দুইটা ফোন নাম্বার আর একটা ফেসবুক আইডি আজকাল বড্ড বেশী জ্বালাচ্ছে। ফোন নাম্বার দুইটা থেকে কোন ফোন আসে না, ফেসবুক আইডি থেকে কোন ম্যসেজ, কমেন্ট এমনকি একটা লাইকও আসে না।
ফোন দিলে বন্ধ পাই, ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলে সিন লেখা আসে না আর রিপ্লাই তো অনেক পরের কথা!
এই তিনজন মানুষই আর এখন বেঁচে নাই। ওদের ফোন নাম্বার আমার কন্টাক্ট লিস্টে, একজনের ফেসবুক আইডি আমার ফ্রেন্ড লিস্টে। মাঝে মাঝেই পুরানো ছবিগুলো দেখি, টেক্সট করি।
আমার কেন জানি মনে হয়, কোন একদিন এই টেক্সটের উত্তর তিনি দিবেন।
এই তিন জনের ভীতরে একজন জাহাঙ্গীর স্যারঃ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় এই স্যারের সন্ধান পেলাম এক বড় ভাইয়ের কাছে। স্যার নাকি খুব মজার মজার গল্প বলেন, বড় ভাইয়ের কাছে শুনে স্যারের কাছে পড়ার খুব ইচ্ছে হল।
কিন্তু বন্ধুদের যদি বলি, চল ব্যাচে যেয়ে গল্প শুনি? তাহলে তো কেও রাজি হবে না তাই ইনিয়ে বিনিয়ে বল্লাম, বিশাল ভালো পড়ান। স্যারের কাছে একবার যে পড়বে, ইহ জনমে সে আর ইংরাজি ভুলবে না, স্বয়ং ইংরেজদের চেয়ে ভালো ইংরাজি বলতে পারবে।
আর গ্রামার? স্যার কে সকলে গ্রামারের জাহাজ বলে ডাকে।
বন্ধুদের উৎসুক প্রশ্নঃ এই স্যারের তো নাম শুনি নি কখনো?
--শুনবি কিভাবে! স্যার তো দেশেই ছিলেন না! এসেছেন কিছুদিন আগে!
স্যারের কাছে ১০\১২ জনের একটা ব্যাচ নিয়ে হাজির হলাম।
জাম্বু আকৃতির শারীরিক গঠন, মুখ ভর্তি দাড়ি, ডাগা ডাগা চোখের দিকে তাকালেই ভয় লাগতো। স্যার যে রুমে পড়াতেন, সেই রুমে একটা নিপ্পন ২১” কালার টিভি ছিল। টিভির পর্দার উপরে সাদা আর্ট পেপারে গোটা গোটা হাতের লেখাঃ এই টিভিতে এনিমেল প্ল্যানেট, ডিসকভারি,পিস টিভি এবং খবরের সময় ঘড়ি ধরে খবর দেখা ছাড়া অন্য কোন অনুষ্ঠান দেখা যাবে না।
যদি কেও এই নিয়মের বাইরে যেয়ে টিভিতে অন্য কোন অনুষ্ঠান দেখে তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমার মৃত্যুর সময় যখন কাফনের কাপড় পরানো হবে তখন আমার লাশের পাশে টিভিটা এনে কুড়াল দিয়ে আঘাত করে চূর্ণ বিচূর্ণ করতে হবে।
তারপর স্যারের কিছু প্রিয় ছাত্রের নাম উল্লেখ করা আছে যারা এই কাজ করবে।
স্যারের টেবিলে বড় বড় কিছু লাঠি রাখা।
স্যার প্রথমেই শুরু করলেনঃ আমার কিন্তু কোন একাডেমিক শিক্ষাগত যোগ্যতা নাই।
মাদ্রাসায় পড়তাম। তারপর কিছুদিন মসজিদে ইমামতি করেছি, তখন প্রথমে আরবি ভাষার প্রতি ঝোঁক আসে এবং শেষে ইংরাজি। শুধু নিজের উদ্যোগে আমি ইংরাজি শিখেছি।
স্যারের এই কথা শুনে সকলে আমার দিকে তাকান শুরু করলো। আমি নিজেও হতবাক।
স্যার বলেন কি?
স্যার আবার বলে চললেন, ইংরাজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে আমার কোন শিক্ষকও ছিলেন না। শুধু বই পড়ে, নিজে নিজে অনুশীলন করে এই ভাষার প্রতি আমার জ্ঞান অর্জন। বাজারে আমার লেখা গ্রামারের উপরে কিছু বই আছে, তোরা চাইলে লাইব্রেরী থেকে কিনে নিতে পারিস। আমার কাছ থেকে কিনলে কিছু ডিসকাউন্ট পাবি।
তারপর স্যার একে একে তার লেখা বিভিন্ন বই দেখালেন।
আমরা সকলেই হতবাক। কিভাবে সম্ভব? স্যার যে কোন একাডেমিক সার্টিফিকেট নেন নাই তা তার কথা বার্তা শুনলেই বোঝা যেত। স্যার প্রতিদিন গল্প দিয়ে শুরু করতেন। প্রথম আধা ঘন্টা গল্প শেষ আধা ঘন্টা পড়া।
স্যারের কাছে সর্ব মোট ছয় মাস মত পড়েছিলাম, তারপর একে একে সকলেই চলে গেল।
একদিন বিকালের দিকে বাসা থেকে বের হয়েছি ক্রিকেট খেলতে মাঠে যাব বলে, হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার গা ঘেঁষে একটা মোটরসাইকেল (আগের আমলের ফিফটি) রাস্তাচ্যুত হয়ে গর্তের দিকে চলে যাচ্ছে। পরের দৃশ্য অনেকটা এরকমঃ মোটরসাইকেল একদিকে পড়ে আছে, স্যার একদিকে।
দৌড়ে স্যারের কাছে যেয়ে তাঁকে টেনে তুলতে গেলে তিনি নিজেই উঠে বল্লেনঃ আর বলিস না! ব্রেকটা ইদানীং কাজ করছে না। সেই কখন থেকে ব্রেক করার চেষ্টা করছি!
স্যার অনেক কষ্টে মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন।
এই বছর শুরুর দিকেও স্যারের সাথে ফোনে কথা হয়েছিল।
ফোন ধরেই বলতেন, কিরে তোকে তো দেখায় যায় না। বাড়ি আসলে দেখা করিস। প্রতিবার একটা করে জোকস শুনিয়ে দিতেন। মন একদম ভালো হয়ে যেত।
আমি আর দেখা করতে পারি নাই।
এর কিছুদিনের মধ্যে একদিন শুনলাম স্যার স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন। স্যারের বয়স খুব বেশী ছিল না, ৫০\৫৫ বছর হয়তো হবে।
স্যারের ফোন নাম্বারটা ডিলিট করতে যেয়ে করতে পারি না। থাকনা আর কিছু দিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।