পঙ্খিরাজে চাদেঁর দেশে জীবনটা হঠাৎ ডাল-ভাত মনে হচ্ছে! ২২ এপ্রিল ২০১২ রোজ রবিবার রাত দশ ঘটিকার সময় আব্বা হাজি শাহ মোঃ মবশ্বর আলী আমাদের ছেড়ে চিরতরে না ফেরার দেশে চলে যান। এই সংবাদে আমাদের উপর বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত শুরু হয়। আমার মনে শত আকুতি থাকা সত্ত্বেও সেই শেষ বিদায়ে অংশগ্রহণ করতে পারি নি। সন্তান হিসেবে এ ব্যর্থতার বেদনাবোধ হয়তো সারা জীবন আমাকে বহন করতে হবে। তবুও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি, আমার দুই ভাই ও এক বোন নিতান্ত আব্বার শেষ বিদায়ের সময় পাশে ছিল।
আমরা অন্য তিন ভাই, তিন বোন বৃটেনে এবং এক ভাই আমেরিকায়, যার যার সংসারের খাচায় বন্ধি।
আব্বার চলে যাওয়া একেবারে হঠাৎ। তিনি অবশ্যি ২০০৪ সালে ২৩মার্চ জীবনের চরম মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেদিন নিউ দিল্লি এসকট হার্ট ইনস্টিটিউটে তাঁর বাইপাস গ্রাফট সার্জারি হয়। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে আল্লাহর রহমতে বাড়ি ফিরেছিলেন।
মৃর্ত্যুর ঘন্টা খানিক আগে এশার নামাজ মসজিদে পড়েন। জামাজান্তে আমার পাশের ঘরের চাচা শাহ এখলাছুর রহমানের ঘরে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘরে ফিরার সময় আমাদের বারান্দায় পড়ে যান। আমার ভাই মামুন শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখে আব্বা। সে আব্বা কি হয়েছে বলে তাঁকে ধরে। কিন্তু আর তিনি কোন কথা বলতে পারেন নি।
আমরা আব্বাকে হারিয়ে মর্মাহত। চৈত্রের খরায় পুড়ে যাওয়া জমির মত আমাদের হৃদয় ফেটে চৌচির। একপশলা বৃষ্টির মত একটু শীতল সমিরন নিয়ে ৩০ এপ্রিল জন্ম গ্রহন করে আমার দ্বিতীয় ছেলে শাহ মুনতাকিম আলম। আব্বার মৃর্ত্যুর মাত্র আট দিন পর তার জন্ম। আব্বার কথা মনে আরো জাগে।
আমার প্রথম ছেলে মুসতাকিমের জন্মের সময় তিনি এখানে (লন্ডন) ছিলেন। আব্বাকে সাথে নিয়ে হসফিটাল থেকে ছেলেকে ঘরে এনেছিলাম। আব্বা হসফিটাল থেকে আমাদের ঘরের পিছনের টাওয়ার দেখে বলেছিলেন ঐ তোমাদের ঘর। হসফিটালে গেলে আব্বা সে কথা মনে পড়ে। মনে মনে বলি এটা আমাদের ঘর হলে, তোমার নয় কি?
একজনের প্রস্থান এবং অন্যজনের ধরায় আগমন।
এযেন পৃথিবীর চিরাচরিত নিয়ম। জীবনের এক সেকেন্ডের যে ভরসা নেই, আব্বার এই চলে যাওয়া। কথায় বলে যার যায় সে বুঝে বিচ্ছেদের কি যন্ত্রনা! আব্বা নেই একথা ভাবলে গলার শ্বাসনালী কে যেন জোরে চেপে ধরে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আব্বাকে ছাড়া আমাদের পরিবার তথা বাড়ির পরিবেশ কল্পনা করা যায় না।
আব্বা সবসময় আমাদের কল্পনায় আছেন বাড়ির উঠোনে, ঘরের বারান্দায়, পুকুর ঘাটে কিংবা মসজিদে নামাজের জামায়াত শেষে প্রভূর আরাধনায়। নিজের অজান্তে মনের কল্পনায় এসব ভাবনা হয়তো আসবে, স্বচক্ষে আব্বার শুন্যঘর ও কবর না দেখা পর্যন্ত।
আব্বা বাড়ি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি কোন আত্মীয়ের বাড়ি রাত্রি যাপন করেছেন বলে আমি শৈশব-কৌশরে কখনো দেখিনি। তিনি মাসে এক দুই দিন বিকেলে বাজারে যেতেন।
বাবুর্চি হিসেবে এলাকায় খ্যাতি ছিল। ফলে বিভিন্ন গ্রামে তিনি রান্নায় যেতেন। তবে তা ছিল সৌজন্যমূলক। এজন্য তিনি পারিশ্রমি নিতেন না। আমি ছোটবেলায় নিজেও বলেছি আব্বা, আপনি টাকা লন না কেন? তিনি বলতেন আমি অধিকাংশ সময় শিন্নির রান্নায় যাই।
মানুষ খেয়ে দোয়া করবে। মৃর্ত ব্যক্তিও তোমাদের জন্য দোয়া করবে। তিনি বলেন অনেক সময় মানুষ পাঁচশ' টাকাও পকেটে ভরে দেয়। আমি বলি এগুলি আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়ে দিবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন।
আব্বার এই সমাজ সেবা বিরল। তিনি প্রায় পচিশ বছর (১৯৮০-২০০৫) বিভিন্ন স্থানে গিয়ে রান্না করেছেন। তিনি যার কাছ থেকে রান্না শিখেছেন, সে ব্যক্তি কেউ স্বেচ্ছায় পারিশ্রমিক দিলে নিতেন। এটা কোন দোষের নয়। আমার চাচা শাহ মতছির আলী দেশে গেলে বলতেন, নিজের ভাটা ভরা পান, সিগারেট নিয়ে রান্নায় যাও।
তাহলে পারিশ্রমিক নেও না কেন? আব্বার তাতে কোন বক্তব্য নেই। আমি যখন বিশ্বনাথ আলীয়া মাদ্রাসায় পড়তাম (১৯৮৭-১৯৯৩) তখন শুনেছি আমার শিক্ষক মাওলানা নুরুল ইসলাম অন্য শিক্ষকদের বলছেন, তার পিতা একজন ফাস্টক্লাস বাবুর্চি। এলাকার বড় বড় রান্নায় যান। তবে কারো থেকে বিনিময় নেন না।
আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল আব্বা ও আমার ছেলে শাহ মুসতাকিম আলমের মধ্য তুলনা করা।
পিতার সাথে আমার জীবনের মিল বেশি, না পুত্রের সাথে বেশি! এজন্য আরো নিতান্ত ছয় বছর অপেক্ষার করতে হত। কারণ মুসতাকিমের বয়স বর্তমানে চার বছর। দশ হলে তার জীবন প্রকৃতি ভাবনা নিয়ে কিছুটা লেখা সম্ভব হত। আব্বার হাতে আর ছয়টি বছর অবশিষ্ট ছিল না। আব্বার বেড়ে উঠা ও জীবনের সুযোগ সুবিধা এবং মুসতাকিমের বেড়ে উঠা ও সুযোগ সুবিধার মধ্য তুলনা ও বিশ্লেষণর্ধমী আলোচনা মূলক গ্রন্থ হত।
তারা উভয়ের মধ্যে আমি নিজের সুযোগ-সুবিধা ও জীবনে মিল খুজে নিতাম।
আব্বা আমাকে যেভাবে শাসন করেছেন, আমি কতটুকু শাসন করতে পেরেছি আমার সন্তানকে? আমার আব্বার জীবন ছিল অনেকটা সুবিধা বঞ্চিত। কৈশরে পিতা মারা যান। লেখাপড়া করতে পারেন নি। চাচাদের সাথে কৃষিকাজে শুরু করেন।
তাছাড়া পিতা থাকলে যে লেখাপড়া করতেন, সে গ্যারান্টিও ছিল না। কারণ পিতা ছিলেন বৃটেন প্রবাসী। অধিকাংশ প্রবাসীদের ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করতে পারে না। প্রথমত পিতার অনুপস্থিতিতে উপযুক্ত শাসনের অভাবে। দ্বিতীয়ত টাকা হাতে থাকলে পড়ায় কি মন বসে? মনে মনে ভাব, মা থাকেন সিলেট আমার বাবা থাকেন লন্ডনে, পুরুত কইরা উইড়া যাইমু চইড়া আমি প্লেইনে।
তবে আমার আব্বার ক্ষেত্রে এগুলি অন্তরায় হওয়ার আগেই পিতৃবিয়োগ তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাই সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য তাঁর অধম্য আগ্রহ ছিল। সিলেটে আমরা কয়েকজন মিলে বাসা ভাড়া করে থাকতাম। ফলে লেখাপড়ায় প্রচুর খরচ হত। আমার নিজে পরিসংখ্যান মতে সাধারণ চাকুরি করে এত টাকা রুজি করা যাবে না।
তাছাড়া বাংলাদেশে হাজার হাজার বেকারের মধ্যে আমিও শামিল হব।
একদিন কথা প্রসঙ্গে আব্বাকে বলি লজিঙ্গে থেকে লেখাপড়া করব। বাসায় থেকে এত খচর করে কোন লাভ নেই। আব্বা শুনে বলেন লেখাপড়ার জন্য যত খরচ করার করো। কোন বাজে কাজে তো ব্যয় হচ্ছে না।
আমাকে এক আত্মীয় বলেছেন, আব্বা তাকে বলেছেন আমার ছেলে যদি সারা জীবন লেখাপড়া করে আমি চালিয়ে যাব। যদি আমার ভাই ও ছেলে লন্ডন থেকে টাকা না দেয়, আমার সম্পত্তি সারা বিক্রি করে পড়াব! আব্বার এই অধম্য ইচ্ছার কথা শুনে আমার চোখে পানি এসে যায়!
এখন সময় এসেছে আমার সন্তানদের জন্য সেই দায়িত্ব পালন করার। আমি কি পারব আমার পিতার মত সর্বোচ্ছ ত্যাগের উদাহরণ দিতে? যদিও এ সমাজে আমাকে আর্থিকের চেয়ে মানসিক ত্যাগে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার সন্তানদের জন্য আমি আমার পিতার মত উদার ও উদাহর হয়ে থাকতে চাই। এজন্য আমার মানসিক ইচ্ছা যথেষ্ট, অর্থনৈতিক নয়।
আব্বার প্রেরণা থাকবে আমার প্রত্যেক রক্ত বিন্দুতে। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করব সেই প্রেরণা আমার সন্তানদের মধ্যে জাগ্রত করতে। আল্লাহর কাছে এই তৌফিক চাই আর চাই আব্বার জন্য পরকালীন সুখ-শান্তির আবাসন!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।