ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হলে অর্জনগুলো ম্লান হয়ে যায়
ফকির ইলিয়াস
=========================================
বেশ ঘটা করেই বিশ্ব শান্তিরক্ষী দিবস পালন করেছে বাংলাদেশ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বিশ্ব শান্তিরক্ষায় আমাদের বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। রাষ্ট্রপতি আরও সাহসী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। সন্দেহ নেই ওয়ার্ল্ড পিস কোরে বাংলাদেশ এখন একটি উজ্জ্বল নাম। বিশেষ করে জাতিসংঘের অধীনে শান্তিমিশনে বাংলাদেশি বাহিনীর সদস্যরা যে ভূমিকা এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন তা বিশ্বের সর্বোচ্চ মহলে প্রশংসা কুড়াচ্ছে।
বিশ্বশান্তির মডেল হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবনাসমূহ আলোচিত হচ্ছে নানা মহলে। যা দেশ ও জাতির জন্য আনন্দের বিষয়। কিন্তু এর পাশাপাশি বেশকিছু অস্বস্তিকর খবরও আছে আমাদের জন্য। সেগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে চরম উদ্বেগের ঘটনা।
অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, মিডিয়ার স্বাধীনতা মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। দুর্নীতি, খুন, গুম বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। ২০১১ সালের ঘটনাবলির নিরিখে করা যুক্তরাষ্ট্রের এ রিপোর্টের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতার মাত্রা চরমে পৌঁছেছে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার যে চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে এ জন্য বিদেশি প্রতিবেদন পড়ার দরকার নেই। প্রমাণগুলো দেশের মানুষ প্রতিদিনই দেখছেন।
তিনজন ফটোসাংবাদিককে বেধড়ক প্রহার করেছে পুলিশ। যা এখন উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই দেশের অন্যতম প্রধান অনলাইন সংবাদ মিডিয়া বিডিনিউজ২৪ডটকমের অফিসে নির্মমভাবে আক্রমণ করেছে সন্ত্রাসীরা। বিডিনিউজ অফিসের মেঝে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের মাটি কত বেদনাহত এবং রক্তাক্ত। না, এমন বাংলাদেশ তো এ প্রজন্ম চায়নি।
তাহলে তারা এমন জঘন্যতমভাবে আক্রান্ত হচ্ছে কেন?
সাংবাদিকতা গোটা বিশ্বব্যাপী একটি মহান পেশা হিসেবে বিবেচিত। সেই পেশায় যেতে আজ ভীত-সন্ত্রস্ত এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। কী ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে চলছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে সামাজিক অশান্তি উসকে দিচ্ছে রাজনীতিকদের বক্তব্য। অতিসম্প্রতি জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুর একটি বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে দেশে-বিদেশে।
তিনি রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার কথা বলেছেন। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ইনুর কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা। এভাবে ঢালাও কথাবার্তা কোন বিজ্ঞ রাজনীতিকের মুখে সমীচীন কি না তা দেশের মানুষই বিবেচনা করবেন। তবে আমি বলতে চাই, উসকানিমূলক মন্তব্য থেকে যত বিরত থাকা যায় রাজনীতির জন্য, দেশের জন্য ততই মঙ্গল। কারণ আমরা দেখেছি এই বাংলাদেশে মুসলিম লীগের মতো বড় রাজনৈতিক দলও তামাদি হয়ে গেছে।
কারণ জনগণ তাদের গ্রহণ করেনি। লিখিত ইশতেহার দিয়ে কাউকে, কোন দলকে রাজনীতি থেকে খারিজ করা যায় না। এতে শুধু পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতই বাড়ে। বাংলাদেশ এমন সংঘাতের জন্য মোটেই প্রস্তুত নয়।
একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটেই যাচ্ছে।
বলা হচ্ছে তদন্ত হবে। খতিয়ে দেখা হবে কিন্তু বাস্তবে খুব বেশি কিছুই হচ্ছে না। সাগর-রুনি হত্যাকা-ের কোন সুরাহা নেই। কূটনীতিক খালাফ হত্যাকা-ের জন্য কেউ গ্রেফতার হয়নি। ইলিয়াস আলীর সন্ধান নেই।
বেড়েছে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ। মনে রাখা দরকার ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হলে অর্জনগুলো মস্নান হয়ে যায়। অর্জন নিয়ে আনন্দ-উৎসব তখনই করা যায়, যখন ঘরে অন্তত শান্তি থাকে।
অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে একটি জমজমাট ভিডিও কনফারেন্স করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্থানীয় টিভি নিউজে এর ফুটেজ দেখেছি।
সেখানে তিনি সরকারের সফলতার চিত্র ব্যাপকভাবে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন। একজন নগণ্য শব্দসৈনিক হিসেবে আমিও সবিনয়ে বলি, আমরাও দেশের সরকারের, গণমানুষের সফলতা নিয়ে লিখতে চাই। মানুষের অর্জনের পতাকা বিশ্বব্যাপী উড়িয়ে দিতে চাই। কিন্তু আমাদের কলম বারবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে কেন? আমার সতীর্থ বিডিনিউজের সাংবাদিকরা এভাবে আক্রান্ত হলেন কেন? কেন তিনজন ফটো সাংবাদিককে নির্মমভাবে প্রহার করা হলো?
দুই বেলার স্থলে একবেলা যদি পেটভরে খেয়েও মানুষ নিরাপদে, শান্তিতে থাকতে পারে তবে তাদের কোন অভিযোগ থাকবে না। নিরাপত্তা বাংলাদেশে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে না পারলে সরকারের কোন অর্জনই মানুষ মনে রাখবে না। যেমনটি বিগত জোট সরকারের ভালো কাজগুলো ধুলোয় মিশে গিয়েছিল।
বাংলাদেশে এখন দুজন স্বরাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তারপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুষ্ঠু জবাবদিহিতা কেন নেই, সে প্রশ্নটি বারবার আসছে। ছাইচাপা দিয়ে মানুষের মনের ক্ষোভ ঢেকে রাখা যায় না।
দেশের বিশিষ্ট এক্সপার্ট গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে। তাদের দিয়ে জরিপ করিয়ে দেখতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার মাত্রাটি কোন পর্যায়ে আছে, তা প্রধানমন্ত্রীর গোচরীভূত হওয়া দরকার।
চট্টগ্রামে হিমু নামে একজন মেধাবী ছাত্রকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে খুন করেছে প্রভাবশালীরা। খুনিদের একজন বিলাতে পালিয়ে গেছে।
কুকুর লেলিয়ে দিয়ে হিমুকে নির্যাতন করা হয়েছে। হিমু নিজে মৃত্যুর আগে খুনিদের নাম বলে গেছে। তারপরও গ্রেফতার নেই কেন?
এ লেখাটি যখন লিখছি, তখনই টিভিতে সংবাদ এসেছে একজন কিশোরী এবং তার পিতামাতাকে সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করেছে পুলিশ। এর প্রতিবাদ করতে গেলে সাংবাদিক-আইনজীবীদের লাঠিপেটা করা হয়েছে। এসব দৃশ্য দেখেছেন দেশ-বিদেশের মানুষ টিভির পর্দায়।
আসলে দেশে এখন এসব কী হচ্ছে? এসব প্রশ্নের জবাব বর্তমান ক্ষমতাসীনদেরই দিতে হবে। পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে গেলে প্রকারান্তরে কারা বিজয়ী হবে, সে ভাবনাটি ক্ষমতাসীনদেরই মনে রাখা দরকার।
নিউইয়র্ক , ২৯ মে ২০১২
--------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ / ঢাকা । ১ জুন ২০১২ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।