আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতঃপর, আমি যেইভাবে হাফ লেডিস হইলাম

বোবা আর বোকার কোনো শত্রু নাই বাংলা ভাষায় যে কয়েকটি ইংরেজি শব্দের বহুল প্রচলন ঘটিয়াছে বোধ করি তাহার মধ্যে হাফ লেডিসও একটি। যদিও নিজের ঐতিহাসিক নামখানির ব্যুত্‍পত্তিগত অর্থ খুঁজিতে গিয়া বড় বড় ডিকশনারি হাতড়াইয়া বরং হতাশই হইয়াছি। যখন বুঝিতে পারিলাম এই শব্দের প্রচলন বঙ্গদেশে সূদর ইউরোপিয়ানরা ঘটাননি বরং আমাদেরই কোন এক রবীন্দ্রনাথ টাইপ বাঙ্গালী আদম সন্তান সর্বপ্রথম ইহার প্রচলন ঘটাইয়াছেন তখন মনে মনে বেশ পুলকিত হইয়াছি। কিন্তু যেদিন থেকে এই অসাধারন নামটি নিজের নামের পাশে জুড়াইয়া গেল, তখন থেকে মাঝেমধ্যেই এর আবিষ্কর্তাকে স্মরণ করিয়া তাহার চৌদ্দগোষ্ঠীকে স্বর্গবাসী করিয়া তুলিতেও দ্বিধাবোধ করিতাম না। যাহাই হোক ইউনিভার্সিটিতে আসিয়া সর্বপ্রথম এই অতিশয় মনোরম শব্দখানার সাথে পরিচিতি লাভ করি।

বুঝিতে পারিলাম এই নারী মার্কা শব্দটি কোনভাবেই নিজের নামের পাশে জুড়ানো যাইবে না। ইহা আর আম কাঁঠালের মত যেনতেন শব্দ নয়। এক্কেবারে আবুল টাইপ পুরুষগুলারে এই নামে ডাকা হয়। একবার কপালে যদি এই নাম জুটিয়া যায় তাহা হইলে মস্ত গোলযোগ বাঁধিয়া যাইবে। তখন বাকি ভার্সিটি লাইফ এই নামটি বহিয়া বেড়াইতে হইবে।

তখন আর ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু বলিয়া কাহারো কাছে মুখ দেখাইবার জো থাকিবে না। প্রথম প্রথম এইটুক বুঝিলাম যাহারা যাচিয়া মেয়েদের সাথে কথা বলিতে চায়, যাহারা মেয়েদের গা ঘেঁষিয়া চলে, যাহাদের কণ্ঠস্বর কিছুটা নামানো মেয়েলী টাইপের, তাহাদেরকে কালেভদ্রে হাফলেডিস ডাকা হচ্ছে। তো যাহাই করি আর নাই করি মেয়েদের সাথে বেশি মাখামাখি করা যাইবে না। তাহা হইলে হাফ লেডিস নামটা গায়ে পারমানেন্টলি সিল পড়িয়া যাইবে। অবশ্য ততদিনে আমরা বেশ কিছু হাফ লেডিস আবিষ্কারও করিয়া ফেলিলাম।

পোলাপাইন তটস্থ হইয়া বসিয়া থাকিতো নতুন নতুন হাফ লেডিসদের সন্ধানে। আপনি একটু মাত্রারিক্ত মেয়েদের সাথে হাসিয়া কথা বলিয়াছেন তো শেষ; আপনার নামের পাশে জুড়াইয়া যাইবে হাফ লেডিস অমুক কিংবা পয়েন্ট ফাইভ তমুক। পয়েন্ট ফাইভ হইতাছে হাফ লেডিসের আরেকটা উন্নত সংস্করণ। এরি মাঝে হাফ লেডিস বনাম ফুল জেন্টস নিয়ে ক্রিকেট ম্যাচও হইয়া গেল কয়েকটা। কেন জানি কিছু কিছু ফুল লেডিস আবার খেলায় ফুল জেন্টসদের সার্পোটও দিয়েছিল।

কিছুদিন পর দেখা গেল হাফ লেডিসরা সংখ্যায় মাত্রারিক্ত বাড়িয়া গিয়াছে। বরং তাহারাই একযোগ হইয়া আমাদের হাফ লেডিস বানাইবার পায়তারা করতিছে। আরো অবাক করা বিষয় হইল তাহাদের সাথে উল্টা ফুল লেডিস নারীকুলও যোগ দিয়াছে। বোধকরি হাফ লেডিসগুলার বেহাল অবস্থা দেখিয়া কিংবা আমাদের শায়েস্তা করিবার জন্যে তাহারা একযোগ হইয়াছে। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বেশ কিছু মুরিদ জুটাইয়া তৈরি করিয়া ফেলিলাম অমর সংগঠন "নাবিক"।

এর পুরো নাম দিয়াছি নারী বিদ্বেষী কমিটি সংক্ষেপে নাবিক। এই সংগঠনের সত্‍ উদ্দেশ্যগুলোর পাশাপাশি একটা অসত্‍ উদ্দেশ্যও ছিল। একটু খোলাসা করিয়াই বলি। আমাদের কাউকে যদি কোনভাবে হাফলেডিস বানাইবার উপযুক্ত প্রমাণ তাহারা পাইয়া যায় তাহা হইলে আমাদের প্রথম কাজ হইতাছে যত রকমের চাপা মারা যায় তা প্রয়োগ করিয়া তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনা। যাহা হোক আমাদের প্রচন্ড পাবলিসিটির দাপটে অল্প কিছুদিনের মধ্যে নাবিকের জনপ্রিয়তা পুরো ডিপার্টমেন্টে ছড়াইয়া গেল।

কিভাবে জানি স্যারদের কানেও নাবিকের সংবাদ পৌছাইয়া গেল। এই লইয়া দু'একদিন ক্লাসে বেশ মারমার কাটকাট আলাপ আলোচনাও হইল। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দাপটে কিংবা নিজেদের ইজ্জতের ভয়ে কোন স্যারই এ বিষয়ে তেমন একটা মুখ খুলিলেন না। এদিকে ক্লাসে মোল্লা বাহিনী যাহারা আছে তাহারা প্রকাশ্যে আমাদের সমর্থন না দিলেও ভিতরে ভিতরে আমাদের পক্ষেই ছিল। অর্থ্যাত্‍ সব দিকেই নাবিক বাহিনীর জয়জয়কার।

ততদিনে দুই সেমিস্টার শেষ হইয়া গেল। অতিরিক্ত পড়া শোনার চাপে কিংবা অন্যকোন এক অজানা কারনে নাবিকে হঠাত্‍ করিয়া ভাটা পড়িয়া গেল। অজানা কারনটা একটু খুলেই বলি। আমাদেরই ভিতর ঘরের শত্রু বিভীষন টাইপ কিছু প্রথম শ্রেণির নাবিক সেনা নিজেদের নব্য প্রেম পিরিতিতে জড়াইয়া ফেলিল। এদিকে তখন আমার নাবিকের প্রেসিডেন্সি আমল চলিতেছিল।

তখন আমরা সংখ্যায় এতটাই কমিয়া গিয়াছি যে ঐ বিশ্বাসঘাতক কালপ্রিট গুলারে বহিঃস্কার করিতেও পারিতেছিনা। মোটামুটি নাবিকের জনপ্রিয়তা ধরিয়া রাখিবার ভার আমার উপর বর্তাইল। তাই একাই দুই তিনজন সাঙ্গপাঙ্গ লইয়া যুদ্ধ চালাইয়া গেলাম। কিন্তু বিধি বাম মড়ার উপর খাড়ার ঘা হইয়া আসিল নিলুফার ম্যাডাম। ম্যাডামের প্রচণ্ড নারীবাদী কথা সারা ক্যাম্পাসই জানিত।

তিনি আমাদের নন-মেজর কোর্স বাংলা পড়াইতেন, আর সুযোগ পাইলেই নারীবাদী সাহিত্য শোনাইতেন। আর এ মোক্ষম সুযোগটাকে কাজে লাগাইল আমাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপ। ফলস্বরূপ প্রেসিডেন্ট হওয়ার কারনে আমার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হইল। দু'একদিন পুরো নাবিক গ্রুপকে ক্লাসে হেনস্তা করাও হইল। তারপরও আমরা দমিবার পাত্র নয়।

একাই আন্দোলন চালাইতে লাগিলাম। যদিও পাঠককে প্রকৃতপক্ষেই একটা সত্য কথা বলিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম, তখন আমরা আসলে নাবিক চালাইতেছিলাম শুধুই ক্লাসে মজাটা ধরিয়া রাখিবার জন্য। এইবার আসল কথায় আসি, যাহার জন্য পাঠক এতক্ষন ধরিয়া ক্যাচাল সহ্য করিয়া লেখাটি পড়িতেছেন; যেইভাবে আমাকে হাফ লেডিস বানানো হয়? একদিন ম্যাডাম ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি পড়াইতেছিলেন। তখন হঠাত্‍ করিয়া আযান শুরু হইয়া যায়। আযানের সময় মাথায় ওড়না দিতে দিতে ম্যাডাম একটা মন্তব্য করিয়া বসিল।

মন্তব্যটা ছিল এইরকম, মাথায় কাপড় দেয়ার চাইতেও আমি ধর্মটাকে অন্তরেই বেশী লালন করি। সাথে সাথে মোল্লাগ্রুপ ম্যাডামকে ছিঁড়িয়া ধরিল। হঠাত্‍ করিয়া একটা বাকবিতণ্ডা বাধিয়া গেল। আমি শুধু মজাটা দেখিতেছিলাম কি হইতে কি হয়। আমাকে অবাক করিয়া কিছু হাফ লেডিসগ্রুপও মোল্লাবাহিনীর সাথে যোগ হইল।

ধর্ম নিয়া আর নারী ইস্যু নিয়া বেশ একটা ক্যাচাল তৈরী হইয়া গেল। আমার অবাকের মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছাইল, যখন দেখি কিছু সংখ্যক ছাত্রী তাহাদের সাথে নীরব সম্মতি দিচ্ছে। যদিও একজন নাবিক বাহিনী হয়ে কেন জানি ম্যাডামের কথাগুলো আমার ভাল লাগিয়া গেল। মনে হইল ম্যাডামই ঠিক বলিতেছেন। তখনি হঠাত্‍ করিয়া ম্যাডাম ধর্ম এবং নারী ইস্যু নিয়া কয়েকটা তীর্ক্ষ্ণ মন্তব্য করিয়া ফেলিল।

কিন্তু এতদিন যারা ম্যাডামের নারীবাদী কথায় রসদ জোগাইতো আজ ধর্ম ইস্যু চলিয়া আসায় কেন জানি সবাই পিছাইতে লাগিল। ম্যাডামকে একা দেখিয়া আমার কেন জানি করুনা হইল। ম্যাডামের কথাটা ছিল অনেকটা এই রকম (অনেকদিন আগের কথাতো যতটুকু মনে আছে), "বাবারা (ম্যাডাম সচরাচর ছেলেদের বাবা আর মেয়েদের মা বলে সম্বোধন করেন) তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যারা নারীদেরকে মা জাতি হিসেবেই দেখবে? নিজেদের স্ত্রীর আপদে বিপদে একসাথে গলা মিলাবে? কখনো তাদেরকে ছোট করে দেখবে না? ধর্মের বাইরে গিয়ে তাদেরকে শ্রদ্ধা করবে? প্লিজ বাবারা আমি দেখতে চাই তোমাদের মধ্যে থেকে অনেকেই হাত তুলবে। " ক্লাসে হঠাত্‍ করিয়া শুনশান নীরবতা। কেউই হাত তুলিতেছেনা।

একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। নিজের ভিতরে কেন জানি বিবেকবোধ মাথাচাড়া দিয়া উঠিল। তাইতো ম্যাডাম তো ঠিকই বলেছেন? আমি আর আগপাছ না ভাবিয়া হাত তুলিয়া ফেলিলাম। কিন্তু এ কী কেউই আর হাত তুলিল না। পুরো ক্লাসের নীরবতার মধ্যে নিজের হাত তোলা অবস্থা দেখিয়া বেশ লজ্জা পাইতেছিলাম।

পরে অবশ্য আরো যোগ বিয়োগ করিয়া হিসাব মিলাইয়া কিংবা আমার হাত তোলা দেখিয়া আরো দুই একজন হাত তুলিতে সাহস করিল। অবশ্য ব্যাপারটা ঐখানেই থামিয়া গেল। ম্যাডাম সৌজন্যতার বশে আমাদের দুইতিনটা গাধারে ধন্যবাদ দিয়ে ঐদিনের মত ক্লাস ছাড়িল। সেইদিন থেকেই পোলাপাইন আমাকে হাফলেডিস বলিয়া ডাকে। এমনকি নারী বাহিনীর কিছু কিছুও।

অনেকে অবশ্য আমাকে ক্ষেপানোর জন্যও বলিতো। আগে হইলে চাপা ঝাড়িয়া তাহাদের শায়েস্তা করিয়া ছাড়িতাম কিন্তু এইবার আর কেন জানি কোন মন্তব্য করিতে ইচ্ছা করিল না। নিজের মনকে কেন জানি এই বলে স্বান্তনা দিতে পারিলাম আমিতো আর নিজের বিবেকের কাছে হারিনি।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৭ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।