আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আত্মসমালোচনা

মুখবন্ধ: কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং ক্লাস পারফর্মেন্স নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা আমাকে জানিয়েছেন মেইল করে। তার কোনো ব্লগ আইডি না থাকতে তার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তার মতামতটা আমি হুবহু এই পোস্টে প্রকাশ করছি। -------------------------------------------------------------------- একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের আত্মসমালোচনা আমি শিক্ষক হিসাবে আবির্ভূত হই এইচ এস সি পরীক্ষার পর। এইচ এস সি পাসের পর ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিলাম ২০০০ এর অক্টোবর এ।

একটাতে চান্স পেলাম, কিন্তু ক্লাস কবে শুরু হবে জানি না। বাসায় বসে আছি আর ক্লাস শুরুর অপেক্ষায় আছি। এমন সময় আমার কাছে দুই জন (একজন ছাত্র আর একজন ছাত্রী) এল প্রাইভেট পড়বে আমার কাছে। আমি রাজি হলাম। মাসে ৩০০টাকা করে প্রতি জন।

পড়াতে শুরু করলাম। কতক্ষন পড়াতাম তার কোন হিসাব ছিল না। আমার হাতে তখন অনেক সময়। তাই যতক্ষণ পড়া শেষ না হত আমি পড়াতাম। আমার আন্তরিকতার কমতি ছিল না পড়ানোতে।

কিন্তু তারা খুব বেশি ভাল করল না। পাস করেছে কিন্তু আমার চেষ্টা অনুযায়ী ভাল করে নাই। এর পর আমি আবার পড়াই যখন আমি অনার্স ৩য় বৎসরে। ছাত্রী ৭ম শ্রেণীর। তাকে পড়াতাম সপ্তাহে ৩ দিন।

আমার ১ ঘণ্টা করে পড়ানোর কথা। কিন্তু আমি ওকে পড়াতাম কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। কারন আমি প্রতিদিন কতটুকু পড়াবো সেটা ঠিক করে নিতাম। ওই দিনের পড়া শেষ করতে আমার ২ ঘণ্টা লেগে যেত। ওর মা খুব খুশি ছিল আমার উপর।

কিন্তু এইখানেও আমি তেমন সফল শিক্ষক না। টানা দুই বছর পড়িয়েছি। এরপর আমি অনার্স পাস করলে ওকে পড়ানো বাদ দিই। এত দিন যাদের কেই আমি পড়িয়েছি তার ছাত্র হিসাবে ছিল মোটামুটি মানের এবং সাথে ফাঁকিবাজ। আমার কপালটাই খারাপ।

কোন সিরিয়াস ছাত্র পেলাম না যাকে নিয়ে একটু গর্ব করতে পারি। যাই হোক এখন আসি আসল কথায়। আমি এখন পেশাদার শিক্ষক। বিভাগের নাম সম্পর্কিত একটা বিষয় পড়াই। খুব বেসিক একটা বিষয়।

সেমিস্টার সিস্টেম যেহেতু, কোর্স প্রতি আমার বরাদ্দ ৩৬ ঘণ্টা (৩ ক্রেডিট কোর্স)। এর মধ্যেই আমাকে সিলেবাস শেষ করতে হবে। ৩৬ ঘণ্টা নেওয়া হয় না। কিন্তু ৩০-৩৩ ঘণ্টা নেওয়া হয়। আমার ক্লাস নেওয়ার স্টাইল নিয়ে কিছু পয়েন্ট বলছি।

১। আমি কোন স্লাইড ব্যবহার করি না। বোর্ড এ লিখে লিখে পড়াই। স্লাইড এ পড়ালে মনে হয় ছাত্ররা বই না পড়ে শুধু স্লাইড পড়বে এই জন্য আমি বোর্ড ব্যবহার করি। ২।

কোন বই থেকে পড়াচ্ছি সেটা ক্লাসের সময় বলে দেই। ৩। অঙ্ক এবং Derivation সম্পূর্ণভাবে ক্লাসে করে দেই। ৪। প্রতি টা টার্ম যতটুকু সম্ভব ব্যাখ্যা করি।

কোন কিছু বাদ দিয়ে বা তাড়াহুড়া করে শেষ করি না। চেষ্টা করি উদাহরন দিয়ে বুঝাতে। ৫। কোন কিছু না বুঝলে আবার বলি। যতক্ষণ বেশিরভাগ ছাত্র না ধরতে পারছে।

৬। ক্লাস টেস্ট নেওয়ার আগে বলে দেই কি ধরনের প্রশ্ন আসবে। ৭। ফাইনাল পরীক্ষার আগেও প্রশ্নের ধরন বলে দেই। ৮।

একটা ব্যাপারে সাবধান করে দেই যে, কোন রকম সাজেশন করে পড়বে না। ইম্পরট্যান্ট দেখে পড়বে না। পুরো বই (যতটুকু সিলেবাস এ আছে) লাইন বাই লাইন পড়তে বলি যাতে কনসেপ্ট পরিষ্কার হয় এবং পরীক্ষায় উত্তর করতে পারে। প্রশ্ন করার সময় আমি কিছু ব্যাপার আমি খেয়াল রাখিঃ ১। এক ই প্রশ্ন যেটা আগে এসেছে সেটা না দেওয়ার চেষ্টা করি।

তার মানে এই না যে আমি সব নতুন প্রশ্ন দেই। কিছু repeated প্রশ্ন থাকে। ২। সব অধ্যায় থেকে প্রশ্ন করার চেষ্টা থাকে। আমি চাই ছাত্ররা পুরো বই পড়ে এসে পরীক্ষা দিবে।

কমপক্ষে যারা A+ পেতে চায় তারা যেন পুরো কোর্স পড়েই A+ পায়। ৩। অঙ্ক দিলে যেটা ক্লাসে করিয়েছি সেইটাই দেওয়ার চেষ্টা থাকে। এমন কি value পর্যন্তও পরিবর্তন করি না। আমি জানি না কেন ছাত্র রা আমার কোর্স এ ভাল করেনা।

আমার পড়ানোতে কি কোন বড় সমস্যা আছে যা আমি ধরতে পারছি না? ৩০ জন ছাত্রের মধ্যে ১০ জন ছাত্র A-,A,A+ এর মধ্যে গ্রেড পাবে এইটা আমি আশা করতেই পারি যখন আমি ছাত্রদের কাছ থেকে শুনি “আমি ক্লাস খুব ভাল নিতে পারি। লেকচার নিয়ে কোন সমস্যা নাই”। কিন্তু বাস্তবতা হল টেনেটুনে ১ কি ২ জন ছাত্র A এর কোন একটা গ্রেড পায় আর বাকিরা যারা পাস করে তারা কোন মতে পাস করে এবং প্রতি বার দেখা যায় ১০ জনের মত ওই কোর্স এ ড্রপ দিচ্ছে। আমি বলছি না যে ওরা খারাপ ছাত্র। ক্লাসের বেশ কয়টা ছেলে আছে যারা ব্রিলিয়ান্ট এবং সিরিয়াস।

ক্লাস করানোর সময় টের পাই আমি যে কোর্স পড়াচ্ছি ওরা সেটা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছে। ফাইনাল পরীক্ষাতে ওরাও তেমন ভাল করছে না। রাগ লাগে যখন দেখি অন্য টিচারদের কোর্সে ক্লাসের সবাই মোটামুটি ভাল করছে এবং ড্রপ ও দিচ্ছে না। আমি যখন ওদের কে জিজ্ঞাসা করি কেন তোমরা খারাপ করেছ তখন তারা বলেঃ ১। ম্যাডাম আপনি অমুক অধ্যায় থেকে তো কোন প্রশ্ন করেন নাই, অমুক অধ্যায় থেকে ১টা ফুল প্রশ্ন আশা করেছিলাম যেমন গতবার এসেছিল।

২। সিলেবাস টা বেশি বড়। ৩। ওই প্রশ্ন টা তো গতবার এসে গেছে, আমরা ভেবেছিলাম এইবার আসবে না। ৪।

প্রশ্ন টা বেশি কনসেপ্ট ভিত্তিক এবং কঠিন ছিল। ৫। এবং সাথে কিছু ব্যাক্তিগত ঝামেলা তো আছেই যেমন জ্বর, ঠাণ্ডা ইত্যাদি পড়তে পারি নাই । প্রশ্ন হল আমি কেন এইসব কথা বলছি। আমার মনে এইটা নিয়ে একটু দুঃখ আছে।

আমি ফাঁকি দেই না এবং আমি ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টাও করিনা। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করি কিন্তু কেন আমি ভাল ফল পাই না। বিশেষ করে শিক্ষক হিসাবে আমি কেন ব্যর্থ? আমার সমস্যা কথায়? আমার ঘাটতি কথায়? মাঝে মাঝে আমি চিন্তা করি সমস্যা টা কি আমার একার? ছাত্রদের? নাকি আমার-ছাত্র সহ সবার? আমার থেকেও কম ক্লাস নিয়ে অন্য টিচাররা ভাল ফল করছে। কিভাবে? আমি সেই উপায় জানতে চাই। আপনাদের কাছে যদি উপায় জানা থাকে আমাকে একটু বুদ্ধি দেন ভাই।

যদি আমার কোন সমস্যা আছে বলে মনে হয় তাহলে সেটাও নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আসলে আমি আমাকে বুঝার চেষ্টা করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.