জাওয়েদ করিম, ছোটবেলা থেকে উদ্ভাবন নেশায় মত্ত তাজা এক প্রাণ। উদ্ভাবনের নেশায় বার বার বাধা আসলেও পিছু ফিরে তাকাননি। বিশ্বব্যাপি ভিডিও শেয়ারিং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইট ইউটিউবের অন্যতম সহ প্রতিষ্ঠাতা। জনপ্রিয় এই সাইট এ বছরে পা দিয়েছে ৬ষ্ঠ বছরে। কিন্তু জনপ্রিয় এ সাইটটি উদ্ভাবনের পেছনে রয়েছে এই বাংলাদেশী বংশোদ্ভুদ জার্মান-আমেরিকান সহ আরও দুজনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
তাঁরা হলেন অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান পেপালে করিমের সহযোগী চাদ হার্লি এবং স্টিভ চেন।
২০০৪ সাল। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়ছেন জাওয়েদ করিম। ছাত্রাবস্থায়ই যোগ দিলেন অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান পেপালে। চাকরিটা একবারে মন্দ ছিলনা।
তবু লেখাপড়া বাদ দিয়ে করা এ চাকরিটা মেটাতে পারলনা তাঁর উদ্ভাবনী মনের তৃষ্ণা। খুঁজছিলেন এর একটা বিকল্প পথ। কিভাবে নতুন কিছু করা যায়। পেপালে তাঁর ঘনিষ্ট সহযোগি চাদ হার্লি এবং স্টিভ চেনের সাথেও মাঝে মাঝে শেয়ার করতেন তাঁর মনের কথা। স্টিভও কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্র।
আর চাদ হার্লি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইন বিভাগের। চাদ আর স্টিভও চাচ্ছেন নতুন কিছু করতে। ব্যাস! সবার মনেই একই ভাবনা। আর ঠেকাই কে! সবাই ভাবতে লাগলেন কি করা যায়। পারষ্পরিক যোগাযোগের অভাবে কিছুদিন আবার ভাটা পড়ে তাদের পরিকল্পনায়।
গড়িয়ে যায় বছর। পরিকল্পনাকে বাস্তব রুপ দিতে নড়ে চড়ে বসেন তাঁরা। সিদ্ধান্ত নেন একসাথে আলোচনায় বসার। আলোচনার সুবিধার্থে সান ফ্রান্সিকোতে স্টিভ চেনের বাসায় নৈশ ভোজের দাওয়াত পড়লো সবার। সেখানেই উদ্ভাবন হলো বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ার করার সাইট ইউটিউব তৈরী করার ধারণা।
অনলাইনে প্রচুর সাইট থাকলেও ভিডিও শেয়ার করার মত কোন উল্লেখযোগ্য সাইট নেই। কিন্তু ভিডিও শেয়ারিং সাইটের সম্ভাবনা যাচাই করে একটি ভিডিও শেয়ারিং সাইটই বানানোর সিদ্ধান্ত হলো।
২০০৫ সাল। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে ইউটিউব ডটকম নামে ডোমেইন নিবন্ধন করে ফেললেন তাঁরা। ডোমেইন নাম নিবন্ধনের পর তরুন এ তিন প্রকৌশলী হাত লাগালেন সাইটটির ডিজাইনের কাজে।
কয়েকমাসের চেষ্টায় দাড় করে ফেললেন সুন্দর একটা সাইট ডিজাইন। সাইট ডোমেইন নিবন্ধন এবং ডিজাইন তো শেষ হলেও এবার মূল কাজ অনেক বাকি। একই বছরের ২৩ এপ্রিলে ‘মি এট জু’ নামক প্রথম ভিডিও টি আপলোড করেন জাওয়েদ করিম নিজে। ভিডিও তে সান দিয়েগো পার্কে হাতিশালায় দাড়ানো তাঁর নিজের একটি ভিডিও আপলোড করে শুরু করলেন ভিডিও শেয়ারিং। ইউটিউব ওয়েবসাইটে এখনও মিলবে ১৮ সেকেন্ডের এ ভিডিওটি।
মে মাসে সাইটটির পরীক্ষামূলক সংস্করন উন্মুক্ত করলেন তাঁরা। পরীক্ষামূলক সংস্করনে ব্যবহারকারীদের ব্যাপক সাড়া পেলেন তাঁরা। দিন দিন বাড়তেই থাকলো ইউটিউবের ব্যবহারকারী সংখ্যা। কিন্তু ব্যবহারকারীদের জন্য সাইটটি পরীক্ষামূলক সংস্করন থেকে অফিসিয়ালী উন্মুক্ত করতে প্রয়োজন আরোও অনেক ওয়েবসাইট হোস্টিং স্পেস। দরকার প্রচুর বিনিয়োগ।
ভেনচার ক্যাপিটালিষ্ট বা প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের দারস্ত হলেন তাঁরা। তরুন এ তিন প্রকৌশলীর পরিকল্পনার কথা শুনে ইউটিউবে বিনিয়োগে রাজি হলেন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান স্কুইয়া ক্যাপিটালিস্ট। নভেম্বর মাসে ‘ব্রডকাস্ট ইওরসেলফ’ শ্লোগানে অফিসিয়ালী উন্মুক্ত করা হলো ইউটিউব সাইটটি। দ্রুত বাড়তে থাকলো ইউটিউব ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ১ কোটি ১৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করলো স্কুইয়া ক্যাপিটাল।
জুলাইয়ে প্রতিদিন সাইটটিতে ৬৫ হাজার ভিডিও আপলোড ঘোষনা দিলো প্রতিষ্ঠানটি। অক্টোবরে ১৬৫ কোটি ডলারে ইউটিউব কিনে নেওয়ার ঘোষনা দিলো সার্চ ইনজিন জায়ান্ট গুগল ইনকর্পোরেশন। ইউটিউব ক্রয় সংক্রান্ত চুক্তি চূড়ান্তভাবে সম্পাদন হলো একই বছরের নভেম্বরের ১৩ তারিখে। ইউটিউবের ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলারের শেয়ার পেলেন জাওয়েদ। ২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই ৬শ কোটি ভিডিও দেখেছেন ব্যবহারকারীরা।
অ্যালেক্সা রাঙ্কিং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভিজিট হওয়া ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে ইউটিউব রয়েছে ৪র্থ অবস্থানে। ইউটিউব ছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ করেছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুদ এ প্রকৌশলী। জাওয়েদ পোর্টেবল ত্রিমাত্রিক গ্রাফিক্স, সলভিং ড্যাড পাজল, থ্রিডি স্প্রিং সিমুলেশন, রোবোটিক ওয়েবক্যাম, রেডিওসিটি ইনজিন, বামপাম্পিং ডেমো, রে-ট্রেসার, লাইফ থ্রিডি, কোয়াক ২ মডেল ভিউয়ার সহ বেশ কিছু প্রজেক্টের উদ্ভাবকও তিনি। প্রযুক্তির জগতে বর্তমানে তাঁর এ উদ্ভাবনগুলো রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘটিয়েছে আমূল পরিবর্তন।
সবসময় গতানুগতিক কোন কর্পোরেট জীবন নয়, নিজের উদ্ভাবন আর উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি আর সম্মান সব ই হাতের মুঠোয় চলে আসে।
আর হয়ত এই উদ্ভাবন ই বয়ে আনতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন- কোন সমাজ, দেশে কিংবা সারা পৃথিবীতে। এক্ষেত্রে মিঃ জাওয়েদ করিম সত্যি ই অনন্য ও বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য অনুকরণীয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।