কবি
প্যারিস রিভিউ-এ গুন্টার গ্রাস দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। অবসরে সেটা অনুবাদ করেছিলাম একদা। কম্পোজ করার অনিহার কারনে এই সাক্ষাৎকারের একটা বিশাল অংশ এখনো অকম্পোজিত অবস্থায় রয়ে গেছে। সেটা পরে একদিন ধীরে ধীরে দেওয়া যাবে। গ্রাসের যতগুলো সাক্ষাৎকার পাঠ করেছি তার মধ্যে এটাকেই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমার কাছে।
এখানে তিনি প্রাণ খুলে নিজের লেখালেখি, শৈশব, নিজ পরিবার, রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াও নানা বিষয়ে কথা বলেছেন।
এলিজাবেথঃ আপনি কিভাবে লেখক হয়ে উঠলেন?
গ্রাসঃ আমার মনে হয় যে সামাজিক পরিবেশ এর মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা, সে পরিবেশে এটা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। আমাদের ছোট্ট দুকামরার একটা বাড়ি ছিলো। আমার আর আমার বোন জানতাম না নিজস্ব রুম বলে কারও কিছু থাকতে পারে।
আমরা থাকতাম একই ঘরে -- সেই ঘরের দুই জানালার ফাঁকে ছোট এক কোনায় আমার বই গুলো রাখতাম। শুধু কী বই -- জলরঙ করার জিনিস পত্র-- এমন অনেক কিছু। মাঝে মাঝে আমি অভাব অনুভব করতাম। ছোট বেলাতেই আমি আমার আত্মার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। আর সে জন্যই ছোট বেলা থেকে লিখতে আর আঁকতে শুরু করি।
আজ আমার যে সহায়-সম্পত্তি তার সমস্তই হয়তো সেই সূচনার ফলাফল। চারটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়া-শোনা করেছি। আমার শৈশবের সেই রূঢ় বাস্তবতা আর একটা ঘরের ছোট্ট কোনায় আমি আর আমার বোনের বেঁচে থাকার সেই স্মৃতিকে আমি আজও ভয় পাই।
এলিজাবেথঃ এমন পরিপার্শ্বের ভেতর খেলাধূলা অথবা অন্য কোন সহজ কাজ না করে পড়া আর লেখালেখির মত কঠিন একটা বিষয় কেনো বেছে নিলেন?
গ্রাসঃ শিশু কালে আমি খুব মিথ্যাবাদী ছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমার মা আবার আমার এই মিথ্যাগুলোকে খুব পছন্দ করতো।
আমি তাকে মহান কিছু বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার রয়স যখন দশ বছর তখন মা আমাকে পিয়ার গিয়স্ট নামে ডাকতো। সেই সময় আমাদের নেপলস ভ্রমনের কথা ছিলো। মা আমাকে সেই ভ্রমন সম্ভন্ধে একটা গল্প লিখতে বলেছিলো। আর তখন থেকেই আমি মিথ্যা লেখা শুরু করি।
আর সেই মিথ্যাচার আমি চালিয়েই গেলাম। বারো বছর বয়সে আমি উপন্যাস লেখা শুরু করি। এটা ছিলো kashubium সর্ম্পকিত, যা বহু বছর পর The Tin Drum-এ Oskar এর দাদি Anna চরিত্রে রূপান্তরিত হলো। প্রথম এই উপন্যাসে আমি একটা ভুল করেছিলাম। উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের শেষের দিকে সমস্ত চরিত্রের মৃত্য ঘটে গেলো।
আমার আর শেষ করা হলো না। তবে এটাই হলো আমার উপন্যাস লেখার প্রথম শিক্ষা চরিত্র সম্ভন্ধে সচেতনভাবে খুব সাবধান থাকতে হয়।
এলিজাবেথঃ কোন মিথ্যা আপনাকে সব থেকে বেশী আনন্দ দিয়েছে?
গ্রাসঃ যে মিথ্যা কাউকে আঘাত করে না, কাউকে বাঁচায়। আমার অভিনব মিথ্যাচার গুতানুগতিক মিথ্যাচার থেকে বেশ আলাদা। এটা আমার পেশা নয়।
সত্য বড় ক্লান্তিকর, তুমি মিথ্যার সাথে সত্যকে ব্যবহার করতে পারো। এতে দোষের কিছু নেই। আমি এটা বুঝেছি যে আমার ভয়ংকর মিথ্যার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যদি কয়েক বছরের র্জামানীর রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু লিখতাম তবে লোকে বলতো, কী নিদারুণ মিথ্যাবাদী।
এলিজাবেথঃ প্রথম উপন্যাসে ব্যর্থতার পর আপনি কি করলেন?
গ্রাসঃ কবিতা আর ড্রয়িং নিয়ে আমার প্রথম কবিতার বই।
প্রকৃতপক্ষে আমার কবিতায় ছিলো ড্রয়িং আর গদ্যের সমাবেশ, কখনও কখনও তা চিত্রকল্পের বাইরে, এমনকি কখনও তা শব্দ-বাক্যহীন। এরপর চব্বিশ বছর বয়সে আমি টাইপ-রায়টার কেনার সামর্থ অর্জন করি। দুই আঙ্গুলে লেখার পদ্ধতি আমার ভালো লাগলো। The Tin Drum এর প্রথম অংশ টাইপ-রায়টারে লেখা। আমার বয়স বাড়তে লাগলো।
আমি শুনছি আমার বন্ধুরা কম্পুটারে লেখে। প্রথম খসড়া আমি হাতে লিখি। প্রিন্টার থেকে The Rat এর প্রথম সংস্করণ লাইনহীন বড় কাগজে বই আকারে পাই। যে কোন বই প্রকাশের আগে সাদা কাগজসহ একটা ব্লাইন্ড কপি আমি প্রকাশকের কাছ থেকে চেয়ে নেই। প্রথম বার হাতে লেখার পর বাকি দুই তিনবার টাইপ-রাইটারে লিখে লেখাটা শেষ করি।
তিন বার না লিখলে আমি কোন বই শেষ করতে পারি না। সাধারণত চারবার সংস্করণের পরই তা মুক্তি পায়।
এলিজাবেথঃ প্রতিটা খসড়া লেখার সময় কি ঘটে? প্রথম থেকে শুরু করে আবার শেষ পর্যন্ত পুনরায় লেখেন?
গ্রাসঃ না। প্রথম বার আমি খুব দ্রুত লিখি। সেক্ষেত্রে আমার পছন্দ নয় এমন অনেক বিষয় থাকে।
কিন্তু দ্বিতীয় বারে লেখার সময় লেখাটি হয় দীর্ঘ, বিস্তরিত ও চুড়ান্ত। হয়তো লেখাটি যথার্থ হলো তারপরও আমার মনে হতে থাকে যে ঠিক রসোত্তীর্ণ হলো না। আবার লিখতে শুরু করি প্রথম বারের স্বতস্ফূর্ততা নিয়ে; দ্বিতীয় বার যা কিছু প্রয়োজনীয় ছিলো তৃতীয় বার তাই পূরণ করি। কাজটা খুব সোজা নয়, বেশ কঠিন।
এলিজাবেথঃ আপনি যখন লেখার ভেতর থাকেন তখন আপনার দৈনন্দিন কাজ কি ?
গ্রাসঃ যদি কিছু লিখি আর যদি তা হয় প্রথম খসড়া তবে সেক্ষেত্রে আমি প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ পৃষ্ঠা লিখি।
আর এটা যদি হয় তৃতীয় থসড়া সেক্ষেত্রে ৩ পৃষ্ঠার বেশী আর আগায় না প্রতিদিন। খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হই।
এলিজাবেথঃ সাধারণত সকালে দুপুরে না রাতে লিখেন?
গ্রাসঃ কখনওই রাতে নয়। আমি রাতে লেখা বিশ্বাস করি না কারণ তখন লেখা খুব সহজে এসে যায়। আর সকালে যখন লেখাটা পড়তে বসি তখন মনে হয় কিছু হয়নি।
শুরু করার জন্য আমার দিনের আলো জরুরী। ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে আমি নাস্তা করি। নাস্তার পর লিখতে বসি। দুপুরে কফি পানের বিরতি তারপর আবার লেখা চলতে থাকে সন্ধ্যা ৭ টা অব্ধি।
এলিজাবেথঃ কিভাবে বোঝেন একটা বই এর পর আর লেখার দরকার নেই অর্থাৎ বুঝেন এখানেই লেখা শেষ করা ভালো?
গ্রাসঃ একটা দীর্ঘ বই লেখা আমার কাছে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
একটা বই লিখতে ৪/৫ বছর লেগে যায়। যখন আমার মনে হয় আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি তখন আমার মনে হয় এখানে ইতি টানা আবশ্যক।
এলিজাবেথঃ ব্রেখট সর্বদা তার লেখা পুনঃলিখন করতো। প্রকাশিত হবার পরও তিনি ভাবতেন না যে লেখাটা শেষ হয়েছে।
গ্রাসঃ আমার মনে হয় আমি কখনও এমন করবো না।
জীবনের একটা বিশেষ সময়ে আমি The Tin Drum অথবা From the Dairy of a Snail লিখেছি। ঐ সময়ের ভাবনাই বই গুলোর পরমাত্মা। আমি নিশ্চিত আমি যদি এখন The Tin Drum অথবা Dogs Year অথবা From the Dairy of a Snail পুনরায় লিখি তবে লেখা গুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।
( প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।