আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত অভ্যন্তরীণ নীতি। নীবর নীতিই হবে বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।

আসুন অন্যের বিচার করার আগে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখি। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে সে আগুন যেমন নিজের ঘরে ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে, মিয়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনায় বাংলাদেশের এখন ঠিক সেই পরিস্থিতি। তো নিজের ঘরে যাতে সে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে সেই ব্যবস্থাই নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। হয় পাশের বাড়ির আগুন নেভাতে নিজের হাতে পানির পাত্র তুলে নিতে হবে, না হয় ফায়ার সার্ভিস খবর দিতে হবে। আর যদি ফায়ার সার্ভিসকে ইতিমধ্যে খবর দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে উচিত হবে তাদের আগমনের জন্য ধৈর্য ধরে থাকা।

কেননা আগুন নেভানোর ক্ষমতা না থাকার পরেও আগুন নেভাতে গিয়ে শুধু শুধু নিজের হাত দুটি পোড়ানো হবে নিছক বোকামি। এর পর প্রশ্ন আসে "পাশের বাড়িতে কে আগুন দিলো?" আগুন কি একা একা লাগলো, নাকি কেউ শত্রুতা করে দিলো ??? আমরা একটু গভীরে চিন্তা করলেই হয়তো সেই উত্তরটা পেয়ে যাব। কিন্তু যদি কেউ শত্রুতা বসে আগুন দিয়ে থাকে তাহলে কি আমরা সেই বদ লোকের বিচার করতে যাব? নাকি চুপ থাকব? বদ লোকটি যদি চিহ্নিত হয় তাহলে বিচার চাওয়াটাই এবং তার শাস্তি চাওয়াটাই হবে আদর্শ পদক্ষেপ। কিন্তু আমরা যদি বদ লোকটির বিরুদ্ধে কোন প্রমান না দাড় করাতে পারি তাহলে তার বিচারের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়াটা হবে আরো বেশি বোকামি। কেননা বিচার শুধু এলাকার প্রভাবশালীরাই করার সামর্থ রাখে।

দুর্বলদের জন্যই বিচার শক্ত হয়, প্রভাবশালীদের জন্য বিচার হয় দুর্বল এবং লোক দেখানো। অনেক সময় অপরাধী প্রভাবশালী হলে তার বিচারের নামে হয় প্রহসন। নানান ছলা কলার অবতারনায় এক সময় মানুষ তার বিচারের কথা বেশুমাল ভুলেই যায়। যাই হোক, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে থাকা দুর্বল একটি দেশ। তাই যে কোন বড় রকমের বিরোধ সমাধানে প্রত্যেক্ষভাবে হস্তক্ষেপের সক্ষমতা বাংলাদেশের এখনও হয়নি।

তাই সে সকল আন্তর্জাতিক ঘটনায় প্রভাবশালী রাষ্ট্রের প্রত্যেক্ষ এবং পরোক্ষ হস্তক্ষেপ আছে, সেসব ঘটনায় বাংলাদেশের নাক না গলানোই হবে দেশের জনগনের জন্য কল্যানকর। যখন বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী অবস্থানে চলে যাবে তখন না হয় তার নীতিগত অনেক পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হবে। এবার মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বপরিমন্ডলে চীন ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করতে সামর্থ্য হয়েছে। সামরিক এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে চীনের এ অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্রের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীনের পাশাপাশি এশিয়ার এ অঞ্চলে আরেক নব শক্তি হিসেবে ভারতের আগমন যুক্তরাষ্ট্রের আকর্ষন এশিয়ামুখী করে দিয়েছে। কেননা দিনে দিনে ইউরোপের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই সামরিকভাবে ইউরোপিয়ান মিত্ররা যুক্তরাষ্ট্রকে সাপোর্ট দিলেও এসব মিত্রদের উপর অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র আর ভরসা করতে পারছেনা। আর চীনের এ অগ্রগতি চলমান থাকলে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আর দাপটে চলাচলের ক্ষমতা থাকবেনা। তাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া অঞ্চলে হস্তক্ষেপ শুরূ করে দিয়েছে।

তাদের উন্নত কুটনৈতিক নীতি এবং চতুরতার মাধ্যমে তারা এ অঞ্চলে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্ম দিতে চায়। যা মাধ্যমে চীন এবং ভারতের বর্তমান সময়ের উন্নতির ধারা কিছুটা হলেও তরান্বীত হবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের গুরুত্ব বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। তাই এ অঞ্চলের উন্নয়নশীল দেশসমুহে কোন অভ্যন্তরিন সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অথবা কুটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে তাদের সামরিক অবস্থান, বিশেষকরে নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে। কেননা চীন এবং ভারত দুটি দেশ্ই স্থল যুদ্ধে ব্যপক পারদর্শী।

দুটি দেশেরই বিরাট সেনাবাহিনী আছে। তাই এই বিরাট সেনাবাহিনী সম্পৃদ্ধ দেশসমূহের সাথে পেরে উঠার একমাত্র উপায় হচ্ছে নৌ-বাহিনীর ব্যবহার এবং বিভিন্ন অভ্যন্তরিন সমস্যায় এ দেশগুলোকে যুক্ত করে দেয়া যাতে তারা অভ্যন্তরিন কোন্দলে দুর্বল হয়ে পরে। সেই সাথে চীনকে দুর্বল করার আরেকটি উপায় হবে চীনের মিত্রদের এবং চীনের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া। "স্ট্রিং অব পার্ল" একটি দেশের প্রগতির মূল সে দেশের জ্বালানীর সরবরাহের উপর নিহিত। চীনের বর্তমান অগ্রগতীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চীনকে বর্হিবিশ্ব থেকে প্রচুর জ্বালানী আমদানী করতে হয়।

আর চীনের আমদানীর মূল উৎস হচ্ছে ইরান এবং সৌদি আরব। চীন তার আমদানী সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য এবং সুবিধা জনক করার জন্য "স্ট্রিং অব পার্ল" নামক একটি ব্যবস্থা বা নীতি গ্রহণ করেছে। যার মাধ্যমে কম খরচে এবং সহজে সে তার আমদানী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার এবং পাকিস্তান চীনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। এ দুটি দেশ চীনকে তাদের ভুখন্ড ব্যবহার করতে দেয়।

সাথে বাংলাদেশও ভবিষ্যতে এ প্রক্রিয়ার অংশ হতে যাচ্ছে। এতে চীন এবং বাংলাদেশ দুদেশই লাভবান হবে। কিন্তু চীনের এই কর্মপন্থা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই যুক্তরাস্ট্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চীনের জ্বালানীর সরবরাহকে কমিয়ে দেয়া এবং বাঁধাগ্রস্ত করা। চীনের পাশাপাশি ভারতের উপরও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়ছে ইরান থেকে তেল আমদানী না করার জন্য।

আর চীনের "স্ট্রিং অব পার্ল" কে বাধাগ্রস্ত করার জন্যই এ ট্রানজিটের পথে পথে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান শক্ত করতে চাইবে। যার দরুন চীনের বহুদিনের মিত্র মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন পরিস্থিতি খারাপ করতে, ইরানকে পঙ্গু করে দিতে, পাকিস্তানকে বিভিন্নভাবে নিজেদের বশে আনতে এবং সর্বপরি বাংলাদেশকে মিত্র হিসেবে পেতে যুক্তরাষ্ট্র অনেক পায়তারা করবে বলেই মনে হয়। ইরানের চারিপাশে মর্কিন বিমানঘাটিসমূহ এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে চলা বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া এবং বিভিন্ন মানবাধী সংগঠন শক্তিশালী ভুমিকা পালন করবে । কেননা গরীবদেশগুলোর সংবাদ মাধ্যমগুলো বিবিসি এবং সিএনএন এর খবরের ভিত্তিতেই খবর প্রচার করে। তাই বিবিসি, সিএনএন যা বলে বাকিরা তার সাথেই ঠোট মিলায়।

বিভিন্ন দুর্বল দেশে নিজেদের উদ্দেশ্য হসিলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এসব সংবাদ মাধ্যম এবং তথাকথিত মানাবাধিকার সংগঠনগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মিয়ানমারে নতুন করে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সেদেশের সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ভুমিকাটি বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আড়াল করে রাখা হয়েছে। যাতে করে মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে একটা গোষ্টি ক্ষেপে উঠে এবং শুরু হয় মিয়ানমারে অভ্যন্তরীন সংঘাত। যার ফলে বর্তমান সামরিক সরকারকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ঘেষা সুচির তথাকথিত গনতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে যুক্তরাস্ট্রের দালালী করতে পারে। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারে চীনের প্রভাব একেবারেই শেষ হয়ে যাবে।

পাশাপাশি মিয়ানমারের যুক্তরাষ্ট্রের একটা ঘাটি গড়ার সুবর্ণ সুযোগও হয়তো এসে যেতে পারে। যাতে করে চীনকে সামরিকভাবে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার যে নীল নকশা যুক্তরাষ্ট্র হাতে নিয়েছে তা অনেকটাই সফল হবে। ইতিমধ্যে পশ্চিম এবং পূর্ব দিক থেকে চীনকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের উত্তরে রাশিয়া থাকায় ঐ দিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলার আশা যুক্তরাষ্ট্র আগেই ছেড়ে দিয়েছে। তাই দক্ষিণ দিক দিয়ে চীনকে ঘিরে ফেলতে হলে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রের মূল কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হবে।

আর তারা সেই টার্গেট অনুযায়ীই অগ্রসর হবে বলে মনে হয়। এর ফলশুতিতে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ-বাহিনীর ভবিষ্যত আনাগোয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। চীনের পূর্ব এবং পশ্চিম দিকের বিভিন্ন দেশে মার্কিন বিমান ঘাটিসমূহ যাইহোক, মিয়ানমারের রহিঙ্গাদের নিয়ে যে খেলা চললে তা এখনও অনেকের চিন্তার বাইরে। এ রহিঙ্গাদেরকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের উদ্ধেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে নিবে। কাজ শেষে এদেরকে আবার ছুড়েও ফেলে দেওয়া যাবে সহজেই।

তার মানে রোহিঙ্গারা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গিনিপিগ হিসেবে কাজ করবে। তাই বাংলাদেশের এখন নীরব দর্শক বনে যাওয়াটাই হবে বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ। কারণ রহিঙ্গাদের নিয়ে এর আগের স্মৃতি বেশি সুখকর নয় বাংলাদেশের। তারওপর এবার পাশার দান সম্পূর্ণ আলাদা। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে এ পাশা খেলায় নিরব দর্শক হয়ে থাকা।

মিয়ানমারের সমস্যা মিয়ানমারকেই সমাধান করতে দেয়া উচিত। বাংলাদেশের ভেতরে রহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার দাবি সোচ্চার হচ্ছে। মানবতা থেকে এটা সরকার করতেই পারে, কিন্তু তা কখনই স্থায়ী সমাধান বলে গণ্য হবেনা। বরং তা বাংলাদেশের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিবে। তাই দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারতের নীতির মধ্যে বাংলাদেশকে খুব বুঝে শুনে প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে।

আর কোন কিছু না বুঝলে চুপ থাকাই সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা। তেমনি বাংলাদেশের জনগনকেও এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার। কেননা সাধারণ জনগণ সব সময় মিডিয়ার খবরের উপর ভিত্তি করে তাদের মতামত প্রকাশ করে। কিন্তু আমাদের সব সময় মনে রাখা প্রয়োজন মিডিয়া এখন কেবল মাত্র প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহের কার্যসিদ্ধির হাতিয়ার মাত্র। তারা শুধুমাত্র সে খবরই অতিরঞ্জন করবে যা তাদের প্রভুদের কার্য হাসিল করবে।

তাই আমাদের উচিত হবে যে কোন ব্যাপারে ধৈর্য সহকারে বিচার বিশ্লেষন পূর্বক মতামত প্রকাশ করা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.