আগের পোস্টের মন্তব্যগুলোতে আরও অনেক খেলার নাম পেয়েছি। সেগুলোসহ আরও কিছু খেলার কথা মনে পড়ছে, আজকের পোস্ট তা-ই নিয়ে।
একটা খেলা ছিল শুয়ে-বসে খেলা যেত। একজন ঘরের কোন একটা জিনিস দেখে বলত, আমি যা দেখতে পাই, তুমি কি তা দেখতে পাও। তখন অন্যরা বলবে, কী জিনিস? সে তখন জিনিসটার নাম বলবে না, কিন্তু একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলবে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
যেমন কেউ বলল, জিনিসটা হল দুইটা সিংহ। এখন খুঁজে বের করতে হবে দুই সিংহ কোথায় আছে। কেউ হয়তো খুঁজে পেল যে কোন টেবিল ঘড়ির দুই পাশে দুইটা সিংহ বসানো, সে তখন পয়েন্ট পাবে। আর যদি কেউ খুঁজে না পায় তো বলবে, সারেন্ডার। তখন যে জিনিসটার কথা বলেছিল সে দেখিয়ে দিবে, আর পয়েন্ট সে পাবে।
ছোঁয়াছুঁয়ির মত একটা খেলা ছিল বরফ-পানি। চোর কাউকে ছুঁয়ে বলবে 'বরফ', তাহলে বরফ হয়ে যেতে হবে, মানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে তাকে। এরপর চোর একে একে অন্যদেরও বরফ করার চেষ্টা করবে। এর ফাঁকে আবার অন্য কেউ যদি আগের বরফকে ছু্ঁয়ে দিয়ে বলে 'পানি', তাহলে বরফ গলে আবার দৌড় দিবে। চোরকে তাই বরফগুলোকে পাহারায় রাখতে হয়।
গরম-ঠান্ডা একটা মজার খেলা ছিল। কেউ একজন কোন একটা ছোট জিনিসকে লুকিয়ে রাখত। তখন অন্য সবাই আরেক ঘরে থাকত। এরপর সে ডাক দিলে সবাই আসত এই ঘরে আর খুঁজতে থাকত সেই জিনিস। খোঁজার সময় যে লুকিয়েছে জিনিসটা, তাকে জিজ্ঞেস করা হত, এখন কি গরম না ঠান্ডা।
যদি জিনিসটার কাছাকাছি থাকত, তাহলে বলত গরম, আর দূরে থাকলে ঠান্ডা। অনেক দূরে থাকলে বলত, একেবারে ডিপ ফ্রিজের মত ঠান্ডা। আর একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেলে আগুন-গরম। এইভাবে যে আগে জিনিসটা খুঁজে বের করতে পারবে তার পয়েন্ট হবে।
কয়েকজন মিলে আরেকটা খেলা খেলতাম, যেখানে একজন হবে চোর যে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়াবে, আর বাকীরা তার বেশ পিছনে সারি করে দাঁড়াবে।
সে দেয়ালে মুখ লুকিয়ে সুর করে বলবে, এ লন্ডি লন্ডন! বলেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবে। সবাইকে স্থির হয়ে থাকতে দেখবে, কিন্তু যখনই সে এ লন্ডি লন্ডন বলতে যাবে তখনই নড়াচড়া করা যাবে। এক পা দুই পা করে এগিয়ে যেতে হবে তখনই। কিন্তু সে যদি ঘাড় ঘুরিয়ে নড়তে দেখে তো সে আউট হবে। আর যে এভাবে এগিয়ে গিয়ে সবার আগে চোরকে ছুঁয়ে দিতে পারবে সে হবে চ্যাম্পিয়ন।
সংসার-সংসার খেলার কথা আগেও বলেছি। একটা মজার সংসার খেলা ছিল, এখানে শুধু ডায়লগ বলতে হত। কোন হাড়ি-পাতিল, পুতুল বা গাড়ির দরকার হত না। আমি আর ছোট বোন মিলে এটা খেলতাম। মনে মনে চিন্তা করতাম যে আমরা দুজন প্রতিবেশী।
সে আমার আমার বাসায় বেড়াতে এসেছে। এরপর শুরু হত আমাদের ভাবী-সুলভ গল্প। ছোট বোন ঢঙ করে বলত, ভাবী, এই যে জামাটা দেখছেন না? এটা আমি নিজ হাতে বেনিয়েছি। এই সময় অতি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে গিয়ে 'বানিয়েছি' হয়ে যেত 'বেনিয়েছি'।
লুডো খেলতাম সেই পিচ্চিকাল থেকে।
খেলাটা বোঝার আগে থেকেই বলা যায়। বড় বোনের কাছে শুনেছি, একবার নাকি বাসায় লুডোর বোর্ড কেনা হয়েছে। চার বোন মিলে খেলতে বসেছি। বড় দুই বোন তো পারেই, আমরা পিচ্চি দুইটা কিছুই বুঝি না। কিন্তু এক সময় মারামারি-কান্নাকাটি লেগেই গেল।
সেই সাথে গুটি ছোঁড়াছুঁড়ি, বোর্ড ছিঁড়ে কয়েক টুকরো। অবশেষে সেই কান্নাকাটি-ঝগড়াঝাটি সামাল দিতে আব্বা রাগ করে চার বোনের জন্য আলাদা করে চারটা বোর্ড কিনে দিলেন। যদিও একা একা কেউই লুডো খেলায় আর আগ্রহী ছিল না। পরে অবশ্য খেলা শিখেছি যখন, তখন থেকে এখন পর্যন্ত আমি লুডোতে বেশির ভাগ সময় লাড্ডুগুড্ডু হই।
আব্বার একটা দাবার বোর্ড ছিল।
দাবা খেলার বেসিকটাও শিখেছিলাম আব্বার কাছ থেকেই। কিন্তু আমার আবার অত প্যাঁচঘোঁচ কৌশল চিন্তা করতে ইচ্ছা করত না। তাই এই খেলায় কখনই পারদর্শিতা অর্জন করতে পারিনি। এইসব আমার মত বোকাদের খেলা না।
ছোট ভাইয়ের একটা বাগাডুলির বোর্ড ছিল।
এটা নিয়ে বাসার সবাই খেলতাম একসাথে। বয়স লাগে না এটা খেলার জন্য। একটা বোর্ডে কতগুলো পিন বসানো ঘর থাকত, এক পাশ থেকে একটা কাঠি দিয়ে মার্বেল গড়িয়ে দেয়া হত। একেকটা ঘরের ছিল একেক রকম পয়েন্ট। মার্বেলগুলো গড়িয়ে যে যে ঘরে গিয়ে আটকাবে, সেগুলোর পয়েন্ট যোগ করে চূড়ান্ত পয়েন্ট বের করা হত।
স্বাভাবিকভাবেই সর্বোচ্চ পয়েন্টের ঘরটা থাকত সবচেয়ে দুর্গম এলাকায়।
একটু বড় হয়ে শুরু করলাম ক্যারম খেলা। অবশ্য সত্যিকারের ভালো খেলা কখনই খেলিনি। আনাড়ীদের সাথে আনাড়ীদের মতই খেলতাম। ভাই-বোনরা মিলে বসতাম খটাস খটাস করে ক্যারম খেলতে।
বরিক পাউডার শেষ হয়ে গেলেই আম্মার ট্যালকম পাউডারের বোতলে হানা দিতাম। মেজপা সব সময় খেলার প্রতিটি চাল দেয়ার আগে এত চিন্তা-ভাবনা করত যে আমরা বলতাম, দাবা খেলতে বসছে।
ক্যারমের একটা চালের নাম আমরা দিয়েছিলাম কোকা-কোলা মাইর। এর পিছনে একটা মজার ইতিহাস ছিল। একবার তিন বোন আর ছোট ভাই মিলে খেলছিলাম।
খেলার মধ্যে ছোট ভাই বড় আবেগের সাথে গান গাইছিল, কোকা-কোলা বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল। "যেখানে আছে ফুল, সুগন্ধ সেখানেই, স্কুল থাকলেই হোমওয়ার্ক থাকবেই, গানের সাথে আছে ছন্দের খেলা, যেখানে আনন্দ সেখানেই কোকা-কোলা.......কোকা-কোলাআআআআআআআআ। " এক সময় তার চাল এল, তখনও সে গান গাইছে। গান প্রায় শেষ, শেষের লম্বা টানওয়ালা কোকা-কোলা বলা বাকী শুধু। এদিকে আমরা বিরক্ত হচ্ছি তার দেরী দেখে।
খুব সহজ একটা চাল ছিল ওর। সে আমাদের বিরক্তি দেখে তাড়াতাড়ি স্ট্রাইকারটা বসিয়ে আবেগের সাথে চোখ বন্ধ করে কোকাকোলাআআআআআআআআআ বলে একটা টান দিল, আর একই সাথে স্ট্রাইকারেও চাল দিল। চালটা খুব সহজ হলেও মনোযোগ ছিল না বলে গুটি পকেটে পড়ল না। সে কোকাকোলা সঙ্গীত শেষ করে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখে গুটি যেখানে ছিল সেখানেই আছে। করে তাকিয়ে রইল।
আর ওদিকে আমরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। এরপর থেকে যে কেউ কোন সহজ গুটি পকেটে না ফেলতে পারলেই আমরা বলতাম, এই যে কোকাকোলা মাইর দিছে।
ছোট ভাই একটু বড় হয়েই আব্বার কাছে আবদার করে ভিডিও গেম বাগাল। প্রথমে তাকে দেয়া হয়েছিল ব্রিক গেমের ছোট ভিডিও গেম। সেটা নিয়ে সে নিজে খেলবে কী? আমরা চার বোনের কাড়াকাড়িতে সে সুযোগই পেত না।
এরপর সে আবারও আবদার করে টিভি গেম বাগাল। এবারও যে কাড়াকাড়ি হয়নি তা না, তবে ব্রিক গেমের তুলনায় কম। টিভি গেমের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল সুপার মারিও ব্রাদার্স। একজন বা দুজন খেলতাম। প্রায় শেষ পর্যন্ত গিয়েছিলাম, কিন্তু একেবারে শেষ করতে পারিনি কখনই, রাজকুমারীকে আর উদ্ধারই করা হল না আমাদের।
মাঝে মাঝে ক্রিকেটও খেলতাম টিভি গেম দিয়ে।
টিভি গেমের দিন শেষ হল বাসায় কম্পিউটার আসার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ততদিনে আমরা আর ছোটটি নেই। যদিও অনেক অনেক খেলেছি, আর এখনও অনেক খেলি। কিন্তু ছোটবেলার খেলার গল্পের মধ্যে এই গল্প আর না-ই করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।