আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

''অসমাপ্ত স্বপ্নের অসমাপ্ত ফুলশয্যা'' [গল্প]

*১* মুসা ইব্রাহীম এভারেস্ট জয় করে এভারেস্ট এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে বিজয়ের পতাকা নিয়ে যেভাবে আকাশপানে তাকিয়ে বিজয়ের আভাস দিয়ে ছিলো,আমিও ঠিক ছয় তলায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে শেরোয়ানী পরে বিজয়ের হাসি দেওয়ার প্রচেষ্টায় নিমগ্ন । কেমনে কেমনে জানি শ্রদ্ধেয় পিতা ও পিতামহ কে রাজি করিয়ে জোছনাকে ঘরে বধু বেশে নিয়ে এনে এক অসাধ্য সাধন করে ফেলেছি। যদিও আমি এখনো স্টুডেন্ট। নিজের পকেট খরচ চালানোর মতই আমার কোন সামর্থ্য নেই। এত কিছুর পরেও বাবা বিয়ে করিয়ে দিতে রাজি হয়েছে এত অল্প বয়সে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ রইল শ্রদ্ধেয় আব্বাজানের কাছে।

কেন জানি আব্বাজানের প্রতি ভালোবাসা আজ স্বর্গ থেকে সরাসরি আগমন হচ্ছে। আম্মাজান তো একেবারে বউকে নিজের মেয়ে হিসেবেই গ্রহণ করে নিয়েছে ইতিমধ্যে । পুত্রের বউ পেয়ে আদর সোহাগ আমার জন্য কিছু বাকী রাখছে তা তো মনে হচ্ছে না আম্মাজানের ব্যবহার দেখে। আজকে বিয়ের দিনেও প্রতিদিনের মত বকা হজম করতে হচ্ছে। তাও দিচ্ছে একেবারে সদ্য বিবাহিত বউয়ের সামনে ।

বউ আনার সাথে সাথেই পুত্রের বউকে নিজের রুমে গিয়ে বসিয়ে রেখেছে । পাড়াপড়শিরাও ঘিরে ধরে বসেছে। এদিকে আমার মন কেমন জানি উতাল পাতাল করছিলো । স্বাভাবিক ভাবে বিয়ের দিন সবার মন যে রকম করে আরকি। নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জনের পথের যাত্রী...।

কয়েক বার ওই রুমে গিয়ে জোছনার সাথে একটু ফ্রি ভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেও হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে । ভাবলাম আজ রাতটাই মাঠি। তাই দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে নিজ রুমে বিয়ের প্রথম রাতেই বউবিহীন ঘুমাতে চলে এলাম । খাটের উপর শুয়েই পড়লাম ঠিক তখনি ভাবি আর দুলাভাইরা এসেই আমাকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিল। পরক্ষনে বুঝতে পারলাম ঘরটাকে নাকি তারা সাজাবে ।

প্রথমে তো ভাবলাম এইসব কিছুই হবে না,নিজের বাসর ঘর সাজানোর কথা কাউকে বলতে গেলেই লজ্জায় নাক কাটা পরে। যাক !তারা যে বেপারটাকে নিজের করে নিলো মনে মনে একটু উত্তেজিত হলেও চুপচাপ স্বভাবে রুম থেকে বাহির হয়ে ছাঁদে চলে আসলাম। আর পেছনের অতীত গুলোকে এক নজরে চোখ বুলানোর চেষ্টা করছিলাম। কাকতালীয় ভাবে আজকের দিনটাই ১২-১২-১২ । এই রাতের ইতিহাসে আকাশে কোন চাঁদ কিংবা জোৎস্না না থাকলে ও আমার চোখে চাঁদ দেখতে পাচ্ছি।

জোৎস্না গুলো আমার গায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে মনকে উদাস করে দিচ্ছিলো । অতীতের মুহূর্ত গুলোকে চোখের পলকে ভেসে উঠছিলো চাঁদের পলকবিহীন জোছনার আলোতে...... *২* শীতের কুয়াশার চাদরে মুড়ি মাখা স্নিগ্ধ সকালে সোসাইটির কুলিং কর্নারের কোণায় বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেহে প্রশান্তি তুলে নিচ্ছে রসিক মামা। ভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম আমি। যাওয়ার পথে আমাকে দেখে ডাক দিল,মামার সাথে বসে সঙ্গ দেওয়ার মত এই মুহূর্তে আমার হাতে বোনাস সময় নেই,তবুও ভদ্রতার সহিতে গিয়ে বসলাম। কথার মাঝে হঠাৎ রসিক মামা বলে উঠল 'তোর আর জোছনার ইটিশ পিটিশ কয় বছর পূর্ণ হলরে?'' চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম,এই রকম একটা আজগুবি প্রশ্নের সম্মুখিন হব মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না আমি।

তত্মত খেয়ে উত্তর দিলাম সাড়ে চার বছর। মামা বলে উঠল ''ও,তোদের মামির সাথে আমার ছয় বছর ছিলো। বয়স তো আর হওয়ার বাকি নেই,আমাদের কি বর যাত্রি যাওয়া হইবেনা নাকি?'' কি যে বলেন মামা,'এখনো তো থার্ড ইয়ারে পড়ি । এই বয়সে যদি বিয়ের কথা বাসায় বলি হাড্ডি ভাইঙ্গা বাসা ছাড়া করবে আমাকে' 'শোন একটা কথা বলি,তুই যদি এখন থেকে বিয়ে নিয়ে সিরিয়াস না হচ্ছিস তাহলে তুদের এই সম্পর্কের কোন গ্যারান্টি নেই। যে কোন সময় এক্সপেয়ার ডেট ওভার হয়ে যেতে পারে।

জোছনা তুকে বড়সড় ছ্যাকা খাওয়ায় বাকা করে আরেকজনের সাথে ভাগবে' রসিক মামার কথা শুনে ভাবতে শুরু করলাম,আসলেই ত ঠিক। জোছনা সেই কবে থেকে চাপ দিচ্ছে আমাদের বিয়ের কথাটা যেন ফ্যামিলিতে জানাই। জোছনার বাবাও মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমি চুপ করে আছি। আমার নিরবতা দেখে ''এই কি ভাবছ এত?' ''মামা ঠিকই বলেছেন।

কিন্তু মামা জোছনার বাবা তো মেয়ে কে ইঞ্জিনিয়ারের কাছে বিয়ে দিতে চাই। আমি ত বিবিএ করছি। আমার প্রস্তাব যদি প্রত্যাখান হয়ে ফেরত আসে?'' -''আরে বোকা,তুই ইঞ্জিনিয়ারের মত মাথা কেলিয়ে কাজ করে বসে থাকবি দেখবি তোকে জোছনার বাবা মেনে না নিয়ে কয় যায়!তোর আব্বাকে সহ মেনে নিবে !'' -'আমার আব্বা ! বিয়ে তো আমি করতেছি মামা,আমার আব্বা নাতো ' -'পাগল !! তোর আব্বাকে বেয়াইন হিসেবে মেনে নিবে আর কি ! সেটাও বুঝছ না !' -'ও !! কি কাজ তাহলে ?'' -''সবাই জানত তোর মামির সাথে আমার সম্পর্ক ছিল ছয় বছরের। কিন্তু না আমরা তিন বছর চুটিয়ে প্রেম করে বোকার মত গুঁটিয়ে না থেকে লুকিয়ে কোর্ট ম্যারিজ করে ফেলছিলাম। এর পর বাসায় জানাই।

আমার শ্বশুর আব্বা ত প্রথমে মেনে নেই নি। কিন্তু যখন বিয়ে করে ফেলছি জেনে আর কিছু করতে না পেরে মেনে নিল । তুই ও এই কাজ করবি বুঝলি?'' -''কিন্তু মামা...'' -''থাক ! কোন কিন্তু নয় যেটা বলছি ওইটাই করবি...... এই হল রসিক মামা। আসল নাম কি কারো জানা নেই। এলাকার ছেলে পুলে থেকে শুরু করে সবাই এই নামে ডাকে।

সোসাইটির যত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সবই তার হাত ধরে। প্রেমের টিপ্স থেকে শুরু করে যাবতীয় সাহায্য সহযোগিতা করে। কথায় কথায় মামীর এবং তাদের সম্পর্কের প্রশংসায় মেতে তুলত কুলিং কর্নারের চা-পানির ফাঁক ফোঁকরে। *৩* এর পরের দিন পড়ন্ত বিকেলে মোটামুটি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে জোছনার বাসার নিচে এসে কল দিলাম... -'হ্যালো !! মাই হানি, কি কর?' -'কি বেপার সাজু !হঠাৎ আজ এত আহ্লাদ?' -'তুমি বাসা থেকে বাহির হও না একটু । প্লিজ লাগে তোমার ।

আমি তোমার বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি' -'এই কি ! তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াও বলছি। আব্বু এখনি বাহির হবে' -শুনো ! তোমার ঐ ভিলেন মার্কা বাবাকে আমি ভয় পায় না বুঝছ? আসলে আসুক ! হবু শ্বশুরকে সালাম করে নেব ! -ঐ স্টুপিড ! তুমি আমার বাবাকে ভিলেন কেন বলছ ? -ভিলেন না তো কি তাহলে !!সারাক্ষণ মেয়েকে ঘরে বন্ধি করে রাখে ........ ততক্ষনে জোছনার বাবা গাড়ি নিয়ে বের হতে দেখা মাত্রয় আমি দৌড় দিয়ে পালিয়ে গাছের আড়ালে নিজেকে আড়াল করে রাখলাম। আমার এই দৌড়াদৌড়ি দেখে জোছনার সেই নজরকারা হাসি যেন আকাশের বায়ুর সাথে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে মায়াবী সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে । সেই বাঁশির সুর অনেক দিনের হৃদয় নীলিমায় জমে থাকা সুখ গুলো যেন নতুন করে বিতারিত শুরু করে দিয়েছে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি নিচ থেকে তিন তলায় জোছনা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মসৃন সরু লম্বা মায়াবী চুল মেলিয়ে হাসির বজ্রপাতের মোহড়া দেখছিলাম।

মুহূর্তের মধ্যে কল্পনার জগতে হারিয়ে সেই মায়া ভরা হাসির আলপনা শুরু করে দিলাম । রবি ঠাকুর কিংবা শরৎচন্দ্র বেঁচে নেই,নতুবা সেই হাঁসির উপমা দিয়ে সাহিত্য রচনা শুরু হয়ে যেত...... -'কি সাজু সাহেব ভয় পেয়েছেন নাকি?' হাসির শব্দ পেরিয়ে জোছনার মুঠোফোনের স্পীকারের কথার ধ্বনিতে আমার হুঁশ ফিরল। -'কিছু বলছ?' -'কয় তোমার ঐ হিরো টাইপের কথা গুলো কয় গেল?লুকিয়ে গেলে কেন বাবাকে দেখে?' নিজের অপারগতার লজ্জা চাপা দেওয়ার চেষ্টায় বলে উঠলাম, -'শুনো ! আমি তোমার দিক চেয়ে পালিয়ে গেছি... -'হয়েছে ! চাপাবাজি কম মারো !তোমার মত ভিতু আমি আর একটাও দেখি নাই -'বীর পুরুষ না কাপুরুষ কিছুক্ষন পরেই টের পাবে। প্লিজ তুমি শাড়ি পরে নিচে নামো এখনি। শাড়ি পরে দেখতে তোমাকে খুব ইচ্ছা করছে' -'হঠাৎ শাড়ি কেন পড়ব ?না আমি বাসা থেকে বাহির হতে পারবোনা এখন' -'পারবেনা ?' -'না বলছিনা... -'তাহলে আজ আমি এখানেই দাঁড়িয়ে দিন পার করব... -'করলে করো,আমার কি আসে যায় ! আমি রাখছি...... মোবাইলের লাইন কেটে দিল জোছনা।

আমি মুখটা বাংলা পাঁচের মত করে জোছনার বাসার সামনের টি স্টলে বসে আছি । মনে মনে হাজারো গালির কাব্য রচনা করতেছি রসিক মামার জন্য। কেন যে তার কথা শুনতে গেলাম। জোছনার উপরেও ভীষণ ক্ষোভ হচ্ছে আমার। খুব হতাশ হয়ে গেলাম।

দেখে নিবো আমিও। আমাকে এত বড় অপমান। মোবাইল অফ করে বসে আছি। প্রায় ত্রিশ মিনিট হয়ে গেল বসা থেকে উঠার কোন খবর নেই আমার। দোকানদারের চামচ আর চায়ের কাপের টুনটুনানিতে হুঁশ ফিরল ।

আজব তো ! আমি এখনো বসে আছি কেন ?যে মেয়ে আসবেনা বলছে তার জন্য কেন এতক্ষন তার বাসার সামনে বসে থাকব। এর কোন মানে হয় না। মনে অনেক ক্ষোভ নিয়ে সিট থেকে উঠে দাঁড়াতেই জোছনাদের বিল্ডিং এর গেট থেকে কে যেন বাহির হওয়ার শব্দ ফেলাম। পিছনে ফিরে তাকালেই দেখতে ফেলাম জোছনাকে । দূর দেখে নীল রঙের শাড়িটা বেশ চকচক করতে দেখা যাচ্ছে।

চোখের চশমাটা খুলে একটু মুছে আবার চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগলাম। হ্যাঁ এটা জোছনা । জোছনাকে দেখে আবার কল্পনার জগতে ঘুরে আসলাম। নীল শাড়িতে বেশ ভাল মানাইছে তাকে যেন স্বর্গের অপ্সরী আমার দিকে আমার হাত ধরার জন্য এগোচ্ছে। জোছনা সামনে আসলে বলে উঠলাম... -'কি !! আসবেনা বলছিলে তো !আবার আসছ কেন?' -'দেখছিলাম আরকি আমার জন্য তুমি কতটা ধৈর্য পরিক্ষা দিয়ে অপেক্ষা করতে পার !' -''তো কি জন্য ডেকেছ বল' এই রিক্সা যাবেন?রিক্সাওলাকে ডাক দিলাম, -হুহ !! কয় যাবেন? -নাছিরাবাদ !কত? -পঞ্চাশ টাকা... বিশ টাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকা।

রিক্সাওলাদের ও এটা অভ্যাস। পাশে সুন্দরি মেয়ে দেখলেই হইল,ভাড়ার দাম দিগুণ বেড়ে যায়। সুন্দরি মেয়ের সামনে দরকষাকষিতে ও নিজের প্রেস্টিজ বলে কিছু আছে। তাই জোছনাকে নিয়ে কোন কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম রিক্সায়। -এই বললে না ত কয় যাচ্ছি আমরা? -সময় হলে সব জানবে -না !! এখনি বলতে হবে' [এক প্রকার হুমকি দিয়ে ] -'আমাদের দুজনের নাম আজকে থেকে এক সাথে একই পৃষ্ঠায় পাশাপাশি ভাবে একই খাতার মলাটে সংরক্ষিত করতে' -'মানে ?' -'মানে কি আর কাজী অফিসে যাচ্ছি' কাজী অফিসের কথা শুনে জোছনার মাথায় বাজ পরলেও নিরবে সম্মতি জানাচ্ছে তা বুঝতে দিল আমাকে ।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি জীবনের এত বড় সিদ্ধান্ত অথচ মেয়েটা দুমিনিটেই রাজি হয়ে গেল কেমনে?কোন গেঞ্জাম ও করল না দেখি । আমার অবাক হওয়ার সীমা অসীম । জোছনার নিরবতার রূপ ভীষণ ভয় পায় । এ নিরবতা দেখে নিজেই এখন ভয়ে আতঙ্কে আছি। আগেও এইরকম কয়েক বার নিরবতার চেহারায় ভয়ংকর রুপ নিয়েছে জোছনা ।

আমি মনে মনে দোয়া দরূদ পড়া শুরু করে দিলাম যেন আমি খাল কেটে কুমির ডেকে আনতে যাচ্ছি... *৪* কাজী অফিসে ঢুকে দেখতে ফেলাম সদ্য দম্পতি আর হবু দম্পতিদের ভিড়। সব গুলাই একই কেসের আসামী । বাবা মা থেকে লুকিয়ে বিয়ে করতে আসছে । কাকতালীয় নাকি কোকিলতালীয় বলা যাচ্ছে না ঠিক এই দিনটিই ও ছিল ১০/১১/১২ । এই সুন্দর তারিখে কাজী অফিস ভিড় হওয়ারই কথা।

এই প্রথম বারের মত দেখে অবাক হলাম বিয়ে করতে এসেও ডাক্তারের রোগী দেখার মত সিরিয়ালে দাঁড়াতে হচ্ছে আমাদের। অবশেষে সেই আনন্দ গনন মুহূর্ত আসল। কাজী সাহেব আমাদের সিরিয়াল ডাক দিল। জীবনে প্রথম বারের মত কাজী অফিসে আসা । কপালে থাকলে হইত আরো আসা হবে তবে সেটা অন্যের সাক্ষী হয়ে।

কাজী সাহেবকে দেখে আমি কিঞ্চিত সন্দিহানে আছি এটা আসলে কাজী নাকি কেরানী ! মাথায় টুপি নেই, হাফ দাড়ি,বলা যেতে পারে ডিজিটাল কাজী। তার লক্ষণ ও বেশ সুবিধার না,যতক্ষন আমাদের নাম ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন খাতায় তুলতেছিল তার ফাঁকে ফাঁকে কাজী সাহেবের চোখ জোছনার রূপের আগুনে জ্বলতে দেখলাম। আমিও রেগে দাঁত কিড়মিড় করায় কাজী সাহেব ভালই ভাবে টের পেয়েছে। তারই জের ধরে বোধহয় ঝামেলা সৃষ্টি করল। উকিলের মত জেরা করতে শুরু করল আমাকে।

শেষমেশ বয়স নিয়ে সমস্যায় পরে গিয়েছি। জোছনার বিশ হলেও জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী আমার এখনো বিয়ের বয়স হয় নাই,একুশ বছর হওয়ার আরো এক মাস বাকি । বিয়ে করতে এসে এত ঝামেলা পোহাতে হবে সেটা আগে কখনো কল্পনাও করিনি আমি। তবে সিনেমা বেশ উপভোগ করতেছি। বাংলাদেশে সবই সম্ভব ।

বাংলাদেশ দুর্নীতিতে ওস্কার পাবে তার ও কোন সন্দিহান নেই। বিয়ের মত শুভ কাজে ও এইদেশে দুর্নীতি চলে। কাজী সাহেবকে কিছু টাকা বাড়িয়ে দিয়ে অবশেষে বিয়ের প্রাথমিক কাজ সেড়ে ফেললাম। কাজী অফিস থেকে বাহির হয়ে মুক্তি পেলাম যেন এতক্ষন আদালতের আসামী হয়ে ছিলাম। *৫* হৃদয়ে খুশির আলাদা একটি রং নিয়ে কাজী অফিস থেকে বাহির হয়ে হাটতে শুরু করলাম।

এত ঝামেলার পরও যে বিয়ে সম্পন্ন হওয়াতে সাফল্যের এক বড় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম । মনে হচ্ছে মহাভারত এতদিন অশুদ্ধ ছিল আজ বিশুদ্ধ করলাম। -'এই শুনোনা বর' ওমা বিয়ে হতে না হতেই এই মেয়ে বর ডাকা শুরু করে দিল -'কি?' - "আচ্ছা আমাদের ফুলশয্যা কবে হবে ?' ফুলশয্যার কথা শুনে আমি টাশকিত । আল্লাহ ! এই মেয়ে বলে কি?নিজেই কথাটায় বলে ফেলল ! ফুলশয্যার কথা শুনে আমি চমকিত সুরে ''হ্যাঁ ! তাই ত,আমার তো মনেই ছিলনা,থ্যাঙ্কস,মনে করে দেওয়ার জন্য কিন্তু কবে কোথায় হবে'' ? আমার চোখে মুখে হাসির আভা বেরিয়ে আসতেছে। কিন্ত সেই হাস্যজ্জল চেহারার বেশিক্ষন স্থায়ী রাখতে দিল না জোছনা ।

মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথায় ঠাডা পড়ল। -''কবে কোথায় মানে?আজকেই তোমার বাসায় হবে'' -'আমার বাসায়?' [ দিশেহারা হয়ে বললাম] -'হ্যাঁ !! তোমার বাসায় !বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতেই ত হই' -'পাগল নাকি?' -শুনো আইন অনুযায়ী আমি তোমার স্ত্রী । আমার সমস্ত ভরণপোষণের দায়িত্ত এখন থেকে তোমার'' আরে এই মেয়ে বলে কি?আমার বৌয়ের খেতাবে নাম তুলেছে এখনো আধা ঘন্টা হয় নাই,এরই মধ্যে শুরু করে দিল নির্যাতন। ভবিষ্যতে আমার কপালে যে কি আছে একমাত্র খোদায় জানে। আমি জানতাম ই এমন কিছু একটা করবে সেই।

এই মেয়ের নিরবতার রূপ যে কতটা ভয়ংকর সেটা একমাত্র আমি ছাড়া আর কারো বুঝার অবকাশ নেই। যা মনস্থির করবে তা করেই ছাড়বে । এমনিতেই আব্বা পরীক্ষায় ভাল রেসাল্ট করতে না পারায় আমার উপর আগুন ,তার উপর ঘরে বউ নিয়ে গেলে আমার অবস্থা......কি হবে তা আর বলতে পারছিনা.. -'মাফ করো আমাকে । এই ফুলশয্যা আমি চাই না ! তুমি বরং এক কাজ করো দোকান থেকে কিছু ফুল নিয়ে বাসায় গিয়ে বিসানায় ছাদরের উপর বিছিয়ে দিয়ে ফুলের উপর ঘুমিয়ে কাটাও আজ রাত । ব্যাস !ফুলের উপর শয্যা ফুলশয্যা হয়ে গেছে।

পারলে আমাকে কল দিও। আমি সহ তোমার ফুলশয্যার সাক্ষী হয়ে থাকব' আমার এই রসিকতার স্বভাব দেখে কটমট হয়ে বজ্রপাত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই। -'দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি মজা। এখনি তোমার বাবার কাছে যাবো,তোমার বাবাকে গিয়ে লাগা্বো তার ছেলে আমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে,এই করছে ,সেই করছে আরো কত কিছু বানিয়ে বলব... এই মেয়েকে বিশ্বাস করা বড়ই দুষ্কর,রেগে গেলে সে কি করবে সে নিজেও ভেবে কূল পায় না। হইত বলেও দিতে পারে।

-'এই না না !! এমন কাজ তুমি করতে পারো না,প্লিজ তুমি আমাকে ছয়টা মাস সময় দাও আমি সিদ্ধান্ত নিবো পরে কি করা যায়' -'এখনো সিদ্ধান্তে পরে আছো?কোন সময় দেওয়া যাবে না । সাহস করে আমার সাথে আলোচনা ছাড়াই বিয়ে করেছো সেটা একটা বড় ধরনের অপরাধ কিন্তু মাফ করে দিলাম আমি শুধুমাত্র তোমার সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে' উপ্স !! এই মেয়ে নিয়ে বড্ড ঝামেলাই আটকে গেলাম,কোন দুঃখে যে আমি রসিক মামার কথা..... মুখ আটকে গেল আমার। মুখ ফসকে রসিক মামার কথা চলে আসাতে কথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেলছিলাম,কিন্তু এই প্রতিভাবান মেয়ে ধরে ফেলেছে। -'এই কি বলেছো তুমি?' -'কয় নাতো !! কিছু না' -'আমি তো মনে করেছিলাম তুমি সাহসি হয়ে আমাকে বিয়ে করেছো। যাও এখন রসিক মামার বুদ্ধি অনুযায়ী আমাকে দু মাসের মধ্যে ঘরে তুলে নিবে,আর এই আল্টিমেটাম টাইমের মধ্যে যদি তোমার বাবাকে আমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে না পারো তাহলে আমি কিন্তু বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবো ।

এর আগ পর্যন্ত তোমার সাথে আমার কোন যোগাযোগ থাকবে না'' -'সিনেমার ডাইলগ মারো নাকি? -'আমি চলিলাম,বেষ্ট অফ লাক ফর ইয়ুর মিশন !' বাই.... আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হতচ্ছাড়ি কোথাকার। সিনেমাতো দেখি একেবারে হিট করে ছাড়বি। আমাকে বিপদে পালাই আবার শুভ কামনাও জানাস ! *৬* পেছন থেকে একজন এসে আমার ঘাড়ে হাত দিলেই কল্পনার জগত থেকে ফিরে আসলাম। পেছনে ফিরে দেখি মেজ ভাবী । -''কি দুলাসাহেব !!এইখানে কি করেন আজকের রাতে?তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে তো আমি নিজেকেও হারিয়ে ফেলেছি।

ওই দিকে বউয়ে তোমার যাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনতেছে । কি খুব চিন্তিত"? -''চিন্তিত না ভাবি মাথাটা খুব ব্যাথা করছিল'' -''যাও রুমে যাও,নিজের বউয়ে মাথা টিপে দিবে ভাল করে'' ভাবির কথা শুনে একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম -''ভাবী আমার খুব ভয় হয়'' -''আরে এই ছেলে বলে কি?নিজের বউয়ের কাছে যেতে ভয় কিসের"? -''ওকে চিননা ভাবি তুমি,গত দু মাস ধরে যে যুদ্ধ করল না আমার সাথে একেবারে আমার বারোটা বাজায় ছাড়ছিলো। আরো বলে কি আজ কে রাতেই নাকি ফৌজদারি আইনে আমার বিচারকার্য শুরু হবে" -'যাও !! বারোটা বাজছে,এখন রুমে যাও। ভয় কর না, এই বিচার মধুর বিচার'' -''ভাবি প্লিজ একটু বলোনা,প্রথমে গিয়ে কি করতে হবে"" ভাবী আমাকে টেনে দরজার সামনে এসে মৃদু হেসে অনেকটা জোড় করে ঠেলে রুমে ঢুকিয়ে দিলো .... *৭* ঘড়ির কাটা ঠিক বারোটা বেজে এক মিনিট । রুমে ঢুকে অবাক হয়ে নিজের রুমটার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে পরলাম ।

গত একঘন্টায় রুমের এই অবস্থা। রুমটা বেশ উজ্জ্বল। ফুলের সৌরভে রুমটা বেশ পুলকিত হয়ে পরেছে । জোছনা সেই খাটের উপর বসে আছে। আমি রুমে ঢুকছি তার খেয়াল নেই কিন্তু যখন দরজা লক করেছি ঠিক তখনি খেয়াল ফিরল আমার দিকে সাথে সাথে ঝাড়ি ''এতক্ষন লাগে নাকি আসতে? কয় ছিলে এতক্ষণ'? ' উত্তর এড়িয়ে খাটে গিয়ে বসে পড়লাম।

একটু বসে রেস্ট নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। অনেক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম পা গুলো চিঞ্চিনে ব্যাথা ও করছিলো । -'এই নামো বলছি' -'আরে,আমি তো এইখানে শুবো' 'কোথায় শুবে সেটা পড়ে দেখা যাবে আগে যেটা বলছি সেটা শুনো'' হুকুমের উপর ঝাড়ি নেমেই গেলাম খাট থেকে । এত বড় অসম্মান ! মানতে পারছিলাম না । কিন্তু ভুলটা ভেঙ্গে গেল মুহূর্তের মধ্যে।

সেই এসে আমার পায়ে ধরে সালাম করে শেরোয়ানী ধরে ঠান দিয়ে তার মুখটা আমার মুখ বরাবর এনে, -'পাগল !! জানো না,বাসর রাতে স্ত্রী স্বামীর পায়ে ধরে সালাম করতে হয়' -'স্যরি প্রথমবার তো সেই জন্য' -''প্রথম বার মানে,আরো বিয়ে করার চিন্তাভাবনা আছে নাকি ? -'আরে না,এই যে আমাদের বিয়ে দুবার হলো না,আমরা নিজেইরাই একবার করেছিলাম,তোমার বাবা সেই বিয়ে না মেনে সমস্ত বিয়ের রীতি মেনে আবার কবুল বলালো । সেই অনুযায়ী দু বিয়েতে দুই বাসর । বেপার না আজকের ভুল কালকে পুঙ্কানুরুপে সাধন হইবে' ''হুহ !! আগে আজকের রাতটা শেষ করতে পারো কিনা দেখ,তারপর আরেকটার কথা ভাবিও'' বলতে বলতে সেই খাটে গিয়ে বসল । আমিও হতভাগার মত দাঁড়িয়ে আছি সাহস পাচ্ছিলাম না খাটে যেতে এই মেয়ে যদি আবার ঝাড়ি মারে ! গত চার বছর তো একেবারে ঝাড়ির উপরই ছিলাম । আজকের ফুলশয্যার রাতেও মাফ নেই ।

''কি? দাড়িয়ে আছো কেন এখনো? আসো খাটে গিয়ে বসে পরলাম । এইবার সেই একটু লজ্জা পেয়ে গেল । মনে মনে ভাবতেছি যাক বাবা এতক্ষনে বাসর ঘরের পরিবেশ ফিরে আসল। বউ যদি ফুলশয্যার ঘরে ফুলের বিছানায় কাটা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে কেমন করে হয়... ঘোমটা দিয়ে আছে অনেক্ষন ধরে। এই মেয়ে ঘোমটা সরাতেই চায় না।

তবে তার প্রতিটা কাজের পিছনে একেকটা রহস্যা থাকে। -''ঘোমটা টা কি একটু সরাবেন মিসেস সাজু?'' -''না '' -'কেন তা জানতে পারি?' -''বাসর ঘরে বিলম্ব করে আসছ তাই ,এটা তোমার শাস্তি'' -'এত বড় শাস্তি? পরে দিলে হই না'' -'না ! সময়ের কাজ সময়ে করে ফেলা ভালো' আমার মন আর মানছে না তাকে দেখার জন্য । বৌয়ের সাজে একদম রূপকথার রাজকন্যার মত লাগতেছে তাকে। সারাদিন তো ব্যস্ততার জন্য দেখতে পারলাম না দুচোখ ভরে । কিন্তু বাসর ঘরে দেখতে চেয়েছিলাম সেখানেই তার বিচারকার্য সম্পাদনে জরুরী হয়ে পরল ।

''আচ্ছা ঠিক আছে তুমি তোমার বিচার নিয়ে থাকো । আমি ঘুমিয়ে পরছি,আর শুনো লাইট টা নিভে দিও,না হয় ঘুম আসবে না আমার'' 'ঘুমিয়ে পরছি''কথাটি জোছনার শ্রবণে ভালই ভাবে আগাত হানল । 'ঘুমিয়ে পড়ছ মানে?এই উঠো !আজকে ঘুমানোর রাত নাকি?' মেয়ে এইবার ঘোমটা সরিয়ে আমার উপর আক্রমন শুরু করে দিল। ঠেনে বালিশ থেকে তুলে ফেলল। -'তো এতক্ষন ঢং দেখাচ্ছ কেন?' আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল।

তার রূপের আগুনে এতটাই পুড়ে যাচ্ছি আমি ভাষায় লিখতে গেলে যে কাগজে লিখব সেই কাগজ ও বোধহয় পুড়িয়ে যাবে। ঠোঁটের নিচের তিল টা এমনিতেই ধরা পরে না,তবে আজ গাঢ় করে দেওয়াতে বেশ মায়াবী লাগতেছে। আর হাসির চাপে তার গালে টোল পরায় আরো মধুর করে তুলতেছিলো আমাকে...... সে হঠাত জড়িয়ে ধরল শক্ত করে আমাকে আমিও আর কিছু না ভেবে.... [পাঠকরা কি ভাবেন?মনে মনে যেটায় ভাবতেছেন সেটাই ] *৮* -'এই শুনো না,এই তোমাকে না একটা কথা বলার ছিলো' আমার বুকে মাথা রেখে বলল -'কি বল' -'এই সবই তো আমার ফন্ধি ছিল'' -'কি ছিল ?'' আমি হতবাক হয়ে বললাম -'রসিক মামা যে বুদ্ধিটা তোমাকে দিল,এটাতো আমার সাজানো' -''সাজানো মানে ?'' অবাক সুরে বললাম জোছনা বুক থেকে ঊঠে নড়েচরে বসে পরল আর সেই হাস্য মাখা চেহারায় মৃদু হেসে হেসে বলতে লাগল ''এই যে তোমাকে যে কোর্ট ম্যারিজের বুদ্ধিটা দিল,সেটা তো আমিই মামাকে বলতে বললাম তোমাকে...'' ওর কথা শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে পড়লাম । এই মেয়ে এইসব কি বলে । আমাকে গত দুমাসে বিপদে ফালাই এই মেয়ে আরো হাসে ! আমিও একটু অভিমানী হয়ে চুপ করে আছি ।

-''এই চুপ করে আছো কেন'?'' -''এত সাজানোর কি দরকার ছিলো,সেটা তো আমাকে বললেই হত'' জোছনা একটু রেগে ''বলেলেই হত মানে ?এই পর্যন্ত বিয়ের কথা কয় বার বলছি হিসাব আছে তোমার?যতবারই বলছি ততবারই একেক টা বাহানা ধরে এড়িয়ে যেতে । এই বুদ্ধিটা যদি মাথায় না আনতাম তাহলে তুমি কোনদিন আমাকে বিয়ে করতে পারতেনা । শুধু আমাকে কেন চিরকুমারই থাকতে সারাজীবন । তোমার মত ভিতু......'' নিজের অপরাধ স্বীকার করে চুপটি মেরে বসে আছি । কেন জানি তবুও মেয়েটার প্রতি আমার রাগটা কমছে না ।

আবার এটাও ভাবতেছি আসলেই তো ঠিক,এইভাবে চাপ না দিলে হইত ফ্যামিলিকে কখনো কথাটি বলা হয়ে উঠত না । আচ্ছা !! তুমি আমাকে এত ভালবাস কেন?আমি এখন একটু রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করতেছি -'কে বলছে তোমাকে আমি ভালোবাসি? না আমি বাসি না তোমাকে ভালো,তোমার মত ভিতু আমার স্বামী হওয়ার কোন যোগ্যতা আছে তোমার?' -'কিন্তু কেন?' -'কেন এর কোন উত্তর নাই' আমিও ছোট্ট শিশুর মত কাঁদো কাঁদো চেহারায় চুপ করে আছি। কেন জানি মেয়েটির সাথে সাথে ফিডব্যাক না ফেলে অল্পতে কষ্ট এসে যায় বুকে। 'এই পাগল!! ভালোবাসি কি সেটা প্রতি কথায় কথায় বলতে হয় নাকি? সেটা অন্তরের ব্যাপার অন্তর দিয়ে ধারণ নিতে হয় সবাইকে" আমার গালটা টেনে জোছনা খাট থেকে নামতে চাইলে আমি হাত ধরে ফেললাম -'এই কয় যাও?' -'এই দ্যাখো না,সেই কবে থেকে এত ভারী শাড়ি পরে বসে আছি। সেটা একটু চেঞ্জ করে থ্রি-পিছ পড়ে আসছি' -'না হবে না,এই শাড়ি পড়ে সারারাত পার করবে...' -''কিন্তু সেটা তো আমার অসহ্যা লাগতেছে...' ''দেখ তোমার এই রূপের ঐশ্বর্য বৌয়ের সাজে সারারাত দেখতে চাই ।

থ্রি-পিছ পরে আসলে তোমাকে আর বৌয়ের মত লাগবে না। তখন তোমাকে অবিবাহিত মেয়ের মত লাগবে । এটা খুব খারাপ দেখায়। আর শুনো কখনো থ্রি-পিছ পরবে না বুঝছ ?'' -''কি !! তুমি এখনো এনালগ যুগে পরে আছ ?আজকাল তো বিবাহিতা আংটিরাই পর্যন্ত থ্রি-পিছ পরে বসে থাকে'' -'শুনো ,এত কিছু বুঝিনা আমি । এটাই আমার আদেশ এবং একজন স্ত্রী হিসেবে তোমাকে মানতে হবে'' -'হুহ !! এইবার আমার শর্ত গুলো বলি?' -'বলেন ম্যাম ! কি শর্ত মানতে হবে আপনার?' -'বলছিলাম ! বাসায় সন্ধ্যার ছয়টার আগে আগে ফিরতে হবে ।

না আসলে তোমার অবস্থা আমি বারোটা বাজাবো । ভার্সিটিতে যাওয়ার আগে চোখ দুইটা দিয়ে ভালোভাবে আমাকে দেখে যাবে এবং সারাদিন যতক্ষন বাহিরে থাকবে ততক্ষন আমার চেহারা চোখের মধ্যে ভাসাবে । আর যদি কোন মেয়ের দিকে থাকাও তাহলে তুমি ঘরে আসলে আমার রুমে জায়গা পাবে না । আর শুনো রামিসা নামের তোমার যে বান্ধবীর সাথে একটু ভাবসাব বেশি ঐটার সাথে যাতে আর যোগাযোগ না রাখো'' তার সমস্ত সুদর্শন দেহের ভার আমার উপর রেখেই সেই তার আদেশ জারি করতেছিল । ভালই লাগতেছে বেশ ! -'জি ! আপনার সমস্ত আদেশ পুংঙ্কানুরুপে মানতে আমি রাজি' -''শুধু এইগুলা না,তোমার যত আবেগ অনুভুতি ভালোবাসা আছে সব গুলো আমাকে দিয়ে দিবে ।

বিয়ের পর অনেকে বউকে তেমন পাত্তা দেই না । তুমি যেন তাদের মত না হও ' *৯* মোবাইল্টা বেজে উঠল। বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা হাতে নিলাম। একটা আননাউন নাম্বারের কল। এর আগে একটা মেয়ে রাতে মাঝের মধ্যে কল করত।

মনের মধ্যে একটু ভয় চলে আসল । কল যখন কেটে দিচ্ছিলাম ঠিক তখনি জোছনা আমার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিল এবং লাউডস্পিকার দিয়ে কল রিসিভ করল । ওপাস থেকে,একটা মেয়ের কন্ঠ ভেসে আসল। আমি তখন দোয়া-দরুদ পরা শুরু করে দিলাম। ধরা খেলে এই রাতে আমার আর জামিন নেই তার কাছ থেকে ।

সোজা রুম থেকে বাহির করে দিবে... -হ্যালো আমি মিলি বলছি ! কি সাজ্জাদ ! চুপ করে আছ কেন ? জোছনা যখন হ্যালো বলে কে বলছেন? বলার সাথে কল কেটে দিল মেয়েটা । জোছনা আমার দিকে কঠিন ভয়াবহ মহামারি চোখে তাকিয়ে আছে । এই মুহূর্তে তার চেহারা হিটারের মত হয়ে গেছে। যেকোন মুহূর্তে হাত দিলে পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে নিশ্চিত । -'মেয়েটা কে?' একটু অনল সুরে -'মেয়েটা কে আমি কিভাবে জানবো?' একটু তোতলানো সুরে ।

ভয় পেলে আমার যে অবস্থা হয় আর কি -'তুমাকে এত রাতে কল করে,আর তুমি কিনা জানো না'' পাল্টা আক্রমণ -'বিশ্বাস কর এই মেয়েটাকে আমি চিনি না'' আকুতি মিনতি করে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম -'তোমাকে বিশ্বাস হয় না আমার আর তোমার নাম কিভাবে জানে ? -''আমার নাম !! আমার নাম তো সাজু ইসলাম'' -''সাজু না !!? তোমার মাবাবার দেওয়া নামকে সংক্ষেপ করছ সাজ্জাদ থেকে সাজু তে সেটা বলো না । দুই নামে দুই মেয়ের সাথে লাইন মারো তাহলে[বত্রিশ পাটি দাঁতকে একেবারে চেঁচিয়ে বলল ] -''দোহায় লাগে তোমার ! এই মেয়েকে আমি চিনি না'' -''আবার মিথ্যা !চটপট উত্তর দাও কে এই মেয়েটা। গত দুই মাস যখন আমাদের যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছি তখন কতজনের সাথে লাইন মেরেছ সব বল এখন' -''এই আস্তে কথা বলো । পাশের রুম থেকে কথা শুনা যায়। আব্বু আম্মুরা ছুটে আসবে তখন।

তখন বলবে বাসর রাতে ঝগড়া। । ছিঃ ছিঃ খুব খারাপ দেখাবে তখন''..... *১০* তুমুল পর্যায়ে ঝগড়া দুজনের মধ্যকার । ফুলশয্যার রাতের পরিবেশ পরিস্থিতি আর ধরে রাখতে পারলাম না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনটা পার হয়ে গেছে ।

আজকের রাত টা খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে মনে হয় । প্রতিদিন ত বালিশের এই পাশ ওপাশ করতে করতে রাত যেত। পাশের বালিশের উপস্থিতির প্রতিক্রিয়া কিন্তু ভালই ভাবে টের পাচ্ছি । ঝগড়ার ঝড়ের পর দুজনেই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছি। দুজনের মধ্যেকার ভাব বিনিময়ের ভাটা পরেছে ।

দুই বালিশের দূরত্ব কিঞ্চিত বেড়ে গেল। এটাই বোধহয় স্বামী স্ত্রী ঝগড়া হওয়ার পর স্বাভাবিক দৃশ্য। অবশ্যই আমি মাঝে মাঝে জোয়ার তুলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু তার অনুকূল স্রোত পাচ্ছি না বলে কিছু করতেও পারতেছি না। মেয়ে অনেক অভিমানী হয়ে শুয়ে আছে । চোখাচোখি ও হচ্ছে আমাদের বেশ।

মানুষের চোখ হল হৃদয়ের আয়না । তার চোখ দেখে বুঝতে পারতেছি,আমি গিয়ে তাকে আদর করি। তার কাছে ক্ষমা চায় । আমার ও এইভাবে চুপ থাকতে ভাল লাগছে না তাই বালিশের দূরত্ব রেখে আমার দূরত্ব তার থেকে কিছুটা কমানোর চেষ্টা করতেছিলাম । মোবাইলটা আমার হাতে ছিল তাই একটু করে ফেসবুকে ঢু মেরে আসার স্বাদ জাগল।

কি আর করা বাসর রাতে যেখানে বৌয়ের আদরে মধ্যে থাকার কথা আর সেইখানে আমি ফেসবুকে থাকতে হচ্ছে । রাতে একটা স্ট্যাটাস ও আপডেট দিয়েছিলাম ফুলশয্যা নিয়ে । এমনিতেই লাইক কমেন্টস না আসলেই আজ মৌসুমি জনপ্রিয়তায় ভোগছি । অনেকে ত কমেন্টসে প্রতিঘন্টার সর্বশেষ খবর জানানোর জন্য আবেদন করে বসে ও আছে। স্ট্যাটাস বক্সে জুকা মামা জিজ্ঞেস করল"ওয়াটস হ্যাপেনিং সাজু? মনে মনে বললাম যা ঘটছে ঘটছে তা যেন আর কোন ছেলের সাথে না ঘটে,এই ঘঠনা যদি শেয়ার করি তাহলে অবিবাহিত ছেলেরা বিয়ের জন্য অনীহা হয়ে পরবে।

আমি চায় না আমার এই দুরবস্থার কথা জেনে কেউ যেন বিয়ের মত জরুরী সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় সম্মুখীন হউক। মোবাইলটা বেজে উঠল আবার। আবারো সেই নাম্বারের কল। জোছনা আমার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে ফেলল। আবার ভয় হওয়ার শুরু করল।

বোধহয় আজকের রাতটা এইভাবে যাবে। নিজের মাথা নিজেই ফাটাই ফেলতে ইচ্ছা করে কেন যে আজকে মোবাইলটা বন্ধ করে রাখলাম না। রিং পরে যাচ্ছে সেই রিসিভ করে না। মনে মনে একটু স্বস্তিতে ফিরতে লাগলাম। তৃতীয় তম কল এ আসল কাহিনী বেরিয়ে আসল।

সেই রিসিভ করল,ওপাস থেকে অপরিচিতা বলে উঠল ''হ্যালো,সরি আপু নাম্বারের লাস্ট ডিজিট টা ভুল হওয়াতে ভুল নাম্বারে কল চলে গেল,কিছু মনে করবেন না,ডিস্টার্ব করার জন্য দুঃখিত'' বলে কেটে দিল। তার চোখে মুখে অপরাধবোধ কাজ করতেছিল। নিজেই নিজেকে খুব অনুতপ্ত দেখাচ্ছে তাকে। আমিও এইবার একটু ভাবে আছি । সেই আমাকে স্যরি বলার চেষ্টা করতেছিল কিন্তু আমি সেই সুযোগ না দিয়ে বিছানা ত্যাগ করে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলাম।

আমি জানি সেই এই মুহূর্তে আমার পিছে পিছে এসে সঙ্গ দিবে আমাকে। হ্যা !!তাই হল ! সকল রাগ অভিমান খাটে ফেলে রেখে পিছন থেকে সেই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল খুব শক্ত করে আর বলে যাচ্ছে ''আই এম স্যরি সাজু,তোমাকে না বুঝে অনেক বকেছি!! এই ভুল আর কখনো করবনা,প্লিজ ক্ষমা করে দাও......'' মেয়েটির গাল বেয়ে দু চোখের অশ্রুতে নির্ঝরের প্লাবন সৃষ্টি হতে চলেছে। তার আকুতি মিনতি দেখে ভাব কে বিসর্জন দিয়ে আমিও জড়িয়ে ধরলাম। খুব শক্ত করে। এমন ভাবে ধরলাম যেন আমার থেকে কেঊ কোনদিন তাকে আলাদা করতে না পেরে।

বিছানার এই পাশ আর ওইপাশে গড়াগড়ি করছিলাম। আম্মাজান এসে জড়িয়ে ধরা কোল বালিশটি টেনে রাম ঝাড়ি দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিল ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে ঘুম ভেঙ্গে গেল। জোছনা জোছনা বলে কয়েক বার বার আওয়াজ করে পাগলের মত খুঁজতেছিলাম রুমের মধ্যে । আমার আওয়াজ শুনে আম্মা আব্বা ছুটে আসতে দেখেই মুখের তালা মেরে দিলাম ।

রুমে অবস্থা দেখে আমি হতবাক হয়ে পরলাম । খাটে কোন ফুল দেখতে পাচ্ছি না। ফুলের চিহ্ন ত দূরে থাক,এমনকি রুমের মধ্যে এতদিন ফুলের টব ছিল,সেটাও দেখি গায়েব হয়ে গেল। বুঝতে আর দেরি হল না এতক্ষন এইসব গভীর ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছিলাম। দীর্ঘ এগারো ঘন্টা ঘুমালাম তবুও সেই স্বপ্নের ফুলশয্যার ইতি টানা হলনা ।

আপনারাও এতক্ষন অবাক হয়েছেন এত কিছু ঘটল কেমনে? আসলে এসবই স্বপ্নে সম্ভব । আগামী সপ্তাহে জোছনার বিয়ে তবে আমার সাথে নয় অন্য আরেক জনের সাথে। আমার অক্ষমতার জন্য তার সাথে আমার কখনো সংসার করা হবে না । মেয়েটিকে নিয়ে একসময় অনেক রঙ্গিন স্বপ্ন দেখতাম,সেই স্বপ্ন গুলো আমার সাদা-কালো জীবনে বাস্তবে রূপ দেওয়ার অনেক চেষ্টা করতাম,কিন্তু কপাল আমার সহে নাই। স্বপ্ন বুনতাম কোন এক পূর্ণিমা রাতে আমাদের ফুলশয্যা হবে ।

কিন্তু বাস্তবে তো হলনা,সেটা স্বপ্নয় ও হল না ,হ্যাঁ হয়েছে তবে সেটা অসমাপ্ত স্বপ্নয় রয়ে গেল ......... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।