নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় ইমরানের । এমন ভোরে ,যখন সাদা সুতো থেকে কাল সুতোকে আলাদা করা যায় না । এই ভোরে ইমরানের ঘুম ভাঙ্গার কথা নয়। সাধারণত তার ঘুম ভাঙ্গে সকাল আটটার দিকে । সে হিসেবে তো এখনো তার গভীর ঘুমে থাকার কথা।
কিন্তু অনাগত আন আর ভাল লাগার অদ্ভুত উত্তেজনায় তার চোখ থেকে ঘুম উধাও। গতকাল বিভিন্ন ব্যস্ততা আর কেনাকাটায় তার সময় কেটেছে। বিছানায় যেতে রাত বারটা বেজে যায়। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলেই তো ঘুম আসার কথা,কিন্তু ইমরানের চোখে ঘুম আসছে না। কল্পনার কল্প রাজ্যে ভাসতে ভাসতে কেটে যায় রাতের বেশ কিছু অংশ।
তবুও যতটুকু ঘুম আসে,তাও কেটে ভঙ্গে যায় খুব ভোরে। মনের ভেতর তাগাদা অনুভব করে। সূর্য উঠার আগেই সে পৌঁছে যেতে চায় নদীর পাড়ে। বন্ধুদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সোমার সান্নিধ্য পেতে চায় সে। পাশাপাশি বসে ওর হাতে গোলাপ তুলে দিয়ে বলতে চায়,শুভ নববর্ষ।
ইমরান ঢাকার একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রথম ক্লাসের দিনই তার বন্ধু-বান্দব জুটে যায়। সোমা তাদের একজন। গতকাল বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেয় পহেলা বৈশাখ তারা এবার ব্যতিক্রমভাবে উৎযাপন করবে। নদীর পাড়ে গিয়ে সবাই মিলে মজা করে বর্ষবরণ করবে।
ইমরান জানে না কিভাবে বর্ষবরণ করে । তাই সে প্রশ্ন করে -তোরা কিভাবে বর্ষবরণ করবি?
রাজ নামের এক বন্ধু তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়-সূর্য উঠা সকালে ওখানে পৌঁছে যাব। রবীন্দ্র সংগীত গাব। এরপর সবাই মিলে পান্তা খাব।
-ওখানে পান্তা কোথায় পাবি?
ইমরানের সরল প্রশ্ন শুনে সোমা সমাধান দিয়ে দেয়।
কেন, আমি রান্না করে নিয়ে যাব।
ইমরান অবাক হয়ে জানতে চায়-পান্তা আবার রান্না করতে হয় নাকি?আমাদের বাড়ি তো দূরের কথা,আমাদের গ্রামে কেঊ কোনদিন পান্তা রান্না করেছে এমন কথা কখনও শুনিনি।
ইমরানের কত্থায় যুক্তি আছে। পান্তা মূলত এ দেশের ধনীদের খাবার নয়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় যাদের,পান্তা মূলত তাদেরই খাবার।
আগের রাতে ভাত খাবার পর যা অবশিষ্ট থাকে,তা পানি দিয়ে রেখে দেয়া হয়। পরের দিন সকালে তা বাসি পান্তা নাম ধারণ করে। একটু লবণ,কাঁচা মরিচ আর পিয়াজ দিয়েই চলে সকালের নাস্তার আয়োজন। কোন কোন পরিবারে শুধু লবণ হলেই চলে । অবস্থা খুব খারাপ হলে নুন আসার আগেই পান্তা ফুরিয়ে যায়।
পান্তা এভাবেই হয়। একে আলাদাভাবে রান্না করতে হয় না। অন্তত ইওমরানের গ্রামে কেউ কখনো করে না।
রাজ বলে,শহরে এসেছিস । অনেক কিছুই দেখবি,যা কোনদিন দেখিসনি।
সোমা বলে,পহেলা বৈশাখে পান্তা রান্না করেই খেতে হয়। রান্না না করলে এত ভোরে বাসি পান্তা পাব কোথায়?তাছাড়া রান্না করা হলে পান্তাটা মুখে তোলা যায়। বাসি পান্তাতে যে টক টক গন্ধ,তাতো পাতেই নেয়া যায় না।
ইমরান তর্ক বাড়ায় না । পান্তা রান্না হওয়াতে তার কিছুই আসে যায় না।
পান্তাকে কেন্দ্র করে সে যে সোমার কাছে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে,এটাই তার বড় পাওনা।
বন্ধুরা সব চলে যায়। ইমরানও যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পেছন থেকে সোমা ডাক দেয়-তোমার কি বিকেলে সময় হবে?
-কেন?
-শপিংয়ে যেতাম।
খনিকক্ষণ ভেবে ইমরান জবাব দেয়-হ্যাঁ,সময় হবে।
ইমরান বিকেলে সোমার সাথে শপিংয়ে যায়। প্রচন্ড ভিড়। যেন ঈদের বাজার। ভিড় ঠেলেই ওরা মার্কেটে ঢুকে। এক দোকানে গিয়ে সোমা নিজেরর জন্য জিন্সের প্যান্ট ও পাঞ্জাবী পছন্দ করে।
ইমরান হাসতে হাসতে বলে-তুমি মেয়ে হয়ে পুরুষদের পোশাক কিনছো কেন?
সোমা রেগে যায়। দেখো,তুমি একটা শিক্ষিত ছেলে । আঠারশ শতাব্দী থেকে দু'হাজার এগারোতে ফিরে এসো। আমার ভাবতেই অবাক লাগছে যে,তুমি ছেলে মেয়ে আলাদা করে দেখো!এখন ছেলে মেয়ে সমান। ছেলে্রা জিন্সের প্যান্ট-পাঞ্জাবী পরতে পারলে মেয়েরা পারবে না কেন?
ইমরান সাবলীল ভঙ্গিতে বলে-তাহলে গেঞ্জি আর লুঙ্গি কিনে দেই।
-তুমি ইনসালট করছো। সোমা রেগে জবাব দেয়।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইমরান বলে-পহেলা বৈশাখের জন্য খুব সুন্দর শাড়ি উঠেছে। আমার জন্য কিনলে কেমন হয়?
-শাড়ি মেয়েদের পোশাক। পুরুষদের এটা মানায় না ।
শান্ত কন্ঠে সোমা জবাব দেয়।
-তুমি না বললে নারী-পুরুষ সমান । তাই ঠিক করেছি আমি শাড়ি নিবো।
-পুরুষরা মেয়েদের পোশাক পরলে দেখতে হিজড়া লাগে । তুমি কি হিজড়া?
-ম্যাডাম,পুরুষরা মেয়েদের শাড়ি পরলে যেমন হিজড়া লাগে ,তেমনি মেয়েয়া যখন পুরুষদের পোশাক পরে তখনও তাদের হিজড়া লাগে।
সুতরাং আধুনিকতার দোহাই দিয়ে প্যান্ট-পাঞ্জাবী পরলে তোমাকে দেখতে নারী মনে হবে না,পুরুষও মনে হবে না। তোমাকে দেখতে তখন হিজড়াদের মতই মনে হবে।
ইমরানের কথায় সোমা চুপসে যায়। সে আর প্যান্ট-পাঞ্জাবী চয়েস করে না। সে শাড়ি কিনে।
ইমরান কিনে পাঞ্জাবী। কেনাকাটা শেষে সোমা হলে চলে যায়। ইমরান চলেন আসে মেসে।
ইমরান থাকে দু'সীটের রুমে। অপরজন বাড়িতে যাওয়ায় আজ সে একা।
তার জন্য আজ অনেক সুবিধা । সোমার জন্য খুব সুন্দর করে একটা চিঠি লেখে। নববর্ষের শুবেচ্ছা জানিয়ে নতুন বছর দু'টি জীবনের জন্য শুভ হয়ে আসুক,এই কামনা করে। সেই সাথে ব্যক্ত করে হৃদয়ের কথা। যা সে দেখার প্রথম দিন থেকে বলতে চায়।
ঊত্তেজনা নিয়ে ঘুমায় ইমরান। ভাল ঘুম হয় না। খুব ভোরেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায় আর সাথে সাথে গতকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। খুব ভাল লাগে । বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে যায়।
প্রাকৃতিক কাজ সেরে ব্রাশ নিয়ে মেসের বারান্দায় যায়। মেসের অন্যান্য রুমের সবাই ঘুমাচ্ছে। তবে ইমরানের পাশের রুমে যে দু'ভাই থাকেন তারা জেগে আছেন। তাদের রুমের পাশ দিয়ে যাবার সময় কুরআন শরীফ তেলাওয়াতের আওয়াজ শোনা গেল। ইমরান একটু অবাক হয়।
যে সময় সবাই ঘুমে বিভোর,সে সময় এরা জেগে কুরআন পড়ছে!তারই তিন ইয়ারের সিনিয়র ভাই এরা। খুব বেশী বড়তো নয়।
ইমরান বারান্দায় দাঁড়ায়। কোথাও কোন কোলাহল নেই। পাশের রাস্তায় কোন মানুষ জন নেই।
রিক্সা-সাইকেলের ক্রিং ক্রিং নেই। মিষ্টি বাতাসের কোমল পরশ ইমরানের দেহ-মন ছুঁয়ে যায়। ভোরের এমন মোহনীয় রুপ ইমরান কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। মহল্লার মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসে। ইমরান জীবনে অনেক আজান শুনেছে,কিন্তু কাছ থেকে শুনা আজকের এই নির্মল ভোরের আজানটা তার কাছে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হয়।
সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে একমনে ব্রাশ করে যায়। একজন একজন করে মুসল্লীন দেখতে পায়। ইমরান দেখে আশপাশের বিভিন্ন মেস থেকে তারই বয়সের ছাত্ররা এই ভোরে মসজিদে যাচ্ছে। তাদের অনেকেই তার মুখচেনা। যে ভোরে ইমরান গভীর ঘুমে থাকে কিংবা আজকের ভোরে উঠে একজন নারীর সান্নিধ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে,সে ভোরেই তারই মত তরতাজা যুবক কিনা মসজিদে যায়!
ইমরান গভীর ভাবনায় ডুবে যায়।
এরা কিসের টানে এতো ভোরে মসজিদে যায়?কিসের ভালবাসায়?ঐ যে পাশের ঘরের সিনিয়র দু'ভাই কুরআন শরীফ পড়ছে,তারা তো অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠেছে। তারা কি প্রতিদিনই এতো ভোরে উঠে?ইমরানের অন্তরে প্রশ্ন-উত্তর চলতে থাকে। অন্তরে উত্তর আসে,এরা এক আকর্ষণে এতো ভোরে উঠে।
-আকর্ষণে উঠা যায়?
-হ্যাঁ,যায়। এই যে আজ তুমি উঠলে,সোমার আকর্ষণে।
-এরা কার আকর্ষণে উঠে?
-এরা ঊঠে তার আকর্ষণে,যিনি সোমাকে ,তোমাকে,আমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন।
ইমরান শুনতে পায়,তার অন্তর বলে,এক সোমার আকর্ষণে আজ তুমি ভোরে জেগেছো। এক আল্লাহ,যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন কোনদিন কি তার জন্য জেগেছো?ধিক তোমাকে!আল্লাহ্র সৃষ্টি এক নারীকে পাওয়ার জন্য তোমার এই ব্যাকুলতা। কখনও কি সেই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্কে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়েছো?
ইমরানের বিবেক অজান্তেই জেগে উঠে। ভোরের নির্মল বাতাসে সে যেন সজীবতা ফিরে পায়।
এই ভোরে মসজিদে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করে। সেই প্রাইমারী থাকতে মক্তবে নামাজ,কোরআন শিখেছিল। সেগুলো তার স্পষ্ট মনে আছে। বারান্দায় আর দাঁড়ায় না। ওজু করে।
মসজিদে যাওয়ার জন্য তার কোন পাঞ্জাবী নেই। পহেলা বৈশাখের জন্য কেনা পাঞ্জাবীটা গায়ে দেয়। রুমের দরজা খুলতেই পাশের ঘরের বড় ভাই মাসুদের সাথে দেখা। তিনি বললেন,ইমরান এই ভোরে কোথায় যাচ্ছ?
-ভাইয়া,ইয়ে মসজিদে............
-মসজিদে যাচ্ছ?খুব ভাল কথা। কিন্তু এই ঢোল,ডুগী,তবলার ছবিযুক্ত পাঞ্জাবী নিয়ে আল্লাহর সামনে যাবে?
-কিন্তু ভাইয়া,এছাড়া তো আমার আর পাঞ্জাবী নেই।
-যদি কিছু মনে না কর,তাহলে আমার একটা পাঞ্জাবী পরতে পার।
ইমরান তার সিনিয়র ভাই মাসুদের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে তারই সাথে মসজিদে যায়। জীবনে এই প্রথম সে ভোরে মসজিদে গেল। নামাজ শষে সে যখন মসজিদ থেকে বের হলো তখন তার মনে অন্যরকম আনন্দ,অন্যরকম পরিতৃপ্তির অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আশপাশের যুবকদের দিকে তাকায়।
কারও ভেতর পহেলা বৈশাখের তাড়া লক্ষ্য করে না। আশ্চর্যের বিষয় মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর সে নিজের ভেতরও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কোন তাড়া অনুভব করে না। যখন সে রুমে পৌঁছে,লক্ষ্য করে,যে আকর্ষণ এবং উত্তেজনা নিয়ে তার ঘুম ভেঙ্গে ছিল,এখন মোটেও তা নেই। বরং এখন তার খুব ঘুম পাচ্ছে।
মোবাইল বেজে ঊঠে।
রাজ কল দিয়েছে। ইমরান কল রিসিভ করে না। একটু পরে কল দেয় সোমা। ইমরান লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়। লাইট অফ করে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
নতুন বছরে প্রথম ভোরে সে যে তৃপ্তিলাভ করলো,তা অতুলনীয়। হে নববর্ষ,তুমি সত্যিই শুভ নববর্ষ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।