লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। স্যারের জন্য উপহার
মোহাম্মদ ইসহাক খান
তারপর কী হল? জাহেদ জিজ্ঞেস করে।
সাইফ বলল, বাবা আমাকে বললেন, নে, এই শার্টটা তোর স্যারকে দিয়ে আয়।
উনি খুশি হবেন। আমি পরের দিন স্যারের বাসায় পড়তে গেলাম। সেদিন আমাদের শেষবারের মতো পড়া, এরপর বোর্ড পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে। আরও কয়েকজন এসেছিল, দেখি স্যারের বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গুজগুজ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে রে?
একজন বলল, স্যার বাসায় নেই।
কোথায় যেন গেছেন।
আমি ভাবলাম, যাক বাবা। নিজের হাতে স্যারকে শার্টটা দেবো ভেবেছিলাম, কিন্তু সেটা করতে হলে কতক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হবে তার ঠিক নেই। কাজেই স্যারের স্ত্রী, আমাদের আন্টিকে শার্টটা দিয়ে এলাম। তিনি প্রথমে নিতে চাইলেন না, বললেন, ছাত্রদের কাছ থেকে কোন উপহার স্যার নেন না।
আমি মুখ কাঁদোকাঁদো করে বললাম, আন্টি, না নিলে বড় কষ্ট পাবো। কাজেই তিনি রেখে দিলেন। আমি চলে এলাম।
তারপর?
তারপর আমাদের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো, স্যারের সাথে আর কথা কিংবা দেখা করা কোনটাই হয় নি। আমি প্রথম পরীক্ষাটা দিয়ে বের হয়ে এসেছি, ভাল পরীক্ষা হয়েছে বলে বেশ খুশি লাগছে, এমন সময় স্যারকে দেখলাম গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।
আমার ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেলো। স্যার রাশভারী মানুষ, ধমক না দিয়ে কারো সাথে কথা বলতে পারেননা, মাথায় চাঁটি না মেরে কোন পড়া শেখাতে পারেননা। তিনি আমাকে দেখেই লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলেন, আমি সালাম দেবার আগেই কোন কথা না বলে আমার কান ধরে হিড়হিড় করে একদিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন।
আশেপাশে কেউ ছিল না?
ছিল না মানে? লোকে লোকারণ্য, ছাত্র, ছাত্রী, তাদের গার্ডিয়ান, অনেক মানুষ। কিন্তু স্যার কাউকে পরোয়া করার মানুষ না।
সবার সামনে একেবারে বে-ইজ্জতী যাকে বলে।
তারপর?
স্যার আমাকে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গেলেন। আমার মাথায় চাঁটি মেরে বললেন, এই গাধা, তুই কী করেছিস?
আমি বললাম, কেন স্যার, কী করলাম?
আমার বাসায় তুই কী দিয়ে এসেছিস?
আমার মনে পড়ে যায়, উৎসাহের সাথে বলি, একটা শার্ট, স্যার। আপনার জন্য।
স্যার দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, শার্ট, আমার জন্য? তোর এতবড় সাহস?
আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলি, কেন স্যার, আপনি খুশি হবেন বলেই তো দিয়ে এসেছিলাম।
বটে? বড় বড় কথা? ঐ শার্ট আজই গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবি। নইলে বিশ্বাস কর, বোর্ডে যোগাযোগ করে আমি তোকে ফেল করিয়ে দেবো। ফাজিল, নাদান, কমিন, তুই আমার পাওয়ার জানিস?
আমার মাথায় কিছুই ঢোকে না। আমি ভেবেছিলাম শার্টটা পেয়ে স্যার খুশিতে আটখানা হয়ে যাবেন, এ তো দেখছি হিতে বিপরীত হয়ে গেলো।
আমি শেষ চেষ্টা করি, আবার বলি, স্যার, আমি তো আপনাকে ভালোবেসেই ... ...
চুপ কর গাধা।
ভালোবেসে? ঐ শার্ট কার টাকায় কেনা?
কেন স্যার, আমার বাবার টাকায়।
নালায়েক, খবিস, আবার বড় গলা করে বলছিস বাপের টাকায়? আমি আজ পর্যন্ত কোন ছাত্রের কাছ থেকে কোন উপহার নিই নি, কারণ সবাই বাপের টাকায় বড়াই করে বেড়ায়। একজন ছাত্রও আমাকে বলে নি, স্যার, এই জিনিসটা নিন, আমি নিজে রোজগার করে সেই টাকায় কিনে উপহার দিলাম। তোর বাপের দেয়া ঐ শার্ট পরে যখন রাস্তায় বের হবো, তখন মানুষকে কী বলবো? আমার ছাত্র বাপের টাকায় আমাকে এটা কিনে দিয়েছে? লজ্জা করলো না তোর, বেশরম, নির্লজ্জ, অপদার্থ, বেতমিজ?
আমি মাথা নিচু করে গালিগালাজগুলো হজম করি, কিছু বলার সাহস হয় না।
স্যার আবার বলেন, ভাল চাইলে আজ রাতেই আমার বাসা থেকে ওটা ফিরিয়ে নিয়ে আসবি।
নইলে তোর আর পাশ করতে হবে না এই বলে রাখলাম। কত বড় সাহস, বাপের টাকায় স্যারকে উপহার দেয়। মুরোদ থাকলে নিজে রোজগার করে আমাকে একটা শার্ট কিনে দিবি, দুশো টাকা দিয়ে ফুটপাত থেকে হলেও। আমি সেটা খুশি হয়ে পড়বো, আর বড় মুখ করে সবাইকে বলে বেড়াবো, আমার ছাত্র আমাকে এটা কিনে দিয়েছে, নিজের রোজগারের টাকায়। বুঝলি ছাগল? এখন কানে ধরে দশবার উঠবস কর।
তোর শাস্তি।
আমি খোলা মাঠে দশবার কানে ধরে উঠবস করলাম, লজ্জায় চোখে প্রায় পানি এসে গেছে, কোনদিকে তাকাতে পারছিলাম না। পুরো দশবার গুণে স্যার বিদায় নিলেন, আমি চোরের মতো মুখ করে বাসায় ফিরে এলাম। চারিদিকে সবাই তখন হাসাহাসি করছিলো।
তারপর? জাহেদ জিজ্ঞেস করলো, তুই ঐ শার্ট ফিরিয়ে নিয়ে এলি?
আনবো না? স্যারকে আমি ভাল করে চিনতাম, যদি ফিরিয়ে না আনতাম, তাহলে নির্ঘাত আমাকে ফেল করিয়ে দিতেন।
তারপর তো অনেক বছর কেটে গেছে। তুই চাকরি বাগিয়েছিস, এখন তো নিজে রোজগার করিস। একটা শার্ট কিনে স্যারকে দিয়ে আসতি, এবার তো আর স্যার না করতে পারতেন না।
গিয়েছিলাম। আজই গিয়েছিলাম।
একটা লাল শার্ট কিনেছিলাম, ভেবেছিলাম স্যারকে নিজের হাতে উপহার দেবো, কিন্তু ... ... চুপ করে যায় সে।
কী হল, সাইফ। কথা বল। স্যার কী বললেন?
কিন্তু স্যার আজই মারা গেছেন, জাহেদ। আমি শার্টটা দিতে পারিনি।
হু হু করে কেঁদে ফেলে সাইফ।
জাহেদ বন্ধুর কাঁধে হাত রাখে। সে নিজের রোজগার করা টাকায় স্যারকে একটা শার্ট কিনে দিয়েছিলো, কিন্তু স্যার সেটা নিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত কোন ছাত্রই তাঁকে কোন উপহার দিতে পারলো না। তিনি বড় মুখ করে কাউকে বলতে পারলেন না যে আমার ছাত্র এটা আমাকে দিয়েছে, নিজের রোজগারের টাকায়।
বাতাসে একটা নীরবতা ঝুলে থাকে। দুই বন্ধু চুপচাপ বসে আছে। কারো সাহস নেই সেই নীরবতা ভাঙার।
[গল্পটির একটি অংশে একটি সত্যি ঘটনার ছায়া আছে। শুধুই ছায়া, আর কিছু নয়।
কেউ যখন একটা গল্প লেখে, তখন সবটুকু কল্পনা থেকেই লেখে ব্যাপারটা সবক্ষেত্রে সত্যি নয়, এটা আমি অনেকবার উপলব্ধি করেছি। নিজের চারপাশ থেকেই, এমনকি নিজের জীবন কিংবা অভিজ্ঞতা থেকেই অনেক সময় ঘটনা ধার করতে হয়। বাস্তব কখনো কখনো কল্পনার চেয়েও বিস্ময়কর। বিনীত - মোহাম্মদ ইসহাক খান]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।