আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গুন্টার গ্রাসের জীবনের অজানা অধ্যায়

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

আমার এই লেখাটি যায়যায়দিনের আর্ট অ্যান্ড কালচার ম্যাগাজিনে 17 আগস্ট সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। ব্লগের জন্য সেটাই আপটুডেট করে পোস্ট করলাম। ফ্রাঙ্কফুর্টার আলেমাইন শাইটুঙ-এ (ফ্রাঙ্কফুর্টার জেনারেল নিউজপেপার) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনের একটি অজানা অধ্যায়ের কথা খুলে বলেছেন গুন্টার গ্রাস। এ নিয়ে লেখা তার নতুন বই উইথ স্কিনস অফ দি বাল্ব (পেঁয়াজের খোসা ছড়াতে ছড়াতে) বাজারে আসার প্রক্কালে এই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন গুন্টার গ্রাস।

সাক্ষাৎকারটি বের হওয়ার পর সাহিত্যমহল তো বটেই; বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ওয়াকিবহাল সব মহলে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছে। বইটির বিক্রি গত সপ্তাহে দেড় লাখ ছুঁয়েছে। 1944 সাল থেকে 2006 সালের 12 আগস্ট পর্যন্ত জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাসের জীবনের এই অধ্যায়টি ছিল সকলের অজানা। পোস্ট-ওয়ার পর্বে নানা বিতর্কের মধ্যেও তিনি নিজের যুদ্ধ অভিজ্ঞতা বিষয়ে ছিলেন নিশ্চুপ। ছেলেমেয়ে বন্ধু-বান্ধব কেউ জানতেন না যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানিতে বসবাসকারী এই লেখক নাৎসি কানেকশনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।

স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নাম লিখিয়েছিলেন ওয়েপন এসএস নামক সামরিক সংস্থায়। শুধু তার স্ত্রী আর তিনিই জানতেন এই গোপন সংবাদ। যুদ্ধের পর গুন্টার গ্রাস নাৎসিবাদ নিয়ে ভেবেছেন। আগাগোড়া রাজনৈতিক প্রণোদনা সমৃদ্ধ এই লেখক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও কারণকে তার লেখায় খুঁজে পেতে চেয়েছেন। বিশেষ করে তার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাস টিন ড্রামে তিনি কৌতুক, বিস্ময়, প্রতিবাদ ও হিউমারের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন জামার্নির যুদ্ধ অভিজ্ঞতাকে।

কিন্তু এতসব সাহিত্যিক উদ্যোগ সত্ত্বেও গ্রাসের মনোবেদনা কমেনি। বরং 62 বছরধরে জীবনের এই গোপন ঘটনার ভার বইতে হয়েছে তাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভারমুক্ত হলেন নিজের আত্মজীবনীতে এই কথা সবিস্তারে বর্ণনা করে। এর আগে গ্রাসের জীবনীর এই অংশটি অস্পষ্ট ছিল। তার নতুন স্বীকবারোক্তিতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।

দেরীতে হলেও একটি ভাল কাজ করেছেন গ্রাস বলে অনেকে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সবচেয়ে শকড হয়েছেন তার জীবনীকার মাইকেল জার্গস। তিনি এই ঘটনাকে বলেছেন, একটি নৈতিক প্রতিষ্ঠানের অবসান । পোল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট লেস ওয়ালেসা বলেছেন, তার উচিত জিডানস্ক শহরের অনারারি নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়া। সবচেয়ে ভাল হয় যদি তিনি এটা নিজে থেকেই করেন।

জার্মানি ও পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দল থেকে দাবি উঠেছে গ্রাস যেন নোবেল পুরস্কারও ছেড়ে দেন। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের ওপেন ফোরামে গ্রাসের নোবেল ত্যাগ করা উচিত কিনা তা নিয়ে আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে। নোবেল কমিটি বলেছে, একবার পেলে নোবেল আর ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। অতএব এটা বিতর্কের বিষয় নয়। গ্রাসের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সালমান রুশদি ও হোসে সারামাগো।

আর পরশু জার্মানির চান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, গ্রাসের নাৎসী কানেকশনের ঘটনায় তিনি রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করছেন। যুদ্ধের সময় আর দশটা সাধারণ জার্মান কিশোরের মতোই গ্রাস ছিলেন বিপর্যস্ত অভিজ্ঞতার শিকার একজন লুফটওয়াফেনহেলফার এমনটাই মনে করা হতো এতদিন। কিন্তু নতুন এই তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে গ্রাস ছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে জার্মান শিক্ষার্থীরা সৈনিক হিসাবে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তাদেরকেই লুফটওয়াফেনহেলফার বলা হয়। গ্রাস তার স্কুলের অনেক সহপাঠীর মতো স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন।

জার্মান ইউ-বোট ফিটে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে সফলতার পর তিনি ওয়েফেন/ওয়েপন এসএস-এ ডাক পান 1944 সালে। ওয়েপন এসএস ছিল যুদ্ধকালীন সময়ে হিটলারের এলিট ফোর্স। এর প্রধান ছিলেন হাইনরিখ হিমলার। কিন্তু ড্রেসডেনে 10 এসএস আর্মড ডিভিশন ফ্রান্ডসবার্গে ডাক পড়ার আগে গ্রাস জানতেন না যে তাকে ওয়েপন এসএস-এতেই ডাকা হয়েছে। এটাকে এক ধরনের সিডাকশন বলে আখ্যায়িত করেছেন গ্রাস।

আর যুদ্ধে শেষে তাকে ঘিরে ধরেছে এক ধরনের অসম্মান বোধ। 1927 সালের 16 অক্টোবর ড্যানজিগে একটি পোলিশ-জার্মান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস। এই এলাকাটি এখন পোল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত ও জিডানস্ক নামে পরিচিত। শরণার্থী হিসাবে জার্মানিতে আসে গ্রাসের পরিবার। 1945 সাল থেকে তিনি পশ্চিম জার্মানিতে থেকেছেন কিন্তু লেখায় বারাবারই ঘুরে ফিরে এসেছে ড্যানজিগে কাটানো তার শৈশবের দিনগুলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আহত অবস্থায় আমেরিকান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন তিনি। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রিজনার অফ ওয়ার ক্যাম্পে । উইপিডিয়া গত সপ্তাহে প্রকাশ করেছে ওয়ার ক্যাম্পে থাকার সময় গ্রাসের বন্দি থাকার রেকর্ড। মার্কিন বাহিনীর জন্য বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হয়েছিল তাকে। পরে তিনি ফার্ম ও খনিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন।

আর্ট বিষয়ে পড়াশোনা করেন ডুসেলডর্ফ ও বার্লিনে। 1956-59 সালে তিনি প্যারিস ও বার্লিনে ভাস্কর, গ্রাফিক আর্টিস্ট ও লেখক হিসাবে পেশা শুরু করেন। 1955 সালে তখনকার সমাজে প্রভাবশালী সংগঠন গ্রম্নপ 47-এ যোগ দেন। গ্রাস অনেক নাটক ও 11টি উপন্যাস লিখলেও বিশ্বব্যাপি তার খ্যাতি ছড়িয়েছে প্রথম উপন্যাসটিই। 1959 সালে প্রকাশিত টিন ড্রাম উপন্যাসটির মাধ্যমে তার লেখক জীবনের যাত্রা শুরু।

টিন ড্রামের পর তিনি এর সিকোয়েল ক্যাট অ্যান্ড মাউস (1961) ও ডগ ইয়ারস (1963) লিখেছেন। এই তিনটি উপন্যাসকে একত্রে ড্যানজিগ ট্রিলজি বলা হয়। 1979 সালে টিন ড্রাম উপন্যাসটির মুভি রূপ দেন ডিরেক্টর ভলকার স্কলনডর্ফ। মুভিটি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জয় করে। উপন্যাসটির মতো মুভিটিও ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে।

ড্যানজিগ ট্রিলজির পেক্ষাপট ভিসটুলা নদীর বদ্বীপ ড্যানজিগ অঞ্চল। ড্যানজিগের কালচালার সেটিং-এর মধ্যে গ্রাস নাৎসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করেছেন তার এ তিনটি উপন্যাসে। ন্যাশনাল সোশালিজম ও হলোকস্টের দলিল হিসাবে ড্যানজিগ ট্রিলজি বিশেষভাবে সমালোচক ও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গ্রাসের নতুন স্বীকারোক্তির পর সমালোচকরা তার ক্যাট অ্যান্ড মাউস উপন্যাসে ওয়েপন এসএস-এর অভিজ্ঞতার ছাপ খুঁজে পেয়েছেন। ক্যাট অ্যান্ড মাউস গুন্টার গ্রাসের দ্বিতীয় বই।

এ উপন্যাসটির পটভূমি ড্যানজিগ শহরের আশপাশের এলাকা। একজন ন্যারেটরের জবানিতে এ উপন্যাসের কাহিনীটি বর্ণনা করা হয়েছে। ন্যারেটর এ উপন্যাসে যুদ্ধের সময়ে অভিজ্ঞতাকে অস্বস্তি ও বেদনার সঙ্গে বর্ণনা করেছে। জার্মানি কিভাবে ন্যাশনাল সোশালিজমের সঙ্গে যুক্ত হয় সেটি তার বর্ণনা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্যাট অ্যান্ড মাউসের এই ন্যারেটরের নাম হেইনি পিলেনজ।

সে 32 বছর বয়সের একজন সমাজকর্মী। সে স্মরণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ড্যানজিগে ছেলেবেলার সঙ্গী জোয়াকিম মালখির সঙ্গে তার বিপর্যসত্দ বন্ধুত্বে কথা। উপন্যাসটির কাহিনী বারবার পোস্টওয়ার ও ওয়ার পর্বে আসা যাওয়া করেছে। হেইনি স্মরণ করেছে হাইস্কুলে থাকার সময় যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা। ছেলেদের পুরো একটি দল আটকে পড়া একটি ইউ-বোটে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছে।

রহস্যময় বোটটিতে তাদের কৈশোরের নানা অভিজ্ঞতা নতুন রূপ পেয়েছে। উপন্যাসটিতে ওই বালকদের জীবনের পাঁচটি বছরকে চিত্রিত করা হয়েছে। আর এটি শেষ হয়েছে মালখির রহস্যময় হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্যদিয়ে। 1944 সালে যখন সে হারিয়ে যায় তখন তার বয়স হয়েছিল 18। 1967 সালে ক্যাট অ্যান্ড মাউস উপন্যাসটি থেকে মুভি তৈরি করেন জার্মান পরিচালক হ্যান্স জারগেন পোল্যান্ড ।

নোবেল বক্তৃতায় ড্যানজিগ ট্রিলজি লেখার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে গ্রাস বলেন, 'আমি তখন তুলনামূলকভাবে তরুণ লেখক ছিলাম। সেই বয়সে এগুলো লেখার অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছিল বই আক্রমণ শানিত করতে পারে। ভীতি, এমনকি ঘৃণার উত্তেজনাও ছড়াতে পারে। কারও দেশকে ভালোবাসা দিয়ে করায়ত্ত করা হলেও সেটাকে নীড় তছনছ করার ঘটনা হিসেবে দেখা হতে পারে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বিতর্কের প্রতি উৎসাহী হয়েছি।

নিজের লেখায় গুন্টার গ্রাস আগাগোড়া পলিটিক্যাল। এই রাজনীতি সচেতনতা তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ড্যানডজিগ ট্রিলজির সাহিত্যিক সাফল্যের পর গ্রাস রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি সোশাল ডেমোক্রাট নেতা উইলি ব্রান্ডট-এর ঘনিষ্ঠ হন। উইলি ব্রান্ডট 1969 থেকে 1974 পর্যনত্দ পশ্চিম জার্মানির চান্সেলর হয়েছিলেন।

সত্তর ও আশির দশকে গ্রাসের আগ্রহ জার্মান ইতিহাস ও সাম্প্রতিক রাজনীতি থেকে বর্ধিত হয় নতুন কিছু বিষয়ের দিকে। এগুলোর মধ্যে ছিল ফেমিনিজম, আর্ট অফ কুকিং ও ইকোলজি। 1975 সালে তিনি প্রথম ইনডিয়া সফর করেন। 1980'র দশকের শেষ দিকে তিনি কলকাতায় ছিলেন। গ্রাসের ডায়রিতে কলকাতা সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা আছে।

গ্রাসের 80 ও নব্বই দশকের কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দি র্যাট। এই উপন্যাসে ন্যারেটর একটি ইঁদুর উপহার পায়। ইঁদুরটি তাকে নানা গল্প বলে। এইসব গল্পের সারমর্ম হলো_ ইঁদুরদের হাতেই আগামী পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। প্রাবন্ধিক হিসাবে গ্রাস বহুলপ্রজ।

তার প্রবন্ধগুলো ঐতিহাসিক ও রাজনেতিক নানা পরিপ্রেক্ষিতে আবর্তিত হয়। ফলে অনেক সময় জার্মানির বাইরের পাঠকের কাছে সেগুলো দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। 1989-91 সালে তিনি ছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির একত্রীকরণের বিপক্ষে। 1992 সালে তিনি জার্মানির রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রতিবাদে জনসমক্ষে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরের দিকের প্রবন্ধগুলোতে তিনি সাম্প্রতিক রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার সমালোচনা করেন।

1976 সাল থেকে তিনি এল ম্যাগাজিনের কোএডিটর। 1983 থেকে 1986 সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বার্লিন একাডেমি অফ আর্টসের প্রেসিডেন্ট। গ্রাস অনেক পুরস্কার, সম্মননা ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য_ গ্রুপ 47 প্রাইজ (1958), ক্রিটিকস প্রাইজ (জার্মানি, 1960), ফরেইন বুক প্রাইজ (ফ্রান্স, 1962), বুহনার প্রাইজ (1965), ফনটেন প্রাইজ (1968), মাজাকোস্কি মেডাল (1977), লিওনার্দ ফ্রাঙ্ক রিং (1988)। 1999 সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.