আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাপ্তির ইতিকথা.

আমার 'কলম' আজো আছে আমার সাথে, আমার কষ্টের সঙ্গী হয়ে,আমার সুখের ভাগ নিয়ে দেনা-পাওনা চুকিয়ে,এক চিলতে হাসি হয়ে... সকাল থেকেই শরীরটা বেশী খারাপ লাগছে শাহানা বেগমের। কিন্তু সংসারের হাজারো কাজের ভীড়ে সেদিকে মনোযোগ দেবার সময় কই...!ক'দিন পর বড় ছেলেটার ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা, মেঝ আর সেঝ ছেলের স্কুলে পুরোদমে ক্লাস চলছে। ছোট ছেলের বয়স তিন বছর সারাক্ষন শুধু মায়ের আঁচল ধরে থাকে,একা একা সংসার সামলাতে সামলাতে তাই হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। সবাইকে দুপুরের খাবার খাইয়ে রান্না ঘর গুছাতে গুছাতে আপন মনেই বিড় বিড় করেন শাহানা বেগম, ''এখন যদি একটা মেয়ে ঘরে থাকতো তাহলে কতোই না ভালো হতো,একা একা এত কাজ করা লাগত না আমার। একটা সংসারে মেয়ে যে কতোটা দরকার তা আমার থেকে ভালো কে বুঝে...!আল্লাহর কাছে কতো করে একটা মেয়ে চাইলাম,কিন্তু আল্লাহ তো শুনেই না,মেয়ের আশায় আশায় চারটা ছেলে হলো...হায়রে কপাল!কেউ মেয়ে চায়না আর আমি চাই পাই না...'' স্বামীর বাইকের আওয়াজ পেয়ে ধ্যান ভাঙ্গে শাহানা বেগমের।

দ্রুত কাজ শেষ করতে লাগলেন। তিলতিল করে অনেক কষ্টে এই সংসারটা গড়ে তুলেছেন শাহানা বেগম আর তার স্বামী ফারুক সাহেব দু'জনে মিলে। ছোট্ট একটা ব্যাবসা থেকে আজ অনেক বড় ব্যাবসা ফারুক সাহেবের,দুবছর হলো বাড়ী করেছেন,আস্তে আস্তে মনের মতো করে সংসার সাজাতে শুরু করেছেন শাহানা বেগম। জীবনে অনেক কষ্টের পর আল্লাহ অবশেষে সুখের মুখ দেখাতে শুরু করেছেন। এখন শুধু মনে একটাই আফসোস,যদি একটা মেয়ের মা হতে পারতেন... ছোট বেলায় শাহানা বেগম যখন থেকে পুতুল খেলতেন তখন থেকেই মনের ভেতর আকাঙ্খা তার নিজের ও এমন পুতুলের মতো একটা মেয়ে হবে।

তার ছোট বেলায় খেলা সেই পুতুল গুলো আজো তিনি তার ট্রাঙ্কে জমিয়ে রেখেছেন,যদি কখনো তার একটা মেয়ে হয় তাহলে এগুলো তাকে দিবেন...তার এসব কাজ দেখে ফারুক সাহেব হাসেন। তবে মনে মনে তিনিও দোয়া করেন আল্লাহর কাছে যেন তার একটা মেয়ে হয়...তিনি যখন বাড়ী ফিরবেন তার মেয়ে তার কাপড় এগিয়ে দিবে,তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে...এমন স্বপ্ন তিনিও দেখেন। শাহানা বেগম প্রায়ই তার মা কে বলেন,মা তুমি কতো ভাগ্যবতি আল্লাহ কি সুন্দর তোমাকে চারটা মেয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমাকে কেন দেন না?!আমার তোমাকে অনেক হিংসা লাগে বুঝলা...!'তার কথা শুনে মা হেসেই খুন। বড় বোনের মেয়ে মুনিয়া কে অসম্ভব আদর করেন তিনি,প্রায়ই বলেন কবে যে আমার তোর মতো একটা মেয়ে হবে্‌...' এমনকি বড় ছেলে শাওন তো প্রায়ই বলে,ধূর মা,খালি তো ভাই আর ভাই,একটা বোন নাই কেন?! আর সেঝ ছেলে শাকিল তো প্রায়ই তাকে খেপায় এই বলে,আম্মু শোন, আমরা চারটা ভাই/বোনের দরকার নাই/কি সুন্দর দিন কাটাই/কোন ঝগড়া নাই !! ফারুক সাহেব ব্যাবসার কাজে একদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন,যদিও এ সময় তিনি বাইরে যেতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু না যেয়ে উপায় নেই।

অবশ্য বাড়ীতে আরও মানুষ আছে, শ্বাশূড়ী, দুই ভাইয়ের বউ,আর আগামী কাল তার স্ত্রীর বড় বোন ও আসবে সুতরাং খুব একটা চিন্তার কিছু নেই। আর তাছাড়া শাহানা বেগম এর আগেও চারবার মা হয়েছেন এবার আর এত চিন্তার কি আছে? এই ভেবে মনে স্বান্তনা নিলেন তিনি। সকালে ব্যাগ গুছিয়ে বের হওয়ার সময় বড় দুই ছেলেকে বুঝিয়ে বলে গেলেন,তিনি বাড়ী না ফেরা পর্যন্ত যেন ছেলে সব সময় বাসায় ই থাকে,কখন কি দরকার পরে বলা যায় না। আর কোন সমস্যা হলে যেন তাকে ফোন করে। আর সারাক্ষন যেন মায়ের আশেপাশেই থাকে।

শাহানা বেগমের কেন জানি আজ অসম্ভব রকমের ক্লান্ত লাগছে,শরীর মনে হচ্ছে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে... এর আগে কখনো এমন লাগেনি,তারপরেও খুব একটা গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন না। স্বামীকে দেখে অনেক কষ্টে হাসলেন তিনি,পাশে বসে ফারুক সাহেব বললেন, ---আমি যাচ্ছি,যতো দ্রুত সম্ভব চলে আসব,তুমি কিন্তু নিজের দিকে ভালো মতো খেয়াল রেখো। সিরাজকে বলে গেয়েছি,কোন দরকার হলেই ও সিএনজি নিয়ে চলে আসবে। --ঠিক আছে,আল্লাহ ভরসা,তুমি কোন চিন্তা করোনা। স্বামীকে হাসি মুখে বিদায় দিলেন শাহানা বেগম,কিন্তু মনের ভেতর কেমন জানি করে উঠল তার... পরের দিন সকাল থেকেই শাহানা বেগমের শরীর আরো খারাপ হয়ে গেল,সবাই হাসপাতালে নেয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগল,কিন্তু শাহানা বেগম কেন জানি হাসপাতালে যেতে রাজী হলেন না,বোন কে বললেন বাসায়ই একজন নার্স ডেকে আনতে।

বোন অনেক করে রিকোয়েষ্ট করলেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য কিন্তু লাভ হলো না। শাহানা বেগম ভাবলেন,একেতো স্বামী বাড়ীতে নেই তার উপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ছেলেদেরকে দেখার কেউ থাকবে না। এসব চিন্তা করে বাসায়ই থাকার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। অবশেষে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে বেলা দশটার দিকে ফুটফুটে এক মেয়ের মা হলেন শাহানা বেগম। সারা বাড়ী আনন্দে ভরে গেল,ছেলেরা বাবাকে ফোন করে সুখবর দিল,ফারুক সাহেব খবর পেয়েই সব কাজ ফেলে ঢাকায় রওনা হলেন।

শাহানা বেগম অনেক দুর্বল হাতে মেয়েকে কোলে নিলেন। মাশায়াল্লাহ,যেন চাঁদের টুকরো দিয়েছেন আল্লাহ তাকে। পাশে থেকে তার মা বলে উঠল,একদম তোর মতোই হয়েছে তোর মেয়ে,আল্লাহ তোর মনের আশা পূরন করেছেন। শাহানা বেগম শুধু হাসলেন। দুপুর ১টার দিক থেকে শাহানা বেগমের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হতে লাগল,তার শুধু মনে হচ্ছে, তার বুক জ্বলে যাচ্ছে,প্রচন্ড ব্যাথায় ছটফট করতে লাগলেন তিনি,দ্রুত ডাক্তার ডাকা হলো,ডাক্তার সব দেখে,দেরী না করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন,কিন্তু শাহানা বেগম তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

আস্তে আস্তে আরো খারাপ হতে লাগল তার অবস্থা। বেলা তিনটার দিকে ফারুক সাহেব বাসায় এসে পৌছালেন,সব দেখে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়ার জ্ন্য তৈরী হলেন। শাহানা বেগম অনেক কষ্টে তার মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করলেন,অনেকক্ষন বুকে জড়িয়ে রাখলেন। তারপর তার ছোট দেবরের বউ কে ডাকলেন,তার বাড়ীর উপর তলাতেই থাকে তার দুই দেবর। মেয়েকে তুলে দিলেন দেবরের বঊরে কোলে,আর বললেন,আমার মেয়েকে দিয়ে গেলাম,যতদিন ও বুকের দুধ খাবে ততোদিন ওকে তোমার কাছেই রেখ,তারপর ওকে আমার বড় বোনের কাছে দিয়ে দিও, আমার বড় বোনই ওকে মানুষ করবে।

''সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে!এর পর তার গলার চেইন টা খুলে মেঝ দেবরের বউকে পড়িয়ে দিলেন,আর বললেন,আমি চলে যাবার পর পারলে আমার সংসারের দিকে একটু খেয়াল রেখো,তিন বেলা কি রান্না হলো,ছেলেরা ঠিক মতো খেল কি না তা দেখ...''বের হবার আগ মুহুর্তে বড় দুই ছেলেকে ডাকলেন,মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি যাই বাবা,মা নেই বলে অনেক দুঃখ করিস না,মানুষের মতো মানুষ হবি,ছোট ভাই-বোন্ কে দেখিস,আর বাবার সাথে থাকিস। '' অশ্রু সজল চোখে বাড়ী থেকে বের হলে শাহানা বেগম,স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন,আর পেছনে পরে রইল তার সাজানো সংসার,তার আকাঙ্খার ধনেরা... হাসপাতালে ঢুকার আগ মুহুর্তে সবাইকে ছেড়ে চলে যান শাহানা বেগম। ফারুক সাহেব যখন স্ত্রীর লাশ নিয়ে কবরস্থানের দিকে রওনা হবেন তখন হঠাত করে তার তিন বছরের ছেলেটা ছুটে এসে বলল,আব্বু,তুমি আম্মু কে কই নিয়া যাও?এত রাতে আম্মু কই যায়?... এতক্ষন নিজেকে সামলে রাখলেও এবার আর সামলে রাখতে পারলেন না,ছেলে কে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। [আজ প্রায় দু'মাস হলো,শাহানা মামী চলে গেছেন,কিন্তু মামী প্রায়ই আমার স্বপ্নে আসেন,হাসি মুখে আসেন,কিছুক্ষন কথা বলেন তারপর দেখি হঠাত মুখটা কালো হয়ে যায়,জিজ্ঞেস করলে বলেন,আজ যাইরে আমার মেয়েটা কাঁদছে,আবার পরে আসব...। আজও যখন শুনি কারো দুই মেয়ে বা তিন মেয়ে হয়েছে বা ছেলে নেই বলে মন খারাপ করেছে আমার চোখে তখন শাহানা মামীর মুখটা ভেসে উঠে,অজান্তেই চোখ ভিজে উঠে।

]  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।