সন্ধ্যার আঁধারে আমি যদি হারিয়ে যাই বন্ধু, আমাকে মনে রেখো তোমার ঘরের ধূপ-আগরের সুবাসে- তোমার ঘরের প্রদীপের আলোয়, আমাকে ফেলে দিও না বাসি ফুলের মত। মনের ঘরেই রেখো বন্ধু পথের ধারের ফুলটি ভেবে। আমি যে জলসাঘরে ...www.jolsaghor.com 'ঈশ্বরত্ব! হ্যাঁ ঈশ্বরত্ব। যে ঈশ্বরত্বের অনুভূতিতে এক পিতা পুত্রকে বলতে পারে না- পুত্র, তুই আমার সব, তুই আমার ছায়া, তুই আমার পৃথিবী। পিতা পুত্রকে ভালোবাসে, পুত্রমোহে ডুবে থাকে।
বলতে পারে না। ঈশ্বর কি এমন হয়?'
'না, জে!'- চার্চের নিরবতায় ফাদারের ভরাট গলা শুনা গেল। রবিবার ছিল সেদিন। এমনই কত রবিবার মাস-বছরের হিসেব করে যুগ হয়ে যায়। এমনই এক রবিবার ছিল অনেক বছর আগে।
যেদিন পিতা আর ঈশ্বরত্বের এক অধ্যায় ভাঙ্গন ধরিয়েছিল। 'সন্তানের পিতা হয়ে যেদিন তুমি এই চার্চের বেদীতে ফুল দিতে আসবে সেদিন হয়তো ভালো করে বুঝবে। জন্মদাতা কি? পিতা কি? পিতা সে যে সৃষ্টি করে। যে পালন করে। তার মাঝে এই আনন্দ থাকে তারই অংশ তার চারপাশে ঘুরছে।
তার মতই। তার মতই কথা বলছে। হাসছে। খেলছে। সন্তানের দুঃখে ব্যথিত হয়।
সন্তানের সাফল্যে হর্ষিত হয়। পিতা! তুমিও একদিন পিতা হবে। সেদিন বুঝবে। পিতার মনে সন্তানের মঙ্গল কামনা ছাড়া কিছু থাকে না। '
'না ফাদার'।
- জে'র শুষ্ক গলা, ঝড়ে প্রাণপনে শিকড় ধরে রাখার তীব্রতার মত শুনা গেল। 'ঈশ্বরের আছে ঈশ্বরত্বের অহম। একজন পিতারও আছে। ভালোবাসি- কথাটি বলতে পারে না। তার ঈশ্বরত্বে আঘাত লাগে।
তার অহমে আঘাত লাগে। এক মনহীন রাজা সে। আপনার ঈশ্বরও তেমন, ফাদার। আমি মানি না ফাদার। পিতা সন্তান-বৎসল হতে পারে- এ আমি মানি না।
আপনার ঈশ্বর মঙ্গলকামী হতে পারে- আমি মানি না। পিতা সৃষ্টির আনন্দে অহংকারী। আপনার ঈশ্বরও অহংকারী। আমি মানি না। মানি না।
'
'জে, তোমার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে বাছা। এ তোমার বিপরীত অনুভূতি। এ তোমার বিপরীত আত্মোপলব্ধি। প্রার্থনা করি, শীঘ্রই তুমি মনে শান্তি পাবে। '
জে'র পিঠে সান্তনার হাত বুলিয়ে ফাদার চলে যান।
নিঃশব্দ চারপাশে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জে। তারপর ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে চলে। নিরবতা ভেদ করে কিছু পদধ্বনি শুনা যায়। একসময় মিলিয়ে যায়।
পথে হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবতে থাকে। হঠাৎ করে তার মনে কিছু শব্দ উদয় হতে থাকে। 'ত্বমেব মাতা চ পিতা ত্বমেব। ত্বমেব বন্ধু চ সখা ত্বমেব'। - জে মনে মনে প্রতিবাদ করে উঠে।
মিথ্যে, মিথ্যে সব মিথ্যে। পিতা বন্ধু হতে পারে না। পিতা সখা হতে পারে না। পিতা ঈশ্বরত্বের অহংকারে নিমজ্জিত এক অস্তিত্ব। ঈশ্বর কিভাবে মাতা, পিতা, বন্ধু, সখা হবে।
সব মিথ্যে। মনুষ্য শরীরের পিতাই বন্ধু হতে পারেনি। ঈশ্বর বন্ধু হতে পারে না। সখা হতে পারে না। ... জে থামে।
একটু নির্জনতা চাই তার। শহরের গলিপথ ধরে জলাঙ্গীর পথে হেঁটে চলে।
সকালে আকাশে মেঘ ছিল। সেই মেঘ কেটে গেছে। রোদের তেজ অসহনীয়।
জলাঙ্গীর ধারে এক বড় গাছের ছায়ায় মাটিতে বসে পড়ে জে। রোদের তেজে শরীরে যে জ্বলন ছিল, থেমে যায়। জলাঙ্গীর জল ছুঁয়ে উঠে আসা বাতাস তার গা মাড়িয়ে চলে। শান্তি লাগে। যন্ত্রনা থামে।
জে ভাবে, পিতা কি এই গাছের ছায়ার মতই? আশ্রয় দেয়। লালন করে। তাহলে ভাঙ্গন কেন আসে? বিভাজন কেন আসে?
অতীতে মন্দিরে প্রার্থনার সকালবেলার কথা মনে পড়ে জে’র। কি শান্তি, কি প্রশান্তি ছিল সেইসব দিনগুলিতে। পাথরের ঈশ্বরে কত প্রেম, কত বিগলন, কত ভক্তি! পিতাতে সেই ভক্তি সেই প্রেম ছিল।
তার পিতার ভক্তি-প্রেম ছিল ঈশ্বরে। এখনও আছে। শুধু তার নিজের সেই প্রশান্তি নেই। ছায়াধারী বৃক্ষের আশ্রয়ে শান্তি-স্বস্থি নেই। পাথর নয় বলেই পিতা কি এমন হয়? পাথর বলেই কি মন্দিরের ভগবান শান্তি-সৌম্যের প্রতীক।
পিতার মত চিন্ময় হলে কি ভাঙ্গন আসে? অহংকার আসে? পাথরের মূর্তির আড়ালে যে ঈশ্বর, সেই মৃন্ময় ঈশ্বর তবে কি পিতার মতই? জে উত্তর পায় না। তার মন অশান্ত হয়ে উঠে। ঘাম দেয় তার শরীর। একটু আগের যে বাতাস ছিল তা উধাও হয়ে গেছে। নদীতে থিরথির জল কাটছে।
গাছের ছায়া আছে। কিন্তু শরীরে জ্বলন। তবে কি ছায়া-শান্তি-প্রশান্তি সব মনের? প্রশ্নের ভেতরে প্রশ্ন আসতে থাকে।
সুন্দর একটি পরিবার ছিল। পরিবারে একজনই মাথা ছিল, জে’র পিতা।
সবকিছু তার কথামত চলত। শান্তি ছিল, কারণ তার কথার অন্যথা হত না। জে যেদিন নিজের পৃথক অস্তিত্ব বুঝতে শুরু করল, সেদিন থেকেই শুরু হলো অশান্তি। জে নিজের মত চলতে চেয়েছিল। পরিবার থেকে পাওয়া ভালো পথে চলার সকল শিক্ষা দিয়েই সে চলতে চেয়েছিল।
তখনই পিতা-পুত্রের সংঘাত শুরু, মনে মনে। বেড়ালের বাচ্চা হলে পুরুষ বেড়ালটি বাচ্চাকে মেরে ফেলে। মানব সমাজে অন্তরে অন্তরে কি সেই সংঘাত চলে? জে তখন ভাবতো। উত্তর পেত না। আজ অবধি পাওয়া হয়নি।
অনেক হালকা কথার ভিড়ে সেই কথাটিকেই তার সত্য মনে হয়, এক ঘরে দুই পুরুষ থাকতে পারে না। ঈশ্বর যেমন এক-অদ্বিতীয় অহংকারে নিমজ্জিত। পুরুষও তেমন। ঈশ্বর পুরুষ। পিতাও পুরুষ।
মন্দিরের ঈশ্বর পাথরের না হলে ঘরে হয় ঈশ্বর অথবা তার পিতার জায়গা হতো। কেনই বা অমন হতো না, সে ঘরে তো তার জায়গা হয়নি।
ছুটির দিন ছিল। প্রার্থনা সংগীতের সুরে জে’র মন ভরে গেল। দরজা খোলে এগিয়ে গেল।
দেখতে পেল, হাসি-খুশী একদল মানুষ। ঈশ্বরের নামে কত আনন্দ তাদের। কত শান্তি তাদের। তাদের দেখে জে’র ইচ্ছে হলো সে হাসবে। সেও নাচবে।
সেও গাইবে। ঈশ্বরের সামনে মাথানত করবে। আনুগত্য প্রকাশ করবে। আনন্দ-হাসির ভিড়ে মিশে থাকবে। তখনই তার পিতার কথা মনে পড়ে গেল।
ভাঙ্গনের কথা মনে পড়ল। বিভাজনের কথা মনে এলো। তাহলে, এসব মানুষের মুখে যে হাসি, যে শান্তি- তা কি সব মেকি? প্রশ্ন আসে। উত্তর পায় না। নিজেকে প্রবোধ দেয় সে- এসব ক্ষণিকের।
এই তো সেদিন ছেঁড়া কাপড়ের জীর্ণ-শীর্ণ এক শিশু হাত পাতলো তার কাছে। সেই শিশুর মুখে হাসি নেই, শান্তি নেই। রোজ রোজ খবরের কাগজ ভরে থাকে রক্তের দাগে। খবরের পাতায় পাতায় আগুন জ্বলে। কান্না শোনা যায়।
হাহাকার শোনা যায়। ...
ভাবতে ভাবতে রক্তচাপ বেড়ে যায় জে’র। সে দাঁড়িয়ে পড়ে। সংগীতের সুর তার কাছে কর্কশ লাগছে এখন। তবে কি সব সুখ, সব শান্তি, সব সুন্দর- শুধু মনের? শুধুই অবাস্তব? নিজেকে প্রশ্ন করে ফিরে চলে।
উত্তর আসে না। তবু তার পা থামে না। তার শরীর ঘাম দেয়। পাখা ছেড়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেয় জে। পাশে পড়ে থাকা পাত্রের তলানি থেকে মদিরায় ঢুক গিলে।
জে’র বারবার মনে হতে থাকে- পিতা পুরুষ, পুরুষ ঈশ্বর, ঈশর অহংকারী, পোশাকের মত ভালোবাসার আবরন আছে শুধু- অস্তিত্ব নেই।
মাটি কাঁপছে। বিছানা কাঁপছে। জে’র মনে হতে থাকে ভূমিকম্প হচ্ছে। অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। জে জ্ঞান হারায়!
------------------
মানসিক নিরাময় কেন্দ্রে সেবিকা এক রোগীকে হেলানো আরাম কেদারায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে শান্ত করতে চাইছে। কিন্তু রোগী হাত-পা ছোড়ছে। সে চিৎকার করছে- পিতা পুরুষ, পুরুষ ঈশ্বর, ঈশর অহংকারী!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।