সিরিয়া এখন পশ্চিমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। পশ্চিমারা না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে। সিরিয়া নিয়ে তাদের সামনে এখন বড় বাধা চীন ও রাশিয়া। ঐতিহাসিক ভাবে রাশিয়া ও চীন ছিল ইরাক লিবিয়া ও সিরিয়ার বড় বানিজ্যিক পার্টনার। ইরাক এবং লিবিয়াতে পশ্চিমাদের হস্তক্ষেপ ও সামরিক অভিযান রাশিয়া ও চীনকে আর্থিক দিক দিযে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এখন সিরিয়ায় পশ্চিমা হস্তক্ষেপ হলে তারা আর্থিক দিক দিয়ে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে, চীন ও রাশিয়া যে সিরিয়ার বন্ধুত্বের জন্য পরপর দুইবার জাতিসংঘে ভেটো প্রয়োগ করেছে, এমনটা নয়। তারা তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ ও বানিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্যই ভেটো প্রয়োগ করেছে।
রাশিয়ার জন্য ব্যাপারটি আর একটু ভিন্ন, কারণ সিরিয়ার ভূ-মধ্য সাগরীয় উপকূলে রাশিয়ার বিশাল এক গ্রীষ্মকালীন নৌঘাটি রয়েছে। এই ঘাটির জায়গাটিও রাশিয়া ছাড়তে চায় না।
পক্ষান্তরে পশ্চিমাদের প্রভাবিত শক্তি সিরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করলে সেখান থেকে রাশিয়ার নৌঘাটি গুটিয়ে নিতে হবে, যা রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
মধ্যপ্রাচ্যে এক সময় মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও দক্ষিণ ইয়েমেন মিলে একটি শক্তিশালী ইসরায়েল বিরোধী সামরিক বলয় গড়ে উঠেছিল। এদের সাথে যুক্ত ছিল পিএলও, যদিও তাদের কোন রাষ্ট্র ছিল না। এই বয়য়ে প্রথম ভাঙ্গন ধরে ১৯৭৩ সালের আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর, যখন মিশর ইসরায়েলের সাথে ক্যাম্পডেভিড শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। মিশরের সাথে ইসরায়েলের এই মিত্রতা ইসরায়েল বিরোধী আরব বলয়কে অনেকখানি দূর্বল করে দেয়।
এখানে উল্লেখ্য যে তখনকার মধ্যপ্রাচ্যে ইরায়েল বিরোধী বলয় প্রকারান্তরে আমেরিকা ও ন্যাটো বিরোধী ছিল। স্বভাবতঃ তখনকার স্নায়ু যুদ্ধের পরিবেশে রাশিয়া ইসরায়েল ও আমেরিকা বিরোধী এই বলয়কে সমর্থন দিয়েছে। তবে রাশিয়ার সমর্থন যতটা না সামরিক তার চেয়ে বেশী ছিল রাজনৈতিক ও কৌশলগত। যে কারণে রাশিয়ার সমর্থন ইসরায়েল বিরোধী বলয়কে সামরিক দিক দিয়ে কার্যকর ভাবে শক্তিশালী করেনি।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান এই বলয়ে যুক্ত হয় এবং তাদের শক্তি কিছুটা বৃ্দ্ধি পায়।
কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে আমেরিকার কূটকৌশল ও কারসাজিতে ইরাক ও ইরান পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে, ইসরায়েল বিরোধী আরব বলয় আরো অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে ১৯৮৪ সালে ইসরায়েল লেবাননে সামরিক হামলা চালিয়ে পিএলওকে উৎখাত করলে ফিলিস্তিনীরা শক্তি হিসেবে বিষদন্তহীন হয়ে পড়ে। তারা লেবানন থেকে উচ্ছেদ হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে তাদের বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র পিছনে ফেলে লিবিয়া, ইরাক ও সুদানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এরপর ইসরায়েল বিরোধী আরব বলয় আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন ১৯৯০ সনে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একিভূত হয়ে মার্কিন প্রভাব বলয়ে চলে যায়।
কার্যতঃ ইরান ইরাক যুদ্ধের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও সামরিক কমান্ডারদের গুপ্তহত্যা শুরু হয়। সেই সাথে শুরু হয় ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিরোধী রাষ্ট্র গুলোকে দূর্বল করা এবং সেখানে আমেরিকাপন্থীদের ক্ষমতায় বসানোর প্রক্রিয়া। কিন্তু পরোক্ষ যুদ্ধ এবং পরোক্ষ তৎপরতার মাধ্যমে যখন উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি পশ্চিমারা অর্জন করতে পারলো না তখন, পরোক্ষ বা গোপন তৎপরতার কৌশল পরিবর্তন করে তারা সরাসরি হামলার কৌশল অবলম্বন করে, যার প্রধান টার্গেট করা হয় ইরাককে। তারপরের ঘটনাটা সবই সবার জানা। ইরাকে সরাসরি হামলার মাধ্যমে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে হত্যা করা হয়েছে।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে লিবিয়াতে, আর বর্তমান টার্গেট সিরিয়া। মাঝখানে ইসরায়েলের গাজা সামরিক অভিযান সরাসরি হামলার মাধ্যমে শত্রুকে দর্বল করার কৌশলেরই অংশ।
ইরাককে এমন সময় ধরা হয় যখন দেশটি আট বছর ধরে ইরানের সাথে যুদ্ধ করে সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাছাড়া ইরাককে দূর্বল করে তার অস্ত্রপাতি গুলো আগে থেকে ধ্বংস করার কাজে জাতিসংঘকে ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশ তখন কল্পনাই করতে পারেনি যে, আমেরিকা সত্যি সত্যি ইরাকে সরাসরি হামলা চালাবে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল বিরোধী বলয়কে কাবু করতে হলে প্রথমেই ইরাককে কাবু করার দরকার ছিল। আমেরিকানরা সেটা হিসাব কষে বুঝে শুনে ইরাককে টার্গেট করেছিল। ইরাকে অভিযান সফল হবার পর তাদের টার্গেট ছিল ইরান। কিন্তু সেখানকার হিসেব-কিতেব সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ায় আমেরিকা ও ন্যাটো তাদের শৌর্য প্রকাশের জন্য সফট টার্গেট লিবিয়াকে বেছে নেয়। কিন্তু এখন আবার ধাক্কা খেয়েছে সিরিয়া প্রশ্নে।
ইরাকের পতনের পর ইরানকে বাদ দিলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল বিরোধী প্রধান শক্তি সিরিয়া। সিরিয়ার তেল কম থাকলেও দেশটি বহুমূখী সম্পদে সমৃদ্ধ। লোকসংখ্যাও অনান্য আবর দেশের চেয়ে বেশী। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা বাহিনীর আকার ৩ লক্ষ যা আর কোন আরব দেশের নেই। এছাড়া সিরিয়ার রয়েছে রাশিয়ায় নির্মিত ৫ হাজার মাঝারী ও ভারী ট্যাঙ্ক।
রয়েছে পাচশ’রও বেশী অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান যা রাশিয়ায় তৈরী। এসব ট্যাঙ্ক ও বিমানের ক্ষমতা কারো অজানা নয়। সিরিয়ার রয়েছে অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম এবং মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যাটারী। এছাড়া কিছু কিছু স্বল্প পাল্লার মিসাইল ও রকেট সিরিয়া দেশেই উৎপাদন করে থাকে। সম্প্রতি তারা রাশিয়ার কাছ থেকে ৬টি জাহাজ বিধ্বংসী মিসাইল সিষ্টেম সংগ্রহ করেছে।
ইরাক যেমন জাতিসংঘের নির্দেশে আধুনিক অস্ত্রগুলি হস্তান্তর বা ধ্বংস করেছিল, সিরিয়ার ক্ষেত্রে তা ঘটে নি। সিরিয়াকে টার্গেট করার কারনও সম্ভবতঃ সেটা- সিরিয়া ইসরায়েলের জন্য প্রধান সামরিক হুমকি।
অপরদিকে রাশিয়া এবং চীনের বিরোধিতার কারনে জাতিসংঘকে ব্যবহার করতে না পারায় সিরিয়া আক্রমনে বৃহত্তর ঝুকি রয়েছে। কারণ সেক্ষেত্রে সিরিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে কোন দেশ আর বাধাপ্রাপ্ত হবে না, তাদের কাছে অস্ত্র বিক্রি অবৈধও হবে না। ফলে পশ্চিমা হামলার সময় অনান্য দেশ যদি সিরিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে তাহলে পশ্চিমারা আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।
ফলে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার ছাড়া সিরিয়ার বিরুদ্ধে প্রচলিত অস্ত্রের যুদ্ধে পশ্চিমারা চুড়ান্ত বিচারে জয়লাভ করলেও সিরিয়ার দিক থেকে ভাল রকমের পাল্টা আঘাত আসার সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়া পাহাড়-পর্বত বেষ্টিত দেশটিতে সামরিক অভিযান চালিয়ে পুরো দেশটি দখলে নেয়া খুব একটি সহজ কাজ নয়। এসব বিষয় পশ্চিমাদের কাছে অজানা নয়। ফলে সিরিয়াতে সামরিক হামলা চালানোর বিষয়টি পশ্চিমাদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের। তারপর আবার চীন ও রাশিয়ার কারণে জাতিসংঘের লেবেল ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
যে কারণে পশ্চিমারা নিজেদের দায়িত্বে সিরিয়ায় সামরিক হামলার ঝুকি নিতে চাইছ না। অপরদিকে অনেকখানি পানি ঘোলা করার পর মিশন অসম্পূর্ণ রেখে সিরিয়া থেকে ফিরে আসতেও তাদের মন চাইছে না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সিরিয়া তাদের গলার কাটা হয়ে আটকে আছে। না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।