অরুণালোক মুখোশ কী : ইংরেজি mask বাংলায় মুখোশ শব্দটির অর্থ হচ্ছে মুখাবরণ, নকল মুখ, কৃত্রিম মুখ বা কপটতা। সত্যিকারের চেহারা অদৃশ্য করে ভিন্নরূপে আবির্ভাব হওয়ার জন্য যে সব উপাদান ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট রূপ ফোটানো হয়, তাই মুখোশ। মুখোশের আড়াল বলতে সাধারণত অস্বাভাবিক কোন আবরণের মাধ্যমে সত্যিকারের চেহারাটা লুকিয়ে ফেলা বোঝায়। মুখোশ প্রকৃত রূপকে আড়াল করার কাজে ব্যবহৃত কৃত্রিম কোন উপাদানের মাধ্যমে তৈরি এক ধরনের আবরণ। প্রাণীজগতের অনেক প্রাণী প্রকৃতিগতভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখার কৌশল জানে কিন্তু সেটা মুখোশ নয়।
কেবল মাত্র মানুষ তার নিজের চেহারা লুকানোর কাজে মুখোশের ব্যবহার করে।
পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মধ্যেই মুখোশের প্রচলন থাকলেও তা কবে থেকে শুরু হয়েছিলো এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি। গ্রীসের জাতীয় পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে রক্ষিত আছে ৩৭০০ বছরের পুরোনো সোনার মুখোশ। মুখোশটির আবিষ্কর্তা হাইনরিখ সস্নিম্যান (১৮৭৬ সালে) মনে করেছিলেন, এটি বিখ্যাত গ্রীক রাজা আগামেনানের ডেথ মাস্ক বা মৃত্যু মুখোশ। কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, মুখোশটি আসলে আগামেনানের নয়।
প্রায় ৪০০০ বছর আগেও মুখোশের প্রচলন ছিলো বলে কেউ কেউ দাবি করেন। তাদের মতে, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মেক্সিকো এসব এলাকার আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাদু ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মুখোশের ব্যবহার ছিলো।
মুখোশের ইতিহাস : পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মধ্যেই মুখোশের প্রচলন থাকলেও তা কবে থেকে শুরু হয়েছিলো এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি। গ্রীসের জাতীয় পুরাতত্ত্ব জাদুঘরে রক্ষিত আছে ৩৭০০ বছরের পুরোনো সোনার মুখোশ। মুখোশটির আবিষ্কর্তা হাইনরিখ সস্নিম্যান (১৮৭৬ সালে) মনে করেছিলেন, এটি বিখ্যাত গ্রীক রাজা আগামেনানের ডেথ মাস্ক বা মৃত্যু মুখোশ।
কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, মুখোশটি আসলে আগামেনানের নয়। প্রায় ৪০০০ বছর আগেও মুখোশের প্রচলন ছিলো বলে কেউ কেউ দাবি করেন। তাদের মতে, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, মেক্সিকো এসব এলাকার আদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাদু ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে মুখোশের ব্যবহার ছিলো। তবে আমাদের ভারত উপমহাদেশে মুখোশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে গবেষকরা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাভারত ও রামায়ণের কথা ব্যক্ত করেছেন। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মধ্যে ভরতনট্যম, শিবের প্রার্থনা ইত্যাদির ক্ষেত্রে মুখোশের ব্যবহার বর্ণনা করেছেন।
কালীনৃত্যে কালো অবয়বে রক্তলালের জিহ্বা বানিয়ে, শিবের গাজন গাইতে বিভিন্ন দেব-দেবীর চেহারা অঙ্কিত করে মুখোশ বানিয়ে নাচ গান, খেমটা ও হিজড়া নাচ ইত্যাদিতে মুখোশের বিষয়টির উল্লেখ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন প্রকার মুখোশ : মুখোশের আকার আকৃতি ও বৈচিত্রের আছে রকমফের। বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কারণেই এ বৈচিত্র। ভারত উপমহাদেশে পুরাণের সাথে যুক্ত হয়ে মহাদেব, কালী, রাধা-কৃষ্ণ, শিব-পার্বতী মুখোশ। উৎসব অনুষ্ঠানের যাত্রা, পালাগান, সং ইত্যাদির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন মুখোশ।
মানুষের পশুসুলভ আচরণগত বাঘ, সিংহ, কুমির, বানর, প্রজাপতি, পাখি, সাপ, কল্পিত রাক্ষস-খোক্কস এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে যুক্ত মানব-মানবী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বুড়ো-বুড়ি ইত্যাদি মুখোশ রয়েছে।
মুখোশ তৈরির উপকরণ : সাধারণত মুখোশ তৈরির উপাদানগুলো হলো কাপড়, কাগজ, শোলা, কাঠ, মাটি, আঠা, রং ইত্যাদি। কোন কোন অঞ্চলে মানুষের মাথার খুলির সাথে অন্যান্য উপাদান যুক্ত করেও মুখোশ তৈরি হতো বলে জানা যায়। এছাড়াও মুখোশ তৈরিতে পস্নাস্টিকসহ বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহারও রয়েছে।
মুখোশ কেন : সৃষ্টিজগতে সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ।
মানুষের ভেতর বহুসত্ত্বার বসবাস। একদিকে সে সৃষ্টিশীল, অন্যদিকে ধ্বংস করার মনও তার ভেতরে লুপ্ত থাকে। তাই বাইরের চেহারার সাথে ভেতরের চেহারার একটা বিশাল পার্থক্য ধরা পড়ে। বাইরের ভোলা-ভালা চমৎকার মানুষটিই যে কোন কারণে রুক্ষ্ম হয়ে উঠতে পারে। ভেতরে রুক্ষ্মতা না থাকলে বাইরে তার প্রকাশ হতে পারে না।
আবার উল্টোটিও হতে পারে। আপাতদৃষ্টে কাউকে রুক্ষ্ম মনে হলেও তার ভেতরে একটা ফুলের মতো কোমল মন রয়ে যায়। এ বৈপরিত্যটা হচ্ছে তার মনের মুখোশ। কথায় কথায় আমরা অনেককে বলতে শুনি লোকটা মুখোশধারী। ভাল মানুষের বেশে লোকটা একটা বজ্জাত ।
অথবা এমনও শুনি, বাইরে লোকটাকে কঠিন বলে মনে হলে কী হবে, ওর ভেতরটা ঠিক যেন একটা ফুল । এক সময় বাইরে থেকে একটি মেয়েকে আমি খুব রুক্ষ্ম ও কঠিনমনা ভাবতাম। মেয়েটাও সেটা জানতো। তাই একদিন তার প্রতি আমার এ মনোভাবটা ভুল প্রমাণ করার জন্য সে আমাকে নারকেলের ভেতরের শাঁষ (নারকেলের অঙ্কুরোদগমের সময় ভেতরে এক ধরনের শাঁষের জন্ম হয়) দুধ দিয়ে ভিজিয়ে এনে খাইয়েছিলো। এটা দিয়ে সে বুঝাতে চেয়েছিলো, বাইরে থেকে আপনি আমাকে যতো কঠিনই মনে করুন না কেন, আদপে আমার ভেতরটা কোমল ।
ঘটনাটা বেশিদিন আগের নয়। সে যাহোক, মানুষের মনের বিভিন্ন রকম রূপ ফুটিয়ে তুলতেই আসলে মুখোশের আবিষ্কার। মুখোশের আবিষ্কারের পেছনে অবশ্য আরও অন্য কারণও আছে। মুখোশ গবেষকগণ মানুষের আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে, জাতিগোষ্ঠির স্বাতন্ত্র রক্ষা করার ক্ষেত্রে, মন্দ আত্মা বা প্রেতের ভয় থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে, ব্যাধি দূর করতে, আমোদ প্রমোদ ও রঙ্গকৌতুক প্রকাশ করতে ও শিকার বা শস্য সংগ্রহের মতো প্রাত্যাহিক জীবনের প্রয়োজনীয় কাজে সাহায্যকারী আত্মার প্রতিকৃতি হিসেবে। বাংলাদেশের লোকঐতিহ্যের অংশ হিসেবে মুখোশের ব্যবহার জানতে পারা যায়।
দ্রাবিড় উত্তরসূরীদের ভেতর ওঁরাওদের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে মুখোশের ব্যবহার ছিলো। নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বিভিন্ন আদিবাসি বিশেষত গারোদের বিভিন্ন পালা-পার্বণে মুখোশের ব্যবহার লক্ষণীয়।
বাংলাদেশে মুখোশ : মানুষের ভেতরের রূপটাকে ফুটিয়ে তোলার কাজটি সারা হয় মুখোশের মাধ্যমে, এ কথা আগেই বলেছি। শাসক দলের ভেতরের রূপ ফুটিয়ে তুলতে মুখোশ শব্দটির ব্যবহার পাওয়া যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের "মুখ ও মুখোশ" চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৫৬ সালে এ চলচ্চিত্রটি স্থানীয়ভাবে নির্মিত প্রথম সবাক চলচ্চিত্র।
নামে মুখোশ শব্দটির ব্যবহৃত হলেও কার্যত ছবিটিতে কোন মুখোশের ব্যবহার হয় নি। সে যাক, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই মুখোশ নিয়ে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। মুখোশ শব্দটির অর্থগত যেমন মুখাবরণ বা ছদ্মাবরণের আড়ালে এটি এখন একটি শিল্প হিসেবেই খ্যাতি পেতে চলেছে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন মুখোশ প্রদর্শনিতে। গত ১লা এপ্রিল ২০১১ তারিখের প্রথম আলোয় সিলভিয়া নাজনীনের "মুখোশে মন্দ্রিত মুখ" শিরোনামে প্রকাশিত খবরে ঢাকার উত্তরায় গ্যালারি কায়া র মুখ ও মুখোশ ৩ মুখোশ প্রদর্শনীর কথা জানা যায়।
এ প্রদর্শনিতে ১৫৮টি মুখোশের স্থান হয়েছিলো এবং শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী শিল্পীদের সৃজনশীলতাকে বিস্তৃত করার জন্যই এ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে শিল্পী ভবেশ মালাকার, তরুণ ঘোষ, কাজী রকিব, মাসুদা কাজীসহ অনেক শিল্পীই উপস্থিত ছিলেন। পরে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভাসিটি বাংলাদেশ র আর্ট ক্লাব আয়োজন করেছিলো এরকম আরেকটি মুখোশ প্রদর্শনীর। এখানে ৭৯টি মুখোশ প্রদর্শিত হয়েছিলো। এ প্রদর্শনীর প্রধান অতিথি ছিলেন আইইউবি র প্রধান উপাচার্য অধ্যাপক এম. ওমর রহমান।
এ আর্ট ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট কামরুন নাহান তিথি জানান, আমি নিজের শিল্পবোধ থেকে এ ধরনের অনুপ্রেরণামূলক কর্মকান্ডে সাথে সম্পৃক্ত থাকতে গর্ব অনুভব করি। তাঁর মতে মুখোশ হচ্ছে আয়নার মতো, যা বিভিন্ন চরিত্রের সমাহার। প্রতিবছর বাংলা নববর্ষকে উদ্যাপন করতে চারুকলা থেকে বের হচ্ছে মুখোশ মিছিল। চিত্রবিচিত্র নানা ধরনের মুখোশ নিয়ে উচ্ছ্বল প্রাণবন্তু এ দৃশ্য দেখতে বেশ লাগে। এছাড়াও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বিভিন্ন মেলা উদ্যাপন উপলক্ষে মুখোশের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
শেষকথা : মানুষের ভেতরের মানুষটাকে প্রকাশ করতে মুখোশের গুরুত্ব ফেলনা নয়। মুখ দেখে ভুল করো না, মুখটা তো নয় মনের আয়না/ মানুষের ভেতরের খবর তো কেউ পায় না । গানটির মতো বাইরে থেকে মানুষের রূপ বোঝা খুব ভার। মানুষের বাইরের চেহারা দেখে ভেতরের রূপ যারা চিনিয়ে দেন, তারা কেউ চিত্রশিল্পী, কেউ সঙ্গীত শিল্পী, কেউ কবি, কেউ সাহিত্যিক। তাঁরা তাদের কর্মকান্ডে মাধ্যমে সমাজে অসাঞ্জস্যগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।
আর তাই সাংস্কৃতিক অঙনের অন্যান্য শাখাগুলোর মতোই মুখোশ শিল্প ও ডাল-পালা ছড়িয়ে মহীরুহের আকার ধারণ করুক, সেই প্রত্যাশায়২ তারিখ : ২৪ই মে, ২০১২, ঢাকা তথ্য : ১। কামরুন নাহার তিথি, সহ-সভাপতি, আর্ট ক্লাব, বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি। :। ইন্টারনেট। গোল্লাইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ র আর্ট ক্লাব আয়োজিত মুখোশ প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত কিছু মুখোশ।
এই মুখোশগুলো পশ্চিমের কিছু ধারণা নিয়ে করা হয়েছে। ওরা সাধারণত খুব ব্যবহার করে এই মুখোশগুলো। হেলইন পার্টি নামক এক অনুষ্ঠানে তারা এই মুখোশগুলো খুব ব্যবহার করে থাকে ।
এগুলো সাজানো হয়েছে শিল্পীর পছন্দের জায়গা ক্যানভাস এ। মানানসই করে এগুলোকে সাজান হয়েছে শিল্পিত চিন্তা ধারার মাধ্যমে।
যা মুখোশকে করে তুলেছে অতুলনীয়। ক্লাবের এত কাজকে সুন্দরভাবে ধারণা দিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ'র আর্ট ক্লাবের কো-অরডিনেটর ও সহকারী অধ্যাপক শিল্পী নাজির আহমেদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।