প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ!
সে সন্মোহনী দৃষ্টি উপেক্ষা করার মত ক্ষমতা ছিলোনা আমার সেদিন। তারই ফলশ্রুতিতে পরবর্তী দু সপ্তাহের মধ্যে সারাটাক্ষণের ছায়াসঙ্গীনি হয়ে পড়লাম তার। আমরা দুজনই ছিলাম স্বল্পভাষী। যতটা সময় আমরা পাশাপাশি ছিলাম খুব টুকটাক কথা হয়েছিলো আমাদের। হৃদয়ের কানে যেন হৃদয়ের ভাষা।
তবে আজ আমি নিশ্চিৎ, সেসব নিয়ে বেশ একটা অসাধারণ কবিতার বই লিখে ফেলা যেত!!
হয়ত সুপ্তই তা পারতো। সুপ্ত, তোমার বলা তুচ্ছ সব কথাগুলোও আজ অমূ্ল্য কবিতার বাণী, জলতরঙ্গের টুংটাং বেজে চলা মিষ্টি কোনো অজানাসূর আমার এ হৃদয়তারে! ছবি আঁকতে তুমি তবে তোমার ঘরের বিছানা, কাপড়ের আলমারী, আশপাশ জুড়ে, বই এর আলমারী বা টেবিলে এমনকি কার্পেটেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি রাশি রাশি কবিতার বইগুলো। তুমি বলতে কবিতার মাঝেই তোমার বসবাস। কবিতায় তোমার বাস ছিলো বলেই হয়তো তোমার হাঁটা চলা বসা কথা বলা সবই কবিতা হয়ে যেত আমার হৃদয়ে আর কেই বা জানতো, একদিন আস্ত একটা জলজ্যান্ত কবিতাই হয়ে যাবে তুমি আমার জীবনে!
শুনেছিলাম শিল্পীরা খুব এলোমেলো, অগোছালো হয়
কিন্তু তোমার সেই চিলেকোঠার একচিলতে রুমের বাসা। অপূর্ব মায়াময় আলোর দীপাবলী!! চারিদিক ঘেরা হাজার বনসাই ক্যাকটাসের ঝাউ সবুজ শীতলতা!! সে ছিলো আমার কাছে এক স্বপ্নরাজ্য আর তুমি ছিলে সেই স্বপনপুরের এক স্বপন কুমার! আজ বলতে দ্বিধা নেই।
তোমার কাছেই আমি প্রথম শিখেছিলাম, কবিতার মত করে চারপাশ সাজিয়ে রাখার গোপন কৌশল!!!
জানো সুপ্ত তোমার নিজের হাতে বানিয়ে দেওয়া সেই অপূর্ব শৈলী কাগজের ল্যাম্প আজও তেমনি আছে আমার বেড সাইড টেবিলে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি, নীলাভ জোৎস্নারঙ মায়াবী আলো হয়ে তুমি জেগে রও আমার পাশে। তোমার হাতে আঁকা সেই শাড়ী পরে আমি আজও ছাঁদে বসি একা একা দোলপূর্নিমার রাতে। বাতাস হয়ে চুপি চুপি আসো তুমি! ছুঁয়ে দাও আমাকে! বেশ বুঝতে পারি আমি। জড়িয়ে আছো তুমি আমাকেই আজও পরম ভালোবাসায়।
সুপ্ত, আমার সম্পর্কে তোমার অনুভুতির তীব্রতা ঠিক কতখানি ছিলো আমি তা কখনই জানতে পারিনি। খুব শান্ত চুপচাপ আর মৃদুভাষী ছিলে তুমি!!
তোমার কি মনে পড়ে সুপ্ত ?একদিন নৌবিহারে গিয়েছিলাম আমরা। কোজগরী পূর্নিমায় ভেসে যাচ্ছিলো চারদিক। আমি গেয়েছিলাম আমার প্রিয় গান,
চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পড়ে আলো...
ও রজনী গন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো...
তুমি নির্বাক নিশ্চুপ!!! গলুই এ মাথা রেখে চাঁদের দিকেই চেয়েছিলে তুমি!! শুনছিলে গান। হঠাৎ জানতে ইচ্ছে হলো...
:সুপ্ত বলোতো আমার হাসিটা কেমন?
:জ্যোৎস্না ঝরা ...
:আর বলা কথাগুলো?
:নদীর কলতান!!
:হেঁটে যাওয়া?
:রাতের আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘমালা...
বলছিলে খুব নির্লিপ্ত অবলীলায়।
তোমার নির্লিপ্ততা, তোমার উদাসীনতাগুলো দিয়ে জড়ানো ভালোবাসার সুতীব্রতা আমি পান করেছিলাম তিলে তিলে। তুমি যেন এক মহীরুহ আর আমি এক আবেশিত স্বর্ণলতা!! তোমাকে ছাড়া সোজা হয়ে দাঁড়াবার এক রত্তি ক্ষমতা নেই আমার তখন আর।
আর একদিন বিকেলে, নীল শাড়িতে সেজেছিলাম আমি। খোঁপায় বেল ফুলের মালা, হাতে নীল রেশমী চুড়ি সবই ছিলো শুধু নীল টিপ ছিলোনা বলে টিপ পরিনি সেদিন। তুমি সেই আক্ষেপ পুষিয়ে দিলে।
চিকন তুলিতে রং নিয়ে লাল নীল আর গোলাপী নক্সায় এঁকে দিলে রুপকথার রংধনু রঙ এক অপূর্ব সুন্দর টিপ!!! রাতে মুখ ধুতে যাবার সময় কিছুতেই সে টিপ মুছে ফেলতে ইচ্ছে করছিলোনা আমার জানো? সেই টিপ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। আর সারারাত আমার কপালে চুমু হয়ে জেগে রইলো তোমার আঁকা টিপ!!! আমার চারিদিকে কত শত স্মৃতি তোমার সুপ্ত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । ঘুরে বেড়ায় তারা আমাকে ঘিরেই নিশব্দ বোবা চোখে।
সে দুপুরের কথা আমার খুব মনে পড়ে সুপ্ত... সেই ক্রান্তিকাল... সেই সব হারানোর বেলা....সূর্য্যডোবার পালা......
ছুটির দিনে নিজে হাতে নতুন নতুন রেসিপি এক্সপেরিমেন্ট , সে আমার কিশোরীবেলা থেকে পাওয়া এক অদ্ভুত পাগলাটে স্বভাব! সেদিনও হল থেকে নিজে হাতে রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি তোমার জন্য, তোমার প্রিয় ঝাল ঝাল গরুর মাংস ভুনা আর রমিজ মিয়ার দোকান হতে স্পেশাল নান।
আর সব ছুটির দিনের মতই তোমাকে সামনে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দেবার জন্য। অন্যান্য সব দিনের মত খোলাই ছিলো তোমার দরজা । ঘরে ঢুকে দেখলাম তুমি একরাশ বই খাতা কাগজের মাঝে দু হাঁটুর ভাজে মাথা রেখে বসে আছো চুপচাপ । কাছে গিয়ে বসতেই উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে তাকালে আমার দিকে।
সেই চোখ সেই সন্মোহনী দৃষ্টির মাঝে কিসের বেদনা, কিসের আঁকুতি যে ছিলো সেদিন আজও তার জবাব জানিনা আমি।
সুপ্ত তুমি ঐ একচিলতে চিলেকোঠার অপূর্ব মায়াময় এক স্বপ্নরাজ্যের বাসিন্দা ছিলে। তোমার বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয় স্বজন কারো কথা কখনও বলোনি তুমি আমাকে। জানতে চাইলে এড়িয়ে যেতে। আমিও কখনও জোর করিনি তোমাকে !! এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সুখী হতে চেয়েছিলাম আমরা, সব থেকেও হারানো, সব পেয়েও না পাওয়া, চালচুলোহীন ভালোবাসার কাঙাল দুজন মানব মানবী।
তুমি কোনো কথা বলছিলেনা।
অনেক চেষ্টা ও সাধ্য সাধনার পরেও আমি জানতে পাইনি ঠিক কি কারন এমন অস্থির করে তুলেছিলো তোমায়। ভীষন অভিমানে বললাম,
আমাকে কষ্ট দিতে খুব ভালো লাগে তোমার?
তুমি নিশ্চুপ!!
তাহলে আমার চির প্রস্থান হোক আজ সে ভালো লাগার অবসান....
ভীষন উত্তেজিত হয়ে উঠলে তুমি। দুচোখ জ্বলে উঠলো যেন জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। ভয় পেয়ে তাকিয়ে রইলাম তোমার সে উন্মাদ দৃষ্টির দিকে। উঠে দাঁড়ালে তুমি আর তারপর হন হন হেঁটে বেরিয়ে পড়লে আমাকে একা ফেলে।
সেই নিশ্চুপ চিলেকোঠার দুপুরে চারিদিকে কবিতার বই, জলপাই রং ঝাউ, সবুজ খয়েরী রঙ অসংখ্য ক্যাকটাস, রঙ তুলি আর ক্যানভাসের র মাঝে চুপচাপ বসে রইলাম আমি। স্থবীর স্থানুবৎ!! একটুও নড়িনি পর্যন্ত।
সন্ধ্যা অবধি তুমি ফিরলে না।
তোমার ঐ ভাবে বেরিয়ে যাওয়া আর তোমার অদ্ভুত সুন্দর শৈল্পিক ঘরটা দুই এ মিলে কি এক অপার্থীব রহস্যময় জগতের সৃষ্টি করেছিলো গোধুলীতে, আমার চারপাশে! সে কথা আমি কখনই কাউকে বলে বুঝাতে পারবোনা।
আমি সেই অপূর্ব মায়াময় এক অচেনা পরিবেশে বসে থাকতে থাকতে বুঝেছিলাম সেদিন, এই পৃথিবীর কেউ নই আমি।
কোথাও কেউ নেই ...কিচ্ছু নেই আমার....অন্য কোথাও রয়েছে আমার শেকড়। আমি বেমালুম ভুলে গেলাম আমার চারপাশ, আমার বাস্তবতা....বসে রইলাম কতটা সময় জানিনা!
সন্ধ্যায় তুমি যখন ফিরেছিলে। এলোমেলো চুল, উদভ্রান্ত চোখ । তোমাকে দেখে আমার মনে হলো, তুমি অনেকটা পথ হেটে এসেছো, উদ্দেশ্যহীন, শ্রান্তিবিহীন এখানে ওখানে। তুমি ঠিক আমার সামনে এসে বসলে হাঁটুগেড়ে।
আমার দুচোখে তাকিয়ে রইলে কিছুক্ষণ। রুক্ষ এলোমেলো চুল, দুচোখে অস্থিরতার নীল মায়াজাল। সেই শীতল গভীর দুচোখে টলমল করছিলো জল। তুমি হঠাৎ আমার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করলে শিশুর মত। কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো আমার বুকটা।
সেই মুহুর্তে প্রতিজ্ঞা করলাম, সারাটা জীবন আগলে রাখবো আমি তোমাকে । ঠিক এইভাবে। আমি স্বর্নলতা আমার মহীরুহকে জড়িয়ে রইবো সারাটাজীবন। একটুও ধুলোবালি কাঁদা ঝড় বা ঝঞা এর ঝাপটা লাগতে দেবো না আমি তোমার গায়ে। সুপ্তকে সেদিন একান্ত আপন করে নিলাম আমি!!! বিনিসুতোর বন্ধন, অলিখিত গোপন চুক্তিতে সুপ্ত তখন আর কারো নয়!! শুধুই আমার!!!
এরপর রাত করে ফিরেছিলাম হলে।
আর তার পরদিন, আমার জীবনের সবচাইতে আশ্চর্য্য এক প্রভাতের সূচনা হয়েছিলো।
খুব ভোরে হলগেটের দারোয়ানের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙ্গেছিলো আমার। দারোয়ান জানালো খুব জরুরী প্রয়োজনে একজন দেখা করতে চাইছেন। খুব জরুরী! মুখহাতে পানি ছিটিয়ে, একটু ভদ্রস্থ হয়ে বের হয়ে এলাম। আগত ব্যাক্তিটির মুখচ্ছবিতে কি ছিলো জানিনা।
মূহুর্তে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো আমার বুক। তারপরও বিন্দুমাত্র কল্পনা করতে পারিনি, কি ভয়ানক দুসংবাদটি অপেক্ষা করছিলো তখনও আমার জন্য ।
ছেলেটিকে কখনও দেখিনি আমি। সুপ্তের খুব হাতে গোনা দু একজন বন্ধুর মাঝে একে চিনিনা আমি। সে জানালো, সুপ্তের ডায়েরী থেকেই আমার কথা জেনেছে সে আর আমার ঠিকানাটাও ওখান থেকেই পাওয়া।
তাই আমার কাছে তার আসা।
আর তারপর........
ছেলেটি জানালো, গতরাতে স্যুইসাইড করেছে সুপ্ত। তার আগে ওকে ফোনে জানিয়েছিলো সে, তার নিষ্ঠুর সেই সিদ্ধান্তের কথা। ছুটে গিয়েছিলো সেও। কিন্তু তার আগেই...
ছেলেটি আরো সব কি কি যেন বলে যাচ্ছিলো কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢুকছিলো না তখন আর।
দাড়িয়ে রইলাম আমি নিস্তব্ধ, পাষান প্রতীম, ওর দিকে চেয়েই। ওর ঠোটের নাড়াচাড়াগুলোই দেখতে পাচ্ছিলাম শুধু, কানে কিছুই ঢুকছিলোনা আমার। কি যে সব বলে গেলো ছেলেটি, জানা হলো না তার কিছুই আমার।
সুপ্তের লাশ দেখতে যাইনি আমি। একফোঁটা কাঁদিওনি সেদিন বা এরপর আর কোনোদিনও।
কান্না পায়নি আমার। অথচ বেলা বাড়তেই কি করে যেন হলের অর্ধেক মেয়েরাই জেনে গিয়েছিলো আমার সেই লুকানো গোপন ভালোবাসাটির কথা। খুব নিভৃতে, সযতনে সবাইকে আড়াল করে যে সম্পর্কটির সৃষ্টি হয়েছিলো আমাদের দুজনার, তা জানতে আর বাকী রইলোনা আমার পরিচিত কারোরই সুপ্তের মৃত্যুর পর। চারিদিকে কানাঘুষা শুরু হল , হলের সিট ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।
চারিদিকে অন্ধকারাছন্ন তমসরাত্রী! খুব সহজে বুঝে গেলাম, শুধু সমাজ কেনো নিজের পরিবারেও স্থান হবেনা আমার আর কখনও।
আমাদের সমাজে কূমারী মায়েদের স্থান নেই যে কোথাও। ঘরে বাইরে সমাজ সংসারে সবখানেই সবার চোখেই তারা চরম অবহেলা ও ঘৃণার পাত্রী, নরকের কীট!
চলবে...
ফাগুন হাওয়া- ১ম পর্ব
আমার এ পর্বের লেখাটা আমি উৎসর্গ করছি আমার আরেকজন অতি প্রিয় লাভস্টোরী রাইটাররিয়েল ডেমোন পিচ্চি ভাইয়াটাকে। আমার চোখে তার লেখনীর সন্মোহনী শক্তি অতুলনীয়!! তার লেখার মাঝে দেখা যায় যেন তারই প্রতিচ্ছবি। ছটফটে, প্রাণ চন্চল, দুষ্টু মিষ্টি এক বিশ্বপ্রেমিককে। ভাইয়া তোমার কাছে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ কখনও থেমে যায়না যেন তোমার কলম/ কিবোর্ড।
আমার মৃত্যুর শেষ দিনটি পর্যন্তও যেন আমি জানতে পাই তুমি লিখে চলেছো অসাধারণ সব প্রেমকাব্য।
আর একটা কথা। লেখাটা লিখতে গিয়ে এই গানটাই কানে বেজে চললো সারাটাক্ষন,
http://www.youtube.com/watch?v=1VV2P71NstI
যেখানে শুরুর কথা বলার আগেই শেষ
সেখানে মুখ ডুবিয়ে খুঁজতে চাওয়া আমারই অভ্যেস
যেখানে রোদ পালানো বিকেল বেলার ঘাম
সেখানে ছুটবো ভাবি গিলবো গল্প ভুল হবে বানান
এই বুঝি ফসকালো হাত আর কালো রাত করে সময় গেলো আজ অনেক
প্রত্যেকদিন ভয় পাওয়া সব ইচ্ছা গুলো অনেক ঝড়ের শব্দ শোনে..
একবার বল নেই তোর কেউ নেই তোর কেউ নেই ........
সুপ্তর জন্য গানটা দিয়ে দিলাম। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।