জীবনের কথা বলতে চাই গত ৬তারিখ দুপুর বেলায় এক রিকশাওয়ালার জীবন যুদ্ধ নিয়ে ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাসে একটি ঘটনা লিখেছিলাম। কিন্তু কষ্টের বিষয়, গামা নামের সামহোয়্যার এর একজন ব্লগার তার ব্লগে আমার লেখাটি তার নামে চালিয়ে দেয় ৭তারিখ সন্ধায়। তাই আমি নিজে একখান ব্লগ খুলে সেই লেখাটি এবং আমার অন্যান্য লেখা এখন থেকে ফেসবুক এবং অন্যান্য ব্লগে পোস্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রিকশাওয়ালা কে নিয়ে আমার লেখা সেই লেখাটি দিয়েই শুরু করছি। যদিও গামা সাহেবের চৌর্যবৃত্তির কল্যানে আপনারা ইতিমধ্যে লেখাটা পড়েছেন ।
তবুও আবার দিলাম। আমার ব্লগার জীবনের শুরু হল এর মাধ্যমে। সবাই দোয়া করবেন।
এক জীবনযোদ্ধার গল্প শুনি আজ। বছর দুয়েক আগের কথা।
নীলক্ষেত থেকে রিকসায় হোস্টেলে ফিরছিলাম। রিকশাওয়ালার ডান হাত কনুই থেকে কাটা।
বুয়েট এর সামনে দিয়ে যাওয়ারও সময় দেখলাম ছেলেপেলে দলে দলে ব্যাগ-বোস্কা নিয়ে হল ছাড়ছে।
রিকশাওয়ালা বলল- ভাই, কি হইছে ??
আমি পাত্তা না দিয়ে বললাম- "ওই পোলাপানের গ্যাঞ্জাম আর কি ! খেলা দেখা নিয়া দুই ব্যাচ মারপিট করছে। তাই হল খালি করতে বলছে
স্যাররা"।
রিকশাওয়ালা আমার দিকে ঘুরে বলল- "ভাই। এইডা কোন কথা হইল ? কত মানুষ পড়তে চায়, সুযোগ পায় না। আর এনারা সুযোগ
পাইয়া এখন মারামারি কইরা বাসায় যাইতেছে! বাসায় গিয়া কি আর পড়া হইব? দেখব তো খালি টিভি! হায়রে!"
কথাগুলো শুনে আমি রীতিমত শক খেলাম। বুঝলাম এই লোক রিকশা চালালেও ভেতরের জিনিস অন্য কিছু। কৌতূহলবশত কথা বলা
শুরু করলাম তার সাথে।
এরপর যা শুনলাম, তা ওনার মুখ থেকেই শুনুন।
"ভাই, আমাগো দেশের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জ । আব্বায় গরিব হইলেও রাস্তার ফকির ছিলনা। ২ বোনের এক ভাই আমি।
খাইয়া পইড়া ভালোই ছিলাম! আব্বার খুব শখ ছিল পোলাপানরে পড়াশুনা করাইব, আমাগো স্কুলেও
ভর্তি করছিল।
আমি ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ছি। আপনাগো মতো না হইলেও ছাত্র খুব খারাপ ছিলাম না। আব্বার ইচ্ছা ছিল কমপক্ষে বিএ পাস
করাইব। আব্বায় অন্যের জমিতে বরগা খাটত, শত কষ্ট হইলেও আমারে কামে ডাকতো না। কিন্তু কপালে সুখ না থাকলে ভাই, কিছুতেই কিছু হয়না।
একদিন স্কুল থিকা বাড়িতে আইসা শুনি আব্বায় মারা গেছে। ক্যামনে কি হইল এতদিনে ভালো মনে নাই।
খালি মনে আছে জমিতে কাম করতে করতে হঠাৎ শুইয়া পরছিল। ওই শোয়াই শেষ কইরা দিলো আমাগো সব।
আম্মায় আমাগো নিয়া দাঁড়ানের চেষ্টা করছিলো, পারে নাই।
বোনেরাও ছোট ছিল, তাই আমিও পড়াশুনা ছাইড়া আম্মার লগে লগে কাম করা শুরু করলাম।
কিন্তু পেটে ভাতেও হয়না। ততদিনে ঘরবাড়ি বন্ধক দিয়া খাওয়া শেষ।
পরে আম্মায় আমাগো নিয়া ঢাকায় আইলো।
আমি কাম নিলাম এক ফ্যাক্টরিতে, আম্মায় মাইনসের বাড়িতে।
এই কইরা বহুকষ্টে বোনেগো বিয়া দিছি। তারপর কিছু টাকাও জমাইছিলাম হাতে।
ভালোই চলতেছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎ হইল আরেক সর্বনাশ। ফ্যাক্টরিতে একদিন এক্সিডেন্ট করলাম।
মেশিনে চাপা পড়ল আমার ডাইন হাত।
পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হইলাম। যা টাকাপয়সা
জমাইছিলাম সব শেষ কইরা একটা হাত খুয়াইয়া ১মাস পর খালি জানডা নিয়া বাসায় আইলাম।
কি আর কমু ভাই, বাসায় আইয়া আম্মায় আর আমি খালি দুইজন দুইজনরে ধইরা কান্দি।
সারারাইত কানলাম। সকালে উইঠা আম্মায় কামে গেলো।
কাইন্দা তো আর পেট ভরব না। আম্মায় যেই বাসায় কাম করত, ওই মালিকের আছিল রিকসার গ্যারেজ। সব কথা শুইনা
বেটা কয়- তোর পোলারে আমার কাছে পাঠাইয়া দিস। কয়দিন পর একটু সুস্থ হইলে গেলাম মালিকের কাছে। মালিকে আমারে একটা রিকশা
ধরাইয়া দিলো।
কয়- জমা লাগব না পরথম মাস। খালি একটু সাবধানে চালাইস। আরেকটা হাত ও খাইসনা ।
সেই থিকা ভাই এই ১৭ বছর ধইরা আমি রিকশা চালাই। আমার ১ মাইয়া।
মাইয়াডারে বহুত কষ্টে পালছি ভাই। অগ্রণী স্কুলে পড়ে। এইবার
মেট্টিক দিবো। হেড ম্যাডাম ছাড়া আর কেউ জানেনা যে মাইয়ার বাপ রিসকা চালায়। মাইয়াডা ওর বান্ধবীগো বাসায় আনতে পারেনা, তাই
কারো বাসায় ডাকলেও যায় না।
মুখে কিছু কয়না। কিন্তু আমি বুঝি মাইয়াডা কষ্ট পায়। গত তিন বছর ধইরা মাইয়ারে ম্যাডাম মাগনা পরাইতেছে স্কুলে। পরীক্ষা আইছে,
তাই গত ৬মাস ধইরা অন্য একটা স্যারের কোচিঙে দিছি। স্যার ভালো মানুষ।
মাসে ১২০০ টাকায় পড়ায়।
আমি এই হাত লইয়া আগে একদিন পর পর রিকশা চালাইতাম, কিন্তু এহন ডেইলি চালাই। মাইয়ার পড়ার খরচ বাড়ছে তো। আমি ভাই
কাউরে এইসব কইনা। কইলে ভাবে বেশি ভাড়া নেওয়ার ধান্দা।
কিন্তু আইজ ওই ভাইগো কাহিনী শুইনা মনডা খারাপ হইল, তাই কইলাম।
আপনে কিছু মনে কইরেন না। আর আমার মাইয়াডার জন্যে দোয়া কইরেন। বহু মাইনষের দোয়ায় মরতে মরতে বাইচা আছি ভাই।
এখন মাইয়াডারেও বাচাইতে পারলে হয়।
কমার্সে দিছি। যদি কোনদিন একটা ব্যাঙ্কে চাকরি পায়, এই আশায় আছি।
এতদূর বলে ভাড়া নিয়ে হাসিকান্না মেশানো একটা চেহারা করে কোনোমতে চলে গেলেন জীবনযুদ্ধে পোর খাওয়া এক রিকশাওয়ালা।
আর আমি হতবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম অসাধারন এক বাবার দিকে, হার না মানা এক ফাইটারের দিকে, আর মন
ভরে দোয়া করলাম মেয়েটার জন্যে।
যদি আমার হিসেবে ভুল না হয়, তাহলে এইবার মেয়েটার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ।
কে জানে, হয়ত গতকাল মেয়েটার
পরীক্ষা ছিল। হয়ত চমৎকার একটা পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়েছে মেয়েটা, আর বাইরে হাসিমুখে অপেক্ষায় ছিল তার বাবা। এই গরমে অন্য মেয়েরা পরীক্ষা
শেষে আইসক্রিম, কোক পেপসি খাচ্ছে।
বাবাটা হয়ত তাই দেখে বলেছে- মা কিছু খাবি ?? মেয়ের হাসিমুখে উত্তর- বাড়ি চল বাবা। গরম ভাত খাব।
এই শুনে বাবা চোখ মুছতে মুছতে বলছে- চল। তোর মায় আইজ ইলিস মাছ রানছে।
লেখাটির ফেসবুক লিঙ্ক- Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।