ইলিয়াস আলী, নামটার সাথে এখন দেশের সবাই পরিচিত। দিনদুয়েক আগেও তিনি শিরোনাম ছিলেন না। আজ শিরোনাম। এদেশে তো ভাই শিরোনাম হওয়া সহজ। সেই শিরোনাম কিন্তু আপনাকে ভোগাবে।
ভোগাবে দেশের মানুষকে। ইলিয়াস আলী শিরোনাম হয়েও ভোগাচ্ছে দেশের মানুষকে। আরও ভোগানোর হুমকি পাচ্ছি আমাদের দেশের তথাকথিত নেতাদের কাছ থেকে। জিম্মি হয়ে পড়ছে দেশের মানুষ। এখন জনমনে প্রশ্ন কেই এই ইলিয়াস আলী।
পত্রপত্রিকা মিডিয়া মারফত যে সব তথ্য বেরিয়ে আসছে সেগুলো খুবই চাঞ্চল্যকর। এই ইলিয়াসই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অন্যতম ত্রাস। যার বিরুদ্ধে ছিল হত্যা ও গুম করার অনেক অভিযোগ। সেই এম ইলিয়াস আলী এখন নিজেই নিখোঁজ। এক বন্ধু মারফত শুনেছি, তিনি নাকি এর আগেও নিখোঁজ হয়েছিলেন একবার।
আবার বেরিয়ে এসেছেন।
বিএনপি তার নিখোঁজ নিয়ে সরকারকে দায়ী করেছে। বলা হচ্ছে সরকারের আইনশৃংখলা বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে গুম করে রেখেছে।
বাজারে ছড়িয়ে আছে অনেক মুখরোচক গল্প। ইলিয়াস আলী তার দীর্ঘ ছাত্র ও জাতীয় রাজনৈতিক জীবনে কম শত্রু সৃষ্টি করেননি, এমন মন্তব্য করে অনেকেই বলছেন এসব শত্রুপক্ষের যে কোনো পক্ষই হতে পারে তার নিখোঁজ হওয়ার কারণ।
সিলেটের রাজনীতির কলকাঠী নাড়ছেন যে ক'জন রাজনীতিবিদ তার মধ্যে ইলিয়াস আলী মূল ভূমিকায়। বিরোধীদলের একজন নেতা হওয়ার পরও ইচ্ছেমত ছড়ি ঘোরাতেন সিলেটের রাজনৈতিক ময়দানে।
সিলেটের এমসি কলেজে এইচএসসি অধ্যয়নকালে ছাত্ররাজনীতির সাথে যুক্ত হন এম ইলিয়াস আলী। সে সময় তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের একজন কর্মী।
১৯৮১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ছিলেন জসিম উদ্দিন হলের আবাসিক ছাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই ইলিয়াস আলী যোগ দেন এরশাদের ছাত্রসমাজে। এসময় অস্ত্রবাজির রাজনীতি শুরু করেন। নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের ক্যাডার হিসেবে যোগ দিলেও পরে দলবদল করে ছাত্রদলের নেতা হয়ে ওঠেন ইলিয়াস আলী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়ই দলে গ্রুপিংয়ের রাজনীতি ঢুকিয়েছিলেন ইলিয়াস আলী। গড়ে তুলেছেন নিজস্ব গ্রুপ।
ছাত্রদলের ক্যাডার পরিচিতি দিয়েই উত্থান তার। একের পর এক ঘটনার নায়ক হয়ে জন্ম দিতে থাকেন অভ্যন্তরীণ সংঘাত। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। ইলিয়াস আলী পরিণত হন ত্রাস সৃষ্টিকারী এক সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্রনেতায়। বহু খুনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
সে কারণে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয় তাকে। জেলে কাটে সময়।
১৯৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৮৮ সালের ১১ ডিসেম্বর ছাত্রদল নেতা বজলুর রহমান শহীদ ওরফে পাগলা শহীদ হত্যাকাণ্ড, ৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর তার নেতৃত্বে ডাকসু কার্যালয় ভাংচুর, ৯২ সালের ৩ আগস্ট ছাত্রদলের রতন গ্রুপের সঙ্গে ইলিয়াস গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির নিহত হওয়া এবং এই সংঘর্ষের জের ধরে ৯২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মামুন ও মাহমুদ নাম দুই ছাত্রদল নেতার হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক ছিলেন ইলিয়াস আলী। মামুনকে হত্যা করে তার লাশ গুম করা হয়েছিলো সূর্যসেন হলের পানির ট্যাংকিতে।
এছাড়াও প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা মির্জা গালিব ও ছাত্রলীগ নেতা লিটন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৯১ সালে গ্রেফতার করা হয় ইলিয়াস আলীকে।
ওই বছর ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তাই এক বছরের মধ্যেই ছাড়া পান ইলিয়াস আলী। এর পর দলের প্রত্যক্ষ মদদে ছাত্রদলে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন তিনি। ৯২ সালে ১৬ জুন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হলে রহুল কবির রিজভী আহমেদ সভাপতি ও এম ইলিয়াস আলী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
কিন্তু তখনও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় বিএনপির শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা তার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন। মাত্র ৩ মাসের মাথায় ছাত্রদলের কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এ সময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকা স্বত্বেও ৯৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মামুন ও মাহমুদ হত্যা মামলায় আবার গ্রেফতার হন ইলিয়াস আলী। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। দুই বছর কারাবাসের পর মুক্তি পান তিনি।
শর্ত হিসেবে বিএনপির হাইকমান্ডকে ইলিয়াস আলী কথা দেন কেবলমাত্র তার নিজ এলাকা বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করা ছাড়া অন্যকিছু নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
এরপর ঢাকার রাজনীতি ছেড়ে সিলেটে যান ইলিয়াস আলী। কিন্তু সিলেট গিয়েই ভুলে বসেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে দেওয়া তার ওয়াদার কথা।
সে সময় থেকেই ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে সিলেট দাপিয়ে বেড়ান এই নেতা। শুধু নিজ এলাকায় বিএনপি সংগঠিত করা নয় সিলেটে তাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের একটি শক্তিশালী গ্রুপ গড়ে উঠে।
তিনি নিজেও তার বেপরোয়া আচরণ অব্যাহত রাখেন। নিজস্ব বলয় গঠন করে সিলেটের রাজনীতির আলোচনায় উঠে আসেন ইলিয়াস আলী।
১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
সিলেটের অনেক সিনিয়র রাজনীতিবীদ ইলিয়াস আলীর ও তার দলবলের হামলার মুখে পড়েন। বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদ এম সাইফুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, এসএমএ কিবরিয়া, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো ব্যক্তিরা ইলিয়াস আলীর রাজনৈতিক কূটচালের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন।
শুধু সিলেট আর ঢাকায় নয় দেশের বাইরেও উশৃংখল আচরণের দায়ে পুলিশের নজরবন্দি হতে হয় ইলিয়াস আলীকে।
২০০০ সালে লন্ডনের মিল্টন কিন্স শহরে জয়পুর রেস্টুরেন্টে ওয়েটারকে হত্যার হুমকি দেন তিনি। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে কঠোরভাবে হুশিয়ার করে দিয়ে যায় তাকে।
২০০১ সালে এমপি হওয়ার পর তার এলাকা বিশ্বনাথ বালাগঞ্জে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করার অভিযোগ উঠে ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে। তার নির্বাচনী এলাকায় সন্ত্রাসী বাহিনী আর প্রশাসনকে ইচ্ছেমতো দলীয়করণের প্রচেষ্টায় নামেন তিনি।
প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মাঠে নামে ‘ইলিয়াস বাহিনীর লোক’ নামে পরিচিত একদল ক্যাডার-এমন অভিযোগ তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের।
এসব কিছুর প্রতিবাদ করারও সাহস ছিলো না মানুষের এমনকি ভুক্তভোগীদের। ২০০১ সালের ওইসব ঘটনার জের ধরে মামলা হয়েছে ১১ বছর পর গত মঙ্গলবার রাতে ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন সকালে। সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, হামলা ও ভাংচুরের অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়।
২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ এনে মামলা দুটি করেছেন আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ব্যবসায়ী বাশারত আলী বাঁচা।
মামলায় সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, ভয় দেখানো, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়েছে। বলা হয়েছে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইলিয়াস আলী ও তার লোকেরা বাদীর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়।
এতসব অত্যাচার নিপিড়ণের অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনার নায়ক ইলিয়াস আলী সবকিছু পাশ কাটিয়ে ফিল্মি স্টাইলে দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠেন।
সর্বশেষ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এ কিবরিয়া হত্যা এবং ব্রিটিশ হাইকমশিনার আনোয়ার চৌধুরীরকে হযরত শাহজালাল মাজার গেটে হত্যা চেষ্টার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
তবে এতকিছুর পরেও ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথ বালাগঞ্জের উন্নয়নে তার সময়ের অবদান এখনও লোকমুখে।
সাধারণ মানুষ রাজনীতির কূটচাল ভুলে ইলিয়াস আলীকে তাদের উন্নয়নের কাণ্ডারী ভাবেন।
ইলিয়াস আলী নিঁখোজের পেছনে নিজ দলের প্রতিপক্ষ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, গোয়েন্দা সংস্থা, সরকার ও জামায়াতে ইসলামের হাত থাকতে পারে বলে অনুমান করছেন সিলেটবাসী।
আর সিলেট-লন্ডন কানেকশন, কোটি কোটি টাকার লেনদেন এসব বিষয় নিয়েও কথা শোনা যায়।
আমরা এই ইলিয়াস আলীর জন্য হরতাল করবো? দেশের কোটি কোটি মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ তৈরি করবো? এইচ এস সি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছে। তাদের কোমলমতি মনটাকে আমরা প্রতিহংসার রাজনীতির বলিতে ফেলে দিচ্ছি।
আমরা তাহলে কীভাবে জাতি হিসাবে সভ্য হবো?
লেখার সূত্র: বাংলানিউজ২৪.কম ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।