আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে নিবন্ধিকৃত মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

“মিডিয়া কারখানার নাট-বল্টু-অস্ত্র কিছুই তৈরি করে না, মিডিয়া তৈরি করে সামাজিক পলিসি, রাজনৈতিক মতাদর্শ। ” (বাগডিকিয়ান, ২০০০:২৮) মিডিয়া যুদ্ধের জ্বালানি। বলা যেতে পারে যুদ্ধের কাঠখড় যোগাচ্ছে। প্রশ্ন জাগতে পারে কাদের কাঠখড় যোগাচ্ছে? কাদের ক্ষমতার মসনদে বসাচ্ছে? আর কাদের বেদী থেকে নামাচ্ছে? ব্যাপারটি সোজা কথায় ব্যাখ্যা করা কঠিন। কারণ যুদ্ধাস্ত্র যখন যুদ্ধের ময়দানে রক্ত ঝরিয়ে মারছে, গণমাধ্যম তখন তথ্য দিয়ে মারছে প্রতিপক্ষকে।

সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া শ্রীলঙ্কান ও তামিলদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কান মিডিয়ার ভূমিকা ছিল ন্যাক্কারজনক। ১৯৮৩ সালের ২৩ জুন থেকে ২০০৯ সালের ১৮ মে পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া এই গৃহযুদ্ধে সরকারি সেন্সরশীপ এবং নিয়ন্ত্রণের কারণে শ্রীলঙ্কার অধিকাংশ মিডিয়াই জনসাধারণকে তথ্য জানানোর কাজটা সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি। তামিল নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া হাউসগুলোকে সেন্সরশীপের আওতায় আনা ছাড়াও হামলা চালিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে যাতে করে তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেয়া যায়। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এবং গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিদেশি মিডিয়ার উপরও আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা খড়গ। এই গবেষণাটির মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ সংঘটনে এবং গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মিডিয়ার ভূমিকা কী তা খতিয়ে দেখা হবে।

গবেষণার উদ্দেশ্য: শ্রীলঙ্কায় তিন দশকব্যাপী স্থায়ী হওয়া গৃহযুদ্ধে তামিল টাইগাররা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এই যুদ্ধে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। এতবড় একটা গৃহযুদ্ধ ঠেকানোর জন্য মিডিয়া কোন ধরণের দায়িত্ব পালন করেছে কিনা তা নির্ণয় করা খুবই প্রয়োজন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে ‘পিস সাংবাদিকতা’র কথা বলা হচ্ছে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই গৃহযুদ্ধে মিডিয়ার ভূমিকা কী রকম ছিল তা জানা প্রয়োজন। সরকারী বাহিনী এবং এলটিটিই দু’পক্ষেরই মিডিয়া ছিল।

যদিও সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলোর সাধারণের কাছে প্রবেশগম্যতা অনেক বেশি ছিল। তারপরও দুইধরণের মালিকানাভিত্তিক মিডিয়ায় কনফ্লিক্ট হ্রাসে কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল কিনা তা জানা। গৃহযুদ্ধের পরে মিডিয়ার কাভারেজ কেমন ছিল তা জানা। গবেষণা প্রশ্ন:  গৃহযুদ্ধ সংঘটনে শ্রীলঙ্কান মিডিয়ার ভূমিকা কেমন?  গৃহযুদ্ধ চলাকালীন মিডিয়া কোনো পক্ষ নিয়েছিল কিনা?  তামিল এবং শ্রীলঙ্কান সরকারের মধ্যে কনফ্লিক্ট হ্রাসে মিডিয়া কেমন ভূমিকা পালন করেছে?  মিডিয়া মালিকানার সঙ্গে গৃহযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে সংবাদ পরিবেশনের সম্পর্ক কতটুকু? গবেষণা পদ্ধতি: এই গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের জন্য ডকুমেন্ট স্টাডি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। গণমাধ্যম গবেষণায় ডকুমেন্ট স্টাডি অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

স্কটের মতে, ডকুমেন্ট অবশ্যই লিখিত আধেয় হতে হবে এবং সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে একে বিশ্লেষণ করতে হবে। (স্কট, ১৯৯০: ৩৪) কোন নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তৈরি রেকর্ড ব্যতিরেকে যেকোন লিখিত তথ্যকে ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। (গোবা এবং লিঙ্কন, ১৯৮১: ২২৮) সিলভারম্যান ডকুমেন্টকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো হচ্ছে ফাইল, পরিসংখ্যানিক রেকর্ড, দাপ্তরিক কাজকর্মের রেকর্ড এবং ইমেজ। (১৯৯৩) এ গবেষণায় প্রাপ্ত সব ধরণের ডকুমেন্টকে বিশ্লেষণ করা হবে।

গবেষণার সমস্যাবলী: এই গবেষণায় শুধু সহজলভ্য ডকুমেন্টগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। আরও সময় নিয়ে অধিক সংখ্যক ডকুমেন্ট ব্যবহার করে গবেষণাটি করা যেত। তাছাড়া এখানে একটিমাত্র পদ্ধতিতেই গবেষণাটি করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ তিন দশক বিস্তৃত। সে তুলনায় কোন নির্দিষ্ট ঘটনার আগে ও পরে নির্দিষ্ট মিডিয়ার সংবাদ উপস্থাপনের ধরণ নিয়ে আধেয় বিশ্লেষণ করলে আরও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যেত।

তথ্য এবং ডকুমেন্ট সংগ্রহের জন্য পুরোপুরি ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। তাত্ত্বিক কাঠামো: টি ম্যাগডার তাঁর ‘টেকিং কালচার সিরিয়াসলি: এ পলিটিক্যাল ইকোনমি অব কমিউনিকেশন’ বইতে বলেছেন, একটি বার্তা কীভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভিতর দিয়ে জনগণের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠে সেটা নিয়ে আলোচনা করে রাজনৈতিক অর্থনীতি। তাঁর এই বক্তব্য থেকে দেখা যায়, রাজনৈতিক অর্থনীতি একটি নির্দিষ্ট সমাজ ও সময়ে গণমাধ্যমের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করে। রাজনৈতিক অর্থনীতি একটি নির্দিষ্ট সমাজের ধরণ-ধারণ নিয়ে আলোচনা করে। মিডিয়া যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সেটি গণতান্ত্রিক না স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ তা নিয়ে আলোচনা করে রাজনৈতিক অর্থনীতি।

মিডিয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতি ধারার প্রবক্তা মার্ক ফিশম্যান বলেন, মিডিয়ায় যে সংবাদ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ হয় তাতে একটি আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে এবং আশ্চর্যজনকভাবে গোটা পৃথিবীটাই একটা আমলাতান্ত্রিক আবহে ঘুরপাক খাচ্ছে। কোন একটা প্রতিষ্ঠান থেকে সংবাদ পেতে হলে তাকে একটি নির্দিষ্ট আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বয়েড ব্যারেট এর মতে, গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোকে মিডিয়াকে বুঝতে হলে তথাকথিত উন্নত দেশ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে বিষয়গুলো ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কাজ করে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করে। (বয়েড, ১৯৮২) নব্য মার্কসবাদী তাত্ত্বিক অ্যান্থনি গ্রামসি মিডিয়া, সমাজ এবং ক্ষমতাশীল শ্রেণির মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছেন, মিডিয়া সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী আধিপত্যকেই টিকিয়ে রাখতে চায়; সমাজের ‘তথাকথিত স্ট্যাটাস কৌ’ বা ‘বিরাজমান অবস্থা’ কে জারি রাখতে চায় এবং সে লক্ষ্যেই সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে চলে।

এডওয়ার্ড এস. হারম্যান ও নোম চমস্কি তাঁেদর ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকোনমি অব ম্যাস মিডিয়া’ বইতে বলেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে মিডিয়া মানুষের সম্মতি আদায় করে চলেছে। সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণির মুনাফা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তবতা তৈরি করে দিচ্ছে। এজন্য যে রকম বার্তা দিলে ক্ষমতাবানরা নিরাপদ থাকে, সেরকম বার্তাই তারা দিচ্ছে। অর্থাৎ ক্ষমতা কাঠামোয় যারা আসীন তাদের আর্থিক, নৈতিক লাভ বা সুবিধার জন্য সমাজের মানুষের মাঝে যেরকম মতামত সৃষ্টি করতে হয় সেটার উপলক্ষ্য সৃষ্টি করে দিচ্ছে মিডিয়া। মিডিয়ার আধেয়ে এমন কোন বিষয় থাকতে পারবে না যা তাদের কর্পোরেট স্বার্থকে ক্ষুণœ করে।

(হারম্যান ও চমস্কি, ১৯৮৮) বাংলাদেশ থেকে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। গণমাধ্যমের সমালোচনা করে মাইকেল প্যারেন্টির অনুবাদ দৈনিক যুগান্তরে ধারাবহিকভাবে প্রকাশ করার কথা ছিল। কিন্তু প্রথম কিস্তি ছাপা হওয়ার পরই পত্রিকার সহ-সম্পাদক সেই লেখার অনুবাদককে বলে দেন, তিনি আর লেখাটি ছাপতে পারবেন না। তিনি হাউজের ভেতর থেকে চাপ অনুভব করছেন। কাজেই বলা চলে যে আর মালিকানা মিডিয়া একই পথে একই গতিতে চলে আসছে সেই প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত।

সি.আর সিপাবিও মডেল ও শ্রীলঙ্কান গৃহযুদ্ধ: আমর আবদাল্লাহ ২০০২ সালে তাঁর “আন্ডারস্ট্যান্ডিং সি. আর. সিপাবিও: অ্যা কনফ্লিক্ট এনালাইসিস মডেল’ শীর্ষক একটি লেখার মাধ্যমে প্রথম এই মডেলটি প্রদান করেন। এতে কনফ্লিক্টের সাথে জড়িত বেশ কিছু বিষয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ঈ= পড়হঃবীঃঁধষ ভধপঃড়ৎং (ঃযব ংড়পরড়ষড়মরপধষ, বঃযহরপ, ঢ়ড়ষরঃরপধষ, মবড়মৎধঢ়যরপধষ, পঁষঃঁৎধষ, ৎবষরমরড়ঁং, মবহফবৎবফ, ) জ=ৎবষধঃরড়হধষ ভধপঃড়ৎং (নড়হফ, ঢ়ড়বিৎ, ঢ়ধঃঃবৎহ বঃপ) ঝ=ংড়ঁৎপব (উৎসসমূহ) ও=রংংঁবং (প্রধান ইস্যু) চ=ঢ়ধৎঃরবং (দ্বন্দ্বে জড়িত গোষ্ঠীসমূহ) অ=ধঃঃরঃঁফবং (মনোভাব) ই=নবযধারড়ৎং (আচরণ) ও=রহঃবৎাবহঃরড়হ (হস্তক্ষেপ) ঙ=ড়ঁঃপড়সব (পরিণতি) ১. কন্টেক্সুয়াল ফ্যাক্টরস (ঈ= পড়হঃবীঃঁধষ ভধপঃড়ৎং (ঃযব ংড়পরড়ষড়মরপধষ, বঃযহরপ, ঢ়ড়ষরঃরপধষ, মবড়মৎধঢ়যরপধষ, পঁষঃঁৎধষ, ৎবষরমরড়ঁং, মবহফবৎবফ, )) পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবন ও খাগড়াছড়ি নিয়ে গঠিত। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি হওয়া সত্ত্বেও এর জাতিগত সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বের অন্য অনেক জাতিগত সহিংসতার মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের এই জাতিগত কনফ্লিক্টও বৃটিশ প্রশাসকদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সৃষ্টি।

পার্শ্ববতী দেশ ভারত আদিবাসীদেরকে বিভিন্নভাবে অস্ত্র ও অন্যান্য দিক দিয়ে সহায়তা করে কনফ্লিক্টকে জারি রাখতে চায়। পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ১২টি ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা রয়েছে। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, প্রথা, বিশ্বাস সবই মূলধারার জনগোষ্ঠী বাঙালীদের চেয়ে ভিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যকে নষ্ট করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যেগ নিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা কোন সরকারের আমলেই তেমন সুবিধা পায় নি।

বৃটিশ শাসন অবসানের পর পাকিস্তান আমল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবসতি স্থানান্তর শুরু করে। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার রাঙ্গামাটি, রামগড় ও বান্দরবানে অনেক বাঙ্গালীদের বসতি স্থাপন করে দেয়। ১৯৬৬ সনে আবার কয়েক হাজার বাঙ্গালীদের পুনর্বাসিত করে। বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার পর পরই দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০,০০০ বাঙ্গালী পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড় অঞ্চলে বসতিস্থাপন শুরু করে। ১৯৭৪ সালে এম.এন.লারমা পাহাড়ীদের পক্ষে আন্দোলনে নামলে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া স্থিমিত হয়ে যায়।

১৯৭৯ সালে সরকার পুনরায় গোপন সার্কুলারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীদের বসতিস্থাপন প্রক্রিয়া আরম্ভ করে। ঐ বছরই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিধিমালার ৩৪ নং বিধি সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে পুনর্বাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূরীভূত করে। একই বছর সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০,০০০ ভূমিহীন বাঙ্গালী পরিবারকে পুনর্বাসিত হয়। এরপর ১৯৮০ সালের শেষের দিকে আরো ২৫,০০০ পরিবার পুনর্বাসিত হয়ে যায়। এভাবে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ৪,০০,০০০ বাঙ্গালী পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হয়।

মূলত: পার্বত্য এলাকার উপর পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের হস্তক্ষেপ খর্ব করা এবং সেখানে বাঙ্গালীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করাই ছিল এই পুনর্বাসনের প্রধান উদ্দেশ্য। ২. রিলেশনাল ফ্যাক্টরস জ=ৎবষধঃরড়হধষ ভধপঃড়ৎং (নড়হফ, ঢ়ড়বিৎ, ঢ়ধঃঃবৎহ বঃপ) ৩. উৎসসমূহ (ংড়ঁৎপবং): এখানে উৎস বলতে কনফ্লিক্টের পিছনের মূল কারণসমূহকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কনফ্লিক্টের মূলে রয়েছে তাদেরকে ক্রমাগত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, আর উচ্ছেদকৃত জায়গাগুলোতে বাঙালিদের বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। এটা তাদেরকে সহিংস হতে বাধ্য করেছে। আদিবাসীরা সম্পূর্ণরূপে বাঙালীদের উচ্ছেদ চায়।

আর তারা একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করা সত্ত্বেও তাদেরকে নিয়মিত সেনাক্যাম্প দিয়ে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে।  সেটলার পনর্বাসন ও ভূমি বেদখল: ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৩৪ নং ধারায় পার্বত্য এলাকায় বহিরাগতদের জমি বন্দোবস্তির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল সরকার তা ১৯৭৯ সালে তুলে নেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩০,০০০ বাঙালিকে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত চার লক্ষ সমতলবাসীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হয়। স্বপন আদনানের মতে, “ভূমি ও বনের উপর অধিকার হারানোর ফলে পাহাড়ি জনগণের ক্রমবর্ধমান একটি অংশ দিনমজুরে পরিণত হতে বাধ্য হয়। ” (মাইগ্রেশন, ল্যান্ড অ্যালিয়েশন অ্যান্ড এথনিক কনফ্লিক্ট: কজেস অ্যান্ড পভার্টি ইন দ্যা চিটাগং হিল ট্যাকস অব বাংলাদেশ, ২০০৪)  ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ: পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আদিবাসীদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

বরং তারা ব্যবসায়িক শোষনের নির্মম হাতিয়ার। বাজার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিধায় তারা তাদের উৎপাদিত সামগ্রী কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পরিবহন, ব্যাংকিং,ঠিকাদারি, সেবাখাত সবকিছু বহিরাগতদের একচেটিয়া দখলে।  তথাকথিত কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সি: পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির নামে আদিবাসীদের উপর চরম দমন-পীড়ন চালায়। মান বমিত্র সেনাবাহিনীর এই কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কলা-কৌশলকে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক এই চারভাগে বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করেন।

অর্থনৈতিক কৌশলের মধ্যে রয়েছে- (ক) পাহাড়িদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ এবং যৌথ খামার, আদর্শ গ্রাম ও গুচ্ছ গ্রামে স্থানান্তর এবং (খ) দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলেও কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি বন্ধ হয়নি।  বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন ও নিয়ন্ত্রণ: পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বহুগুন বৃদ্ধি পায়। পেপার মিলে, ইট ভাটায়, তামাক চুল্লিতে ও আসবাবপত্র তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য অবাধে কাঠ আহরণের ফলে একদিকে যেমন বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে ও এর ফলে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে; অপরদিকে বনকে নির্ভর করে পাহাড়ি জনগণের অর্থনৈতিক জীবন পুরোপুরি ধ্বংস হতে চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঠ ব্যবসার মূল্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।

(সূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন রিপোর্ট, আপডেট ৩)  তথাকথিত উন্নয়ন কর্মসূচি: উন্নয়ন শ্রেণী-নিরপেক্ষ নয়। যে এলাকায় সশস্ত্র বিদ্র্রোহ বিরাজ করে সেখানে উন্নয়ন কৌশল বিদ্রোহ দমনের হাতিয়ারে পরিণত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামেও তাই হয়েছে। ১৯৮০ দশকে উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে যৌথ খামার ও আদর্শ গ্রাম কর্মসূচির নামে সেনাবাহিনীর রণকৌশলগত লক্ষ্যকেই বাস্তবায়ন করা হয়। এসব কর্মসূচির ফলে আদিবাসীদের স্বনির্ভর অর্থনীতি ভেঙে দিয়ে যৌথ খামারে ও রাবার বাগানে তাদেরকে মজুরি দাসে রূপান্তরিত করা হয়।

২০০৭-০৮ সালে বান্দরবানের চিম্বুকে সেনাবাহিনী মুরুংদের জমিতে ‘নীলগিরি’ নামে একটি পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ করলে শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ৪. প্রধান ইস্যু (রংংঁবং): যে বিষয়টি নিয়ে কনফ্লিক্ট হচ্ছে তা-ই হচ্ছে এখানে প্রধান ইস্যু। পার্বত্য চট্টগ্রামে কনফ্লিক্টের ক্ষেত্রে প্রধান ইস্যুসমূহ হচ্ছে-  পাবর্ত চট্টগ্রামে সেটেলারদের পুনর্বাসন বন্ধ করতে হবে।  আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।  সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিতে হবে  বাঙালী কর্তৃক বনজ সম্পদ লুন্ঠন বন্ধ করতে হবে  তথাকথিত উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস বন্ধ করতে হবে।

৫. দ্বন্দ্বে জড়িত গোষ্ঠীসমূহ (ঢ়ধৎঃরবং): কনফ্লিক্টে জড়িত গোষ্ঠগুলো খুঁেজ বের করতে হবে। পাবর্ত চট্টগ্রামের জাতিগত কনফ্লিক্টে প্রথম দিকে সরকার এবং আদিবাসীরা জড়িত ছিল। তাই সরকার ছিল এখানে মুখ্য তথা প্রধান গোষ্ঠী। কিন্তু সরকারের পরে সেখানে বাঙালিদের স্থানান্তর করে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরাই প্রধান গোষ্ঠীর ভূমিকা পালন করছে।

অন্যদিকে ভারত এখানে সমসময় তৃতীয় পক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। ৬. মনোভাব (ধঃঃরঃঁফবং): ১৯৯৭ সালে ইউপিডিএফের সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মনোভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক আলোচনা সভায় বলেন, “সেটেলারদের পাহাড়িরা মেনে নেয়নি, এখনও নিচ্ছে না। তারা সেটেলারদেরকে রাজনৈতিকভাবে অর্থাৎ অস্তিত্ত্বের হুমকি মনে করে। ” তার এই উক্তিটিই আদিবাসীদের মনোভাবকে অনেকাংশে প্রকাশ করে। আদিবাসীদের অনেকেই পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে অসম চুক্তি বলে মনে করে।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রধান ধারা যেখানে তাদেরকে ‘উপজাতি’ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে তারও ঘোর বিরোধী আদিবাসীরা। সাংস্কৃতিক জাত্যাভিমান আদিবাসীদের মধ্যে প্রবল। চাকমারা মনে করে তাদের সংস্কৃতিই অপর আদিবাসী সংস্কৃতির চেয়ে সেরা। এছাড়া আদিবাসী-সেটেলারদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, অসহায়ত্ব বোধ করা ইত্যাদি মনোভাব রয়েছেই। ৭. আচরণ (নবযধারড়ঁৎং): পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা তাদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য বিভিন্ন সভা-সমিতি গঠন করেছে।

এগুলো হচ্ছে জন সংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ, পাহাড়ি গণপরিষদ, পাহাড়ি ছাত্রপরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন। এদের মধ্যে প্রত্যেকে নিজের মতো করে সমস্যার সমাধান করতে চায়। প্রত্যেকটি সংগঠনের মধ্যেও রয়েছে মত ও আদর্শের ভিন্নতা। তারা বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ, কখনো কখনো সহিংস আচরণ করে থাকে। ৮. হস্তক্ষেপ (রহঃবৎাবহঃরড়হ): আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি সাক্ষ্যরিত হয়।

এর কয়েকটি দিক হচ্ছে- পার্বত্য চট্রগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করা, স্বাক্ষরের পর হতেই চুক্তি বলবৎ করা এবং বিডিআর ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা। কিন্তু চুক্তির মূল বিষয়গুলো নিয়ে যেমন দ্বন্দ্ব রয়েছে তেমনি এর বেশ কিছু বিষয় এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। ৯. পরিণতি(ড়ঁঃপড়সব): পরিণতি হচ্ছে সাধারণত শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা করা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনও সেই কাঙ্খিত শান্তি আসে নি। পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোর আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তিতে ‘উপজাতি’ শব্দটি নিয়ে এখনও আন্দোলনে নামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদসহ আরো বেশ কয়েকটি সংগঠন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে, বাংলাদেশ শুরু থেকে কখনোই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি-অধিবাসীদের বা পাহাড়িদের ‘আদিবাসী’ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিবদমান সমস্যার অনেকখানিই এই ‘স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির’ সাথে সম্পৃক্ত। এখনও তুচ্ছ কারণে আদিবাসী ও সেটেলারদের মধ্যে সংঘর্ষ ভয়াবত রূপ লাভ করে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র এটি।

গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথে অবস্থানের কারণে দেশটিকে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নৌ-যোগাযোগের সংযোগস্থল বলা যায়। শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। এর অবস্থান বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং আরব সাগরের দক্ষিণ-পূর্বে। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে দেশটি মান্নার উপসাগর ও পক প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এর আয়তন ৬৫,৬১০ বর্গ কিলোমিটার।

সমুদ্র উপকূল ১,৩৪০ কিলোমিটার। অধিকাংশ ভূ-খন্ড নিচু, সমতল সমুদ্র উপকূলীয় এবং দক্ষিণাঞ্চলে কিছু পর্বত রয়েছে। সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ ‘পিদুররুতলাগলা’ যার উচ্চতা ২ হাজার ৫২৪ মিটার (৮,২৮১ ফুট)। সিংহলিরা উত্তর ভারত থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ ভাগে শ্রীলঙ্কায় আসে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা শুরু হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সাল থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনুরাধাপুরে এবং ১০৭০ থেকে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পলন্নাড়–য়ায় দুটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। চতুর্দশ শতাব্দীতে দক্ষিণ ভারতীয় রাজবংশ উত্তরাঞ্চলের ক্ষমতা দখল করে এবং তামিল রাজত্ব গড়ে তোলে। দীর্ঘ দুই হাজার বছর স্থানীয়দের রাজত্বের পর ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগাল এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে হল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে চলে যায় অঞ্চলটি। পরবর্তীতে ১৮১৫ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাজত্বের অংশে পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়, যার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে একটি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

শ্রীলংকার মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এর মধ্যে ৭৪% বৌদ্ধ ধর্মানুসারী সিংহলী, মাত্র ১৮% তামিল হিন্দু, বাকী ৮% মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। শ্রীলঙ্কা গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ। এর সরকার রাষ্ট্রপতি এবং সংসদীয় পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় প্রধান, সরকার প্রধান এবং সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক।

জনগণের ভোটে ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন, যিনি সংসদের নিকট দায়ী থাকেন। শ্রীলঙ্কার সংসদ এক কক্ষবিশিষ্ট যার সদস্য সংখ্যা ২২৫ জন। রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের নিয়োগ দেন এবং পরিষদের প্রধান থাকেন। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির অধীন থাকেন। ১৯৩১ সাল থেকে শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিরাজমান।

শ্রীলঙ্কার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো হলো- বর্তমান রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ রাজাপাকসে’র নেতৃত্বাধীন ‘শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি’, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনীল বিক্রমাসিংহ’র নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি’ এবং ‘ন্যাশনালিস্ট জেভিপি’। এছাড়াও কিছু বৌদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক, তামিল জাতীয়তাবাদী দল রয়েছে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী গেরিলা সংগঠন তামিল টাইগারদের (এলটিটিই) বিরোধী কিন্তু স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন এবং নাগরিক অধিকার আদায়ের দাবিতে সোচ্চার। শ্রীলঙ্কায় জাতিগত সংঘাতের শুরু বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দর নায়েকের সময় থেকে। তাঁর সময়ে ১৯৭২ সালে সিংহল নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শ্রীলঙ্কা এবং রাষ্ট্রভাষা ইংরেজী বাদ দিয়ে সবখানে প্রচলিত হয় সিংহলী ভাষা। আর এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংখ্যালঘু তামিলরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং দেশজুড়ে আন্দোলনের ডাক দেয়।

ফলে গণতান্ত্রিক সরকারকে আন্দোলন ঠেকাতে জারি করতে হয় জরুরী ক্ষমতা আইন। ১৯৭৬ সালের ৫ মে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ তামিলদেরকে আজন্ম শত্রু সিংহলীদের থেকে মুক্ত করতে টিএনটি (তামিল নিউ টাইগার) গোষ্ঠীকে দক্ষতার সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এবং দুর্ধর্ষতম কর্ম সম্পন্নকারী শক্তিশালী একটি এলিট ফোর্স গঠন করেন। নতুন নামকরণ করেন ‘এলটিটিই’ (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম)। ২৩ জুলাই, ১৯৮৩ তারিখে উত্তর ও পূর্ব শ্রীলংকার তামিল অঞ্চল জাফনা’র বাইরে লংকান সেনাদের উপর প্রথম হামলা চালিয়ে ১৩ সেনা খতম করে ‘এলটিটিই’ তাদের শক্তিমত্তা বহির্বিশ্বে প্রথমবারের মত জানান দেয়। অন্যদিকে গোটা তামিল সম্প্রদায়ের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্ন নতুন করে বাসা বাঁধে।

দলে দলে তরুণরা টাইগারদের সাথে যোগ দেয়। মুক্ত দেশ পাওয়ার নেশায় উন্মাদ হয়ে এক একজন ভয়ংকর ও দুর্ধর্ষ গেরিলা হয়ে উঠে। এমনকি জীবন বিনাশী ‘সায়ানাইড ক্যাপসুল’ সবসময় তাদের গলায় শোভা পেত। আক্রান্ত হলেই তারা বিষের এই ট্যাবলেট গিলে মুক্ত দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করত। যদিও নির্মম বাস্তবতা হল, এর প্রবক্তা প্রভাকরণ জীবনের কঠিন সায়াহ্নে ‘সিংহলী’ সেনাদের থেকে বিষ খাওয়ার সেই সময়টুকু পাননি।

আরো একটি প্র্যাকটিস তাদের মধ্যে ছিলো তা হল ‘ঙধঃয ড়ভ ষড়ুধষঃু’ বা তামিল রাষ্ট্র গড়ার আনুগত্যের কঠিন শপথ। প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘাঁটিসমূহে আত্মঘাতী আক্রমণ চালানোর ব্রত নিয়ে ১৯৮৭ সালে এলটিটিই’র সুইসাইড স্কোয়াড ‘ব্ল্যাক টাইগার’ গঠন করে। এবছরই তারা একটি সেনা ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে চল্লিশজনকে বধ করতে সক্ষম হয়। ব্ল্যাক টাইগারদের মনোবল বহুগুণে চাঙ্গা হয়ে উঠে। ‘নিরাপদ-যোদ্ধা’ হিসেবে শত শত কিশোর ও মহিলাদেরকে তারা প্রশিক্ষিত করে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে ছেড়ে দিয়ে সফল আক্রমণের পারদর্শিতা দেখাত।

এই যুদ্ধে ভারতও এক সময় প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮৭ সালে হতাশ ও উদবাস্তু তামিলদের ভেতর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ তীব্রভাবে দেখা দেয়। সুযোগটি ভারত ভালভাবে কাজে লাগায়। একসময় ইন্দো-শ্রীলংকা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যদিও দ্বন্দ্বটি ছিল সিংহলী ও তামিলদের মধ্যে। পঞ্চাশ হাজার ‘ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স’ (আইপিকেএফ) শ্রীলংকায় অবস্থান নেয়।

তামিলদের ক্ষুদ্র কয়েকটি গ্রুপ এ চুক্তি মেনে নিলেও টাইগাররা মানতে পারেনি। তাদের পছন্দের প্রতিনিধিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি হয়নি ভারত। ‘এলটিটিই’র অস্ত্র এবার ঘুরে যায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর দিকে। একই বছরের ৮ অক্টোবর রেশন ট্রাকের উপর হামলা চালিয়ে পাঁচজন ভারতীয় প্যারা-কমান্ডোকে মেরে গলায় জ্বলন্ত টায়ার পেঁচিয়ে রাখে যোদ্ধারা। আত্মসম্মান বাঁচাতে বেপরোয়া হয়ে উঠে অজনপ্রিয় আইপিকেএফ।

‘অপারেশন পবন’ নামে তামিল নিধনে নির্মম অভিযান শুরু করে তারা। টাইগাররা হিং¯্র ও প্রতিশোধপরায়ন হয়ে ওঠে। আগে থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীরা ভারতীয়দের হস্তক্ষেপ কোন মতেই মেনে নিতে পারেনি। ফলে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি গুণে নাস্তানাবুদ হয়ে শ্রীলংকা সরকারের অনুরোধে ভারতীয় সর্বশেষ সৈন্যটি ফিরে যায় ১৯৯০ সালে। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে এলটিটিই গঠনের জন্য তরুন প্রভাকরনকে ভারত সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সব ধরনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা প্রদান করে।

৭০’র দশকে ইন্দিরা সরকার ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’কেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। এমনকি প্রভাকরনের একসময় অফিসও ছিল তামিলনাড়ুতে। ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেসের থলেতে ভারতীয় তামিলদের ভোট পাকাপোক্ত করতেই শ্রীলংকার বিরোধী আন্দোলনকে উৎসাহিত করেছেন যার শেষ হলো বহু বন্ধুর ও রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে। ভারতীয় শান্তি রক্ষী বাহিনী স্বদেশে ফিরে গেলেও প্রতিহিংসাপরায়ণ টাইগারদের রাগ এতটুকু কমেনি। সুযোগ খুঁজতে থাকে বদলা নেয়ার।

সুইসাইড স্কোয়াড দলের ব্ল্যাক টাইগাররা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে শান্তি চুক্তি সম্পাদনকারী দুই দেশের দুই রাষ্ট্রপ্রধানকেই নির্মমভাবে শেষ করে দেয়। রাজীব গান্ধীকে হত্যা করে ১৯৯১ সালে আর শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানাসিংহ প্রেমাদাসাকে ১৯৯৩ সালে। তিন দশকের এই লড়াইয়ে যুদ্ধ-বিরতির হরেক রকমের প্রস্তাবনা এসেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র থেকে সরে এসে স্বায়ত্ত্বশাসন, স্পেশাল স্ট্যাটাস কত কিছু! অন্তত চার চারবার শান্তি চুক্তি ভেঙ্গে যায়। সর্বশেষটি ভন্ডুল হয় ২০০৬ সালে।

তখন থেকেই শ্রীলংকান সেনাবাহিনী সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে এলটিটিইকে কোনঠাসা করে ফেলে। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় যারা দেশের এক তৃতীয়াংশ বা কমপক্ষে ১৫ হাজার বর্গ কি.মি. এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত সেই দুর্ধর্ষ ও অজেয় টাইগারদের তাড়িয়ে সেনারা মোল্লাইথিভু জেলার মাত্র ১.৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জঙ্গলের মধ্যে আটকে ফেলে। কট্টর তামিলবিরোধী প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে তখন থেকেই বিজয়ের বার্তা গুণতে থাকেন। কিন্তু ২০০৯ সালের মে মাসে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর সেই অধ্যায়েরও অবসান হয়। দীর্ঘ তিন দশকের এই রক্তাক্ত সংঘর্ষে প্রাণ হারায় ২৪,০০০ শ্রীলঙ্কান সৈন্য।

আবার ২০০৬ সাল থেকে পরিচালিত সর্বশেষ যুদ্ধে প্রাণ হারায় সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌ-বাহিনীর মোট ৬,২০০ সৈন্য এবং আহত হয় প্রায় ২৯,৫৬০ জন। অন্যদিকে তামিলরা জানায়, দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে তাদেরও ২২,০০০ সামরিক ক্যাডার নিহত হয়। আর জাতিসংঘ দাবি করে, দীর্ঘ জাতিগত সংঘর্ষে অনুমানিক ১,০০,০০০ লোক নিহত হয়। এই সংঘর্ষে দুই পক্ষের বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও তদন্ত করছে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। তাদের অভিযোগ, যুদ্ধকালীন সময়ে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে জড়িত।

শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের শেষ দৃশ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গেরিলা নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের শেষ পরিণতি। সেই দৃশ্যে দেখা যায়, মাথায় গুলির চিহ্নসহ বিস্ফোরণ উন্মুখ প্রভাকরণের মৃত দেহটি। সেনাবাহিনী তখন দাবি করে পালানোর সময় সেনাবাহিনীর গুলিতে মারা যান তিনি। একজন প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেন, হত্যার আগে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছিল প্রভাকরণের ওপর। এমনকি তাঁর ১২ বছর বয়সী ছেলে বালাচন্দ্রকেও হত্যা করা হয় নির্যাতনে।

এ ধরনের অভিযোগ করে জাফনাভিত্তিক ইউনিভার্সিটি টিচারস ফর হিউম্যান রাইটস। ৪৮ পৃষ্ঠার সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রভাকরণকে হত্যার আগে সেনাবাহিনীর ৫৩ ডিভিশনের সদর দফতরে একজন তামিল রাজনীতিক এবং একজন তামিল জেনারেলের সামনে তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রভাকরণের সামনেই তাঁর সন্তানকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। নো-ফায়ারিং জোনে অবশিষ্ট তামিলদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এছাড়া শ্রীলঙ্কান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও বেশ কয়েকটি মৃতদেহের ছবি প্রদর্শন করা হয়।

পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়ার দাবি, গৃহযুদ্ধে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং দু’পক্ষই এই অপরাধে দোষী। এলটিটিই’র প্রভাব-প্রতিপত্তি: এলটিটিই’র শক্ত ও সুসংগঠিত সামরিক কাঠামো ছিল। আত্মঘাতী স্কোয়াড ‘ব্ল্যাক টাইগার’, সুসজ্জিত মেরিন বাহিনী ‘সি টাইগার’, এমন কি আধুনিক একটি বিমান বাহিনী ‘এয়ার টাইগার’ও ছিল (যা কিনা পৃথিবীর ইতিহাসে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত কোন গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে প্রথম বিমানবাহিনী), গোয়েন্দা শাখা, রাজনৈতিক শাখা সবই তাদের ছিল। উল্লেখ্য, এই সংগঠনটিকে আমেরিকা, কানাডা, বৃটেনসহ ৩২টি দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সামরিক শক্তি হিসেবে প্রধানত এলটিটিই’র ব্যাপক পরিচিতি থাকলেও পর্যায়ক্রমে এরা নর্থ আইল্যান্ডের গোটা এলাকায় একটি ক্রিয়াশীল স্বঘোষিত বেসামরিক ‘সরকার’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

এই মিনি সরকারের অধীনে বিচারবিভাগ (ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, এমনকি আপিল কোর্ট) ছিল। ধর্ষণ, খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধসমূহ বিচারের জন্য দুটো হাইকোর্ট আর তামিল ইলমদের বিচারের দায়িত্বে ছিল সুপ্রীম কোর্ট। বিচার বিভাগ ল’বুকের হালনাগাদ পর্যন্ত করত। টাইগাররা দাবি করত তাদের বিচারালয় ও নিজস্ব পুলিশ বাহিনী সক্রিয় থাকায় জাফনাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে অপরাধপ্রবণতা অনেকাংশে কম ছিল। যদিও সমালোচকরা বলে থাকেন, এই পুলিশবাহিনী স্বেচ্ছাচারী এলটিটিই’র আজ্ঞাবহ থাকায় জনসাধারণ সারাক্ষণ ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত।

সামাজিক নিরাপত্তা ও মানবিক দিকসমূহ দেখভালের জন্য টাইগাররা সোশ্যাল ওয়েলফার চালু করেছিল। ফান্ডে টাকা আসত জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স ও বিদেশ থেকে সহানুভূতিশীল সংগঠনসমূহ থেকে। এই অর্থ তামিলদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করত। অভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতির জন্য সুন্দর একটি অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃতি না দিলেও এলটিটিই নিজেদের জন্য বানিয়েছিল একটি মানবাধিকার কমিশন।

‘ব্যাংক অব তামিল ইলম’ নামে উচ্চ সুদের একটি ব্যাংক তাদের ছিল। প্রশাসনিক রাজধানীর নাম ছিল কিলিনোচছি। ২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী সুনামীর তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য এলটিটিই ‘সুনামি টাস্ক ফোর্স’ গঠন করে সাধারণ মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। তাদের মহিলা শাখাটিও ছিল খুব শক্তিশালী। চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিগৃহীত, নির্যাতিত ও অবহেলিত মহিলাদেরকে টাইগারদের ‘নারী-স্বাধিকার’ অবস্থ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.