লিবিয়ায় যুদ্ধের ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে বিদ্রোহীদের একটি বিসদৃশ প্রচেষ্টা অনেকের চোখ এড়িয়ে গেলেও বেশ কয়েকজন লেখকের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। আর এই প্রচেষ্টাটি হচ্ছে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ এড়িয়ে এমনকি তাদের নিজস্ব একটি সরকার গঠনের আগেই একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ। ইকনমিক পলিসি জার্নালে রবার্ট ওয়েনজেল লিখেছেন, ‘একটি গণঅভ্যুত্থানের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ার মতো ঘটনা আমি এর আগে কখনো শুনিনি। এতে ধারণা করা যায়- এ ধরনের সাজানো বিদ্রোহের বাইরে এখানে বেশ কিছু বিশেষ প্রভাব কাজ করছে। ’
নিউ আমেরিকানে অ্যালেক্স নিউম্যান লিখেছেন, ‘উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছে যে, ‘লিবিয়ার মুদ্রানীতি পরিচালনার জন্য বেনগাজীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থাপন এবং তার ওপর মুদ্রার কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন।
এ জন্য বেনগাজীতে লিবিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি অস্থায়ী সদর দফতর স্থাপন করে একজন গভর্নর নিয়োগও জরুরি। ’
লিবিয়া সরকার তার দেশে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক ব্যয়সাপেক্ষ একটি সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে মরুভূমিতে পানির নহর বইয়ে দিয়েছে। এ প্রকল্পটির নাম জিএমএমআর (গ্রেট ম্যান মেইড রিভার) বা মনুষ্য নির্মিত সর্ববৃহৎ নদী। এতে ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এটা মনে রাখতে হবে, লিবিয়ার জনজীবনে জ্বালানি তেলের তুলনায় পানি অনেক বেশি মহার্ঘ।
লিবিয়ার বিশাল ভূগর্ভস্থ পানির জলাধার নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন অ্যাকুফার ব্যবস্থা থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি তুলে তা ৪ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে দক্ষিণের মরুভূমি এলাকা থেকে উত্তরের উপকূল এলাকা পর্যন্ত জনগণকে সরবরাহ করা হচ্ছে। এই জিএমএমআর প্রকল্প দেশটির ৭০ ভাগ জনগণের পানীয় ও সেচের পানির সরবরাহ নিশ্চিত করে। লিবিয়া সরকার অন্তত এ অতিপ্রয়োজনীয় সঠিক কর্তব্যটি সমাধান করেছে।
লিবিয়ার জনগণ বিনে পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ পায় এবং তার হাসপাতালগুলো বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত। বিনা ব্যয়ে সেখানে শিক্ষা দেওয়া হয়।
এমনকি তরুণদের বিদেশে শিক্ষা লাভের জন্যও পুরো ব্যয় বহন করে সরকার। যুবসম্প্রদায় বিয়ের সময় আর্থিক সহায়তা হিসেবে ৬০ হাজার লিবিয়ান দিনার (৫০ হাজার মার্কিন ডলার) সুদমুক্ত ঋণ পায়। দেখা যায়, এই ঋণ শোধের ব্যাপারে কোনো সময়সীমা নেই। সরকারি ভর্তুকির কারণে গাড়ির দাম ইউরোপীয় যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক কম এবং তা প্রতিটি পরিবারের ক্রয়সাধ্যের মধ্যে। জ্বালানি ও রুটির দাম নামমাত্র।
কৃষি কাজে নিয়োজিতদের কোনো কর দিতে হয় না। লিবিয়ার জনগণ অত্যন্ত শান্ত এবং শান্তিপ্রিয়। তারা মাদকে আসক্ত নয় এবং অত্যন্ত ধর্মভীরু’ (গাদ্দাফির) শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের শাসককে কে না পছন্দ করবে?’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বাইরে লিবিয়া আক্রমণের আর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে ‘শুধু তেলের জন্য’ এ যুদ্ধ। এটা আংশিক হলেও পুরো সত্য নয়।
ন্যাশনাল জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটি বিশ্বের মোট উৎপাদিত তেলের মাত্র ২ ভাগ উৎপাদন করে। বাজার থেকে লিবিয়ার তেল যদি উধাও হয়েও যায় তাহলে সৌদি আরব সে ঘাটতি পূরণে সক্ষম। এবং যদি শুধু তেলই এ আক্রমণের কারণ হতো, তাহলে নতুন একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থাপনের জন্য এতটা তড়িঘড়ি কেন?
অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন জেনারেল ওয়েসফি ক্লার্কের ‘ডেমোক্র্যাসি নাও’ নামের ২০০৭ সালের একটি সাক্ষাৎকার। এতে তিনি বলেন, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ১০ দিন পর তাকে একজন সেনাধ্যক্ষ ইরাকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য যেতে বলেন। ক্লার্ক এতে অবাক হন এবং জানতে চান, কেন? প্রত্যুত্তরে ছিল, ‘আমি কিছু জানি না!’ তিনি আরো বলেন, ‘আমি ধারণা করি, এর পর কি করা যায় তারা তা জানে না!’ পরে ওই একই সেনাধ্যক্ষ তাকে বলেছিলেন যে, তারা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সাতটি দেশ দখল করবে।
দেশগুলো হচ্ছে- ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইরান। এই সাতটি দেশের সাধারণ প্রতিপাদ্য কি? এদের কোনোটিই ৫৬ সদস্যের ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টস বা বিআইএসের সদস্য নয়। এ জন্য এরা প্রত্যেকেই সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ‘বিশ্বাসঘাতক’ হচ্ছে লিবিয়া ও ইরাক। এই দুটি দেশই শেষ পর্যন্ত আক্রমণের শিকার হয়েছে।
এক্সামিনার ডট কমে কেনেথ সোয়ের্টজেন এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘সাদ্দামের পতন ঘটানোর জন্য ইরাক আক্রমণের ছয় মাস আগে দেশটি তেল বিক্রিতে ডলারের বদলে ইউরোতে বিনিময় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ডলারের বিশ্বময় যে কর্তৃত্ব রয়েছে তা হুমকির সম্মুখীন হয়। আর এ কর্তৃত্বই হচ্ছে পেট্রো ডলার। ’ রাশিয়ার একটি নিবন্ধের শিরোনাম হচ্ছে, ‘বম্বিং অব লিবিয়া- পানিশমেন্ট ফর গাদ্দাফি ফর হিজ অ্যাটেম্পট টু রিফউজ ইউএস ডলার। ’ গাদ্দাফিও একই ধরনের সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
তিনি ডলার ও ইউরোকে অস্বীকার করার একটি নতুন আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন। তিনি আরব ও আফ্রিকান জাতিগুলোর প্রতি ডলার ও ইউরোর বদলে স্বর্ণের দিনার চালুর আহবান জানিয়েছিলেন। গাদ্দাফি যুক্ত আফ্রিকা গঠন করে ২০ কোটি মানুষের জন্য একটি একক মুদ্রা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
গত এক বছরের মধ্যে গাদ্দাফির এই পরিকল্পনা অনেক আরব এবং আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ স্বীকার করে নিয়েছিল। এর বিরোধী ছিল একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ও আরব লীগ প্রধান।
এই উদ্যোগটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নেতিবাচক বলেই গণ্য করে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি লিবিয়াকে মানব ইতিহাসের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে ঘোষণা দেন। তবে গাদ্দাফি এতে দমে না গিয়ে বরং সংযুক্ত আফ্রিকা গঠনের উদ্যোগটি চালিয়ে যেতে থাকেন।
বর্তমানে লিবীয় সরকার লিবীয় দিনারকে তার নিজস্ব মুদ্রা হিসেবে তৈরি করেছে। আর সে এটা করেছে তার নিজস্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে।
কেউই যুক্তি দেখান না যে, লিবিয়া একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে তার বিপুল সম্পদের মাধ্যমে নিজের অর্থনৈতিক ভাগ্য নিজেই গড়তে ও চালু রাখতে সক্ষম। বিশ্ব ব্যাংকিং কার্টেলের জন্য বড় ধরনের একটি সমস্যা হচ্ছে- লিবিয়ার সঙ্গে ব্যবসা লিবীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে তার জাতীয় মুদ্রায় করতে হয়। এতে তাদের কর্তৃত্ব শূন্যের কোঠায় নেমে আসে এবং ক্ষমতার দালালির শক্তি সম্পূর্ণ লোপ পাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এ জন্যই ওবামা, ক্যামেরন ও সারকোজির বক্তৃতায় লিবিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এক হাত নেওয়ার বিষয় উহ্য থেকেছে। অথচ লিবিয়া যাতে তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে মানিয়ে চলে এটা অবশ্যই বিশ্বায়ন এজেন্ডার শীর্ষ একটি বিষয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে কম করেও ১৪৪ টন স্বর্ণ মজুদ রয়েছে। এই পরিমাণের সম্পদের যে মালিক তার বিআইএস কিংবা আইএমএফের প্রয়োজন কোথায়? আর তার এসব আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইন মেনে চলার প্রয়োজনই বা কি?
এসব কিছু বিবেচনায় এনে এখন বিআইএসের আইন ও নিয়ম-নীতি এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে সেগুলোর প্রভাবের ওপর নিবিড় দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। বিআইএসের ওয়েবসাইটের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, সেন্ট্রাল ব্যাংক গভর্ন্যান্স নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর একমাত্র অথবা প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘মূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা’। সরকার থেকে এদের স্বাধীন রাখতে হবে যাতে এই ম্যান্ডেটে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা হস্তক্ষেপ করতে না পারে এটা নিশ্চিত করা যায়। ‘মূল্যের স্থিতিশীলতা’র মানে হচ্ছে স্থিতিশীল মুদ্রা সরবরাহ বজায় রাখা, এমনকি তা যদি জনগণের ঘাড়ে বিশাল বিদেশী ঋণ চাপিয়ে দিয়ে করতে হয়- তাও।
মুদ্রা ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করে প্রত্যক্ষভাবে বা ঋণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কল্যাণে তার ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বিআইএস-এর নীতি অনুযায়ী।
এশিয়া টাইমস অনলাইনে ‘দ্য বিআইএস ভার্সাস ন্যাশনাল ব্যাংকস’ শিরোনামে ২০০২ সালের এক নিবন্ধে হেনরি লিউ লেখেন, ‘বিআইএস নীতিমালা শুধু আন্তর্জাতিক বেসরকারি ব্যাংকিং ব্যবস্থাকেই শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। এমনকি তা জাতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে হলেও। আইএমএফ জাতীয় মুদ্রা ব্যবস্থার জন্য যা করে বিআইএস জাতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য একই কাজ করে। আর্থিক বিশ্বায়নের অধীনে জাতীয় অর্থনীতি কোনোক্রমেই জাতীয় স্বার্থকে প্রতিফলিত করতে পারে না।
এফডিআইয়ে (প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ) সবসময়ই বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডলার প্রাধান্য বিস্তার করে। এতে রফতানি উন্নয়নের বেলায় ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে এবং অনেক দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। আর এটা করে শুধু এফডিআইয়ের ডলার নিয়ন্ত্রিত সুদ প্রদান করতে হয় বলে। ’
সুতরাং এ যুদ্ধ কি সার্বিক তেলের জন্য অথবা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য? হয়তো উভয়ের জন্য এবং এমনকি পানির জন্যও। জ্বালানি, পানি এবং এগুলোর উন্নয়নের কাঠামো তৈরির জন্য বিশাল ঋণের নিজস্ব ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি জাতি বিদেশী ঋণ ও সেই ঋণদাতা বিদেশীদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে নিয়েছে।
এখানেই লিবিয়া আন্তর্জাতিক সুদের কারবারীদের কাছে সত্যিকারের ভীতি হিসেবে দেখা দিয়েছে। তারা বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে পেরেছে, হ্যাঁ, এটা সম্ভব। অনেক দেশেরই হয়তো তেল নেই। কিন্তু নতুন প্রকৌশল ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব। এই ব্যবস্থা তেল উৎপাদন করে না এমন সব দেশকে জ্বালানি পরাধীনতা থেকে মুক্ত করতে পারে।
বিশেষ করে জাতির নিজস্ব সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অবকাঠামো তৈরির ব্যয় অর্ধেক কমিয়ে এনে এটা করতে পারে। জ্বালানি-স্বাধীনতা সরকারগুলোকে আন্তর্জাতিক ব্যাংকারদের ঋণ জাল থেকে মুক্ত করতে পারে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের ঋণ শোধের প্রয়োজনে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বিদেশী বাজারের জন্যও তাদের উৎপাদনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
গাদ্দাফির যদি পতন ঘটে, তাহলে একটি মজার বিষয় লক্ষ্য করার মতো হবে, নতুন এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি কি বিআইএসএ যোগদান করে কিনা এবং জাতীয়করণকৃত তেলশিল্প বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করা হয় কিনা কিংবা বিনা ব্যয়ে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাটি টিকে থাকে কী-না।
দেখুন, http://bit.ly/en8oNQ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।