বসে থাকে তনয়।
“আমি বাড়ি যাচ্ছি কে বললো? আমি তো বিয়েতে যাচ্ছি। আর সাথে তুমিও যাচ্ছো। “
“আমি? বিয়ে? মানে?”
“মানে আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে। কিন্তু ফুপি তো একা একা আমাকে ছাড়বেনা। তাই সাথে তুমিও যাচ্ছো।
“
কথাটা শোনার পর বাচ্চাদের মতো খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে তনয়, “সত্যি বলছিস? কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“অনেক সুন্দর একটা জায়গা। গেস করতো দেখি...”, বলে ভুরু নাচালো তিতির।
“উমম...চিটাগাং। “
“দ্যাটস গুড। “
“হাহা...দেখলি কেমন গেসিং পাওয়ার আমার!!!” কিছু বলেনা তিতির।
মুচকি হেসে ব্যাগ গোছাতে শুরু করে।
পরদিন কমলাপুর স্টেশানে পৌঁছে সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে এসে তনয় দেখে তিতির সিলেটের ট্রেনের দিকে এগুচ্ছে।
“কিরে ঐদিকে কই যাস?”
“তো কোনদিকে যাবো?”
“বাহরে, তুই না বললি চিটাগাং যাবি!” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে তনয়।
“কখন বললাম?” আরোও অবাক হয়ে প্রশ্ন করে তিতির।
“বাহরে, আমি চিটাগাং এর কথা বলার পর বললি না গুড।
“
“গুড বলছি, চিটাগাং যাবো তাতো বলিনি। “ বলে তনয়কে বোকা বানিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় তিতির। সেই মুহুর্তে পিত্তি জ্বলে যাওয়া ছাড়া আর কোন কিছু অনুভূত হয় না ওর। রাগে গজগজ করতে তিতিরের পেছন পেছন হাঁটা ধরে সে।
বিয়ের অনুষ্ঠানে খুব ভালোই কাটে দুজনের।
নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, সবকিছু মিলিয়ে দারুন। ফিরে আসার পরও প্রায় সপ্তাহখানেকেও তার রেশ কাটেনা।
এমনই এক দিনে তিতির সকালে ক্লাসে চলে যায়। আর তনয় ঘুম থেকে উঠতে না পারায় সকালের ক্লাসটা মিস করে বসে। ক্লাস আবার সেই দুপুরে।
তাই দেরি করে যাবে বলেই বিছানা ছাড়তে ভীষন গড়িমসি শুরু করে। কিন্তু মায়ের ঝাড়ির মুখে তা আর বেশিক্ষণ সম্ভব হয় না। ব্রেকফাস্ট সেরে চায়ের মগটা হাতে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। যাবার পথে কি মনে করে যেন তিতিরের রুমে উঁকি মারে তনয়। পড়ার টেবিলে একগুচ্ছ লাল গোলাপ।
ফুলগুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে। খুব সম্ভবত একদিনের বাসি ফুল হবে। হাতে নিতেই একটা অজানা ভয় এসে ভর করে ওর মনে। ফুলগুলোর পাশে তিতিরের ডায়েরি পড়ে আছে। একটা কলম দিয়ে মার্ক করা আছে।
মনের প্রবোধ থাকা স্বত্ত্বেও ডায়েরিটা খোলে তনয়। হয়তো ফুলগুলোর কারনেই, জানে না ও।
রোজ একগুচ্ছ গোলাপ হাতে নিয়ে ছেলেটা অপেক্ষা করে। আর আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। ছেলেটার দিকে নয়, তার হাতের গোলাপগুলোর দিকে।
রক্তলাল গোলাপ। আজকাল তেমন একটা দেখা যায় না এই রংয়ের গোলাপ। তবুও কোথাথেকে যেন ঠিক রক্তলালা গোলাপ নিয়ে হাজির হয় ছেলেটি। এনেক্স বিল্ডিং এর সামনে আমি দাঁড়িয়ে থাকি বাসের অপেক্ষায় আর আমার ঠিক বিপরীতেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকে তার ভালোবাসার মানুষটার অপেক্ষায় হাতে একগুচ্ছ রক্তলাল গোলাপ নিয়ে। ভালোই লাগে দেখতে যে যান্ত্রিক এই শহরে আজোও প্রতিদিন কেউ না কেউ অপেক্ষা করে থাকে তার প্রিয় মানুষটির জন্য।
প্রতিদিনের মতো আজোও ছেলেটা অপেক্ষা করে। তার কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা আসে। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাবার পরও বাস আসছে না দেখে বুঝি আজ আর ট্রিপ দেবেনা। রিক্সার খোঁজে পা বাড়াতেই দেখি ছেলেটার সাথে মেয়েটার প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হচ্ছে। থমকে দাঁড়াই আমি।
কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে মেয়েটা গোলাপগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে থাকে। ছেলেটাও যায় পিছু পিছু। আর ফুলগুলো পড়ে থাকে চরম অবহেলায়। কেন জানি মেনে নিতে পারিনা। এগিয়ে যাই আমি ফুলগুলোর কাছে।
নিজের অজান্তেই হাতে তুলে নেই। ফিরে আসি ঘরে।
রক্তলাল গোলাপ...আমার বহুদিনের আকাঙ্খিত। সেই আকাঙ্খিত জিনিসটাই যখন অন্য কেউ দুমড়ে-মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কেন জানি সহ্য করতে পারিনা। পৃথিবীর নিয়মটাই বড় অদ্ভুত – “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে, দিবসে সে ধন হারায়েছি আমি-- পেয়েছি আঁধার রাতে”।
ডায়েরিটা বন্ধ করে ভাবনার জগতে হারিয়ে যায় তনয়। নিজের রুমে ফিরে যায় ও। আজ আর হয়তো যাওয়া হবে না ক্লাসে।
ক্লাস শেষে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে তিতির। বাস না আসলে আজকেও অনেকগুলো টাকা গচ্ছা দিতে হবে।
ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়েই ছেলেটার খোঁজ করেছে ও। আজ আর আসেনি। আর কখনো আসবে কিনা কে জানে। কি মনে করে যেন আবার রাস্তার অপরদিকটায় তাকায় তিতির। “ঐতো ছেলেটা বসে আছে।
হাতে রোজকার মতো রক্তলাল গোলাপ। যাক শেষমেশ সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেলো তাহলে!“ ভেবে যেন স্বস্তি পায় ও। অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে ঠোটের কোণে। হঠাৎ মনে হলো ছেলেটাও যেন পালটা হেসে জবাব দিল। অবাক হয় তিতির।
ভুল দেখছে নাতো। ক্লাস থেকে বের হয়েই চশমাটা খুলে রাখে ও। ভুল দেখছে নাকি যাচাই করার জন্য চশমাটা চোখে দেয়। শুরু হয় বিস্ময়ের পালা।
তনয়কে দেখে এগিয়ে যায় তিতির।
“তুই? এখানে?”
“কেন? আসতে পারিনা আমি এখানে?”
“বাহরে, আমি কি তা বলছি নাকি? আমি তো বলছিলাম...হাতে লাল গোলাপ নিয়ে...কার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে শুনি? হুমম?” বলে মিটিমিটি হাসে তিতির।
“তোর জন্য...”, বলে তনয় ও ভুরু নাচায়।
“স্টপ কিডিং ইয়ার। বল না...এমন করিস ক্যান? আচ্ছা যা...প্রমিজ করলাম, ফুপিকে বলবোনা। এবার তো বল...”
“আররে...বললাম তো।
বিশ্বাস না করলে আমার কি করার আছে! কি করলে বিশ্বাস হবে বল?” কিছুক্ষণ ভাবার ভান করে তনয় বলে, “যা...এই নে তোর গোলাপ তোকে দিলাম। এবার বিশ্বাস হলো তো?”
অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তিতির। তনয় বলে, “জানিস তো, অদ্ভুত এই পৃথিবীতে যতই অদ্ভুত নিয়ম থাকুক না কেন, কেউ যদি একান্তভাবে মনের গভীর থেকে কিছু চায় উপরওয়ালা ঠিক তার কাছে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়। হয়তো তোর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য উনি আমাকে আমাকেই বেছে নিয়েছেন। “
তারপরও তিতির তাকিয়ে থাকে ওর দিকে কিছু না বলে।
এবার কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করে তনয়। বলে, “স্যরি। তোকে না বলে তোর ডায়েরিটা পড়েছি। আসলে কি হয়েছে জানিস? অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম কথাটা বলবো বলে। কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না।
ডায়েরিটা পড়াতেই তো বুদ্ধিটা মাথায় আসলো। ...............কিরে? কিছু বলবিনা?“
“উহু। এই প্রথমবারের মতো সব কথা যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। কখনো ভাবিনি যে ছুঁতে চাওয়া স্বপ্নেরা এভাবে হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেবে...”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।