প্রবাসী আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯১২ সালের ১৪/১৫ই এপ্রিল উত্তর আটলান্টিকে বরফের চাইয়ের আঘাতে খন্ড বিখন্ড হয়ে ডুবে যায় টাইটানিক জাহাজ। জাহাজ ডুবির ইতিহাসে এটিই হল সবচে বিয়োগান্তক ঘটনা। টাইটানিক নিয়ে তৈরী হয়েছে অসংখ্য সিনেমা, লেখা হয়েছে গল্প,নাটক, উপন্যাস। অনেক গান, অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে রেডিও, টেলিভিশনে। ।
১৯৯৭ সালে জেমস ক্যামেরুন নির্মিতএবং লিওনার্ডো ডি ক্যাপ্রিও অভিনীত “টাইটানিক”(Titanic) ছিল রেকর্ড ভঙ্গকারী চলচ্চিত্র। অপর এক উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ছিল ১৯৫০ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র “"A Night to Remember”
ইতিহাস-
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিমান ছিল না। জাহাজই ছিলো সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার একমাত্র ভরসা। ইউরোপ থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকা যাওয়ার জাহাজ ব্যবসা ছিল খুব লাভজনক। ধনী এবং অভিবাসী যাত্রীদের আকৃস্ট করতে জাহাজ কোম্পানী গুলো থাকত সদা তৎপর।
ঐ সময়ের ইংল্যান্ডের প্রধান দুই জাহাজ কোম্পানী হল হোয়াইট স্টার(White Star) এবং কুনার্ড( Cunard )। ১৯০৭ সালে কুনার্ড কোম্পানী যখন স্বল্পতম সময়ে আমেরিকা পৌছানোর দ্রুতগতি সম্পন্ন জাহাজ লুইজিতানিয়া (Lusitania )এবং মৌরিতানিয়া ( Mauretania) তাদের বহরে যোগ করল , চিন্তায় পড়ে গেলেন হোয়াইট স্টার লাইন (White Star) কোম্পানীর চেয়ারম্যান ইসমে ( J. Bruce Ismay )। বেলফাস্টের জাহাজ নির্মা্নকারী প্রতিষ্ঠান হারল্যান্ড এন্ড উলফ (Harland and Wolff) এর মালিক উইলিয়াম পিরি ( William Pirrie,) এর সাথে পরামর্শ করে তিনটা বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ অলিম্পিক( Olympic ) টাইটানিক (Titanic)এবং ব্রিটানিক(Britannic ) নির্মানের সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। ১৯০৯ সালেহারল্যান্ড এন্ড উলফ (Harland and Wolff) কোম্পানির স্থপতি টমাস এন্ড্রু (Thomas Andrews ) র নকশায় শুরু হল টাইটানিক জাহাজের নির্মান কাজ। সেই সময়ের সবচে বড় এবং বিলাসবহুল জাহাজ হিসেবে টাইটানিককে গড়ে তোলা হল।
জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাহাজকে ভাগ করা হয় ১৬টা আলাদা প্রকোষ্ঠে। এক প্রকোষ্ঠ হতে অন্য প্রকোষ্ঠে পানি ঢোকা ছিল অসম্ভব । ১৬ টার মধ্যে ৪ প্রকোষ্ঠে পানি ঢুকলেও জাহাজ ভেসে থাকতে অসুবিধা হত না। ফলে অনেকে বিশ্বাস করতেন টাইটানিক জাহাজ কোনদিন ও ডুববে না। ৩১শে মে ১৯১১ সালে জলে নামান হল টাইটানিককে।
তারপর শুরু হল যন্ত্রপাতি লাগানো, সাজশয্যা। ১৯১২ সালের এপ্রিলের গোড়ার দিকে পরীক্ষামুলক সমুদ্র যাত্রা শেষ হওয়ার পর তাকে নিরাপদ এবং আরামদায়ক সুমদ্র ভ্রমন উপযোগী জাহাজ হিসেবে হস্তান্তর করা হল জাহাজ কোম্পানীর কাছে । জাহাজের পুরো নাম হল RMS Titanic (Royal Mail Ship = RMS)
টাইটানিক জাহাজের নকশা
ঐ সময়ের বৃহত্তম আরামদায়ক জাহাজ টাইটানিক ছিল ৮৮২.৫ ফুট লম্বা, সবচে চওড়া স্থানে ৯২.৫ ফুট,ধারন ক্ষমতা ছিল ৪৬,৩২৮ টন এবং সম্পুর্ন বোঝাইকৃত অবস্থায় জাহাজের ওজন ৫২,০০০ টনের ও বেশী, জাহাজের সবচে নীচের থেকে মাস্তুলের আগা পর্যন্ত উচ্চতা ছিল ১০৪ ফুট। মোট ১১ টা ডেকের ৯ টি ছিল যাত্রীদের জন্য আর নীচের দুটো ব্যবহৃত হত, ডাক, মালামাল এবং ইঞ্জিন রুম হিসেবে। জাহাজে বেতার যোগাযোগ এবং টেলিগ্রাফের ব্যাবস্থা ছিল।
সে যুগের সর্বোচ্চ আরমাদায়ক ব্যাবস্থা ছিল জাহাজে। ১ম শ্রেনীতে ৪১৬, ২য় তে ১৬২ এবং ৩য় শ্রেনীতে ৪৬২- মোট ৮৪০টি কামরা ছিল যাত্রীদের জন্য।
ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দরে ছাড়ার আগ মুহুর্তে টাইটানিক।
টাইটানিকের প্রথম এবং একমাত্র সমুদ্র যাত্রা- ১৯১২ সালের ১০ ই এপ্রিল টাইটানিক জাহাজ রওয়ানা দিল ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বন্দর থেকে। সেটিই ছিল টাইটানিকের প্রথম এবং একমাত্র সমুদ্র যাত্রা।
১০ তারিখ দুপুরে যাত্রা করে প্রথম নোঙ্গর ফেলে ফ্রান্সের শেরবুর্গ বন্দরে। তারপর আইয়ারল্যান্ডের কুইন্সটাউন এবং কুইন্সটাউন ছাড়ে ১১ ই এপ্রিল দুপুর ১-৩০ মিনিটে। তখন ক্রু এবং যাত্রী মিলে জাহাজে ২,২০০ জন লোক।
১২, ১৩ তারিখ নিরাপদে কেটে গেলেও ১৪ তারিখে সমুদ্রে ভাসমান বরফ খন্ড সম্পর্কে সতর্ক বার্তা পেতে থাকেন ক্যাপ্টেন স্মিথ। রাত ৯-২০ ক্যাপ্টেন সবাইকে সতর্ক থাকতে বলে বিশ্রামে গেলেন।
রাত ১১-৪০ এ বরফের চাই যখন খুব কাছে ফার্স্ট অফিসার মারডক নির্দেশ দিলেন জাহাজ বায়ে ঘুরিয়ে পেছনের দিকে সরে যেতে। কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছে ততক্ষনে। মুহুর্তের মধ্যেই বরফের চাই আঘাত হানল। যাত্রীরা অধিকাংশ তখন ঘুমে যারা জেগে ছিলেন তারাও খুব বেশী টের না পেলেও ক্যাপ্টেন ঠিকই বুঝলেন । বরফের আঘাতের পর জাহাজের ১৬ প্রকোষ্ঠের মধ্যে ৬ টাতেই পানি ঢুকছে তখন।
ক্যাপ্টেন ১২-১০ মিনিটে লাইফবোট বার করতে এবং চারিদিকে বিপদ সঙ্কেত পাঠানোর নির্দেশ দিলেন বেতার কর্মীদের। ১২-৪৫ এ প্রথম লাইফ বোট পানিতে নামল। ২-০৫ এ যখন শেষ লাইফবোট জাহাজ ছাড়ল তখন বাকীদের আর কোন আশাই থাকল না। যাত্রীরা ভেসে থাকার মত হাতের কাছে যা কিছু পেল (যেমন ডেক চেয়ার) তাই আকড়ে ধরে বাচতে চাইল। ২-১৮ মিনিটে জাহাজ ভেঙ্গে দুটুকরো হয়ে , ২-২০ মিনিটে পুরো জাহাজ তলিয়ে গেল পানির নীচে।
উদ্ধার তৎপরতা- বিপদ সঙ্কেত পেয়ে প্রথম এগিয়ে আসে জাহাজ কার্পেথিয়া। ৩-৩০ মিনিটে লাইফবোটের যাত্রীদের নজরে আসে কার্পেথিয়া। ৪-১০ এ প্রথম লাইফবোটের যাত্রীরা কার্পেথিয়াতে ওঠেন। পরবর্তী ৪ ঘন্টা যাবত উদ্ধার তৎ পরতা চালিয়ে ৭০৬ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে কার্পেথিয়া। মারা যান ১৫১৭ জন।
উদ্ধারকারী জাহাজ কার্পেথিয়া ১৮ই এপ্রিল বেচে যাওয়া যাত্রীদের নিয়ে নিউ ইয়র্ক পৌছে।
টাইটানিকের যাত্রাপথ এবং দূর্ঘটনাস্থল।
টাইটানিক সম্পর্কে কিছু তথ্য-
১) টাইটানিক জাহাজে পর্যাপ্ত সংখ্যক লাইফবোট ছিল না। জাহাজে ৬৫ টি লাইফবোট নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ঐ দিন ছিল মাত্র ২০ টি । লাইফবোটের মোট ক্ষমতা ছিল ১১৭৮ জন।
কিভাবে লাইফবোট ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে মহড়া অনুষ্ঠানের কথা ছিল ১৪ই এপ্রিল সকালে। অজ্ঞাতকারনে ক্যাপ্টেন স্মিথ ঐ দিন মহড়া অনুষ্ঠান বাতিল করেন। মহড়া হলে আরো কিছু জীবন রক্ষা পেত এমন ধারনা করেন অনেকে।
২) অনেকগুলো লাইফবোট যাত্রী বহনক্ষমতা পুর্ন হওয়ার আগেই সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়। লাইফ বোট-১ এ ৪০ জন যাত্রী বহন করার ক্ষমতা থাকলেও ছিল মাত্র ১২ জন , প্রথম জলে নামানো লাইফবোট-৭ এ ৬৫ জন বহন ক্ষমতা থাকলেও ছিলেন মাত্র ২৮ জন।
৩) আশে পাশে বরফের চাইয়ের উপস্থিতি টের পাওয়া সত্বেও জাহাজের গতি কমানো হয় নি। জাহাজ ঘোরানোর চেস্টা শুরু করা হয় শেষ মুহুর্তে কিন্তু সঙ্ঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয় নি।
৪) অনান্য জিনিসের মধ্যে ৩০০০ ব্যাগ ডাক এবং একটা গাড়ী নিয়ে যাচ্ছিল টাইটানিক। ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় ডাক বয়ে নিয়ে যাওয়ার কারনেই এর নাম হয়েছিল RMS Titanic. জাহাজে্র পোস্ট অফিসে পাঁচজন কর্মচারী দিনে ১৩ ঘন্টা করে সপ্তাহের প্রতিদিনই কাজ করতেন। তারা প্রতিদিন ৬০,০০০ চিঠি বাছাই করতেন।
৫) প্রথম শ্রেনীর যাত্রীর স্যুটের টিকিটের ঐ সময় দাম ছিল ৪, ৩০০ ডলার এবং বার্থের টিকিটের দাম ছিল ১৫০ ডলার।
৬) ঐ জাহাজেই সর্বপ্রথম গরম পানির সুইমিং পুলের ব্যাবস্থা রাখা হয়।
৭) যাত্রার সময় জাহাজ এত নতুন ছিল যে অনেক যায়গায় রঙ তখনও শুকায় নি।
8) জাহাজডুবিতে মারা যাওয়া ১৫১৭ জনের মধ্যে মাত্র ৩০৬ জনের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
জাহাজের ক্রু এবং যাত্রী মিলিয়ে মোট ৭০৬ জন ( ৩১. ৬ % ) রক্ষা পান, বাকিদের সলিল সমাধি ঘটে।
যদি সমস্ত লাইফ বোট পুরোপুরি ব্যবহার করা হত তাহলে অর্ধেকের ও বেশী (৫৩. ৪%) যাত্রী রক্ষা পেত।
৯) প্রতিটা কক্ষে বিজলী বাতি এবং গরম রাখার ব্যাবস্থা ছিল, যা ঐ সময়ে বিলাস সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হত।
১০) বেচে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে সবচে বেশী ছিলেন প্রথম শ্রেনীর যাত্রীরা। প্রথম শ্রেনীর ৬১% যাত্রী, ২য় শ্রেনীর ৪২% এবং ৩য় শ্রেনীর ২৪% যাত্রী রক্ষা পান।
১১) নারী এবং শিশুদের সর্ব প্রথম লাইফবোটের অধিকার থাকলেও অনেক পূর্ন বয়স্ক লোক লাইফ বোটে উঠে পড়ে উদ্ধার পান এবং অনেক শিশু ও নারী মারা যান যারা ছিলেন ২য় এবং ৩য় শ্রেনীর যাত্রী।
মহিলা যাত্রীদের ৭৫% বেচে গেলেও পুরুষদের মাত্র ২০% রক্ষা পান। বেচে যাওয়াদের মধ্যে দুটো কুকুরও ছিল।
১২) এই সমুদ্র যাত্রার পরপরই ক্যাপটেন স্মিথের অবসর নেওয়ার কথা ছিল।
১৩) টাইটানিক জাহাজ নির্মানে খরচ পড়েছিল তখনকার দিনের ৭৫ লক্ষ ডলার, সময় লেগেছিল ৩ বছর।
১৪) যাত্রার সময় জাহাজে খাবার হিসেবে ছিল ৪০হাজার ডিম, ৭৫ হাজার পাউন্ড মাংশ এবং ১০০০ বোতল মদ।
১৫) মোট ৮৮৫ জন ক্রু ছিলেন জাহাজে। ক্রু বাদে যাত্রীবহন ক্ষমতা ছিল ৩৫৪৭ জন।
১৬) জাহাজের প্রতিদিন জ্বালানী লাগত ৮২৫ টন কয়লা ।
১৭) গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ২৩ নট বা প্রায় ৪৩ কিলোমিটার।
১৮) টাইটানিক জাহাজের নিজস্ব সংবাদপত্র প্রকাশে্র ব্যবস্থা ছিল।
প্রতিদিন প্রকাশিত হত The Atlantic Daily Bulletin পত্রিকা যা খবর, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি প্রকাশের পাশাপাশি ঐ দিনের যাত্রীদের খাবার তালিকা প্রকাশ করত।
১৯) বিজলী বাতি ছিল ১০,০০০ মত।
২০) প্রতিদিন ব্যবহার হত ১৪,০০০ গ্যালন পানীয় জল ।
২১) জাহাজ সম্পূর্ন ডুবে যেতে সময় লেগেছিল ২ ঘন্টা ৪০ মিনিট । ১৪ই এপ্রিল রাত ১১-৪০মি থেকে- ১৫ই এপ্রিল সকাল ২- ২০ মিনিট ।
২২) জাহাজ ডুবীর সময় সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা ছিল -২ ডিগ্রী, ফলে অধিকাংশ যাত্রী কম তাপমাত্রা বা Hypothermia র কারনে মারা যান।
২৩) বরফের চাই আঘাত হানার আগে মোট ৬ বার সতর্ক সঙ্কেত দেওয়া হয়।
২৪) ডুবে যাওয়া জাহাজ টাইটানিকের যাত্রীদের উদ্ধারে প্রথম পৌছে Carpathia জাহাজ । মজার ব্যাপার হল অপর জাহাজ Californian আরো কাছাকাছি থাকলে ও তা যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। কারন হলCalifornian জাহাজের বেতার কর্মী তখন ঘুমাচ্ছিলেন এবং জাহাজের ক্রুরা রাত ১২- ৪৫ মিনিটে আকাশে অদ্ভুত আলো ( টাইটানিক জাহাজের বিপদ সঙ্কেত) সম্পর্কে ক্যপ্টেনকে জানালেও ক্যাপ্টেন তা উপেক্ষা করেন ।
ক্যালিফোর্নিয়ান জাহাজ ঘটনাস্থলে আসে অনেক পরে।
২৫) ফ্রাঙ্কো-আমেরিকান অভিযানে ১৯৮৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর Robert Ballard ১২, ৬০০ ফুট গভীরে ডুবে যাওয়া জাহাজ টাইটানিককে সমুদ্র তলে খুজে পান।
সুত্র-
১)http://en.wikipedia.org/wiki/RMS_Titanic ২)http://history1900s.about.com/od/1910s/a/titanicfacts.htm
৩)http://www.titanicfacts.net/the-titanic.html
৪)http://www.britannica.com/titanic/timeline?tocId=9574268
৫)http://www.titanic-facts.com/titanic-facts.html ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।