আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

।।--তালগাছ ও বটগাছের গল্প।--।।

যতোবার আমি শান্তি খুঁজেছি, ঠিক ততোবার আমার মাথায় শুধু একটি চিন্তাই এসেছে। সেটা হচ্ছে একটা ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথার খুলিটা ফুটো করে দেওয়ার চিন্তা। তিন দিন ধরে মটকা মেরে বাসায় পড়ে আছি। মেজাজ কিঞ্চিত খারাপ। বাইরে যেতে পারছিনা।

যখনই ভাবি, একটু বের হবো তখনই বৃষ্টি শুরু হয়। গ্রীষ্মের দিনে অল্প বৃষ্টি ভালো লাগে। কিন্তু সারাদিন বৃষ্টি ভালো লাগে না। এদিকে আবার চলে হরতাল। সবসময় বাইরে বের হওয়ার উপায়ও নেই।

কিন্তু কোন কাজ কর্ম ছাড়া এভাবে রোবটের মতো বসে থাকলে হাতে পায়ে মরিচা ধরাও অস্বাভাবিক না। ডায়েরিটা টেবিলের কোনায় পড়ে আছে। বহুদিন কিছু লেখা হয়না। হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা নিলাম। আজ অনেকদিন পর লিখতে ইচ্ছা করছে।

তবে ভারী কিংবা গম্ভীর কিছুনা। খুব হালকা কিছু। ডায়েরির পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখলাম- "এক দেশে ছিলো এক রাজকন্যা। " নাহ। লাইনটা ভালো লাগছে না।

রাজকন্যা নিয়ে এখন কিছু লিখবো না। রাজা-রানী, রাজকন্যা নিয়ে কি কম গল্প লেখা হয়েছে? ঠাকুরমার ঝুলি ভর্তি রাজা রাজকন্যার গল্প। আমিও যদি এখন লিখি তাহলে কেমন হয়? লাইনটা কেটে দিয়ে লিখলাম- এক দেশে ছিলো এক তালগাছ। হ্যা, এবার লাইনটা সুন্দর লাগছে। একদেশ এ কি ছিল? তালগাছ ছিলো।

তালগাছকে নিয়ে আগে কেউ কি গল্প লিখেছে? লিখলে লিখেছে। আমার কি? যাই হোক, গল্প শুরু করি। এক দেশে ছিল এক তালগাছ। সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখন এতো বেশি মানুষজন ছিলো না।

ছিলো না এতো গাড়ি ঘোড়া, ছিলো না অট্ট্রালিকা। শুধু ছিলো মাঠ এর পর মাঠ। খোলা প্রান্তর। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। আর হলদে সবুজ প্রকৃতি।

সেরকমই বিশাল বিশাল প্রান্তর আর হলদে প্রকৃতি ঘেরা একটা গ্রাম এর নাম হরতকি। ছোট গ্রাম। লোকসংখ্যা বলতে শ তিন দুই। অধিকাংশই চাষা-ভুষো, উদয়ন্ত খেটে খাওয়া মানুষজন। সূর্য উঠার সাথে সাথে তারা মাঠে যায়।

সারাদিন ক্ষেতে খামারে কাজ করে, সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসে। পিদিমের মিটমিটে আলোয় ঘরের দাওয়ায় বসে তারা সন্তানদের গল্প শোনায়। বাচ্চারাও গুটুর গুটুর করে সেই গল্প শোনে। একসময় ঘুমিয়ে যায়। বড়রা এসে তখন বাড়ির বড় উঠোনে বসে।

সবাই মিলে সুখ-দুঃখের গল্প করে। সুখ দুঃখের গল্প শেষে একটু রাত হলেই সমস্ত হরিতকি ঘুমিয়ে পরে। সেই গ্রামের অদুরেই বিশাল এক খোলা প্রান্তরে একা একা মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকে যে, সে হলো তালগাছ। আশে পাশে কিচ্ছু নাই। না ঘরবাড়ি, না গাছপালা।

যতদূর চোখ যায় শুধু ধু ধু মাঠ। একেবারে তেপান্তরের মাঠের মতো মাঠ। মাঠের মধ্যিখান থেকে লম্বা সরু একটা মেঠো পথ একেবেকে চলে গেছে হরিতকির বাইরে। সেই পথের পাশে দাড়িয়ে থেকে তেপান্তরের মাঠ পাহারা দেয় লম্বা তালগাছ। আকাশে পাখিরা উড়ে বেড়ায়।

তালগাছ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে। তার তো আর পাখা নেই। যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে দৃষ্টি মেলে শুধু দেখে যায় সে। মাঝে মাঝে পাখিরা উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে যখন তার পাতার ফাকে এসে বসে তখন তার বড় আনন্দ হয়। গ্রীষ্মের বিকেলে মাঝে মাঝে বিনা বাতাসেই সে তার সরু দেহটা নিয়ে দোল খায়।

একেবেকে চলে যাওয়া পথ ধরে মাঝে মাঝে চলাচল করে দু একজন মানুষ। তালগাছ আগ্রহ নিয়ে তাদের দেখে। ভর দুপুরে ক্লান্ত পথিকদের কেউ কেউ তার ছোট্ট ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়। প্রখর রোদে অল্প একটু ছায়া, তাদের কিছুটা হলেও প্রশান্তি দেয়। তেমনি এক গ্রীষ্মের দুপুরে সেই মেঠো পথ ধরে যাচ্ছিলো এক ফেরিওয়ালা।

মাথার উপরে তীব্র কাঠফাটা রোদ, প্রচণ্ড গরমে প্রান যায় যায় অবস্থা। চারিদিকে ধুলো মাখা প্রান্তর, কোথাও কোন ছায়া নেই। দূরে তালগাছ এর সরু ছায়া দেখে দ্রুত পা চালালো সে। এসে বসলো গাছের নিচে। দীর্ঘ পথ হেটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বড়।

যেতে হবে সুকর্ণপুর। সেখানের জমিদারকন্যাকে বটগাছের বীজ পৌঁছে দিতে হবে। জমিদারকন্যার আবার বটগাছের খুব শখ। ঝোলার মধ্যে বটগাছের অনেকগুলো বীজ নিয়ে সুকর্ণপুরের পথে রওয়ানা হয়েছে সে। গাছের ছায়ায় বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলো ফেরিওয়ালা।

তারপর ঝোলা থেকে চিড়ে আর গুড় বের করলো। দুপুরে খাওয়া হয়নি, খিদেও লেগেছে প্রচণ্ড। পথের মাঝে আবার ছায়া কখন পাওয়া যায় না যায়, তারচেয়ে এখানে বসেই খাওয়া যাক। ঝোলা থেকে খাবার বের করার সময় অগোচরে বট গাছের একটা বীজ গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। ফেরিওয়ালা টেরও পেলোনা।

খাওয়া শেষ করে আর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। একবার তালগাছটার দিকে পিছে ফিরে তাকালো। তারপর আবার পথ চলতে শুরু করলো। বট গাছের বীজ পড়ে রইলো মাটিতে। অনাদরে, অনাগ্রহে।

মাটির জিনিস মাটিতেই তার জায়গা করে নিলো। একদিন সেই বীজ থেকে আস্তে আস্তে জন্ম নিলো বটগাছের এক চারা। খুব দ্রুত বড় হয়ে উঠতে লাগলো সে। তালগাছের একক রাজত্বে বটগাছের এই অভিবাসন তালগাছ খুব ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার রাজ্যে ভাগ বসাতে এই হতচ্ছাড়া বটগাছ।

তালগাছ অসম্ভব বিরক্ত হয়। হাত থাকলে এখনই বটগাছটাকে তুলে একটা আছাড় মারতো সে। তা না, অবাক হয়ে তালগাছ দেখে, সেদিনের সেই পিচ্চি বটগাছ কিভাবে ডালপালা ছড়িয়ে অল্পদিনের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছে। বড় হবি তো হ, একটু দূরে বড় হতে পারতি না? একেবারে গায়ের মধ্যে এসেই ঢুকতে হবে? তালগাছ রাগে কিড়মিড় করে। বটগাছও তালগাছকে খুব একটা পাত্তা দেয়না।

ভাবখানা এমন যে, তালগাছের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতে তার বয়েই গেছে। ওই লিকলিকে আর ঢ্যাঙা শরীরের জন্য আর কতটুকুই বা জায়গা লাগে তার? আর আকাশের দিকটা তো ছেড়েই দিয়েছে সে। তালগাছ যে তার লম্বা গলাটা বাড়িয়ে আকাশে এদিক ওদিক দোল খায় আর বাতাস খায়, বটগাছ সেটা নিয়ে কি কিছু বলেছে? তাতে বুঝি কিছু হয়না? সারাদিন তালগাছ আর বটগাছের মধ্যে খিটিমিটি লেগেই থাকে। নির্জন প্রান্তরে দুইজন দাড়িয়ে থেকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝগড়া করে যায়। দিন শেষে আধার নামে।

তালগাছের অভিযোগ তবু থামতে চায় না। বটগাছ বলে-শসস। পাখিরা ঘুমিয়েছে। তালগাছ এবার চুপ করে যায়। পাখিদের ঘুম নষ্ট করতে চায়না সে।

আর তার পাশে মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকে বটগাছ। নির্জন রাত আরও নির্জন হয়। চুপচাপ পাশাপাশি দাড়িয়ে আকাশের তারা গোনে দুইজন। একসময় দুইজনেই হারিয়ে যায় তারাদের রাজ্যে। পাখির ডাকে ভোর আসে।

আড়মোড়া ভাঙে বটগাছের। তালগাছকে ডেকে বটগাছ বলে- "দেখোতো আকাশে উকি দিয়ে, সূর্য উঠলো কিনা। " "কেন আমি দেখবো?" খেকিয়ে ওঠে তালগাছ। " আমি পারবো না। তুমি নিজে দেখে নিতে পারো না?" "কেন? তুমি তো ঢ্যাঙা।

একটু দেখে বললে কি হয়?" "আহা। " বিদ্রুপ করে তালগাছ। "এখন বুঝি নিজের খর্বাকৃতি নিয়ে কষ্ট হচ্ছে? পাশে তো বেড়েছো হাতির মতো। উপরে নিচে মাপলে তো বাট্টু্স। " মুখ বেকিয়ে বলে তালগাছ।

"আর তুমি নিজে কি?" খোটা দেয় বটগাছ। "নিজের লিকলিকে শরীরটা দেখেছো? এক ফু দিলে তো উড়ে যাবে। এতো বড় বড় কথা বলো কেন?" "ঠিক আছে। তোমার সাথে আর কখনো কথা বলবো না আমি। " "বলো না।

আমার কি?" তালগাছ মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। তার মুখ আরও গোমড়া হয় যখন সে দেখে মানুষজন এসে আর আগের মতো তার ছায়ায় বিশ্রাম না নিয়ে বটগাছের ছায়ায় বসে। বটগাছ তার দিকে আড়চোখে তাকায়, আর গর্বের হাসি হাসে। "দেখেছো তো? কে বেশি আরাধ্য?" টিপ্পনী কাটে বটগাছ। "চুপ থাক তুই।

ধামড়া কোথাকার। কি আছে তোর ওই মোটা শরীরটা বাদে? আমার তাল খেয়ে মানুষজন তাদের তেষ্টা মেটায়। রস বানিয়ে খায়। আর তুই কি দিস তাদের? বটফল? ছো!! কেউ খায় তোর ফল?" "খাওয়ার কি জিনিসের অভাব আছে পৃথিবীতে? তাল দিয়েই এতো বড়াই তোমার? তোমার তাল খেয়ে মানুষ বাঁচে? মানুষ বাঁচে ভাত খেয়ে। দেখো, কতো ছোট আর পাতলা ওই ধান গাছ।

মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ফলায় তারা। কখনো বড়াই করতে দেখেছো তাদের? ছোট ধান গাছও তো তোমার চেয়ে বেশি বিচক্ষন!!" "চুপ!! তোর সাথে কথা বললেই আমার ঝগড়া লাগে। কোন কুক্ষণে যে এইখানে ফেরিওয়ালাটা মরতে এসেছিলো? আহ! জীবনটা একেবারে শেষ করে দিয়ে গেলো। " খোলা প্রান্তরে দুইজনে এইভাবে ঠায় দাড়িয়ে থাকে, আর সারাদিন খিটমিট করে। একজন আরেকজনের মুখও দেখতে পারে না, কিন্তু কথা বলাও থামায় না।

একজন আরেকজনের পিছে না লাগা পর্যন্ত তাদের শান্তি নেই। পাখিরা এসব দেখে আর হাসাহাসি করে। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বছর ঘুরে নতুন বছর আসে। প্রকৃতিও তার রঙ বদলায়।

গ্রীষ্ম এর এমনি এক রাতে- ঈশান কোনটা থমথমে হয়ে আছে। আকাশের তারাগুলো আজ উঠেনি, কোন এক অজানা আশংকায় লুকিয়ে গেছে। ভ্যাপসা একটা পরিবেশ, চারিদিকে সুনসান নীরবতা। প্রকৃতি যেন দম বন্ধ করে কোন কিছুর অপেক্ষা করছে। হঠাৎ দমকা একটা ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগলো বটগাছের গায়ে।

ধক করে উঠলো বটগাছের বুক। "ভয়ংকর একটা প্রলয় আসছে। " তালগাছকে বললো সে। "তুমি কিভাবে জানো?" "জানি আমি। " বাতাস এর মধ্যেই প্রবলভাবে বইতে শুরু করেছে।

দূরে কান পাতে তালগাছ। সমস্ত পৃথিবী ছিন্নিভিন্ন করে কিছু একটা ছুটে আসছে। চাপা তার গর্জন, হিংস্র তার রাগ। সমস্ত আকাশে খড়কুটোর মতো উড়ছে টিনের চাল, কাঠের টুকরো, ঘরবাড়ি, গাছপালা। আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ঝিলিক খেলে যাচ্ছে কালবৈশাখীর তীব্র কুটিল হাসি।

প্রবল উন্মত্ততায় মেতে উঠেছে সমস্ত পৃথিবী। বুক কাপিয়ে দেওয়া আর গগনবিদারী বজ্রপাতগুলো যেন তাদের মৃত্যুর পরোয়ানা ঘোষণা করে চলেছে। প্রলয়ংকারী বায়ু বার বার তার হিংস্র ছোবলে উপড়ে ফেলতে চাইছে তাদের। তালগাছের দিকে একবার তাকালো বটগাছ। "শক্ত হয়ে থেকো না, ভেঙে যাবে।

" চেঁচিয়ে বললো সে। বটগাছের তারস্বর চিৎকার তালগাছ শুনতে পায় না। পায়ের উপর শক্ত হয়ে বাতাসের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে আছে সে। এভাবে দাড়িয়ে থাকলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। উপায়ন্তর না দেখে বটগাছ তার সমস্ত ডালপালা মেলে দিলো তালগাছের চারপাশে।

জড়িয়ে ধরলো তালগাছকে। ঝড়ের প্রবল ঝাপটা তার গায়ে লাগে লাগুক, সে তালগাছের কোন ক্ষতি হতে দেবে না। কিছুতেই না। সে তালগাছকে বাঁচাবে। কেন বাঁচাবে সেটা বড় কথা না।

তালগাছকে তার বাঁচাতে হবে। একের পর এক ছোবলে বটগাছের দেহ ক্ষতবিক্ষত হলো, তবু সারাটারাত সে তালগাছকে আগলে রাখলো। বাতাসের গর্জন একটা সময় কমে এলো। মুষলধারে নামলো বৃষ্টি। প্রলয় শেষে কাঁদল প্রকৃতি।

কাঁদল আকাশ। আর অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো তালগাছ। বটগাছের এখন সর্বাঙ্গে ব্যাথা। সমস্ত শরীর হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। কালবৈশাখী প্রবল আক্রোশে সমস্ত রাত তাকে খুবলে খুবলে আর ছোবল মেরে রক্তাক্ত করেছে।

শরীরের এতোটুকু জায়গাও ফাকা রাখেনি। তবুও ক্লান্ত বটগাছের মুখে আত্মতৃপ্তির ছোঁয়া। তালগাছের শরীরে আঁচড় লাগতে দেয়নি সে। "কেন বাচালে আমাকে?" বটগাছ কে জিজ্ঞাসা করে সে। "এমনি।

" "না এমনি না। " মাথা নাড়ে তালগাছ। " নিশ্চয়ই কোন কারন আছে। আমি মরে গেলেই তো ভালো হতো তোমার। তারপরেও কেন বাচালে? অদ্ভুত তো।

" "বললাম তো এমনি। " "না এমনি না। কারন বলো। " " বা রে! তুমি চলে গেলে আমি ঝগড়া করবো কার সাথে? আমার একা একা লাগবে না?" খিলখিল করে হেসে ওঠে তালগাছ। " আমি তো চিরকাল থাকবো না।

একদিন তো আমাকে যেতেই হবে। তখন? তখন কি হবে?" "কেন যেতে হবে?" জিজ্ঞাসা করে বটগাছ। "বাহ! আমি তো মাত্র ৭০-৮০ বছর বাঁচবো। আর তুমি তো বেঁচে থাকবে সেই ৪০০ বছর। তখন কিভাবে কাটাবে তুমি?" বটগাছ কোন উত্তর দিতে পারে না।

সে এভাবে চিন্তা করেনি। তালগাছ সত্যিই চলে যাবে? বিশ্বাস হয়না তার। এতো লম্বা সময় কি করে সে তালগাছকে ছাড়া থাকবে? নিজের দীর্ঘ আয়ুকালকে হঠাৎ করেই অভিশাপ মনে হয় তার কাছে। মুষড়ে পড়ে বটগাছ। তাকে অত্যন্ত বিমর্ষ লাগছে।

তার বিমর্ষ মুখ দেখে তালগাছ বলে- "কি হলো? অমন হাড়ির মতো মুখ করে রেখেছো যে? আমি কি আজই চলে যাচ্ছি নাকি?" "তো কি হয়েছে? একদিন তো যাবে। " "যখন যাবো, তখন মুখ ভার করে রেখো। আসো, যতদিন আছি, ততোদিন সুখ দুঃখের গল্প করি। " প্রলয় শেষে প্রকৃতি আবার নতুন করে জেগে ওঠে। আবারো নীড়ে ফেরে পাখিরা।

আবারো আগের মতো মানুষজন বটের ছায়ায় এসে বিশ্রাম নেয় দুপুরে। তালগাছ আর বটগাছ পাশাপাশি থেকে সুখ দুঃখের গল্প করে। মাঝে মাঝে বটগাছের খুব ইচ্ছে হয় তার মনের গোপন কথাটা তালগাছকে বলতে। কিন্তু পরক্ষনেই ভয় হয়। তার নিজের চেহারা কুৎসিত ও কদাকার।

সে তালগাছের মতো সরু না, বরং মোটা। তালগাছ লম্বা, আর সে কতো খাটো। তালগাছ এটা নিয়ে তাকে মাঝে মাঝেই খোটা দেয়। ভালোবাসার কথা বললে যদি তালগাছ তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যদি আর কথাই না বলে? বটগাছ আর ভাবতে পারে না। গোপন কথাটাও বলা হয়না।

ওদিকে তালগাছ ভাবে, বটগাছ কতো সুন্দর। তার মতো ঢ্যাঙা না, বরং সুদৃঢ়। তার মতো লম্বুও না। বটগাছও তালগাছের চেহারা নিয়ে দিনের মধ্যে চল্লিশবার খোটা দেয়। তালগাছেরও বটগাছকে নিয়ে গোপন কথা আছে।

কিন্তু তা বললে যদি বটগাছ রেগে যায়? যদি তার সাথে আর কথা না বলে? শেষ দিনগুলো যদি নীরবেই দাড়িয়ে থাকা লাগে তার? তবে কেমন হবে? তালগাছেরও কিছু বলা হয়না। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বেলা গড়িয়ে পড়ে। সূর্যটা পুরনো লাগে। অবশেষে একদিন তালগাছ ডাক দেয় বটগাছকে।

"আমি চলে যাচ্ছি। " বলে সে। "কোথায়?" হতবিহব্বল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে বটগাছ। "যেখানে যাওয়ার কথা, সেখানে। " মৃদু হাসে তালগাছ।

বটগাছ চিৎকার করে ওঠে। "না। যেও না। আরও কিছুদিন থাকো আমার সাথে। তুমি চলে গেলে আমি অনেক একা হয়ে যাবো।

" "একা হবেনা। " বলে তালগাছ। "ঐযে চেয়ে দেখো, তেপান্তরের মাঠ আর তেপান্তরের মাঠ নেই। এখানে জন্ম নেবে লোকালয়। বাচ্চারা খেলা করবে।

গড়ে উঠবে নগরী। তোমার আর কখনো একা লাগবে না। " "না, তবু যেও না। " কেঁদে ওঠে বটগাছ। "আমার যে সময় হয়ে এসেছে।

আমাকে যে যেতেই হবে" বলে তালগাছ। তার নিজেরও গলা ধরে আসে। বটগাছ কাঁদে আর কাঁদে। তার কান্না দেখে তালগাছের চোখটাও ভিজে ওঠে। "কেঁদো না।

আমার খারাপ লাগছে। " "তুমি কি জানো তোমাকে আমি ভালবাসতাম?" কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে বটগাছ। "তো বলোনি কেন?" "ভেবেছি এটা শুনলে তুমি রাগ করবে। " " তুমি একটা বোকা!! এবার শোন, আমিও তোমাকে অনেক ভালবাসতাম। " "তো তুমি বলোনি কেন?" "আমিও একই কথাই ভেবেছিলাম।

আমি তো তোমার মতো না। আমি ঢ্যাঙা আর কদাকার। " দুজনে আর কোন কথা বলতে পারেনা। টপ টপ করে চার চোখ থেকে শুধু বৃষ্টি ঝরে। "আমি যদি আমার জীবনটা তোমাকে দিয়ে দিতে পারতাম।

" কাঁদতে কাঁদতে বলে বটগাছ। "উহু। তার দরকার নেই। জীবনটা অল্প সময়ের জন্যই সুন্দর। এইযে দেখো, তোমার সাথে কি সুন্দর একটা জীবন কাটিয়ে গেলাম।

নিঃসঙ্গতা আমাকে ছুঁতে পারেনি। জীবন আসলেই অনেক সুন্দর। তাই না?" বটগাছ জবাব দেয় না। একটু থেমে তালগাছ বলে- "আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি তোমার কাছে আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা রেখে যাচ্ছি।

" "কি সেটা?" "দেখবে। সময় হলেই দেখবে। শুধু আমাকে বলো, তুমি তার দায়িত্ব নেবে। তুমি তাকে দেখে শুনে রাখবে। তার মাঝেই আমার ছায়া দেখতে পাবে তুমি।

" সেই রাতে পাখিদের আর ঘুম আসেনি। নীড় ছেড়ে তারা উড়েছিল আকাশের উঁচুতে, আরও উঁচুতে। আরও উঁচুতে। ভোর হলো, সূর্য উঠলো। কিন্ত সেই ভোরের সূর্য আর দুইজন দেখলো না।

দেখলো শুধু আজ একজন। ---------------------------------------------------------- শূন্য প্রান্তরে লোকালয় গড়ে ওঠেনি। শূন্য প্রান্তর শুন্যই আছে এখনো। তবে ছোট ছোট বাচ্চারা আজকাল খেলা করে সেখানে। বাচ্চাগুলোর জন্য স্নিগ্ধ বিকেলগুলো আরও বেশি মায়াময় লাগে।

বৃদ্ধ বটগাছটার পাশে দাড়িয়ে বিকেলের বাতাসে দোল খায় ছোট্ট তালগাছটি। মা তালগাছ চলে গেছে, মেয়েটাকে রেখে গেছে ঠিক তার জায়গায়। বটগাছের উপরে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে মেয়েটাকে দেখাশোনা করার। বটগাছ তাই তার বাবা না হয়েও বাবা। আকাশে সেই পুরনো বিকেলগুলোর মতোই পাখি উড়ে বেড়ায়।

ছোট্ট তালগাছের তা দেখে বড় আনন্দ হয়। বটগাছকে সে বলে- "বাবা, আমি আকাশে উড়বো। " "ধুর বোকা। " বলে বটগাছ। "তোর কি পাখা আছে যে আকাশে উড়বি? তোর উড়তে হবে না, পাখিরাই উড়ে উড়ে তোর কাছে আসবে।

তার চেয়ে সন্ধ্যা নামুক, আজ তোকে বরং আকাশের তারা চিনাবো। " শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকে বৃদ্ধ বটগাছ আর ছোট্ট তালগাছ। বাবা এবং কন্যা। দিনগুলো ঠিক পুরনো দিনগুলোর মতো। নির্জন প্রান্তরে দাড়িয়ে তারা দুইজনে অপেক্ষা করে চলে আকাশের তারাগুলোর জন্য।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।