আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতিভাবান

মনস্তত্ত্ববিদগণ বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের বিভিন্ন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন- বয়সানুপাতে একজন শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানের দক্ষতার উপরে ভিত্তি করে তারা বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করেন। সমস্যা উপস্থাপন এবং সংকেত অনুসরণ করে সমাধানের দক্ষতা হয়তো শিক্ষার্থীর বিষয়বস্তু অনুধাবনের দক্ষতাটুকু নির্ধারণ করতে সক্ষম- আরও ব্যপকার্থে বিবেচনা করলে হয়তো মনস্তত্ত্ববিদদের বুদ্ধিমত্তাপরিমাপের প্রক্রিয়াটুকু পাঠদান পদ্ধতির পরিমাপক হয়ে উঠতে পারে- কিন্তু একজনকে সেসব সমস্যা সমাধানের দক্ষতায় কি বুদ্ধিমান বলা সম্ভব? অশিক্ষিত একজন, যার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তিনি যখন সমস্যার সমাধান করতে চান, তার সমস্যা সমাধান পদ্ধতির সাথে অপরাপর প্রশিক্ষিত ব্যক্তির সমস্যা সমাধানপদ্ধতি ভিন্ন হবে- সমস্যার গ্রহনযোগ্য সমাধান হয়তো তিনি কোনো এক সময় করেও ফেলতে সক্ষম হবেন- যদি সমস্যা সমাধান করবার দক্ষতাই বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ হয় তাহলে প্রশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত উভয়েই সমান মাপের বুদ্ধিমত্তার অধিকারি বিবেচিত হতে পারেন- হয়তো দুজনের সমস্যা সমাধানের সময় আলাদা হবে কিন্তু তারা উভয়েই কোনো এক সময়ে সমস্যাটির সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। মনস্তত্ত্ববিদগণ ধরেই নেন একজন শিক্ষার্থী তার বয়েসানুসারে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত থাকবে। তার বয়েস জেনেই সে বয়েসউপযোগী সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে দিবেন, সেসব সমস্যা যদি সে সমাধান করে ফেলতে পারে তার চেয়ে বয়স্ক একজনের সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে দিবেন- এভাবে একটা পর্যায়ে শিক্ষার্থী সকল সমস্যা সমাধানেই ব্যর্থ হবে- সে অনুযায়ী তার বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করা হবে। সেখানে একজন শিক্ষার্থী যে তার বয়েস অনুযায়ী সকল সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম তার বুদ্ধিমত্তার মাণাঙ্ক হবে ১০০- যদি ১০ বছর বয়েসী একজন ১৪ বছর বয়েসী শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত সমস্যা সমাধান করতে পারে তাহলে তার বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ হবে ১৪০- এমনি ভাবে যদি ১০ বছর বয়স্ক একজন ১৬ বছর বয়েসী শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত সমস্যা সমাধান করতে পারেন তাহলে তার বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ হবে ১৬০।

প্রশ্নের ধরণ, বিষয়বস্তু চয়নের ভিন্নতা থাকতে পারে- কিন্তু মোটা দাগে বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের প্রক্রিয়া এমনই। যার আইকিউ ১৫০ এর উপরে তাকে কি আমরা জিনিয়াস অভিহিত করতে পারবো? এমন একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হয়েছিলো কয়েক দিন আগে। কাকে জিনিয়াস বলা যাবে? সমস্যা সমাধানের দক্ষতা- সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনে প্রচলিত ভাবনার বাইরে গিয়ে ভাবতে পারা এবং সমস্যার গ্রহনযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারার দক্ষতা হয়তো অপরাপর সাধারণ মানুষের তুলনায় তার সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকেই প্রতিষ্ঠিত করে- সে দক্ষতা কি তাকে জিনিয়াস অভিহিত করতে যথেষ্ট? ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সকল অনুভুতি- উদ্দিপনার শরীরবৃত্তীয় প্রকাশ হচ্ছে মস্তিস্কের রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিভিন্ন উদ্দীপনায় মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশ উদ্দীপ্ত হয় এবং আমরা আশৈশব সেসব উদ্দীপনাকে আলাদা আলাদা চিহ্নিত করার প্রশিক্ষণ গ্রহন করি। কারো কারো ক্ষেত্রে এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি অপরাপর সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশী- একজনের শরীরবৃত্তিয় সক্ষমতা কি তাকে অপরাপর মানুষ থেকে ভিন্ন কেউ করে তুলতে পারে? একজন হয়তো ১০ কেজি ভার বহন করতে পারে না, অন্যজন অনায়াসে ১০০ কেজি ভর বহন করতে পারে- যে ১০০ কেজি ভর বহন করতে সক্ষম তার এই শাররীক দক্ষতা কি তাকে জিনিয়াস হিসেবে পরিচিত করতে সক্ষম? ধরা যাক আইনস্টাইন- তিনি একই বছরে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধে তিনটি তৎকালীন সমস্যার সমাধান করেছিলেন, সে বছরটা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবার বছর- ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট- বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব এবং ব্রাউনিয়ান গতির ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন আইনস্টাইন সে বছর। যদি সে বছর আইনস্টাইন এই তিনটি সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হতেন তাহলে কি এই তিনটি সমস্যার সমাধান হতো না? বিজ্ঞান একধরণের সামষ্টিক প্রক্রিয়া- এখানে প্রত্যেকেই নিজস্ব অবদান রাখে- কারো অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু সে সমস্যার সমাধানের অতীত ব্যর্থতাগুলোও সফল সমাধানের সূত্র হিসেবে কাজ করে কিন্তু এই ব্যর্থতাগুলো স্বীকৃতি পায় না।

ফটোইলেক্ট্রিক ইফেক্ট ব্যখ্যা করতে আইনস্টাইন যে ধারণাগুলো ব্যবহার করেছিলেন সেই ধারণাগুলো অতীতেও একটি সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়েছিলো- ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক আলোর কোয়ান্টাকে ব্যবহার করেছিলেন একটি সমস্যার সমাধান হিসেবে- আইনস্টাইন প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে গ্রহন না করে সেই ধারণাকেই গ্রহনযোগ্য মনে করেছিলেন। সমস্যার সমাধান খুঁজে নেওয়ার এ দক্ষতাটুকু অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ- কিন্তু এই সমস্যাটুকু কোনো না কোনো সময় কেউ না কেউ সমাধান করতোই- আইনস্টাইন তার ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তিনটি গবেষণা নিবন্ধে যাদের প্রস্তাবিত সমাধানসূত্র নিয়ে কাজ করেছেন আইনস্টাইনের সমাধানের নেপথ্যে তাদের অবদানটুকু অনুল্লেখিত। আইনস্টাইন যে সময়ে সাধারণ আপেক্ষিতাসূত্র প্রদান করলেন তারও ৫ বছর আগে একই প্রক্রিয়ায় হিলবার্ট সমস্যাটি সমাধান করেছিলেন, বলা হয় তারা একই সময়ে একই সমীকরণে পৌঁছান- আইনস্টাইন হুট করেই সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেছেন এমন না, তিনি তারও দুই বছর আগে থেকেই এই বিশেষ সমস্যাটি সমাধানের জন্য বিশেষ একটি গাণিতিক বিধিও শিখেছেন। তার সমীকরণ প্রকাশিত হওয়ার ১ বছরের ভেতরেই সেটার একটা সমাধান করেন শোয়ার্সচাইল্ড- তিনি তখন যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক- আইনস্টাইন তার সমীকরণ সমাধান করার আগেই দুজন তার সমীকরণ সমাধান করে ফেলেছেন এবং পদার্থবিজ্ঞানের দুটো বিষয়কে ব্যখ্যার প্রয়োজনে সেটার ব্যবহারও করেছেন। আইনস্টাইনকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং বুদ্ধিমান মানুষদের একজন হিসেবে- সে ক্ষেত্রে যারা তারও আগে কোনো সমস্যার সমাধান করে ফেললো তারা কি আইনস্টাইনের চেয়ে বেশি জিনিয়াস, বেশি বুদ্ধিমান ছিলেন? মনস্তাত্ত্বিক ভাবে এই ধরণের বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহন সক্ষমতার পরিমাপ।

কেউ কেউ অপরাপর সাধারণ মানুষের চেয়ে শিক্ষাগ্রহনে ধীর গতির , এদের আইকিউ ১০০ থেকে কম- ধরা যায় যাদের আইকিউ ৭০ এর নীচে তারা নির্বোধ- কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত মানুষই- অপরাপর মানুষের সাথে তাদের ভিন্নতা হলো তারা প্রচলিত শিক্ষা পরিমাপে তার সমবয়সীদের তুলনায় শিক্ষা আত্মস্থকরণে কিছুটা ধীর গতির- তারা ১০ বছরে বয়েসে ৭ বছরের শিশুর সমস্যা সমাধানের দক্ষতা অর্জন করেছেন, হয়তো তারা ২০ বছর বয়েসে ১৪-১৫ বছর বয়েসের শিশুদের উপযুক্ত সমস্যাগুলো সমাধান করতে সক্ষম হবেন। এভাবে তারা ৩০ বছর বয়েসে এসে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষদের সমকক্ষ হয়ে উঠবেন- আনুষ্ঠানি ভাবে মানুষের শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হয় ২৩ বছরের আশে পাশে- সে শিক্ষা সমাপ্ত করতে হয়তো একজন ৭০ আইকিউর মানুষের লাগবে ৩৬ বছর, কিন্তু তিনি লেগে থাকলে অবশ্যই পারবেন সেসব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করতে। শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ইলেক্ট্রোলাইটস- ইলেক্ট্রন- মস্তিস্কের বিভিন্ন অংশের ভেতরে সংযোগ স্থাপন করে- প্রতিটি ক্ষেত্রেই মস্তিস্কের এক কিংবা একাধিক অংশ উদ্দীপ্ত হয়- এদের ভেতরে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পায়- প্রতিটি নিউরণ হয়তো উদ্দীপ্ত হয় না সমানভাবে কিন্তু প্রতিটি নিউরণের সাথেই এইসব অভিজ্ঞতার সংযোগ থাকে- দুই এর সাথে দুই যোগ করতে হবে কোন কোন নিউরণের ভেতরে সংযোগ স্থাপন করতে হবে সেটা শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া জানে- লাল রং দেখলে গাড়ী থামাতে হবে এই প্রক্রিয়া মস্তিস্কের কোন কোন অংশকে উদ্দীপ্ত করলে তা সম্ভব এটাও প্রশিক্ষণের অংশ- একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির ক্ষেত্রে মস্তিস্কের রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন নিউরণের আন্ত:সংযোগের সক্রিয়তা অপরাপর সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী- তিনি এই শাররীক সক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন এবং তার প্রশিক্ষণ তাকে এই রক্তসঞ্চালন নিয়ন্ত্রনের দক্ষতা দিয়েছে কিন্তু যদি রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকে তাহলে সেটা বিভিন্ন ধরণের মানসিক প্রতিক্রিয়ার ত্রুটি হিসেবে প্রকাশিত হয়। একজন অটিস্টিক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও মস্তিস্কে এই ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়- মাত্রাভেদে দেখা যায় মস্তিস্কের একটি বিশেষ অংশে রক্তসঞ্চালন এবং উদ্দীপনা অসহনীয় পর্যায়ে বৃদ্ধি পায়- কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেসব রক্তসঞ্চালন মস্তিস্কের ভুল অংশেও পরিলক্ষিত হয়- এমন নিউরাল নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত সমস্যা আদতে আচরণে প্রকাশ পায়- যাদের এমন সমস্যা সামাজিক বিবেচনায় সহনীয় তাদের আমরা শূঁচিবায়ুগ্রস্ত- কিছুক্ষেত্রে বাতিকগ্রস্ত বলি কিন্তু সেটা সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার সীমা অতিক্রম করলে আমরা তাকে মানসিক সমস্যাক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করি- একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি যে সকল পরিবেশে সকল উদ্দীপনায় একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবেন এমন না ও হতে পারে- সামাজিক পরিবেশে সামাজিক গ্রহনযোগ্য আচরণ করবার ব্যর্থতাও এদের থাকতে পারে- অন্য সব প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ মনোনিবেশে হয়তো তাদের সামাজিক আচরণ দক্ষতার পরিমাণটুকু কম- তবে তাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতায় তাদের কিঞ্চিৎ প্রশ্রয় দেয় সমাজ। তাদের এইসব সামজিক ত্রুটি আমরা প্রতিভাবানের ক্ষ্যাপামি হিসেবে পাশ কাটিয়ে যাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.