যেমন কর্ম তেমন ফল।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক সংগঠক অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। ধানমণ্ডির শাহী ঈদগাহ মাঠ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দুটি জানাজার পর তার মরদেহ দাদার কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। গত মঙ্গলবার রাত ১১টা ২২ মিনিটে তিনি রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি... রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।
মৃত্যুকালে তিনি সহধর্মিণী অধ্যাপিকা রওশন জাহান, দুই ছেলে ব্যাংকার সিরাজুল আমিন ও মমতাজুল করিম এবং একমাত্র মেয়ে অধ্যাপক সোহেলা নাজনীনকে রেখে গেছেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ একুশে পদকে ভূষিত হয়েছিলেন।
অধ্যাপক আহমেদ ছিলেন আজীবন শিক্ষক ও গবেষক। অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয়। একই সঙ্গে তিনি সক্রিয় ছিলেন পরিবেশ আন্দোলন, মানবাধিকার রক্ষা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে।
অনেকগুলো সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। এসব কাজের জন্য তিনি রাজনীতিবিদদের কাছে সমালোচিত ও নিন্দিত হলেও লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। সত্ ও নির্লোভ ব্যক্তি হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল।
গতকাল সকাল ১১টায় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের লাশ হিমঘর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর সাত মসজিদ রোডের বাসভবনে। সহধর্মিনি, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজনরা শেষবারের মতো দেখেন তাকে।
দুপুর ১টার দিকে পরিবারের সদস্যরা তাকে প্রিয়বাসভবন থেকে বিদায় দেন চিরদিনের জন্য। প্রথম জানাজার জন্য তার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ধানমণ্ডির শাহী ঈদগাহ মাঠে। বাদ জোহার তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানায় অংশ নেন, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও ড. মঈন খান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন আহমেদ, কলাম লেখক আবুল মকসুদ, ফজলে নূর তাপস এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, সুজনের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ সহস্রাধিক লোক জানাজায় শরিক হন।
দুপুর ২টায় মৃতদেহ নিয়ে আসা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে।
এখানে মরহুমের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখওয়াত হোসেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, আইনজ্ঞ ড. তুহিন মালিকসহ কয়েকশত লোক জানাজায় অংশ নেন। দুপুর আড়াইটায় তার মৃহদেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়ে যাওয়া হয় আজিমপুর কবরস্থানে। সংরক্ষিত কবরস্থানে দাদার কবরের পাশে বিকেল সাড়ে তিনটায় তাকে সমাহিত করা হয়।
বিশিষ্টজনদের প্রতিক্রিয়া
অধ্যাপক মোজাফফর দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখেছেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, তার মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
অধ্যাপক মোজাফফরের দীর্ঘ দিনের কর্মসঙ্গী টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তিনি গণমানুষের প্রতি দরদ থেকে আজীবন সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। আমি আমার খুব কাছের এক সহযোদ্ধাকে হারালাম। সুলতানা কামাল বলেন, আমরা একজন অভিভাবক হারালাম। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। দেশ হারালো তার সেরা সন্তান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, অধ্যাপক মোজাফফর সবসময় বলতেন, তার কাছে ধর্মীয় বিশ্বাস, পরিবারের প্রতি আনুগত্য ও দেশপ্রে সবচেয়ে বড়। বন্ধু হিসাবে ও মানুষ হিসাবেও তিনি খুব ভাল ছিলেন। দেশের একজন সেরা সন্তান চলে গেলেন। ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, মোজাফফর আহমেদ আমার শিক্ষক ও অভিভাবক। দুর্নীতির বিরোধিতা একটি বড় লড়াই।
দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের অধিনায়ক মোজাফফর আহমদ চলে গেলেন। এই লড়াইয়ে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখে গেছেন।
শোকবার্তা
অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের মৃত্যুতে সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ শোক প্রকাশ করেছেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান এক শোক বার্তায় বলেন, তিনি ছিলেন এক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। শিক্ষা, গবেষণা ও সামাজিক উন্নয়নে তার অসাধারণ ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোক বার্তায় মোজাফফর আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। আরেক শোকবার্তায় বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলেছেন, এই শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। বিএনপি চেয়ারপারসন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক মোজাফফরের দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করেন এবং প্রয়াতের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানান।
জাতীয় সংসদের স্পিকার আবদুল হামিদ, ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী পৃৃথক বার্তায় মোজাফফর আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী: অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৭ মার্চ।
বাবার নাম নাজির আহমেদ এবং মা জাহানারা বেগম। ১৯৫০ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে তিনি অনার্স এবং ১৯৫৬ সালে মাস্টার্স করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে অধ্যাপক রওশন জাহানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।