রাব্বিআল্লাহ্--আল্লাহ্ই আমার একমাত্র রব্ব-সার্বভৌমত্ব, আইন-বিধান ও নিরংকুশ কর্তৃত্বের একমাত্র মালিক। “প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে যারা পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহ্কে খুব বেশি করে স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। ” (সূরা আহযাব: ২১)
তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাস। বদর প্রান্তরের অসম লড়াইয়ে নির্মম পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে মদীনা অভিমুখে ধেয়ে আসছে কাফিরের দল। নেতৃত্বে আবু সুফিয়ান।
সঙ্গে আবু সুফিয়ানের ২স্ত্রী সহ ১৫জন নারী, ২শত অশ্বারোহী, ৭শত উষ্ট্রারোহী ও ২১শত পদাতিক সৈন্য সহ মোট ৩হাজার জনের সেনাদল। দলের সঙ্গে আছে তাদের প্রিয় দেবতা হুবল -এর প্রতিমাটিও। সংবাদ পেয়ে নাবীউল মালাহিম রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের উদ্দেশ্যে জিহাদের ডাক দিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে কে আছো, যে রাসূলে আরাবীর ডাকে সাড়া দিবে! জিহাদ করবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্য জান ও মাল দিয়ে; বিনিময়ে পাবে জান্নাত, যার পাদদেশে সুমিষ্ট পানির নহর প্রবাহিত। ’
রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডাকে লাব্বাইক বলে একে একে মু’মিনগণ জমায়েত হতে লাগলেন শাহাদাতের তামান্না নিয়ে। এদের মধ্যে শিশু বাচ্চা কোলে এক মহিলাকেও দেখা গেলো।
মহিলাকে দেখে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘ওহে বোন আমার! আপনি কি জানেন না শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষমদের জন্য জিহাদের হুকুম প্রযোজ্য নয়? আপনার ঘরে কি কোন সক্ষম পুরুষ নেই যে আমাদের সাথে ময়দানে জিহাদে শরীক হতে পারে? জবাবে মহিলা বললেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিহাদের হুকুম সম্পর্কে আমি অবশ্যই অবগত আছি। ইতিপূর্বে পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য শিশুটির বাবা আপনার আনীত দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছে। আমারও দিল চায় শিশুটির বাবার মতো আপনার সাথে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জিহাদে শরীক হই। কিন্তু দুগ্ধপোষ্য শিশুটিকে রেখে আমার নিজের পক্ষে জিহাদে শরীক হওয়া সম্ভব হবেনা চিন্তা করে শিশুটিকেই আপনার হাতে সোপর্দ করার মনস্থ করেছি। আমি জানি হে রাসূলে আরাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একথা শোনার পর আপনি হয়তো বলবেন,একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুর পক্ষে কিভাবে শত্র“র মোকাবেলা করা সম্ভব? হ্যাঁ, হয়তো সম্ভব নয়; কিন্তু হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দয়া করে আমার উপর রহম করুন! আমার এ শিশু বাচ্চাটিকে আপনি গ্রহণ করুন।
আর তা এজন্য যে, যখন কোন কাফিরের তীর আমার রাসূলে আরাবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিকে ধেয়ে আসবে চুড়ান্ত আঘাত হানার জন্য তখন শিশুটিকে যেন তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। শত্র“র নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে রক্তাক্ত-ক্ষত-বিক্ষত হোক কলিজার টুকরো সন্তানের কুসুম-কোমল দেহ; আমার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই! কিন্তু আমার দ্বীনের চেরাগ, রহমতের নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গায়ে কাফিরের এতটুকুন আঁচড় লাগবে তা আমি কিছুতেই বরদাশ্ত করতে পারবো না। সুবহানাল্লাহ্। এরই নাম নবী প্রেম! কী এক জান্নাতী সুগন্ধীর খোঁজ পেলেন এই মা, কী এমন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার আকর্ষণে স্বীয় সন্তানের জীবনকে তুচ্ছ ভাবতে পারেন এক মা!
উপস্থিত সাহাবীদের হৃদয়কে নবী প্রেমের এ বিরল ঘটনা প্রবলভাবে নাড়া দিলো। সবার সম্মিলিত কণ্ঠে ধ্বনিত হলো-
নারায়ে তাক্বীর-আল্লাহু আক্বার
সাবিলুনা, সাবিলুনা-আল জিহাদ, আল জিহাদ
তরিকুনা, তরিকুনা-মুহাম্মাদ, মুহাম্মাদ।
অতঃপর অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে, সান্তনা দিয়ে শিশুসহ মহিলাকে রেখেই ৭শত মুজাহিদের এক কাফেলা নিয়ে রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘাঁটি স্থাপন করলেন ওহুদের পাদদেশে। ইসলামী নিশানের তিন নিশানবরদার হলেন যথাক্রমে- মুসআ’ব (রাদিআল্লাহু আনহু), হুবাব খয্রজী (রাদিআল্লাহু আনহু) এবং উসায়দ আওসী (রাদিআল্লাহু আনহু)। প্রধান সেনাদলের নেতা নিযুক্ত হলেন যুবায়র বিন আওয়াম (রাদিআল্লাহু আনহু) আর বর্মবিহীন সেনাদলের কমান্ডার নিযুক্ত হলেন হযরত হামযা (রাদিআল্লাহু আনহু)। হযরত আবদুল্লাহ্ বিন যুবায়েরের নেতৃত্বে ৫০জন তীরন্দাজ রইলেন গিড়িপথ পাহারায়।
শুরু হলো প্রচন্ড লড়াই।
লড়াইয়ের এক পর্যায়ে হঠাৎ উৎবা বিন ওয়াক্কাস তরবারি দিয়ে রাসূল মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাথার উপর এমন প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো যে, তাঁর হেলমেট দু’অংশে ছিন্ন হয়ে তাঁর মুখের উপর দিয়ে নিচে পড়ে গেল। এ আঘাতের প্রচন্ডতা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই আচম্কা কাফিরের নিক্ষিপ্ত এক তীর দয়ার নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখে আঘাত হানলো। বেশ কয়েকজন কাফির আবার তাঁর মাথা লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ শুরু করলো। হঠাৎ কাফিরদের নিক্ষিপ্ত এক প্রস্তরাঘাতে লুটিয়ে পড়লেন দয়ার নবী, রাহমাতুল্লিল আলামিন। তাঁর পবিত্র রুবাই নামক দাঁত মোবারক শহীদ হয়ে মুখ থেকে রক্ত ঝরতে লাগলো।
হযরত আলী (রাদিআল্লাহু আনহু) সহ অন্যান্য সাহাবীগণ রাসূলকে রক্ষায় চারদিক থেকে ঘিরে রাখলো আর নিজ জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাসূলের দিকে নিক্ষিপ্ত তীর, প্রস্তরাঘাত নিজেদের শরীর দিয়ে ফেরাতে লাগলো। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রানপ্রিয় চাচা হযরত হামযা (রাদিআল্লাহু আনহু) আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার ভাড়াটে নিগ্রো গোলামের বর্শাঘাতে শহীদ হয়ে গেলেন। হিন্দা বদর প্রান্তরে হামযার হাতে নিহত ভ্রাতৃ ও পিতৃ (উৎবা) হত্যার প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্রোধে উন্মত্ত সারমেয়তে রূপ নিলো। সে শহীদ হামযার (রাদিআল্লাহু আনহু) পেট চিরে যকৃৎ বের করে এনে তা চর্বন করলো। এতেও তার অন্তরের জিঘাংসা চরিতার্থ না হওয়ায় বল্লম আর ছোরা দিয়ে হামযার (রাদিআল্লাহু আনহু) দেহকে ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগলো।
শেষ পর্যন্ত ৭০জন মরণজয়ী মুজাহিদের শাহাদাতের পরও মদীনা দখলে ব্যর্থ হয়ে মক্কার কাফিরগণ আপনালয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হলো।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ্র রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আহত, রক্তাক্ত হওয়ার সংবাদ তাঁর নিখোঁজ বা শাহাদাতের সংবাদ রূপে মদীনায় পৌঁছে গিয়েছিলো। এ সংবাদে মদীনা থেকে দলে দলে লোক ওহুদের দিকে আসতে লাগলো। সকলের চোখে-মুখে চরম উৎকণ্ঠা; অন্তরে জানার প্রবল আকুতি-কী অবস্থায় আছেন আমাদের সীরাজাম মুনীর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! লোকজন ছুটতে ছুটতে ওহুদের ময়দানে এসে গেলো। এরিমধ্যে দেখা গেলো মুখে মুখোশ পরিহিত এক মহিলা ময়দানের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছোটাছুটি করছেন আর শহীদদের মাঝে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন! মুখোশ পরিহিত থাকায় মহিলাকে চেনা যাচ্ছিল না তাই কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেস করলো- কে তুমি, কাকে খুঁজছো? মহিলা উত্তর দিলো- ওমুক গোত্রের ওমুকের মেয়ে, ওমুকের স্ত্রী আমি।
জবাব পেয়ে তাকে কেউ একজন ধ্বিক্কার দিয়ে বলে উঠলো- জিহাদে তোমার বাবা শাহাদাত বরণ করেছেন কোথায় তুমি শোকে পাগল হবে, তা-না করে মুখোশ পরে স্বজন খুঁজতে এসেছো! মহিলা বললো- ওহে রাসূলের জন্য আমার জান কুরবান হোক! আমার বাবা শহীদ হয়েছেন এই শোকে আমিতো আমার শরীয়তের বিধান পর্দা লংঘন করতে পারি না। আর আমার উদ্দেশ্য আমার বাবার খোঁজ নয়, তোমরা বল, আমার দ্বীনের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী অবস্থায় আছেন? অতঃপর এ কথার জবাব না দিয়ে কেউ একজন তার স্বামীর শাহাদাতের সংবাদ দিলো। এতেও মহিলা বিচলিত হলেন না; বরং জিজ্ঞেস করলেন- আমার নয়নের মনি, দ্বীনের রাহ্বার মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংবাদ তোমরা কেন দিচ্ছো না! তিনি এখন কী অবস্থায় আছেন? লোকজনের মধ্য হতে এবার কেউ একজন তাকে সংবাদ দিলো- জিহাদে তার একমাত্র পুত্রও শাহাদাতবরণ করেছে। এসব কোন সংবাদই মহিলাকে বিচলিত করতে পারলো না বরং কাতর কণ্ঠে বলতে লাগলেন- হলো কী তোমাদের! তোমরা কেন বলছো না আমার দু'চোখের প্রশান্তি, বিশ্ব মানবতার কান্ডারী রাসূলে আরাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছেন? অতঃপর যখন তাকে রাসূল মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্মুখে নেয়া হলো তখন নবী প্রেমের বাঁধভাঙ্গা অশ্র“ দর-বিগলিত ধারায় ঝরতে ছিলো। মহিলা বললেন- হে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার জন্য আমার মা-বাবা কুরবান হোক! ঐ মহান সত্ত্বার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ! আমাকে যখন একে একে আমার পিতা, স্বামী ও একমাত্র পুত্রের শাহাদাতের সংবাদ দেয়া হচ্ছিল তখন আপনার মুখ থেকে শোনা মহান আল্লাহ্ সুব্হানাহু ওয়া তা’য়ালার একটি বাণীই আমাকে সান্তনা যুগিয়েছে- যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রব্বের নিকট থেকে জীবিকাপ্রাপ্ত।
(আল ইমরান:১৬৯)। সুতরাং উক্ত সংবাদে আমার বিচলিত হবার মতো কোন উপাদানই ছিলো না। আমার অন্তরে শুধু এই জিজ্ঞাসাই ঘুরপাক খেয়েছে যে, আমার পিতা-স্বামী-পুত্র কি আমার রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সঠিকভাবে সহায়তা করতে পেরেছে? জিহাদের ময়দানে নবী প্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা তারা কি দেখাতে সক্ষম হয়েছে? কারণ হাদীসে কুদ্সীতে আল্লাহ্ সুব্হানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেছেন- ‘আল্লাহ্ তাদেরকে বিশেষভাবে ভালোবাসেন, যারা রাসূল মুহাম্মাদকে সেবা করে এবং অগ্নি প্রতিরোধের ন্যায় যারা শত্র“র বিরুদ্ধে স্থির প্রতিজ্ঞ থাকে। ’
সুব্হানাল্লাহ্।
দয়ার নবীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিয়ে জিহাদের কাফেলা ফিরে এলো মদীনায়।
ওহুদ যুদ্ধের কিছুদিন পর ইয়ামানের কারন নামক স্থানে ঘটে গেলো নবী প্রেমের আরেক বিরল ঘটনা। উয়াইস বিন আমের নামক এক ব্যক্তি ছিলেন ইয়ামানের কারনে। যিনি রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় ঈমান আনা সত্ত্বেও নিজের কুষ্ট রোগ ও পঙ্গুঁ মায়ের সেবা শুশ্র“ষার কারনে তাঁর সাথে দেখা করতে পারেননি; সাহাবীর মর্যাদাও লাভ করতে পারেননি। কিন্তু তার অন্তরাত্মা সদা-সর্বদা, আকুলি-বিকুলি করতো দয়াল নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সংবাদ জানার জন্য। তো রাসুলুল্লাহ্র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাঁত মোবারক শহীদ হওয়ার ঘটনা তাঁর কানে পৌছা মাত্রই তিনি সংকল্প করলেনÑআমার প্রাণপ্রিয় নবীজীর দাঁত মোবারক শহীদ হয়েছে দ্বীনের জন্য, আর আমি উয়াইস সব দাঁত নিয়ে ঘরে বসে বসে নবী প্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছি! যেই ভাবনা সেই কাজ; পাথর দিয়ে আঘাত করে তিনি তার সম্মুখের একটি দাঁত উপরে ফেললেন।
কিন্তুু তবুও মন প্রশান্ত হচ্ছিল না; যেহেতু তিনি নিশ্চিত ছিলেন না নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঠিক কোন দাঁতটি শহীদ হয়েছে; তাই তিনি আবারও পাথর দ্বারা আঘাত করতে করতে সম্মুখের কয়েকটি দাঁত ভেঙ্গে ফেললেন। সুব্হানাল্লাহ্। অদেখা নবী প্রেমও যে একজন উম্মতকে কতোটা পাগল প্রায় করে তুলতে পারে হযরত উয়াইস তার বাস্তব নমুনা। ইনি হচ্ছেন সেই নবী প্রেমীক যাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী বলেছেন। শুধু তাই নয় প্রচন্ড মাতৃভক্তি ও নবী প্রেমের কারণে আল্লাহ্ তাকে এক বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছিলেন।
হযরত উমার (রাদিআল্লাহু আনহু)এর ভাষায়- আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি যে, ইয়ামানের বীর মুজাহিদের সাথে উয়াইস বিন আমের নামক এক ব্যক্তি তোমাদের কাছে আসবে। তার বাড়ি ইয়ামানের কারনে। তার কুষ্ঠ রোগ ছিল। এক দিরহাম জায়গা বাদে তা সেরে যাবে। তার এক মা থাকবে এবং সে এতটাই মা ভক্ত হবে যে সে আল্লাহ্র কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ্ তাকে তা দেবেন।
সম্ভব হলে তার কাছে গিয়ে আল্লাহ্র নিকট গুনাহ্ মাফের আবেদন জানাতে অনুরোধ করো। অতঃপর আমি রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথা অনুযায়ী বললাম, হে উয়াইস! আমার গুনাহ্ ক্ষমার জন্য আল্লাহ্র নিকট দোয়া করুন। তিনি আমার জন্য দোয়া করলেন। এই নবী প্রেমীক উয়াইস করনী নামেই অধিক পরিচিত।
ওহুদ যুদ্ধের পর আযল ও কারাহ্ গোত্রের একদল লোক রাসূলুল্লাহ্র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এসে বললো আমাদের গোত্রে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেছে।
এখন আপনি যদি কয়েকজন সাহাবী আমাদের মাঝে প্রেরণ করতেন তবে খুবই কল্যান হতো। সাহাবীগণ আমাদেরকে সহীহ্ভাবে কুরআন ও ইসলামের বিধিবিধানসমূহ শিক্ষা দিতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সরল বিশ্বাসে আসেম বিন সাবেত, খুবাইব বিন আদী ও যায়েদ বিন দাখিনা সহ ছয়জন মতান্তরে দশজন সাহাবীকে পাঠিয়ে দিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট আগমণকারীরা প্রকৃতপক্ষে মু’মিন ছিল না, ছিল ম’মিনের ছদ্মবেশে ভন্ড নবী প্রেমীক, মুনাফিক। এই মুনাফিকরা পথিমধ্যে রাসূলের সাহাবাদের কয়েকজনকে শহীদ করে দিলো।
এবং কয়েকজনকে বন্দী অবস্থায় মক্কায় নিয়ে গেল। মক্কায় বন্দীদের মাঝে যায়েদ বিন দাখিনাও ছিলেন। মুনাফিকরা তাঁকে মক্কার কাফিরদের হাতে তুলে দেওয়ার পর কাফিররা তাকে বদর-ওহুদের প্রতিশোধস্বরুপ হত্যার সিদ্ধান্ত নিলো। হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান জিজ্ঞাসা করলো- ওহে যায়েদ! বলতো, তোমার জায়গায় যদি মুহাম্মদ থাকতো এবং তোমার পরিবর্তে আমরা তাকে হত্যা করতাম এবং তুমি নিরাপদে বাড়ি চলে যেতে তাহলে কেমন হতো? যায়েদ (রাদিআল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহ্র কসম আমাদের প্রাণপ্রিয় নবী মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যা তো দুরে থাক্, তাঁর গায়ে যদি ১টি কাঁটাও ফোটে তবে আমি যায়েদ নিজের মুক্তির বিনিময়েও তা সহ্য করবো না। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান বললো, মুহাম্মদের সঙ্গীরা তাকে যেমন ভালোবাসে এমন ভালোবাসতে আমি আর কাউকে দেখিনি।
অতঃপর পাষণ্ডরা হযরত যায়েদকে শহীদ করে দিলো। আল্লাহু আক্বার কাবীরা। এরাই ঐ সকল লোক যাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনোই মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের রব্বের নিকট থেকে জীবিকাপ্রাপ্ত। ’ অর্থাৎ দুনিয়ার নশ্বর জিন্দেগীতে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভালোবাসায় যারা নিজেদেরকে জানে-মালে পরিপূর্ণ আত্মোৎসর্গ করতে পেরেছে তারাই আখিরাতের রিযিক সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’য়ালার পক্ষ থেকে পেয়েছে নিশ্চিত গ্যারান্টি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার নির্দেশে হিজরতের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তাঁর বাড়ী ছিলো শত্র“ দ্বারা পরিবেষ্ঠীত।
কাফির-মুশরিকরা সংকল্প করেছিলো রাসূল মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় করে দিবেন। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে এহেন কুকর্ম সমাধা করার জিম্মাদারী কেও নতে রাজী হচ্ছিল না। বিশেষ করে জাগ্রত মুহাম্মাদের সামনা-সামনি হয়ে তাঁকে হত্যার চিন্তা করতেই তাদের মস্তিস্ক এক অজানা আশংকায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো মুহাম্মাদ যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন সহজেই তরবারীর এক ঘায়ে উদ্দেশ্য হাসিল। রাসূল মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হত্যার এমন অনেক ষড়যন্ত্রই তাদের মন-মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত কোন পক্ষের নিকট থেকেই আসছিলো না।
দুশমনদেরকে আল্লাহ্ দ্বিধা-দ্বন্দে ফেলে রাখলেন। আল্লাহ্র হাবীব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ পাকের বিশেষ নুসরতে শত্র“র সামনে দিয়েই ঘর হতে বেরিয়ে গেলেন হিজরতের উদ্দেশ্যে; কিন্তু কফিররা কোন কিছু আঁচও করতে পারলো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘরে প্রবেশ করলেন হযরত আলী (রাদিআল্লাহু আনহু)। অতঃপর মৃত্যু নিশ্চিতপ্রায় জেনেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বিছানায় ঘুমাতেন, হযরত আলী ঠিক সে বিছানায়ই আপাদমস্তক চাদর দ্বারা আবৃত করে শুয়ে পড়লেন। প্রেম-ভালোবাসা কতটুকু গভীর হলে একজন মানুষ তাঁর প্রেমাষ্পদের কল্যান কামনায় মৃত্যুকেও তুচ্ছ জ্ঞান করে! এদিকে শত্র“রা নিজেদের মনস্থির করতে করতে প্রায় ভোর হয়ে এলো।
প্রত্যুসের প্রথমভাগে সকলেই হুড়মুড় করে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরে ঢুকে পড়লো এবং তরবারী দ্বারা মরণ আঘাত করার উদ্দেশ্যে যেই না চাদর উঠিয়েছে, কাফিরদের চোঁখ তো ছানাবড়া; মুহাম্মাদের বিছানায় এ কাকে দেখছি? এ তো আলী! মুহাম্মাদের ঘরে সে ঢুকলো কখন? সারারাত আমরা মুহাম্মাদ মনে করে এ কাকে পাহারা দিলাম হত্যার উদ্দেশ্যে? সুবহানআল্লাহ্! এরই নাম নবী প্রেম! এরই নাম আল্লাহ্ওয়ালা। এদের রক্ষা করা এবং এদের উদ্ধারের জন্য পরিকল্পনা করার জিম্মাদার স্বয়ং আল্লাহ্। ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘কাফিররা সংকল্প-পরিকল্পনা করলো, আল্লাহ্ পাকও পরিকল্পনা করলেন; নিশ্চয়ই পরিকল্পনাকারী হিসেবে আল্লাহ্ তা’য়ালাই শ্রেষ্ঠ। ’
ঘটনাটির মাঝ পর্যায়ে অপর আরেক স্থানে ভিন্ন পরিবেশে সংঘটিত হলো রাসূলের প্রতি ভালোবাসার আরেক অবিশ্বাস্য ঘটনা। রাতের আঁধারে প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
প্রিয় জন্মভূমি, চিরচেনা পরিবেশ আর নাড়ীর টান তাঁকে পিছু টানছিলো, ডাকছিলো বার বার। কিন্তু তাঁকে তো যেতে হবে, আল্লাহ্ তা’য়ালাই তো যেতে বলেছেন। তিনি তো শুধু মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে কর্তব্যের টানে জন্মভূমি ছেড়ে বেড়িয়েছেন। তবুও হাঁটছিলেন আর আপন মনে বলছিলেন- বিদায় হে জন্মভূমি, বিদায়! আবার হয়তো দেখা হবে কোন জান্নাতী আবহ ঘেরা ফজরে কিংবা রৌদ্রজ্জ্বল যোহরে! সালাম, মক্কাবাসী সালাম! মক্কাবাসীর আল-আমিন রাসূল মুহাম্মাদের এ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের হিজরতকালীন সঙ্গী হয়েছিলেন হযরত আবুবকর (রাদিআল্লাহু আনহু)। মক্কা হতে ৪/৫ মাইল দুরবর্তী ছাওর পাহাড়ের পাথুরে, কন্টকাকীর্ণ লতা-গুল্মময় পথে চলতে গিয়ে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বারবার হোঁচট খাচ্ছিলেন; হোঁচট খেতে খেতে তাঁর মোবারক পদযুগল যখম হয়ে যাচ্ছিল।
দরদী রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এহেন কষ্ট আবুবকর আর সহ্য করতে পারলেন না। নবীজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় কাধে তুলে নিলেন। অতঃপর এক গিরিগুহার সন্ধান পেয়ে তার সম্মুখে নবীজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাধ হতে নামালেন। এরপর, একাকী নিজেই অন্ধকারময় গুহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এবং গুহা পরিস্কার করার পর সাপ-বিচ্ছু জাতীয় ক্ষতিকর প্রাণীর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য নিজ পরিধেয় জামা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে গুহার ভেতরের ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে লাগলেন।
আপ্রাণ চেষ্টা করেও একটি ছিদ্র বন্ধ করার মতো প্রয়োজনীয় কোন উপাদান না পেয়ে অবশেষে নিজ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী দ্বারা ছিদ্রটিকে ঢেকে রেখে নবীজীকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভেতরে আসার আহ্বান জানালেন। গুহায় প্রবেশ করে ক্লান্ত অবসন্ন মন-দেহ নিয়ে নবীজী আর বসে থাকতে পারলেন না। আন্তরিক অনুরোধে বাধ্য হয়ে আবুবকরের কোলে মাথা রেখে নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুমিয়ে পড়লেন। আবুবকর এ এক নতুন মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবিস্কার করলেন। আবুবকর বিষ্ময় দৃস্টিতে অবাক তাকিয়ে রইলেন।
এ যেন তাঁর এতোদিনের চেনা-জানা মুহাম্মাদ নয়। শিশু যেমন আপন মাতৃক্রোড়ে জান্নাতী আবেশে ঘুমায়; ঠিক তেমনি নিষ্পাপ এক শিশু মুহাম্মাদকে কল্পনা করতে লাগলেন আবুবকর। হঠাৎ আবুবকরের কল্পনার জাল ছিন্ন হয়ে গেলো; তিনি অনুভব করলেন কী একটা যেন তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে দংশন করলো, যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা তিনি গুহার ছিদ্র মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন। প্রথমে পোকা-মাকড়ের কামড় মনে করে গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে বিষের যাতনায় যখন শরীর নীল হয়ে আসছিল তখন আবুবকরের (রাদিআল্লাহু আনহু) মনে হচ্ছিল আসমান-জমিনের সকল বস্তু বোধ হয় তার বুকের উপর জেঁকে বসেছে। অসহ্য যন্ত্রনায় মাথা ভারি হয়ে নুয়ে আসছিলো।
কিন্তু ক্লান্ত-অবসন্ন নবীজীর জান্নাতী ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে এই ভয়ে আবুবকর (রাদিআল্লাহু আনহু) কোন নড়াচড়াতো দুরে থাক, উহ্ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না। এদিকে বিষের তীব্র যাতনায় আবুবকরের চোখ দিয়ে অশ্র“ ফোঁটা বেড়িয়ে আসলো এবং তিনি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তা নবীজীর পবিত্র চেহারা মোবারকের উপর গড়িয়ে পড়লো। তপ্ত অশ্র“বারীর স্পর্শে নবীজীর ঘুম ভেঙ্গে গেল এবং তিনি আবুবকরকে জিজ্ঞেস করলেন কিহে আবুবকর আপনি কাঁদছেন কেন? কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি তা খুলে বললেন। অতঃপর নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবুবকরের সর্পদংশিত আঙ্গুলে পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দিলেন এবং আবুবকর (রাদিআল্লাহু আনহু) ধীরে ধীরে বিষমুক্ত হয়ে গেলেন।
সুব্হানাল্লাহ্! ভালোবাসার এর চেয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে! আসলে রাসূলের প্রতি ভালোবাসা তখনই নিজের জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করতে পারে যখন সে ভালোবাসাটা হবে নিতান্তই ঈমানের দাবী।
আর তাই সাহাবায়ে আযমা’ঈনের মতো আমাদেরকেও রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিঃশর্তভাবে ভালোবাসতে হবে শুধুমাত্র ঈমানের দাবীতে, অন্তরের তাকীদে। তবেই দুনিয়ায় মিলবে কল্যান, আখিরাতে মিলবে জান্নাত।
আবু যারীফ
ঢাকা, ২৪ জুলাই ২০১১ ঈসায়ী। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।