আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিলেটী বিয়ে

হট বাংলা মোঃ নাজমুল ইসলাম মকবুল বিয়ে নিয়ে ছোট্ট একটি ছড়া লিখেছিলাম। যার প্রথম চারটি লাইন হলোঃ- বিয়ে মানে খুশির খবর / বিয়ে মানে যুগল মন / বিয়ে মানে মুচকি হাসি / বিয়ে মানে এক দুজন। বিশ্ব সেরা খুশির খবরঃ গ্রীনিজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এ বিশ্ব রেকর্ডধারী সবকিছুর নাম লিপিবদ্ধ করা হলেও বিশ্ব সেরা খুশির খবর কোনটি? ওখানে তার স্থান দেয়া হয়েছে কি না তা আমাদের জানা নয়। তবে আমার মতে যদি স্থান দেয়া হয় তবে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে বিয়ের খবর বা সংবাদটাকেই। কারণ বিয়ের খবরে হবু বর ও কনের মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ-খুশি উদ্বেলিত হয় তা দ্বিতীয় কোন সংবাদে হতেই পারে না।

সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ (ছিল্লখ) আছে ‘মাইজিয়েও কইন (বলেন) বিয়া, বাবাজীয়েও কইন বিয়া, কুলকুলাইয়া আসি উঠে গিয়া। ’ সিলেটাঞ্চল ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার বিয়ের হালচালঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্ন জাতিতে, বিভিন্ন ধর্মে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার অনুযায়ী বিয়ের বৈচিত্রময় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয়, এবং কম-বেশী ফুর্তি-ফার্তিও হয়। তাই রাষ্ট্র, ধর্ম, সংস্কৃতি ও এলাকাভেদে বিয়ের আচারানুষ্ঠানে বিভিন্নতা দেখা যায়। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের সিলেটাঞ্চল ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার বিয়ের হালচাল কেমন একটু তাকিয়ে দেখি সেদিকে।

লন্ডন যাওয়ার সিঁড়ি বিয়েঃ বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট। তাইতো বিয়েতেও প্রভাব ফেলে এই প্রবাস জিন্দেগী। বিলেত, আমেরিকা, কানাডা সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে সকল প্রবাসী বৈধভাবে বসবাস করেন তারা স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে সেখানে নিয়ে বসবাস করতে পারেন। সে সকল দেশে বাংলাদেশের ন্যায় দুর্নীতির মহোৎসব, লুটপাট, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ঘুষ ও বেকারত্ব তুলনামূলকভাবে অনেক কম, উন্নত যোগাযোগ ও জীবন ব্যবস্থা, যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক ব্যবস্থা থাকায় মানুষ সেসব দেশে যেতে ও বসবাস করতে দারুন আগ্রহী। আর সে সব দেশে যাওয়ার অন্যতম সিঁড়ি হচ্ছে বিয়ে।

তাই অধিকাংশ মাতা-পিতা বা অভিভাবক ছেলে অথবা মেয়েকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে হলেও লাল পাসপোর্টধারী কারো সাথে বিয়ে দিয়ে এসব দেশে পাঠাতে পারলে নিজেকে চরম সৌভাগ্যবান মনে করেন। এ পর্যায়ে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত, সুশ্রী যুবক-যুবতীর মা, বাবা মান্নত করে রাখেন তাদের ছেলে/ মেয়েকে বিলেত প্রবাসী পাত্র/ পাত্রী ছাড়া বিয়ে দেবেন না। ‘বাইরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট’ হলেও আপত্তি নেই, লাল পাসপোর্টধারী হলেই হলো। কালো টাকা, দালালী ও যৌতুকের ছড়াছড়ির মাধ্যমে বিয়েকে আজ-কাল এক ধরনের বেচা-কেনার অনুষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাস্তব একটি উদাহরণ না দিয়ে পারছি না।

আমার এক বন্ধু সেদিন আফসোস করে বললেন ‘তাঁর পরিবারের প্রায় সবাই প্রবাসী হওয়ায় এবং চলমান বিবাহ বিচ্ছেদ সহ নানা ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে (সুশ্রী, শিক্ষিত ও প্রচুর সম্পদশালী হওয়া সত্বেও) দেশের কোন মেয়েকে বিয়ে করে দেশের সহায় সম্পদ দেখা শুনা সহ নিজ দেশেই প্রতিষ্ঠিত থাকতে চান। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। নিজ ফ্যামিলির সাথে ম্যাচিং করে এমন ভাল, ধার্মিকা, শিক্ষিতা, সুন্দরী ও বংশধর কোন মেয়ে পাওয়াই মুশকিল। যা পাওয়া যায় সবই বিলেতি পাত্রদের জন্য মান্নত করা। ’ তাঁর মতো স্ব-দেশি বরের কাছে অনেকেই পাত্রী দিতে রাজী হন নাই।

এ জন্য আমাদের সমাজে বিবাহ বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। কারণঃ বিলেত প্রবাসী বরের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে প্রায় সবাই আগ্রহী। তবে এতে অনেকে সফলও হচ্ছেন এবং আর্থিকভাবে হচ্ছেন লাভবান, স্বল্প সময়ে অগাধ ধন-সম্পদ ও প্রচুর অর্থ, বিত্তের মালিক। ছেলে বা মেয়ে আর্থিকভাবে হচ্ছে সু-প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তেমন একটা চিন্তা করতে হয় না। আবার অনেকে হচ্ছেন ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত।

কারণ পাত্র বা পাত্রী বিলেত প্রবাসী হওয়ায় ওদের প্রকৃত চারিত্রিক ও পারিবারিক খোঁজ খবর না নেয়ায় ও তড়িগড়ি করে বিয়ে দেয়ায় বিয়ের পর দেখা যায় বর মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল বা হেরোইন আসক্ত, অর্ধপাগল বা পরকিয়া প্রেমের শিকার। তখন সংসারে আসে বৈশাখী ঝড় ও চরম অশান্তি। অনেক ক্ষেত্রে মেহেদীর রঙ শুকাতে না শুকাতেই বিয়ে ভন্ডুল হয়ে যায়, প্রবাসে আর যাওয়া হয় না। আর প্রবাসে কোনরকমে গেলেও পোহাতে হয় চরম দুর্গতি। কারণঃ উভয়ের মনের মিল না হলে বিয়েতে শান্তির বদলে অশান্তিই সৃষ্টি হয় বেশী।

রাসুল (সাঃ) বলেছেন ‘নেক বিবি হলে দুনিয়ায়ই বেহেস্তের সুখ-শান্তি কিছুটা পাওয়া যায়। আর বেহায়া বিবি হলে দুনিয়াই দোযখ। ’ ঘটকালী ও বিয়ের প্রস্ত্ততি যেভাবেঃ এবার বিয়ের প্রস্ত্ততি নিন। পুস্তকের প্রারম্ভে যেভাবে ভূমিকা লিখার দরকার হয় বিয়ের প্রারম্ভে দরকার হয় ঘটকের। আগেকার যুগে ঘটকদের ছিল দারুণ কদর ও সম্মান।

কারণঃ তারা টাকা পয়সা নিতেন না। মিথ্যে বলতেন না এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত সম্মানিত ব্যক্তিরাই এ কাজ করতেন সওয়াবের উদ্দেশ্যে। বর্তমানে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ‘ঘাটে কালারুকায় মিলাইয়া’ যে যত বেশি মিথ্যে বলতে পারেন সেই ঘটকালিতে তত বেশি চ্যাম্পিয়ন। চুক্তির মাধ্যমে অথবা ছয় চার করে টুপাইস কামানোর এই সহজ পদ্ধতিকে অনেক বেকার লোকেরাই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

তাদেরকে বলা হয় রায়বার বা বিয়ের দালাল। এই দালালীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে-বেনামে পাত্র/পাত্রী অনুসন্ধান কেন্দ্র। গড়ে উঠেছে জমজমাট ব্যবসা। যাদের নির্ধারিত অফিস নেই তাদের অফিস হলো শহর বা বাজারের নিম্নমানের হোটেল-রেস্তোঁরা বা অন্যান্য পরিত্যক্ত জায়গা। তবে এর মাধ্যমে কোটি কোটি বেকারের এই দেশে বেকারত্বের হার কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে বলা যায়।

তাই ঘটকদের জন্য দেশের প্রতিটি থানা সদরে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে অফিস করে রেট নির্ধারণ করে দিয়ে রসিদের মাধ্যমে টাকা পেমেন্টের সুযোগ করে দিলে ঝগড়া-ঝাটি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত এবং এ থেকে সরকার ভ্যাট বা ট্যাক্স উত্তোলনের মাধ্যমে আয় করতে পারতো প্রচুর নগদ অর্থ যা দেশের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দের নামে মজা করে ভাগবাটোয়ারা করা যেত। বর্তমানে প্রবাসী পাত্র/পাত্রীর অভিভাবকরাও চুক্তিভিত্তিক ঘটকালী করতে দেখা যায়। যেমন বর বা কনের বাবা, ভাই, চাচা, মামা, দুলাভাই বা কোন আত্মীয় যার প্রভাব ও পরিবারে খাটে। তারা ওয়ানটাইম ঘটকালী করে ৫/৭ লাখ বা তারও বেশি টাকা এককালীন পকেটস্থ করতে শুনা যায়। পাত্রী মনস্থ হওয়ার পরঃ ঘটকের বা অন্য কোন মাধ্যমে পাত্রী মনস্থ হওয়ার পর কনে পক্ষ বরের নাম ঠিকানা রাখেন।

গোপনে ওই ফ্যামিলির জাত-মত ও সহায় সম্পদের খবর নেন। আগেকার যুগে খবর নেয়া হতো কার হাড় ‘নরম’ কার হাড় ‘টনটনা’। এখন বলা হয় ‘ভাতের ঘরে জাত’। পাত্র দেখা হয় বাজারের হোটেলে বা অন্য কোথাও। পাত্র পছন্দ ও ফ্যামিলি মনোপুত হলে পাত্রী পক্ষ রায়বারের (ঘটক) কাছে তারিখ দেন কনে দেখার, তবে বিলেত প্রবাসী হলে তেমন একটা দেখার প্রয়োজন মনে করেন না অনেকেই।

হবু বর মিষ্টি-মিটাই ও সাথে দুলাভাই, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে যান কনের বাড়িতে। মহা ধুমধামে হয় ভুড়িভোজন। পরে কনে দেখা। ফাঁকি রোধ কল্পে সাথে নেয়া হয় মহিলা। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা হয়।

অপছন্দ হলে সরাসরি কিছু না বলে বলা হয় ‘বুঝিয়া জানাইমু’ এবং কোথাও সাময়িক কিছুটা উপঢৌকন দেয়া হয় কোথাও আবার দেয়া হয় না। আর পছন্দ হলে সালামী (টাকা বা উপঢৌকন) আদান প্রদান করা হয়। চিনি-পানঃ নির্দিষ্ট তারিখে কনের বাড়িতে আবার বর পক্ষের নেতৃস্থানীয় আত্মীয়রা বিয়ের তারিখ, লেনদেন ও বিয়ে সংক্রান্ত আলাপ আলোচনার জন্য যেতে হয়, আগে থেকে বা চুপিসারে বিস্তারিত পাকাপোক্ত করা থাকলেও স্বজনদের খুশি করতে তাদের দাওয়াত দিয়ে একটা নাটক মঞ্চস্থ করতেও দেখা যায়। ওটাকে বলা হয় দুধ-পান বা চিনি-পান। আগেকার যুগে নাকি গরুর দুধ এবং পান-চিনি সাথে নিয়ে যাওয়া হতো, তবে বর্তমানে নেয়া হয় মিষ্টি-মিটাই।

ওইদিন মোহরানা লেন-দেন সহ বিয়ে ও আকদের নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক হয়। অনেক অসাধু ও পরসম্পদলোভী অভিভাবকরা এদিন বা সুযোগমতো কোন একদিন দাবি করেন যৌতুক এবং আদায়ও করেন সময়মতো। যৌতুকঃ বর্তমান সমাজে যৌতুক প্রথা এতো মহামারি আকারে বেড়ে চলেছে যার দরুন দাম্পত্য জীবনে শুরু হয় চরম অশান্তি, নারী নির্যাতন, খুন ও বিবাহ বিচ্ছেদ। এ জন্য অনেক গরীব পিতা-মাতা অর্থাভাবে উপযুক্ত, শিক্ষিতা ও সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতে না পেরে অত্যন্ত অনুতাপে দিনাতিপাত করছেন। যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে একটা বহুল প্রচলিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

অথচ রাসূল (সাঃ) বলেছেন ‘বিবাহে যে যৌতুক তলব করবে আল্লাহ তাকে দারিদ্র্য ও আযাব ছাড়া আর কিছুই দেবেন না। ’ এটা কেহ ভাবেন না যে পিতা মাতা তাঁর স্নেহের নিজ কন্যাসন্তানকে আঠারো/ বিশ বৎসর নিজে খেয়ে না খেয়ে সীমাহীন কষ্টে লালন পালন ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে খাওয়ায়ে পরায়ে বড় করার পর পাথরে বুক বেঁধে নিয়তির অমোগ বিধানের কাছে হার মেনে একমাত্র কন্যার সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে সাধ্যমতো অর্থকড়ি ব্যয় করে তুলে দেন অপরিচিত এক ছেলের হাতে। ওই ছেলের সেবা করার জন্য। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় হবু বর বা তার মাতা পিতা, আকদের পর বা বিয়ের দু-একদিন পূর্বে অথবা পরে কনের কাছে বা কনের পিতার কাছে দাবি করেন যৌতুক। মোটর সাইকেল, কার বাসার জায়গা, নগদ টাকা, বিদেশ পাঠানো, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি।

সুচতুর বর পক্ষ কনে পক্ষকে নাজেহাল করার জন্য বিয়ের দু-একদিন পূর্বে তা জানিয়ে দেয়। যাতে কনের পিতা (যেহেতু সকল আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়া হয়ে গেছে এবং লোকজন ওই মেয়ের বিয়ের সংবাদ জেনে গেছেন) লোকলজ্জায় সে আবদার পূরণ করতে বাধ্য হন। যদি না দেন তবে বিয়ে ভন্ডুল করে দেয়ার হুমকি। তাই অনেকেই অনিচ্ছা সত্বেও মুসিবতে পড়ে যৌতুক প্রদান করেও কন্যা বিয়ে দিতে বাধ্য হন। লোকজন যাতে শুনতে না পান সেজন্য আইনের দ্বারস্থ হন না।

তবে কোন কোন জাদরেল পিতা বর পক্ষের চাহিদামতো যৌতুক প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানান এমন নজিরও পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে জনৈক এডভোকেটের কন্যার বিয়ের একটি উদাহরণ দেয়া যায়। এডভোকেটের মেয়ের বিয়ের তারিখ ও সবকিছু ঠিকঠাক। বিয়ের দু-দিন পূর্বে বর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হলো হবু বর সাহেব যৌতুক হিসেবে চান একটি নতুন ঝকঝকে মোটর সাইকেল। তা অবশ্যই দিতে হবে নতুবা এ বিয়ে হবে না।

এডভোকেট সাহেব রাজী হয়ে গেলেন। বিয়ের নির্দিষ্ট দিনে দাওয়াতী মেহমান সহ বর পক্ষ সবাই আসলেন আনন্দে আটখানা হয়ে। এডভোকেটসাহেব একটি নতুন সুন্দর মোটর সাইকেল এনে সাজিয়ে রাখলেন নিজ বাড়িতে। বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে এমন সময় এডভোকেট সাহেব উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন গোস্তাখী মাফ করবেন! আপনারা ধৈর্য সহকারে আমার কথাগুলো শুনুন। সবাই থ মেরে রইলেন।

এডভোকেট সাহেব শুরু করলেন। আমার হবু দামান মিয়া বিয়ে করবেন একটি মোটর সাইকেল। আমার মেয়ে বিয়ে করা তার উদ্দেশ্য নয়। তাই আমার মেয়েকে উনার কাছে কোনক্রমেই বিয়ে না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রিকোয়েস্ট আসতে পারে ভেবে গতকালই আমার মেয়েকে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।

তাই আমার অনুরোধ দয়া করে আমার হবু দামান মিয়া এই মোটর সাইকেলটিকে বিয়ে করে নিয়ে চলে যান। আজ আমি কাউকে কোন ধরনের আপ্যায়ন করাতে পারবো না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বর পক্ষ উচিত শিক্ষা ও সীমাহীন লজ্জা, ভৎর্সনা পেয়ে এডভোকেট সাহেবের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যকলাপ না করার শর্তে কোনমতে সে স্থান ত্যাগ করলেন। আসল কথা হচ্ছে দেশে আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। আর বিয়ে একটি স্পর্শকাতর বিষয়।

অনেক মহিলা নির্যাতিতা হয়েও বিবাহ বিচ্ছেদের ভয়ে বা লোকলজ্জার ভয়ে ইচ্ছে থাকা সত্বেও আইনের দ্বারস্থ হন না। আমাদের দেশের মহিলারা অত্যন্ত স্বামীভক্ত ও ধর্মপরায়ণ। তারা জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদ কাম্য মনে করেন না এবং দুই স্বামী গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেন। তাই তারা মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করেন। আবার কেহবা ক্ষোভে অভিমানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।

আক্দঃ কারো কারো বিয়ের ক’দিন পূর্বেই আক্দ অনুষ্ঠান হয়। এতে গীত গেয়ে মেহেদী লাগানো সহ আড়ম্বর ও অনাড়ম্বর বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতে দেখা যায়। এ অনুষ্ঠানে কনের পিতা বা অভিভাবক আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করাতে হয় স্থানীয় রেস্তোরায়। এতে কনে পক্ষেরই অধিক পরিমাণে খরচ হতে দেখা যায়। বিয়ের আয়োজনঃ উভয় পক্ষ কার্ড ছেঁপে আরম্ভ করেন দাওয়াত দেয়া।

কারো আকদ ও বিয়ে হয় দু-দিনে তবে বর্তমানে বাড়তি খরচ ও ঝামেলা এড়াতে বেশিরভাগ লোক একদিনেই এ কাজ সম্পন্ন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বিয়ের দু-তিন দিন পূর্বেই শুরু হয় বিভিন্ন আচারানুষ্ঠান। নির্দিষ্ট তারিখে উভয় পক্ষের মুরববী, আত্মীয়-স্বজন, দুলাভাই সহ বর-কনের পোষাক, গয়না ইত্যাদি কেনা হয়। কেনাকাটায় পছন্দ-অপছন্দ, এই দোকান-সেই দোকান, বেশদামী-কমদামী ইত্যাদি নিয়ে কোথাও ঝগড়া ঝাটি, হাতাহাতি এবং বিয়ে ভন্ডুল হতেও দেখা যায়। আবার কেনাকাটায় বর্তমানে কোথাও কোথাও দালালীর মাধ্যমে বিনা মেহনতে টু-পাইস কামাতেও দেখা যায় অনেককেই।

কনের শাড়ি-গয়না ইত্যাদি বিয়ের আগের দিন পাঠিয়ে দেয়া হয় কনের পিত্রালয়ে। উভয়ের বাড়িতে বিয়ের আগের দিন থেকেই বিভিন্ন ধরনের গেইট ও রঙ বেরঙের হরেক রকম বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। গভীর রাতে শুরু হয় মেহেদি সন্ধ্যা ও সম্পূর্ণ ওপারের হিন্দু সংস্কৃতি থেকে নব আমদানিকৃত গায়ে হলুদ নামক নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় একটি অনুষ্ঠান, যাতে আজে বাজে কিছু কর্মকান্ড ছাড়াও ব্যয় হয় প্রচুর অর্থ। পুরুষ-মহিলা সংমিশ্রণ, বিজাতীয় অপসংস্কৃতি ও সীমাহীন অপব্যয়ের কারণে এসব অনুষ্ঠান ইসলাম কোন মতেই অনুমোদন করে না বরং লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো এসব অপরাধমূলক অনুষ্ঠান না করে এ টাকা দিয়ে বিভিন্ন দরিদ্র সম্পতির বিবাহকার্যে সহযোগিতা করলে অশেষ পূণ্য অর্জন সম্ভব হতো। ওই রাতেই বর কনের হাতে মহিলারা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গীত (হাতে লাগাও মেন্দি সাজাও দামান/ কন্যা........)/ (আইলা দামান বইলা খাটো, হাতে হাতে মেন্দি বাটো........)/ (মেন্দির এ রাতে হাতে মেন্দি লাগিয়ে সাজে কন্যা যাবে শ্বশুর বাড়ি.........) গেয়ে গেয়ে মেহেদী লাগানো হয়।

উল্লেখ্য শুধুমাত্র মহিলাদের বা কনের জন্য হাতে মেহেদী লাগানো ইসলাম অনুমোদন করে, মহিলাদের সৌন্দর্যের জন্য যেমন অলংকার ব্যবহার করা হয় ঠিক সেভাবে তাদের জন্য মেহেদীও একটি অলংকার স্বরূপ, বর বা পুরুষদের জন্য এ অলংকার নয় তাই হবু সকল বরদের তা পরিত্যাগ করা উচিত। বিয়ের পূর্বের রাতে কনের বাড়িতে গরু জবাই করে শুরু হয় রান্না-বান্না ও স্টেজ বাঁধার হিড়িক। পরদিন সকালে বরপক্ষ ও দাওয়াতীদের বসার জন্য তৈরী করা হয় চেয়ার টেবিল সাজানো ও স্টেজ বাধার অসম্পূর্ণ কাজ। আসতে থাকেন আত্মীয়-স্বজন, ইস্টি-কুমুট নতুন অথবা সুন্দর সুন্দর জামা পরে। এরপর অপেক্ষার পালা, কবে আসবে কাঙ্ক্ষিত সেই ক্ষণ।

আসবে নতুন বর, শুরু হবে বিয়ের আয়োজন। বাচ্চা-কাচ্চারা করে নানান ধরনের ফুর্তি-ফার্তি, দৌড়াদৌড়ি, হৈ-চৈ। গেইটের পাশে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে বরযাত্রীর বহর আসছে কি? গ্রামে বা মহল্লায় দাওয়াত দেয়া হয় ‘পান তামাক খাইতা, নউশা তুলতা’। আগেকার যুগে বিয়ের দিন সকালে বরের বাড়িতে আনা হতো নাপিত। উঠোনে একটি চাটাই (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় আদি) এর উপর একটি খাটে বরকে বসিয়ে চুল কাটা ও শেভ করানো হতো, এরপর অন্যান্যদেরও।

নাপিত সামনে একটি রুমাল বা গামছা বিছিয়ে রাখতো। সেখানে ইষ্টি-কুটুম পড়সীরা টাকা দিতেন সাধ্যমতো। বর্তমানে বিউটি পার্লারের যুগ। তবে চুল কাটার অনুষ্ঠান তেমন একটা চোখে পড়ে না। গ্রামের ঘরে ঘরে দাওয়াত দেয়া হয় ‘নউশা হাজাইতা, পান তামাক খাইতা’।

তবে এখন সিগারেট, বিড়ি, চা, পান ইত্যাদি ছাড়া তামাকের প্রচলন নেই। এরপর বরকে হলুদ দিয়ে গোসল দেয়ানো হয় সাথে হৈ-হুল্লোড়, কাঁদা ছুড়াছুড়ি ও সমবেত কণ্ঠে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গীত গাওয়া। (হলদি মাখাও সাজাও নউশা হক্কলে মিলিয়া, নয়া কইন্যা আনবা নউশায় মুখে রুমাল দিয়া/ মাথায় দিবা পাগড়ী আরও শেরওয়ানী পিন্দিয়া, নয়া কইন্যা আনবা নউশায় মুখে রুমাল দিয়া.......) দাদী ভাবীরা বরের জন্য থাল সাজিয়ে রাখেন, শুরু হয় বিচিত্র সাজের থাল খাওয়া। এবার বরকে পরানো হয় পোষাক। চাটাইয়ের উপর বিছানা চাদর (ছতরং) বিছিয়ে দুলাভাই-দাদা-নানা ও বন্ধু-বান্ধবরা পোষাক, শেরওয়ানী ও পাগড়ী পরান নতুন বরকে, পাগড়ীতে একটি সেপটিপিন গেঁথে রাখা হয় নাহলে নাকি (পারে না) অমঙ্গল হবে, স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য রেকর্ড করা হয় অনুষ্ঠান।

মুচকি মুচকি হেসে বর সালাম করেন মুরববীদের। এক গ্লাস দুধ পান করানো হয় বরকে। এবার শুরু হয় শুভাযাত্রা। (সিলেটিয়া রঙিলা দামান যাইতা শ্বশুর বাড়ীগো যাইতা শ্বশুর বাড়ী......)/ বিয়ার গীত গাও গো, পানর বাটা লও গো, দামান যাইতা শ্বশুর বাড়ি তাড়াতাড়ি আওগো....)/ (সোনার বান্দাইল নাও পিতলের ঘোড়ারে, পিতলের ঘোড়া, ও রঙের ঘোড়া দৌড়াইয়া যাও.....)। বরের বোন এক চিমটি চাল বরের উপরে ছিটিয়ে দিয়ে বলেন ‘মাইজিয়ে যেনে কইছলা মনো রাখিও’।

এতে নাকি বর সারাদিন চিন্তায় থাকবে মাইজিয়ে কি বলেছিলেন। জামাই যাবে শ্বশুর বাড়িঃ এবার উঠা হয় যানবাহনে। বর্তমানে ইডি কার, লুসিডা, মার্সিডিজ বা জিপ, টংটং, সিলসিলা ঘোড়ার গাড়ি, হাতি বা হেলিকমের হেলিকপ্টার চড়ে সেজে গুজে শুভাযাত্রা সহকারে রওয়ানা দেন নতুন বর। বরের সাঁজানো গাড়ি সামনে চলে পিছনে সারিবদ্ধভাবে চলতে থাকে বরযাত্রীদের মাইক্রো (লাইটেস)। রাস্তায় রাস্তায় ছবি তোলার জন্য দাঁড়াতে কিংবা স্লো চলতে হয়।

এভাবে পৌছে যান কনের পিত্রালয়ে বা নির্ধারিত কমিউনিটি সেন্টারে। শালা-শালী গেইটে সুতা দিয়ে বেঁধে স্লিপ রাখেন গেইট পাস...... টাকা। টাকা নিয়ে কোথাও দেন দরবার হয় কোথাও হয় না। গাড়ী থেকে নেমে বরযাত্রী সহ বর হাটি হাটি পা পা করে ঢুকতে থাকেন শ্বশুরালয়ে কিংবা নির্ধারিত কমিউনিটি সেন্টারে। ছিটানো হয় ফুলের পাপড়ি, জানানো হয় ওয়েলকাম, সাদর সম্ভাষণ, ক্যামেরাগুলো উঠে ক্লিক ক্লিক করে।

ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে বর নির্ধারিত জায়গায় (কুঞ্জে) অনুমতি নিয়ে সালাম দিয়ে বসে পড়েন, সাথে বসেন দুলাভাই, বন্ধু-বান্ধব বা দাদা-নানারা। অন্যান্য চেয়ারে বরযাত্রী। কনে বাড়ির লোকেরা বরের চেহারা-ছুরত কেমন তা দেখার জন্য উকি ঝুঁকি মারেন, মহিলারা দেখেন বিভিন্ন ফাঁক ফোকর দিয়ে। সাথে নেয়া হয় মিষ্টি, জিলাপী ও পান সুপারী। ওগুলো সাধারণতঃ সমাজের দরিদ্র মানুষদের মাধ্যমে বহন করানো হয়।

তাদেরকে ভাবা হয় নিচু বা ছোট লোক বা হয় ‘ফুরু মানুষ’ (অথচ বিশ্বের সকল মানুষ একই আদম ও হাওয়া থেকে সৃষ্ট)। আশপাশ বাড়িতে পানদান দিয়ে পান-সুপারী পাঠানো হয়, ওরা পানদানে দেন সাধ্যমতো টাকাকড়ি। পূর্বে আকদ না হলে শুরু হয় আকদ (ইজাব-কবুল) এর আয়োজন। উকিল প্রথমে কনের কাছে একটি সাজানো পান্দান নিয়ে দুজন স্বাক্ষী সহ গিয়ে বলেন (ক এর) ছেলে (খ) এর টাকা মোহর (বেশির ভাগ বাকি যা পরে আর আদায় করা হয় না) দিয়ে আমাকে উকিল পাটাইছইন, তোমার জজইয়তে কবুল নি? কনে কিছুটা কালক্ষেপন করেন এবং উপস্থিত সকলের পীড়াপীড়িতে বহুক্ষণ চিন্তাফিকির করে অবশেষে কবুল বলেই পাশে বসা মহিলার গলায় ধরে কান্নাকাটি শুরু করেন (ও শুনা মাইজিগো, ও শুনার বাবা রেবো)। এ সময়কার দৃশ্য বাংলার অন্যতম প্রধান কবি আল-মাহমুদ এর কবিতায় চমৎকারভাবে এসেছে এভাবেঃ আবরু আলগা করে বাঁধোফের চুলের স্তবক চৌকাট ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী সনানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক বধুবরণের লাগি দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল কবুল।

। এরপর ওরা আসেন বরের পাশে। বলেন..... গ্রাম নিবাসী অমুকের মেয়ে তমুক এত টাকা মোহর...... কবুল নি? বর মুখে রুমাল দিয়ে কিছুটা কালক্ষেপন করে মুচকি হেসে অবশেষে বলেন কবুল। শুরু হয় ইমাম সাহেবের খুতবা পাঠ ও দোয়া। বিতরণ করা হয় খেজুর বা জিলাপী।

এবার বরের টেবিলে শরবত। শুরু হয় ভোজন পর্ব। খাবার মেনুতে সালাদ, কাঁচামরিচ, রুষ্ট/ঝালফ্রাই, মুগ ডাল/ সবজি, কাবাব, গরু, খাসি ভুনা, দই এবং রঙিন ও সাদা ভাত। ইদানিং অভিজাত শ্রেণির বিয়েতে ব্যয়বহুল মাছও পরিবেশন করতে দেখা যায়। খাবার পর বরযাত্রীরা যে যারমতো চলে যান।

বরকে দেয়া হয় শ্বশুর বাড়ির পোষাক (স্যুট-সাফারী ইত্যাদি) বর পাজামা-শেরওয়ানী খুলে শ্বশুর বাড়ির জামা পরেন মহানন্দে তবে বর্তমানে শহরাঞ্চলে শেরওয়ানীই থাকে বরের গাঁয়ে এগুলো পরিধান করেন পর দিন ওয়ালিমা অনুষ্ঠানে। বর-কনেকে নিয়ে একই মঞ্চে বসানো হয়, শুরু হয় মালাবদল, আংটি বদল, শরবত পান, বর কনেকে মাল্যদান, সালামী দেয়া, আত্মীয়দের পরিচয়পর্ব, কনেকে বরের কাছে মা-বাবার সঁপে (সমজে) দেয়াসহ রকমারী আয়োজন। শালা-শালীরা নয়া দুলাভাইয়ের গলায় মাল্যদান করেন এবং তাদেরকে দেয়া হয় উপঢৌকন হিসেবে নগদ টাকা। কোন কোন জায়গায় শালা শালীরা নয়া দুলাভাইকে ধাঁধা (পই) দেন ভাঙানোর জন্য, তবে বর্তমানে তা অনেক হ্রাস পেয়েছে। যেমনঃ পানদান দিয়ে বলা হয়ঃ ‘পান খাও পন্ডিত ভাই, কথা মাতো টারে/ এই পান জন্ম লইছে কোন পরিস্তানে যদি না কইতায় পারো এই ভেদের কথা/ ছাগল অইয়া ছিবাইয়ায় এই পান পাতা।

’ জীবনের এই স্মৃতিময় দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে অনেকে প্রকাশ করেন ‘বিয়ে স্মারক’। যদ্দুর জানা যায় সেকেলে যুগে গাড়ির সংখ্যা কম এবং রাস্তা-ঘাট কাঁচা ছিল বিধায় চার বেহারার পালকি চড়ে নতুন বর যেতেন শ্বশুরালয়ে, আর বরযাত্রীগণ (বৈরাতী) হেটে হেটে যেতেন। বর্ষাকালে অথবা নৌকা চলার সুযোগ ও সামর্থ থাকলে যাত্রা হতো পানসি নৌকা চড়ে এবং বাঁজানো হতো মাইক। বর সাহেব পায়ে দিতেন পেছন দিকটা উঁচু সু জুতা, হাঁটার সময় যা ঘট ঘট শব্দ করতো, সু জুতা নিজের না থাকলে ধার করে আনতেন। (এখনও সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে অধিকাংশ বিয়ে নৌকা দিয়েই হয় এবং মালদার পার্টি হলে নৌকায় মাইক বাজানো হয় শান শওকতের সাথে)।

বরযাত্রীরা অডিও টেপ সঙ্গে করে নিতে দেখা যেতো, যাতে অনবরত বাজানো হতো বিয়ে বা মালজুড়া গান। কেহবা (দুশ্টুমি করে) কনে তোলার সময় কনের কান্না রেকর্ড করতেন। কনের বাড়িতে উঠার সময় আতশবাজী, পটকা (গোল্লা) ফুটাতেন। বরের মুখে সব সময় হাতের ফুল তুলা সাদা রুমাল থাকতো ভাজ করা। কদিন পূর্বে আমার এক বন্ধুর বিয়েতে দেখলাম একটি ভাজ করা রুমাল গুজে মুখে চেপে ধরে আছেন।

আমি বললাম ‘রাখো তোমার রুমাল-টুমাল, ওখন আর ঢিফা দেওয়ার যুগ রইছে না’ সাথে সাথে তিনি মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে নিলেন। বিয়ে বাড়িতে অডিও টেপে বাজানো হতো বিয়ের গীত ‘আইলারে নয়া দামান আসমানর তেরা, বিছানা বিছাইয়া দেও শাইল ধানর নেরা দামান বও দামান বও’। অথবা (‘আইলারে নয়া দামান মুখে রুমাল দিয়া.....’) (সিলেটিরা নউশা, সাথে তান বৈরাতী......)। গেইট বাঁধা হতো কলাগাছ ও বাঁশ দিয়ে, তথায় রঙিন কাগজ কেটে লাগানো হতো, এ কাজ সাধারণতঃ কনে বাড়ির ছেলেমেয়েরা করত। গেইটের সামনে চেয়ার টেবিল রেখে টেবিলের উপর গ্লাস ভর্তি পানি ও শরবত রাখা হতো।

গ্লাস রাখা হতো উল্টিয়ে, উল্টানো গ্লাস বরকে সোজা করতে হতো। ঘরের ভেতর চাটাই এর উপর ছতরং এর উপর লাল কাপড় (দস্তারখা) বিছায়ে বরযাত্রীসহ বরকে বসানো হতো ফ্লোরে, গৃহের চতুর্দিকে রঙিন কাপড় (গীন্নি) দিয়ে প্যাচ দেয়া হতো, যাতে ঘরের বেড়া দেখা না যায়। তফাৎটা ছিল বরের দুপাশে থাকতো শুধু মাত্র দুটো বালিশ। বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে একরাত অবস্থান করতে হতো, খাবার মেনুতে থাকতো কোরমা (পাকা কুমড়া দিয়ে যা তৈরী করা হয়) পোলাও, বিন্নি ভাত, ফুলের বড়া, বেগুনের বড়া, গরুর গোশত, নারিকেলের মুরববা, মিটা তুরছি (নারিকেল ও গুড় দিয়ে যা তৈরী করা হয়), গরুর দুধ-দই সহ অনেক আইটেম। নিজের ঘরে দুধাল গাভী না থাকলে প্রতিবেশীরা কলসী দিয়ে দুধ পাটিয়ে দিতেন।

শালা-শালিরা মরিচ গুলে পানি ও রং ছিটাতো বরযাত্রীদের উপর, হৈ-হুল্লুড়, ঢং-তামাশা তো হতোই, সারা রাত কারো চোখে ঘুম নেই। অনেকে রাত কাটাবার জন্য তাস খেলতেন। পরদিন খেয়ে দেয়ে বরের পালকিকে কাপড় দিয়ে পেচিয়ে (ছুয়ারী বানাইয়ে) সেথায় কনেকে তুলে অথবা নৌকায় তুলে আনা হতো। বরের বাড়িতে গেইট বাঁধার ও ওয়ালিমার প্রচলন ছিল না। কনে বিদায়ঃ অতঃপর বিদায় বেলা।

আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের আনা প্রেজেন্টেশন ও কনের পক্ষ থেকে বরকে দেয়া উপঢৌকন বা যৌতুকের লিষ্টি দিয়ে মালামাল সমজে দেয়া হয়, অনেকে বরের সই নেন কপিতে। অপর কপি দেয়া হয় বর পক্ষের অভিভাবকের হাতে। এবার প্রস্থান। সুহৃদরা উভয় দিকে ধরে কনেকে নিয়ে গাড়িতে উঠেন হাটি হাটি পা পা করে। তুলে দেন গাড়িতে অথবা আত্মীয় স্বজন কেহ তুলে দেন কুলে করে, কনে কাঁদতে থাকেন উচ্চস্বরে অথবা নীরবে ফেলেন চোখের পানি।

হাউ মাউ করে অথবা নীরবে কাঁদতে থাকেন মা-বাপ আত্মীয় স্বজন। যা অসংখ্য গীতি কাব্যে ফুটে উঠেঃ (যাইবার সময় কইন্যায় কান্দইন মাইজির গলাত ধরিয়া অত মায়ার মাইজি থইয়া কেমনে বইতাম বিয়া)। / (জামাইর বাড়ি যাইতা কইন্যা সাজিয়া গুজিয়া, সাজিয়া গুজিয়া অত মায়ার কইন্যা আমার কেমনে দিতাম বিয়া)। / (হাজিয়া গুজিয়া নয়া কইন্যা.....)। বর উঠেন গাড়িতে।

অবসান হয় জীবনের স্মরণীয় স্মৃতিময় একটি দিনের। গাড়ি চলে যায় অদৃশ্যে। কনে তোলাঃ বিয়ে বাড়ির মহিলারা কনেকে ঘরে তুলেন দারুন খুশিতে। মুখে দেন চিনি কিংবা মধু, এতে নাকি কনে ওই বাড়িতে সারাজীবন মিটা মিটা কথা বলেন। শুরু হয় মহিলাদের দামাইল ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় গীতঃ (‘আইলারে নয়া কইন্যা......’।

)/ (দামান্দর মা সামনে বাড়ইন মুচকি মুচকি হাসিয়া, খুশি হইয়া নয়া কইন্যা আনইন ঘরে তুলিয়া, নয়া কইন্যা তুলইন মাইজিয়ে মুখে চিনি দিয়া, সারাজীবন মিঠা কথা মাথিবার লাগিয়া)/ ইষ্টি-কুটুম সবাই আসেন অনেক খুশি হইয়া, টেকা-টুকা সালামী দেইন নয়া কইন্যা দেখিয়া.....)/ (লিলাবালি লিলাবালি ভরও যৈবতী সইগো, কি দিয়া সামাইমু তোরে.....)। সারা রাত গীত আর ধুম-ধাম, কনে দেখা, ফুর্তি-ফার্তি, হৈ-চৈ, খাওয়া, দাওয়া। বিয়ের পরদিন এবং ওয়ালিমাঃ পরদিন সকালে কনে বাড়ি থেকে টিফিন দিয়ে খাবার পাঠানো হয় কনের জন্য। কেহবা ওয়ালিমা অনুষ্ঠান করেন মহাধুমধামের সাথে। অনুষ্ঠান হলে কনের বাড়ি থেকে আসে মিষ্টি-মিটাই আর স্বজনরা নিয়ে আসেন উপহার সামগ্রী, বাদ জোহর শুরু হয় ভুড়িভোজ।

তবে বর্তমানে ওয়ালিমার প্রচলন ক্রমশঃ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। সারাদিন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নতুন কনের মুখ দেখে টাকা পয়সা সালামী দেন এবং প্রদান করেন বিভিন্ন উপহার সামগ্রী। অনেকে কনে সম্পর্কে বিভিন্ন মন্তব্য করেন। বাজারখানীঃ বিকেলে বর সাহেবকে যেতে হয় বাজারে। সাথে দুলাভাই, বন্ধু-বান্ধব ও কনের সাথে আসা শালা-শালী।

শালা শালীদের জন্য কেনা হয় কাপড় চোপড় আর বাড়ির জন্য কেনা হয় মাছ (ঘনিয়া মাছ)। ভাবীরা আরও কিছু লিষ্টি দেন। যা হলো মিষ্টি পান, টিলার মাটি (ছিকড়), আরও হাবি যাবি। বাসর ঘর ঃ কবি আল মাহমুদ লিখেছেন সোনার দিনার নেই দেন মোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি ভালোবাসা দাও যদি আমি দেবো আমার চুম্বন ছলনা-জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি। ....................... লোবানের গন্ধে লাল চোখ দু’টি খোল রূপবতী ....................... বর্তমানে বাসর সাজানো হয় কাঁচা ফুল সহ বিভিন্ন রঙ বেরঙের ফুল দিয়ে।

দাদী-ভাবীরা বর-কনেকে পরিচয় করিয়ে দেন। বাসর ঘরে স্বামী-স্ত্রীকে টিলার মাটি খাওয়ানো হয় এ নিয়তে যে তাদের দাম্পত্য জীবনে যাতে ঝগড়া ফ্যাসাদ না লাগে, উভয়ের জীবনটা যেন মাটির মতো চলে। মাটি খেলে জীবনটা মাটির মতো চলার আজগুবী ফর্মূলা কে বা কারা আবিস্কার করলো তা কিন্তু জানা যায় নি। তাহলে উভয়কে বরফ খাওয়ালে ও মাথায় দিলে জীবনটা বরফের মতো ঠান্ডা হতো। কনেকে দিয়ে মহিলারা আরও নাকি অনেক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন যা এলাকা ভেদে ভিন্ন ধরনের হয়।

আড়াইয়াঃ পরের দিন যেতে হয় শ্বশুর বাড়ি। সেখানে গিয়ে আড়াই দিন থাকতে হয়, যা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় আড়াইয়া। শ্বশুর বাড়ি নতুন বরকে কোনক্রমেই মাছ দিয়ে নাকি খাওয়ানো যাবে না, যতদিননা বর স্ব-ইচ্ছায় শশুর বাড়ি মাছ নিয়ে না আসেন। (এখনও প্রায় বাড়িতে জামাই এলে নিজের মুরগী না থাকলে পাশের বাড়ি থেকে মুরগি বা আন্ডা এনে জামাই বাবাজীকে খাওয়ানো হয়, তবুও মাছ সামনে দেয়া হয় না, তাতে নাকি অমঙ্গল)। কনে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেময়েরা স্বমস্বরে ঐদিন বিকেলে ছড়া কাটতে থাকে- ঝিঙার ফুল ফুটিছে/ দামান আইয়া উঠিছে/ কন্যার মা ঘরো নিগো- ঘরো/ মুরগার ঠেঙো ধরো/ মুরগা দিলো ফাল/ খাইলায়নিরে বৈরাতীর পাল।

অথবা আগের নাওয়ে ঝুম্মুর ঝুম্মুর/ করের নাওয়ে বিয়া/ আইবা আমরার দুলাভাই মিষ্টি-মিটাই লইয়া/ পচা মিষ্টি খাবো না/ আমরার আপা দেবো না/ আপার মাথায় লম্বা চুল/ খোপার মাঝে গোলাপ ফুল। অথবা নয়া দুলাভাই আসলে তারা রসিকতা করে বলে ‘দুলা ভাই দুলা ভাই আগে আইলায়না/ গোশতর ঠেলাঠেলিয়ে ডাইলে পুষে না’। শ্বাশুড়ী নয়া দামান্দের জন্য হরেক রকম নাশতা ও খাবারের আয়োজন করেন। কারণ দামান্দের জন্য শ্বাশুড়ীর মমতাই আলাদা। কথায় বলে ‘পুতরা আইলে ধরো ধরো, দামান আইলে জবো করো।

’ দামান্দও শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় নতুন জামা অথবা ইস্ত্রি করা ভাল জামা পরে যান। কারণঃ শ্বশুর বাড়ি অসুন্দর জামা বা লুঙ্গি পরে যাওয়া বেমানান। তাইতো মহিলারা গেয়ে থাকেনঃ সিলট থাকি আইলা দামান লুঙ্গি কাপড় পিন্দিয়া/ ওই দামান্দর কাছে কেমনে মাইয়া দিতাম বিয়া। আড়াই দিন পর নউশা কন্যাকে সাথে নিয়ে আবার নিজ বাড়িতে চলে যান। শুরু হয় জীবনের নতুন এক অধ্যায়, স্বপ্নিল বর্ণিল কাব্যিক ছন্দময় জিন্দেগী।

এ যেন এক পরিপূর্ণ জীবন যা নিয়ে লিখেন নাই এমন কবি-সাহিত্যিক বোধ হয় পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। এ জন্যই বিয়ে হচ্ছে সামাজিক রীতি, ধর্মীয় প্রয়োজন, মানসিক প্রশান্তি তথা চিরন্তন শান্তি, সু-শৃঙ্খল জীবন, প্রাকৃতিক নিয়মের পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও পবিত্র জীবন ধারা। বিশ্বের সকল বর কনের জন্য তাদের কাঙ্ক্ষিত এ শুভ দিনে বয়ে আনুক আনন্দের বার্তা। ইসলাম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুসংগঠিত জীবন জাপন করার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিয়েছে। আদিকাল থেকেই বংশানুক্রমিক ধারা ও নব প্রজন্মের আবির্ভাব বিয়ে তথা স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমেই এ পৃথিবীতে হচ্ছে এবং হবে।

মহানবী (সাঃ) বলেছেন ‘আননিকাহু নিছফুম মিনাল ঈমান’ অর্থাৎ নিকাহ হচ্ছে ঈমানের অর্ধেক। মানব জীবনে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিয়ের মাধ্যমে মানুষ পরিপূর্ণ জীবনে পদার্পণ করে। আমার ছড়াটির শেষ লাইন কটি দিয়েই শেষ করছি আজকের সিলেটী বিয়ের আয়োজন ঃ বিয়ে মানে মনের সকল/ শুন্যতাকে হটিয়ে দেয়া/ বিয়ে মানে দুজনার মন/ একই সাথে বিলিয়ে দেয়া/ বিয়ে মানে একটু হাসি/ সোহাগ আদর ভালবাসা/ বিয়ে ছাড়া একা জীবন/ নিঃসঙ্গ ও সর্বনাশা। লেখক : সভাপতি, সিলেট লেখক ফোরাম [linkনবযুগ|http://www.dailynobojug.com/2012-03-28-09-30-41/659-2012-05-09-05-14-41.html| ] ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.