আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুন্টার গ্রাস ও জয় গোস্বামী

৮৪ বছর বয়সের অশিতিপর বৃদ্ধ গুন্টার গ্রাস সারা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন । কি করেছেন তিনি ? এই বয়সে আর কিইবা করা যায়! ’হোয়াট মাস্ট বি সেইড বা ‘যে কথা বলতেই হবে’ এই শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছেন মাত্র। কবিতাটি ৪ এপ্রিল একইসঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত জার্মান দৈনিক ‘সুদ ডয়েচে যাইটুং’ (Süddeutsche Zeitung)-এর সাহিত্য পাতাসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে কিন্ত তাতেই বইছে প্রচণ্ড সমালোচনার ঝড়। আজকে ১০ই এপ্রিল ইসরায়েল সরকার এ কবিতার কারণে সাহিত্যে নোবেলজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ইসরায়েলে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। নিজ দেশের সরকার এবং জনগণের একাংশও তারপরে ক্ষেপা, কারণ তাদেরকেও তিনি ছাড় দেননি।

ইহুদিদের সমর্থন এবং তাদের কাছে জার্মানীর ডুবোজাহাজ বিক্রীর প্রকাশ্য সমালোচনাও করেছেন ১৯৯৯ সনে নোবেল পাওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বয়স্ক মুক্তবুদ্ধির সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাত গুন্টার গ্রাস। এদিকে আমাদের বাড়ীর পাশে রানাঘাটের কবি ’বাংলা কবিতার নতুন উত্থান’ হিসেবে খ্যাত জয় গোস্বামীও কবিতার জন্য কম নিগৃহিত হননি। আমরা দেখেছি তার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস এবং অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ানো ক্ষমতা। গুজরাতের দাঙ্গার পর তার কবিতায় ধিক্কার এসেছে অবশ্যম্ভাবী রুপে। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি বাঁচাও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি তিনি তাঁর কবিতায় ধিক্কার জানিয়েছেন | এই কবিতা নিয়ে, "বিজল্প" প্রকাশিত তাঁর ১৫টি কবিতার বই "শাসকের প্রতি" বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা | কিন্ত— সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে কবির প্রকাশ্য বিরোধী ভূমিকার ফলস্বরূপ তাঁকে তাঁর দীর্ঘদিনের নিশ্চিন্ত জীবিকার আশ্রয় ছেড়ে কাজে ইস্তাফা দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে।

সইতে হয়েছে অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা। গুন্টার গ্রাস এবং জয় গোস্বামী উভয়ের মধ্যে একটি বিষয়ে চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায় আর তা হলো তাদের দুজনেরই সত্য কথন এবং অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । তফাৎ শুধু একজনের বিচরণ জাতীয় পর্যায়ে এবং অন্যজনের বিচরণ আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে। গুন্টার গ্রাসঃ গুন্টার উইলহেম গ্রাস ( জন্ম ১৬ই অক্টোবর ১৯২৭) অনেক গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। তিনি একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার, অঙ্কনশিল্পী, গ্রাফিক শিল্পী, ভাস্কর এবং ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ।

১৯৫৯ সনে প্রকাশিত তার প্রথম উপন্যাস The Tin Drum এর জন্য তিনি ব্যপক সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করেন। 'যে কথা বলতেই হবে'- কবিতায় গুন্টার গ্রাস ইসরায়েলের ইরান-নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন । লিখেছেন ইরান নয় বরং ‘ভঙ্গুর’ বিশ্বশান্তি আরো ‘বিপন্ন’ করবে পারমানবিক শক্তিধর ইসরায়েল। অনুবাদে কবিতাটির কিছু লাইন হচ্ছে এরকম— যে কথা বলতেই হবে পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত ইসরায়েল, ভঙ্গুর বিশ্বশান্তিকে আরো বিপণ্ণ করছে। কলমের শেষ কালিতে এসব কথা আমি এখন কেন বলছি, এই বার্ধক্যে ? কারণ এ কথা বলতেই হবে, অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে আগামীকালের জন্য¨ অপেক্ষায়, (বলতেই হবে) কারণ আমরা- জার্মানরা অনেক সহায়তা দিয়েছি এমন এক অপরাধে কোনো সাধারণ অজুহাতেই যে দুষ্কর্মে সহযোগিতার শাপমোচন হবে না| এবং হ্যাঁ, আমি আর চুপ থাকবো না পশ্চিমের ভণ্ডামিতে আমি ক্লান্ত, আশাবাদীও এজন্য যে অনেকেই নিরবতা ত্যাগ করবে।

প্রতিরোধ করো আসন্ন বিপদের সহিংসতার নিন্দা জানাও এবং জোর দিয়ে আহবান জানাও-- দুই দেশের সরকার কর্তৃক অনুমোদিত আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা ইসরাইলের পরমাণু অস্ত্রের ও ইরানের পারমানবিক কর্মসূচির বাধাহীন ও স্থায়ী নজরদারি করা হোক | গুন্টার গ্রাসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ¯স্বয়ং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার তিনি যে কথা বলতেই হবে কবিতাটিকে লজ্জাজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং দাবি করেছেন যে ইসরায়েল নয় বরং ইরানই হচ্ছে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। গ্রাসের কবিতায় ইসরায়েলের হামলাতে ইরানি জনগণের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কv তিনি অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। | এছাড়া ইসরায়েলের ধর্মীয় কট্টরপন্থী সাইস পার্টির সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলি ইসাই এই জার্মান কবিকে একজন ‘ইহুদি বিদ্বেষী’ বর্ণনা করে ইসরায়েলের মতো পবিত্র ভূমিতে তাঁর ঢোকার অধিকার নেই বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য বিখ্যাত ইসরায়েলি ঐতিহাসিক টম সেভেক সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে ‘অবিবেচক’ বলেছেন।

জার্মান সাপ্তাহিক ডের স্পিগেলকে তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের রাজনীতি ইরানের মতোই। ’ তাঁর এই মন্তব্যের জবাবে আবার জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুডো ভেস্টারভেলে বলেছেন, ‘ইসরায়েল ও ইরানের রাজনীতির তুলনা করা ঠিক হয়নি। ’ তবে সমালোচনায় বা ইসরায়েলে নিষিদ্ধ হওয়ায় একবিন্দু দমে যাননি গুন্টার গ্রাস। ¨ বিভিন্ন সমালোচনার প্রতিবাদI জানিয়েছেন তিনি ইতিমধ্যে। জার্মান টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, কবিতাটির প্রচণ্ড সমালোচনা হবে জেনেই তিনি তা লিখেছেন।

এবং তার মতে এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক করার এখনই উপযুক্ত সময় । তিনি আরো বলেছেন এখুনি এ বিষয়ে সবাইকে মুখ খুলতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি জার্মান দৈনিক ‘সুদ ডয়েচে যাইটুং’ সাহিত্যপাতায় যেখানে ৪ এপ্রিল কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল, সেই পত্রিকাতেই পুরো বিষয়টি তিনি আরও বিশদভাবে লিখবেন। --এবং এভাবে ইসরায়েলের মুখোশ আরো উন্মোচনের জন্য কাজ করবেন। সাবাশ বুড়ো! এবং জয় গোস্বামীঃ জয় গোস্বামীর জন্ম কলকাতা শহরে।

ছোটবেলায় তাঁর পরিবার রানাঘাটে চলে আসে। তখন থেকেই তাঁর স্থায়ী নিবাস সেখানে। তাঁর পিতা রাজনীতি করতেন, তাঁর হাতেই জয় গোস্বামীর কবিতা লেখার হাতে খড়ি। ছয় বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তাঁর মা শিক্ষকতা করে তাঁকে লালন পালন করেন।

জয় গোস্বামীর প্রথাগত লেখা পড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে একাদশ শ্রেণীতে থাকার সময়। সাময়িকী ও সাহিত্য পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। এভাবে অনেক দিন কাটার পর দেশ পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়। এর পরপরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুদিন পরে তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ক্রিসমাস ও সীতার সনেটগুচ্ছ প্রকাশিত হয়।

১৯৮৯ সালে তিনি ঘুমিয়েছ, ঝাউপাতা কাব্যগ্রন্থের জন্য আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালের আগস্ট মাসে তিনি পাগলী তোমার সঙ্গে কাব্য সংকলনের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন/ জয় গোস্বামী অনেকদিন থেকেই অলোচিত হচ্ছেন তার সত্যকথন এবং দুর্জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে কলম ব্যবহারের জন্য। তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত কবিতার বই শাষকের প্রতি থেকে কয়েকটি কবিতা নিচে উল্লেখ করা হলো কে বেশী কে কম/ শাষকের প্রতি চিনতে পেরে গেছে বলে যার জিভ কেটে নিল ধর্ষণের পরে দু’হাতে দু’টো পা ধরে ছিঁড়ে ফেললো যার শিশুটিকে ঘাড়ে দু’টো কোপ মেরে যার স্বামীকে ফেলে রাখলো উঠোনের পাশে মরা অবধি মুখে জল দিতে দিল না সেই সব মেয়েদের ভেতরে যে-শোকাগ্নি জ্বলছে সেই আগুনের পাশে এনে রাখো গুলির অর্ডার দেওয়া শাসকের দু’ঘন্টা বিষাদ তারপর মেপে দ্যাখো কে বেশি কে কম তারপর ভেবে দেখ কারা বলেছিল জীবন নরক করব, প্রয়োজনে প্রাণে মারব, প্রাণে! এই ব’লে ময়ূর আজ মুখে রক্ত তুলে নেচে যায় শ্মশানে শ্মশানে আর সেই নৃত্য থেকে দিকে দিকে ছিটকে পড়ে জ্বলন্ত পেখম | বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে বাংলার গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে… কেউ ছুটে গেল খালের ওদিকে বুক ফাটা গলায় কার মা ডাকল : “রবি রে…” উত্তরের পরিবর্তে, অনেকের স্বর মিলে একটি প্রকাণ্ড হাহাকার ঘুরে উঠল… কে রবি? কে পুষ্পেন্দু? ভরত? কাকে খুঁজে পাওয়া গেছে? কাকে আর পাওয়া যায় নি? কাকে শেশ দেখা গেছে ঠেলাঠেলি জনতাগভীরে? রবি তো পাচার হচ্ছে লাশ হয়ে আরও সর লাশেদের ভিড়ে… শাসকের প্রতি আপনি যা বলবেন আমি ঠিক তাই কোরবো তাই খাবো তাই পরবো তাই গায়ে মেখে ব্যাড়াতে যাবো কথাটি না বলে বললে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকবো সারা রাত তাই থাকবো পরদিন যখন বলবেন এবার নেমে এসো তখন কিন্তু লোক লাগবে আমাকে নামাতে একা একা নামতো পারবো না ও টুকু পারি নি বলে অপরাধ নেবেন না যেন আইনশৃঙ্খলা (‘নন্দীগ্রামে, আইনশৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, আজ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে |’ বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্যের প্রতিবাদে`| ) কপালে স্টিকার আঁটা : সুকুমার গিরি | বুকে মস্ত ছ্যাঁদা নিয়ে চিত হয়ে আছে তমলুক হাস্পাতালে | ঢাক্তার বুঝেছেন এ লোকটাকে বেডে তুলতে গেলেই এক্ষুনি মরে যাবে | ঠিক | গেল তাই | কিন্তু, ছেলে তার বুঝছে না এখনো | বলছে, ‘বাবু, পায়ে পড়ি, বাবাকে বাঁচান’ | ডাক্তার কি করবে আর! ওর ছেলে জানেও না লিডারের কয়েকটি কথায় নির্দেশিত আমাদের শোয়া বসা হাঁটা চলা মরা আর বাঁচা— আমাদের কাজ শুধু মর্গা আর হাসপাতালে পুলিশের গুলি খাওয়া মৃতদেহ হয়ে ‘আইনশৃঙ্খলা’ রক্ষা করা | ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.