জীবন মানেই, অনিশ্চয়তায় গা ভাসিয়ে নিশ্চিন্তে পথ চলা। ঘুম থেকে উঠে দেখি ফোনে অনেকগুলো মিসকল। কল ব্যাক করলাম,
- কিরে কোথায় তোরা?
- আমরা তো অনেক দূর চলে এসেছি, তোকে কতবার ফোন করলাম। কই থাকিস?
- আর বলিস না ঘুমায় পড়ছিলাম, ঠিক আছে তোরা বেড়া আমি আবার ঘুমাই।
আজকে ঈদের দিন, ঈদগাহ থেকে নামাজ পড়ে এসে একটু শুয়েছিলাম, ব্যাস ঘুম।
গতকাল ছিল চাদরাত, তাই অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া হয়েছে, আবার সকালে নামাজ পড়তে যেতে হয়েছে। তাই দিনের বেলা ঘুমটা একটু বেশিই পেয়ে বসেছিল। আজকে বন্ধুদের সাথে সারাদিন মোটর সাইকেল নিয়ে ঘোরার কথা ছিল, অনেক মজা করার কথা। কিন্তু আমার আবার ঘুমের সময় ফোন করে কেউ তুলতে পারে না। তাই ওরা আমাকে ফোনে না পেয়ে চলে গেছে।
আফসোস হচ্ছে খুব, যে ওরা আমাকে রেখে কত আনন্দ করছে। এই ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে ঊঠে দেখি বিকেল হয়ে গেছে, আম্মু ডেকে তুলে দিয়ে বললেন, ঈদের দিন কেউ এভাবে ঘুমায়, যা তোর নানার বাসা থেকে বেড়িয়ে আয়, তোর নানী তোকে দেখতে চাইছে, প্রতিবার এসে তো দেখা করিস এবার দেখাও করিস নাই। যা ঘুরে আয়।
বিছানা থেকে উঠে বের হলাম, কিন্তু নানার বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না এখন।
নানা নানী আর মামা মামীরা একটু বেশিই আদর করে, এতো আদর আমার ভালো লাগে না। তাই বাসা থেকে বের হয়ে এলোপাথারি হাটা শুরু করলাম। কিছুদুর যাবার পর একটা চায়ের দোকানে বসলাম চা খাবার জন্য। ঘুম থেকে উঠার পর রঙ চা খেতে ভালোই লাগছিল, তাই একবারে ৩ কাপ চা খেয়ে ফেললাম। এখন কি করব কিছুই বুঝতে পারছিনা, ঈদের দিনটা পুরাই মাটি হয়ে যাচ্ছে।
চা খেতে খেতেই খেয়াল করলাম দোকানের সামনে একটা মেয়ে এসে দাড়িয়েছে। মেয়েটার বয়স ৫/৬ বছর হবে, ময়লা বর্ণ, পড়নে পুরনো ময়লা একটা জামা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে গরিব মানুষের মেয়ে, যে মানুষটি ঈদের দিনেও মেয়ের জন্য একটা নতুন জামার ব্যাবস্থা করতে পারেনি। মনে করলাম মেয়েটি হয়ত ভিক্ষা করতে এসেছে। আমার খুব মায়া হলো মেয়েটিকে দেখে।
এগিয়ে গেলাম, দেখি মেয়েটা কাদছে। মেয়েটির হাতে পাঁচ টাকার একটা নোট দিতে দিতে বললাম, কিরে কাদছিস কেন? আজকে হলো ঈদের দিন, এই দিনে কেউ কাদে নাকিরে? মেয়েটি কাদতে কাদতে বলল, আমি আমার মায়েরে হারায় ফালাইছি। মেয়েটির কথাবার্তা শুনে যা বুঝলাম তা হলো মেয়েটির বাড়ি এখান থেকে অনেক দূর একটা গ্রামে, এখানে সে তার মায়ের সাথে ভিক্ষা করতে এসেছে, সে তার মায়ের সাথে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষা করছিল, কিন্তু হঠাত করে সে তার মাকে খুজে পাচ্ছে না। মেয়েটিকে আমি একটা চকলেট কিনে দিলাম, বললাম তোর মায়ের কাছে ফোন নেই? এই কথাটি বলার পরে আমি নিজেই বোকা হয়ে গেলাম, যার এই ছোট্ট মেয়েটিকে ঈদের দিনে একটা জামা কিনে দেবার সামর্থ নেই তার কাছে কিভাবে ফোন থাকবে। তবে ইদানিং রিক্সাওয়ালাদের কাছেও ফোন থাকে, তবে ভিক্ষুকদের কাছে থাকার কথা নয়।
মেয়েটিকে নিয়ে কি করা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। বললাম, তোদের বাড়িতে তুই একা যেতে পারবি না?, মেয়েটির কান্নাকাটি আরো বেড়ে গেল। সে তার বাড়িতে কিভাবে যেতে হয় সেটা বলতে পারল, কিন্তু একা একা যাবার সাহস নেই তার। আর এই ছোট্ট মানুষটি কিভাবেই বা একা একা ৭/৮ মাইল পথ পারি দিবে। আমি ভাবলাম, আমার তো কোন কামকাজ নাই আমি মেয়েটিকে তার বাসায় দিয়ে আসি, সময়টা তো কাটবে।
মেয়েটিকে নিয়ে রউনা দিলাম, প্রথমে কিছুদুর রিক্সায় তারপর করিমন তারপর নৌকা তারপর হেটে কিছুদুর। আমার ভালই লাগছিল, অনেক রকম ভ্রমন হয়ে যাচ্ছে একসাথে। যখন নৌকায় করে যাচ্ছিলাম তখন সন্ধ্যা লেগে গেছে, সন্ধ্যা বেলা নৌকা ভ্রমনটা আসলেই অনেক ভালো লাগল, মনে হচ্ছিল ঈদের সকল আনন্দ বুঝি এখানেই হয়ে গেল। মেয়েটির বাসা লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন একটা গ্রামে। ঘরবাড়ি দেখে বোঝাই যায় যে এই গ্রামে সকল মানুষই গরিব, ভিক্ষুক বা শ্রমিক শ্রেণীর হবে।
ঈদের দিনের কোন আমেজ নেই, এদের কাছে ৩৬৫ দিনের মাঝে কোন পার্থক্য নেই, প্রতিদিনই তারা রুর বাস্তবতার সাথে লড়াই করেই বেচে থাকে। মেয়েটির বাসায় যখন পৌছেছি ততক্ষনে অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিকে। চাদের আলোও নেই, দুই একটা বাড়িতে মিটিমিটি কেরসিনের বাতি জ্বলছে। ফোনেও দেখি কোন নেটওয়ার্ক নেই। মেয়েটিকে পৌছে দিলাম বাসায়, কিন্তু এখন আমার নিজের তো বাসায় ফিরতে হবে একা একা।
এমন একটা জায়গায় এসে পরেছি যে এখানে কেউ আমাকে খুন করে সবকিছু নিয়ে গেলেও দেখার কেউ নেই। এখানে আমিও কাউকে চিনি না আমাকেও কেউ চেনে না। তাই ভয়ে ভয়ে বাসায় আসার জন্য বের হলাম। কিছুক্ষন হাটার পর অদুরে ঢোল আর হারমোনিয়াম এর সুর শুনতে পেলাম। এগিয়ে গেলাম ঐদিকে, গিয়ে দেখি এক বাড়ির ঊঠানে লালন গীতি গাইছে বুড়া গোছের একজন মানুষ।
তার সাথে আরো কয়েকজন দোহার আর বাজনাবাদক। গান শোনার দর্ষকও কম নয়, ঊঠান ভরে গেছে। গ্রামের সকল মানুষ যেন এখানে এসেই ভীর জমিয়েছে। অবশ্য কিই বা করবে এরা, এখানে বিনোদনের ব্যাবস্থা বলতে তেমন কিছুই নেই, বিদ্যুৎ নেই নেই টিভি ডিস। এখানে জমায়েত হয়ে গান গাওয়াটাই প্রধান বিনোদন।
আজকে ঈদের দিন তাই আমেজটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে। আমি দারিয়ে দারিয়ে গান শুনতে লাগলাম। লালন বাউল এইসব গান আমার অনেক ভালই লাগে, যদিও লালনের গান শুনতে গিয়ে অনেকের কাছেই খ্যাত গেয়ো উপাধি পেতে হয়েছে, তবুও আমি কিছু মনে করি না। আমার যেটা ভালো লাগে সেটা আমি করব, এতে লোকের কথায় কিছু যায় আসে না। গ্রামের মানুষজন অনেকেই গানের দিকে খেয়াল দেয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।
কিছুক্ষন পরে একজন এসে আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো, আমি আমার সকল বৃত্তান্ত বললাম। সবকিছু শুনে লোকটা আমাকে সামনে নিয়ে গেলো, একটা চেয়ার এনে বসতে দিল। আমাকে বলল আপনি এখন যাবেন কিভাবে এতক্ষনে তো খেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া একা একা রাতের বেলা যাওয়া নিরাপদ না। আমি তো ব্যাপক চিন্তায় পরে গেলাম, একে তো রাত হয়ে গেছে তার উপরে আবার ফোনে নেটওয়ার্ক নেই।
বাসা থেকে হয়ত এতক্ষনে আমাকে ফোনে না পেয়ে চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। ছোটবেলায় একবার ঘুরি ঊরাতে গিয়ে সুতা ছেড়া ঘুরির পেছনে ছুটতে ছুটতে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। বাসা থেকে খুজে না পেয়ে সে কি কান্ড, মাইকিং করা এদিক অদিক সম্ভাব্য সকল জায়গায় লোক পাঠানো আরো কত কি। এখন হয়ত এমনভাবে খুজবে না তবে চিন্তা করবে।
আমি লোকটিকে বললাম, কোনভাবেই কি যাবার ব্যাবস্থা করা যায় না? লোকটি বলল, এখানে কয়েকজনের নৌকা আছে, গানের আসরটা শেষ হলেই আপনার যাবার ব্যাবস্থা করতে পারা যাবে।
তারমানে গানের আসর শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। বাউল গান আমার ভালই লাগছিল। একের পর একজন শিল্পী আসছেন গান গেয়ে যাচ্ছেন, বোঝাই যাচ্ছে এরা সবাই এই গ্রামেরই শিল্পী। তবে সবার কন্ঠেই গানগুলো খুবই ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে গানগুলো যেন তাদের গলার জন্যই লেখা হয়েছে।
ক্ষুধাও কম লাগেনি এতক্ষনে, আমি সেই লোকটিকে বললাম, আচ্ছা আপনাদের এইদিকে কোন খাবার হোটেল আছে কিনা? লোকটি হেসে দিয়ে বলল, এই পাড়াগায়ে হোটেল পাবেন কই? চলেন আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে খেতে দিই, আপনার অনেক ক্ষুধা লেগেছে তাই না। আমি বললাম না থাক দরকার নেই, আমার তেমন ক্ষুধা লাগেনি। কিন্তু লোকটি আমাকে একরকম জোর করেই তার বাড়িতে নিয়ে গেল। লোকটি বলছিল, ঈদের দিন আপনারা পোলাউ কোরমা খান, আমাদের বাড়িতে তো আর ওইসব নেই আপনার হয়ত ভালো লাগবে না। তবুও চলেন গরীবের এলাকায় আসছেন কিছু না খেয়ে তো আর যেতে পারবেন না।
খাবার মেন্যুতে পোলাউ কোরমা ছিলনা সত্য কিন্তু খেয়ে এমন তৃপ্তি পেলাম যা বলার মত না। হলে খেয়ে খেয়ে পেটটাকে এমন বানিয়েছি যে এখন পাথর খেলেও হজম হয়ে যায়। তাই আমার কোন অসুবিধা হলো না। খেয়ে দেয়ে এসে আবার গান শুনতে বসলাম। গানগুলো এতই ভালো লাগছিল যে আমি বাসায় যাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
বাংলার গ্রাম্য সংস্কৃতি যে এতটাই মধুর হতে পারে আজকের দিনের অভিজ্ঞতাটা না হলে হয়ত আমার অগোচরেই থেকে যেত। গানের আসর যখন ভাঙল তখন রাত প্রায় ১১টা বাজে। আসরটা শেষ হওয়ায় মনটা একটু খারাপই হলো, ভালই তো লাগছিল এতক্ষন এখন আবার এতখানি পথ পারি দিয়ে বাসায় ফিরতে হবে।
সেই লোকটি একটা নৌকা যোগার করে আমাকে নদী পার করে দিল। তারপর আমি কিছুদুর হেটে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
আসার পথে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম আপনাদের এখানে কবে কবে এমন গানের আসর বসে, এই গানগুলা আমার অনেক ভালো লাগে, আমি আবার আসতে চাই। লোকটি বলল মাঝে মাঝেই হয়, তবে এখন ঈদ উপলক্ষে প্রতিদিনই বসবে। যারা গ্রামের বাইরে থাকে তারা এসেছে তো তাই কিছুদিন নিয়মিত গানের আসর বসবে, আপনি চাইলে কালকেই আসতে পারেন। আমি বললাম আচ্ছা ঠিক আছে, সময় পেলেই চলে আসব। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১ টা বেজে গেছে।
আম্মুর কিছু বকুনি শুনতে হল, কিন্তু কোনকিছুই খারাপ লাগল না। কানে ভেসে আসছিল লালনের নানান গানের কথা। আর আমারে মারিসনে মা।
পরের দিন সন্ধ্যা না হতেই আবার রউনা দিলাম ওই গ্রামটার দিকে। আজকেও শুনতে হবে বাউল গান।
বাসায় বসে থেকে ঈদের নানান রকম অনুষ্ঠান দেখার ধৈর্য নেই আমার। অনুষ্ঠানের চেয়ে বিজ্ঞাপনই দেয় বেশি, তাই বিনোদন খুজতে আমি আবারও পারি জমালাম লালনের আড্ডাখানায়। অইদিন সারারাত গান শুনে সকাল বেলা বাড়ি ফিরলাম। তারপরের দিন যেতে চাইলেও আম্মু যেতে দিল না। বলে দুইদিনের জন্য ঢাকা থেকে আসিস, বাসায় তো একদমি থাকিস না, আজকে বাসায় থাক।
পড়ের দিন ব্যাস্ততার খাতিরে ঢাকায় চলে আসা। তবে এখন থেকে যখনি বাসায় যাব না কেন, লাললেন আড্ডায় আমি যাবই। এমন নির্মল বিনোদনের উৎস আর কিছুই হতে পারে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।