-----
অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল প্যারিসে । কিন্তু এরকম ধারা ব্যাপার
বার্লিন, ভিয়েনা, লন্ডন, প্রাগ যে-কোনো জায়গায় ঘটতে পারত ।
প্যারিসে আমার পরিচিত যে কয়টি লোক ছিলেন তাঁরা সবাই গ্রীষ্মের অন্তিম নিঃশ্বাসের দিনগুলো গ্রামঞ্চল অথবা সমুদ্র-তীরে কাটাতে চলে গিয়েছেন । বড্ড একা পড়েছি ।
ন্যাশনাল লাইব্রেরি আর গিমে ম্যুজিয়মে সমস্ত সময় কাটানো যায় না –প্যারিসের ফুর্তিফার্তি রঙ্গরস করা হয়ে গিয়েছে, তার পুনরাবৃত্তিতে আর কোনো নূতন তত্ত্ব নেই ।
এসব কথা ভাবছি আর প্লাস দ্য লা মাদলেনের জনতরঙ্গে গা ভাসিয়ে দিয়ে সমুখপানে এগিয়ে চলেছি এমন সময় শুনি, বঁ সোয়ার মসিয়ো ল্য দকতর । ’ তাকিয়ে দেখি ফ্রান্সের লক্ষ লক্ষ সুন্দরী যুবতীদের একজন । চেনা চেনা মনে হয় কিন্তু চেষ্টা করেও নামটা স্মরণ করতে পারলুম না । অনেকখানি অভিমান মাখিয়ে সুন্দরী অনুযোগ করলেন, ‘চিনতে পারলেন না, অথচ প্যারিসের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পূর্বেও আপনি আমাকে চিনতেন । ’ ঠাস করে মাষ্টারমশায় চড় মারলে ছেলেবেলা যে-রকম মন্টোনিগ্রোর রাজধানীর নাম আচম্বিতে মনে পড়ে যেত ঠিক সেই রকম এক ঝলকে মনে পড়ে গেল দেশ থেকে মার্সেই হয়ে প্যারিস আসার সময় ট্রেনে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ।
হ্যাট পূর্বেই তুলেছিলাম, এবারে বাও করে বললুম, ‘হাজার অনুশোচনা, মনস্তাপ এবং ক্ষমা-ভিক্ষা, মাদমোয়াজেল শাতিন্নো । ’ কায়দাকানুন বাবদে প্যারিস লক্ষ্মৌ-এ বিস্তর মিল আচে । বিটাকে যদি প্যারিসে এটিকেট সম্বন্ধে দ্বিধাগ্রস্ত হন মবে নির্ভয়ে লক্ষ্মৌ চালাবেন । পস্তাতে হবে না । ইতর ব্যাপারে ‘যাহা অল্প তাহাই মিষ্ট’ হতে পারে, কিন্তু ভদ্রতার ব্যাপারে ‘আধিক্যে দোষ নেই ।
’
মাদমোয়াজেল ক্ষমাশীলা । ‘আঁশাঁতে(enchanted) । ’ বলে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন । আমি দস্তনা পরা হাত ঠোঁটের কাছে ধরলুম-শাস্ত্রে বলে চুমো খাবে, কিন্তু অল্প পরিচয়ে ‘ঘ্রাণেন অর্ধভোজনং’ সূত্রই প্রযোজ্য । মাদমোয়াজেল বললেন, ‘মা-হারা শিশুর মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন যে ? আমি বললুম, ‘ললাট লিখন,’ তিনি বললেন, ‘ চলুন আমার সঙ্গে সিনেমায় ।
’
খেয়েছে ! একে তো সিনেমা জনিসটার প্রতি আমার বিতৃষ্ণা, তার উপর ঈষৎ অনটনে দিন কাটাচ্ছি । একেবারে যে দরিয়ায় পড়েছি তানয়, কিন্তু একটুখানি ইয়ে-অর্থাৎ কিনা দু’দন্ড জলে গা ভাসাতে হলে যে গামছার প্রয়োজন মা-গঙ্গাই জানেন তার অভাব কিছুদিন ধরে যাচ্ছে । আনিটা সিকিটা করব আর ফুর্তিও হবে এমন হিসিবি ব্যসনে আমি বিশ্বাস করিনে । তাই আমার গড়িমসি ভাব দেখে মাদমোয়াজেল বললেন, ‘আমার কাছে দুখানা টিকিট আছে-‘পশ্চিম রণাঙ্গন নিশ্চুপ’ বইখানার প্রশংসা শুনেছি । ’ আর এড়াবার পথ রইল না ।
মাদমোয়াজেল বললেন, ‘এখানে তো ঘন্টাখানেকের বাকি । কাফেতে । ’ ‘চলুন । ,
ক্লের বিবি যে পানীয়ের ফরমাইস দিলেন তার নাম আমি কখনো শুনিনি, ওয়েটারটা পর্যন্ত প্রথমটায় বুঝতে পারেনি । আনতেও আনেক দেরি হল ।
সে পানীয় এলেনও অদ্ভুত কায়দায় অ প্রকান্ড গম্বুজের মত গেলাসের তলাতে আধ ইঞ্চিটাক ফিকে হলদে,খোদার মালুম কী চীজ । আমি কফির অর্ডার দিলুম ।
ক্লের দশ মিনিটেই সেই খোদার-মালুম-কিশেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ‘চলুন, বড্ড গরম, এখানে আমারদম বন্ধ হয়ে আসছে । ’ তখন ওয়েটার এসে আমাকেই বলল চল্লিশ ফ্রাঁ’ অর্থাৎ চার টাকার কাছাকাছি । বলে কা ? ওই তিন ফোঁটা-যাকগে ।
ক্লের তখন ব্যাগ থেকে রুমাল বের করছিলেন; ব্যাগ বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘আপনিই দেবেন, সে কি ?’ আমি বললুম, ‘নিশ্চয়,আনন্দের কথা, হেঁ হেঁ । ’
বেরিয়ে এসে ক্লের প্যারিসের পোড়া পেট্রলভরা বাতাসের লম্ব দম নিয়ে বললেন, ‘বাঁচলুম । কিন্তু এখানে তো অনেক সময় বাকি । কোথায় যাই বলুন তো ?’
দেশে থাকতে আমি ম্যালেরিয়ায় ভুগতুম । সব সময় সব কথা শুনতে পাইনে ।
ক্লের বললেন, ‘ ঠিক, ঠিক, মনে পড়েছে । সিনেমার কাছেই খোলা হাওয়ায় একটা রেস্তরাঁ আছে । আপনার ডিনার হয়ে যায়নি তো ?’
বাঙালীল বদ অভ্যাস আমারও আছে । ডিনার দেরিতে খাই । তবু ফাঁড়া কাটাবার জন্য বললুম, ‘আমি ডিলার বড় একটা-’
বাধা দিয়ে ক্লের বললেন, ‘আমিও ঠিক তাই ।
মাত্র এক কোর্স খাই । সুপ না, পুডিং না । রাত্রে বেশী খাওয়া ভারী খারাপ । অগস্টের প্যারিস ভয়ঙ্কর জায়গা । ’
ততক্ষনে ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়েছে ।
প্যারিসের ট্যাক্সিওয়ালা ফুটপথে মেয়েদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে গ্রাহক কি না ঠিক ঠিক বুঝতে পারে ।
জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারলুম রবীন্দ্রনাথ কতো বিদনা নিয়ে লিখেছলৈন;
‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ । ’
নিশ্চই ট্যাক্সি চড়ে এসে গিয়েছিলেন, মিটার খারেপ ছিল এবং ভাড়াও আপন ট্যাক থেকে দিতে হয়েছিল । না হলে গানটার কোন মানেই হয় না । পায়ে হেঁটে গেলেদ দু’মাইল চলতে যা চর্চা, দু’লক্ষ মাইল চলতে তাই ।
বাহারে রেস্তোরাঁ কুঞ্জে কুঞ্জে টেবিল । টেবিলে টেবিলে ঘন সবুজ প্রদীপ । বাদ্যিবাজনা, শ্যাম্পেন, সুন্দরী, হীরের আংটি আর উজির-নাজির কোটাল । আমার পরনে গ্রে ব্যাগ আব ব্লু ব্লেজার । মহা অস্বস্তি অনুভব করলুম ।
ক্লের ওয়েটারকে বললেন, ‘কিছু না, শুদ্ধু ‘অর দ্য ভর’। ’
‘অর দ্য ভর’ এল । বিরাট বারকোষে ডজন খানেক ভিন্ন ভিন্ন খাদ্য খোপেখোপে সাজানো । সামোন মাছ, রাশান ষ্যালাদ, টুকরো টুকরো ফ্রাঙ্কফুটার, টোস্ট-সওয়ার- কাভিয়ার, ইয়োগুৎ (দই) , চিংড়ি, স্টাফট অলিভ, সিরকার পেঁয়াজ-এক কথায় আমাদের দেশের সাড়ে বত্রিশ ভাজা । তবে দাম হয়ত সারে বত্রিশ শ’ গুণেরও বেশী হতে পারে ।
একেই বলে ‘এক কোর্স খাওয়া !’কোথায় যেন যেন পড়িছি মোতি-লালজী সাদাসিদে কুটির বানাতে গিয়ে লাখ টাকার বেশী খর্চা করেছিলেন । তালিমটা নিশ্চয় প্যারিসের ‘এক কোর্স খাওয়া’ থেকে পেয়েছিলেন ।
ওয়েটার শুধাল, ‘পানীয় ?’
ক্লের ঘার বাঁদিকে কাত করে বললেন, ‘নো’, তারপর ডান দিকে কাত করে বললেন, ‘উয়ি’, ফের বাঁদিকে ‘নো’ফের ডান দিকে ‘উয়ি’-
আমার ‘দোলাতে দোলে ডান দিকে নড়ল, অর্থাৎ লাল পানি ।
ক্লের দুফোঁটা ইংরেজীও জানেন । যে পানীয় অর্ডার দিলেন তার গুনকীর্তন করতে গিয়ে আমাকে
বুঝিয়ে বললেন, ‘ইং ইজ নৎ এ দ্রীনক বাৎ এ দ্রীম (স্বপ্ন) মিসয়ো, এ জিনিস ফ্রান্সের গৌরব, রসিকজনের মোক্ষ, পাপী তাপীর জর্দন জল ।
’
নিশ্চই । স্বযং রবীন্দ্রনাথ এক র্কোস খাওয়া শেষ হতে না হতেই ওয়েটার এসে আমাদের বলল হঠাৎ এক চালান তাজা শুক্তি এসে পৌঁচেছে । সমস্ত রেস্তরাঁয় আমরাই যে সবচেযে দামী দামী ফিনসি খাদ্য খাবার জন্য এসেছি, এ তত্ত্বটা সে কি করে বুঝতে পেরেছিল, জানি নে । মৃদঙ্গের তাল পেলে নাচিয়ে বুড়ীকে ঠেকাতে যায় না, এ সত্যও আমি জানি, কাজেই ক্লের যখন ফরাসী শুক্তির উচ্ছ্বাসে গেয়ে তার এক ডজন অর্ডার দিলেন, তখন আমি এইটুকু আশা আঁকড়ে ধরলুম যে, যদি কোনো শুক্তির ভেতর থেকে মুক্তো বেরোয় তবে তাই দিয়ে বিল শোধ করব ।
ক্লের ঢেকুর তোলোননি ।
না জানি কত যুগ ধরে তপস্যা করার ফলে ফরাসী জাতি একডজন শুক্তি বিনা ঢেকুরে খেতে শিখেছে । ফরাসী সভ্যতাকে বারম্বর সমস্কার ।
প্রায় শেষ কপর্দক দিয়ে বিল শোধ করব ।
সে রাত্রে সিনেমায়ও গিয়েছিলুম । পাঁচ সিকের সিটে বসে ‘অল কোয়াটের’ বন্দুক কামানের শব্দের মাঝখানেও ক্লের ঘুমের শব্দ শুনতে পেয়েছিলুম ।
‘নাক ডাকা’টা বললুন না, গ্রাম্য শোনায় আর ফরাসী সভ্যতার দায় যতক্ষন সে জাগ্রত আছে ।
রাত এগারোটায় সিনেমা শেষে যখন বাইরে এসে দাঁড়ালুম, তখন ক্লের বললেন, ‘কোথায় যাই বলুন তো,আমার সর্বাঙ্গ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে । ’
আমি বলতে যাচ্ছিলাম ‘নৎর দামের গির্জেয় । সেই একমাত্র জায়গা যেখানে পয়সা খর্চা না করেও বসা যায়’, কিন্তু চেপে গেলুম, ‘আমাকে এই বেলা মাড করতে হচ্ছে মাদমোয়াজেল শাতিন্নো । কাল আমার মেলা কাজ, তাড়াতাড়ি না শুলে সকালে উঠতে পারব না ।
’
ক্লের কি বললেন আমি শুনতে পাইনি । ভদ্রতার শেষরক্ষা করতে পারলুম না বলে এএকটু দুঃখ হল । ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে দশমীর বিসর্জনের মত দেবিপূজার শেষ অঙ্গ । এত খর্চার পর সবকিছু ‘এটুকু বাধায় গেল ঠেকি ?’ চাবুক কেনার পয়সা ছিল না বলে দামী ঘোড়াটাকে শুধু দানা-পানিই খাওয়াতুম, জিনটা পর্যন্ত লাগানো গেল না ।
বাস-ভাড়া দিয়ে দেখি আমার কাছে আছে তিনটে কফি, একখানা স্যানউইচ আ পাঁচটি সিগারেটের দাম।
আমার কপাল-বাসের টায়ার ফাটল । আধ মাইল পথ হাঁটতে হবে ।
প্যারিসের হোটেলগুলো বেশির ভাগ সংযমী মহল্লায় অবস্থিত । সংযমীর বর্ণনায় গীতা বলেছেন সর্বভূতের পক্ষে যাহা নিশা সংযমী তাহাতে জাগ্রত থাকেন । তারপর সংযমী সেই নিশাতে কি করেন তার বর্ণনা গীতাতে নেই ।
আমার ডাইনে বাঁয়ে যে জনতরঙ্গ বয়ে চলেছে, তাদের চেহারা দেখে তো মনে হল না তাঁরা পরমার্থের সন্ধানে চলেছেন । তবে হয়ত এরা অমৃতের সন্তান-অমৃতের সন্ধানে বেরিয়েছেন আর অমৃতের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক ঋষি বলেছেন, ‘অমৃতাস্তি সুরালয়েষু’ অথবা ‘বর্ণিতাধরপল্লবেষু । ’
ভারতবর্ষের হিন্দু মূর্খ, সে কাশী যায়, মুসলমান মূর্খ, সে মক্কা যায় । ইয়োরোপীয় সংযমী মাত্রই অমৃতের সন্ধানে প্যারিসে যায় ।
প্রারিস নীশাভাগে নারীবর্জিতাবস্থায় চলনে পদে পদে বর্ণিতাধরপল্লবেষু থেকে আপনার কর্ণকুহরে অমৃত প্রবেশ করবে ‘বঁ সোয়ার মসিয়ো-আপনার সন্ধ্যা শুভ হোক ।
’ আপনি যদি সেএ ডাকে সাড়া দেন তবে-তবে কি হয় না হয় সে সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার নেই, প্রয়োজনেও নেই, এমিল জোলার মল্লিনাথও আমি হতে চাই নে । শরৎ চাটুয্যে যা লিখেছেন, তা আমার এখনও হজম হযনি ।
হোটেল আর বেশী দূরে নয়-মহল্লাটা ঈষৎ নির্জন হয়ে আসছে । হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিলুম, তাই আপন অজানাতে একটা ‘বঁ সোয়ারের’ উত্তর দিয়েই বুঝতে পারলুম ভুল করে ফেলেছি । এক সন্ধ্যায় দুই সুন্দরী সামলানো আমার কর্ম নয় ।
আমার পূর্বপুরুষগণ একসঙ্গে চার সুন্দরী সামলাতে পারতেন । হায়,আমার অধঃপাত কতই গগনচুম্বী থেকে কতই অতলস্পর্শী ।
নাঃ এঁর বেশভূষা দেখে মনে তো হচ্ছে না ইনি ‘বসন্তসেনার’ সহোদরা, যদিও ‘দরিদ্র চারু দত্ত’ আমি নিশ্চই বটি । এরকম নিখুঁত সুন্দরী রাস্তায় বেরুবে কেন ? তবে হাঁ, তুলসীদাস বলেছেন, সংসার কি অদ্ভুদ রীতিতে চলে দেখ, শুঁড়ি দোকানে বসে মদ বিক্রয় করে, সেখানে ভিড়েরও অন্ত নেই,আর বেচারী দুধওলাকে ঘরে ঘরে ফেরি দিয়ে দিয়ে দুধ বিক্রয় করতে হয় । ’ কিন্তু এ নীতি তো হেথায় খাটে না ।
আমি বললুম, ‘অপরাধ নেবেন না; কিন্তু আপনাকে ঠিক প্লেস করতে পারছি নে । ’
সুন্দরী স্মিত হাস্য করলেন, বীণার পয়লা পিড়িঙের মত একটা ধ্বনিও বেরুল । সে হাসি একই লাজুক আর মিঠা যে তকখুনি চিনতে পারলুম যে এঁকে আমি চিনি নে । এরকম হাসি অতি বড় অরসিকও একবার দেখলে ভুলতে পারে না ।
কি করি, এ যে আবার আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে আরম্ব করেছেন ।
এ-সুহাসিনী রসের হাটের বসন্তসেনা নিশ্চই নয়, তবে এরকম গায়ে পড়ে আলাপ করল কেন ? আর ভালো-মন্দ কোনো কিছু বলছেই না কেন ? এ কি রহস্য । নাঃ, কালই প্যারিস ছাড়ব । ক্রসওয়ার্ড আমি কাগজেই পছন্দ করি, জীবনে নয়।
হঠাৎ হোঁচট খেয়ে বেচারী পড়ে গেল । আমি তাড়াতাড়ি তাকে তুলে ধরলুম ।
শুধালুম, ‘কি হয়েছে । ’ বলল, ‘রাস্তায় দোষ নয়,আমি বড্ড ক্লান্ত । ’
আমি জানি আমার পাঠকরা আমাকে আর ক্ষমা করবেন না, বলবেন, ‘ওরে হস্তীমূর্খ এক সন্ধ্যায় দু’ দু’বার ইত্যাদি । ’ তবু স্বীকার করছি আমি আবরন সেই আহাম্মুখিই করলুম । কিন্তু এবার সোজাসুজি, প্যারিস-লক্ষ্মৌকে তিন-তালাক দিয়ে ।
বললুম, ‘আমার কাছে তিনটে কফি,একটা স্যানউইচ আর পাঁচটি সিগারেটের দাম । কোনো কাফেতে গিয়ে একটু জিরোবেন । ’
বলল, ‘আমি শুধু কফি খাব । ’
কাফেতে বসিয়ে বললুম, ‘কফি স্যানউইচ খেয়ে বাড়ি যান । ’
কিছু বলল না, আপত্তিও জানাল না ।
কাফেতে কড়া আলোতে মেয়েটির চেহারা দেখে মনে হল এর দুর্বলতা না-খেতে পেয়ে ।
প্রম অন্ধ কিন্তু প্যারিস তো প্রেমিক নয় । তবে সে এ-সুন্দরীকে উপোস করতে দিচ্ছ কেন ? কিন্তু সে রহস্য সমাধানের জন্য একে প্রশ্ন করা বর্বরতা তো বটেই, তাই নিয়ে আপনমনে তোলপাড় করা অনুচিত। পৃথিবীর অনাহার ঘোচাবার দাওয়াই যখন আমার হাতে নেই তখন রোগের কারণ জেনে কি হবে ?
হঠাৎ মেয়েটি বলল, ‘তুমি ভুল বুঝেছ আমি যে-’
আমি বললুম, ‘চুপ, আমি কিছু শুনতে চাইনে । ’
বলল, ‘তাই vous(আপনি) না বলে tu(তুমি) বললুম ।
তবে নূতন নেবেছি । কাল রাত্রে প্রথম । কিন্তু কেউ আমার কাছে ঘেঁষল না সাহস করে,আমার চেহারা তো ওরকম নয় আমি জানি । আমিও কাউকে সাহস করে ‘বঁ সোয়ার’ বলিনি ?’
বোধ হয় বিদেশী-, না, কি জানি কেন । ঠিক বলতে পারব না ।
’
আমি বললুম, ‘থাক, আমি সত্যি কিছু শুনতে চাইনে । ’
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কিন্তু আজ রাত্রে যে করেই হোক আমাকে খদ্দের যোগার করতেই হবে । আজ সকালেই ল্যান্ডলেডি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে চেয়েছিল । ’
রাত ঘনিয়ে আসছে,আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হল, ‘আপনি বাড়ি যান আর নাই যান,আমার সঙ্গে বসে থাকলে তো আপনার- । জানেন তো, পুরুষের সঙ্গে বসে আছেন দেখলে কেউ আপনার কাছে আসবে না ।
রাতও অনেক হয়েছে। এখন মাতালেন সংখ্যা বেড়েই চলবে । ’
কেঁপে ওঠেনি, কিন্তু তার মুখখানি একটু বিকৃত হল ।
কোনো কথা কয় না । বড় বিপদে পড়লুম, ‘আমি তা হলে উঠি ?’
বলল, ‘কেন? আমার সঙগে বসতে চাও না ।
’
আমি তাড়াতাড়ি মাপ চেয়ে বললুম, ‘না, না, তা নয় । আপনাকে সত্যি বলছি । কিন্তু আমার সঙ্গে বসে থাকলে আপনার সময় যে বৃথায় যাবে । ’
বলল, তুমি আমাকে কফি খাওয়ালে । ’
কাতর হয়ে বললুম, ‘প্লীজ জিনিসটা এরকম ধরে নেবেন না ।
’
‘তা হলে তুমি আমাকে কফি খাওয়ালে কেন ?’
আমি বললুম, ‘প্লীজ, প্লীজ, এসবের কথা বাদ দিন । ’
বলল, ‘কেউ তো খাওয়ায় না । না, তুমি বসো । তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার সত্যি ভালো লাগছে। ’
এই দুঃখ বেদনার মাঝখানেও এর সাহচর্য যে আমাকে টানছিল সে-কথা অস্বীকার করে আপন দাম বাড়াতে চাইনে ।
বলল, ‘আর জানো, তুমি চলে গেলেই আমাকে ‘বঁ সোয়ারের’ পাত্র খুঁজতে বেরুতে হবে । আমি আর সাহস পাচ্ছি নে । ’
হায় অরক্ষণীয়া, তুমি কি করে জানলে প্যারিস কত রুঢ় কত নিষ্ঠুর ।
বললুম, ‘আজ তাহলে থাক না । আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দি ।
কোথায় থাকেন বলুন তো ?’
‘কাছেই, লাভনীর হোটেলের পাশের হলিতে । ’
খুশী হয়ে বললুম, ‘তা হলে চলুন, আমি লাভনীরেই থাকি । ’
রাস্তায় চলতে চলতে সে আমার বাহু চেপে ধরল । হাতের আঙুল কোনো ভাষায় কথা বলে না বলেই সে অনেক কথা বলতে পারে । তার কিছুটা বুঝলুম, কিছুটা বঝেও বুঝতে চাইলাম না ।
হঠাৎ মেয়েটার কেমন যেন মুখ খুলে গেল; বোধ হয় সে রাত্রে ‘বঁ সোয়ার’ বলার বিভীষিকা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে বলে । বলতে লাগল, পয়সা রোজকারের কত চেষ্টা সে করেছে, কত চাকরি সে পেয়েছে, তারপর যারা চাকরি দিয়েছে তারা কি চেয়েছে, কি রকম জোর করেছে, সে পালিয়েছে, আরো কত কি ?.
আর কি অদ্ভুদ সুন্দর ফরাসী ভাষা । থাকতে না পেরে বাধা দিয়ে বললুম, ‘আপনি এত সুন্দর ফরাসী বলেন । ’
ভারী খুশী হয়ে গর্ব করে বলল, ‘বাঃ । দোদে পরিবারের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল যে ।
’
তাই বলো । আলফঁস দোদের মত ক’টা লোক ফরাসী লিখতে পেরেছে ।
হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে সে অনেক কথা বলে ফেলল ।
হোটেলে পেরিয়ে মেয়েটির বাড়ি যেতে হয় । দরজার সামনে সে দাঁড়াল ।
আমি বললুম, ‘চলুন, ‘আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দি । ’ বলল, ‘না । ’ আমি বললুম, ‘সে কি ?’ উত্তর না পেয়ে বললুম, ‘তা হলে বন ন্যুই-, শুভরাত্রি-তুমি এইটুকু একাই যেতে পারবে । ’ শেকহ্যান্ড করার জন্য তার হাত ধরেছিলুম । সে হাত ছাড়ল না ।
মাথা নীচু করে বলল, ‘তুমি আমাকে তোমার ঘরে নিয়ে চলো । ’
আমাকে বোকা বলুন, মেয়েটিকে ফন্দিবাজ বলুন, যা আপনাদের খুশী, কিন্তু আমার ধর্ম সাক্ষী আমি তাকে খারাপ বলে কিছুতেই স্বীকার করে নিতে পারলুম না । বললুম, ‘আমার সামার্থ্য নেই যে তোমাকে সত্যিকার সাহায্য করতে পারি, কিন্তু তোমাকে ভগবান যে সৌন্দর্য দিয়েছেন তাকে বাঁচাতে পারলে যে-কোনো লোক ধন্য হবে। ’ ‘ভগবান শব্দটা প্যারিসের পথে বড় বেখাপ্পা শোনাল ।
মেয়েটি মাথা নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ।
আমি বললুম, ‘কি হবে বৃথা উপদেশ দিয়ে । তুমি বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে । ’
আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল । ডাগর ডাগর দু’চোখ আমাকে কি বলল সে কথা আজও ভুলিনি । আমার দিকে ও-রকম করে আর কেউ কখনো তাকায়নি ।
তারপর আস্তে আস্তে সে আপন বাড়ির দিকে রওয়ানা হল ।
আমি মুগ্ধ হযে অপলকে দৃষ্টিতে দেখলুম, তার সমস্ত দেহটি আপন অসীম সৌন্দর্য বহন করে চলেছে রাজরাণীর মত সোজা হয়ে, আর মাথাটি ঝুঁকে পড়েছে বেদনা আর ক্লান্তির ভারে ।
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই মনে হল, ভুল করেছি । মানুষ সাহায্য করতে চাইলে সর্বাবস্থায়ই সাহায্য করতে পারে । নিজের প্রতি ধিক্কার জম্মাল, এত সোজা কথাটা কাল রাত্রে বুঝতে পারলুম না কেন ।
তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে মেয়েটির-কি মূর্খ আমি নামটি পর্যন্ত জিঞ্জেস করিনি-সন্ধানে বেরুতে যাবার মুখে হোটেলের পোর্টার আমাকে একটি ছোট পুলিন্দা দিল ।
খুলতেই একখানা চিঠি পেলুম;
‘বন্ধু, তোমার কথাই মেনে নিলুম । আজ পাঁচটার ট্রেনে আমি গ্রামে চললুম । সেখানেও আমার কেউ নেই । তবু উপবাসে মরা প্যারিসের চেয়ে সেখানেই সহজ হবে ।
বিনা টিকিটেই যাচ্ছি ।
তোমাকে দেবার মত আমার কিছুই নেই, এই সুয়েটারটি ছাড়া । ভগবানেরই দয়া, তোমার গায়ে এটা হবে।
জ্যুলি। ’
-সৈয়দ মুজতবা আলী
এরকম একটা ক্লাসিক পড়ার পড় যদি একবার লাইক বাটন চাপতে না পারেন সে দীনতা আমার নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।