রাগের মাথায় ভারী গ্লাসটা ছুঁড়ে মারতে গেলেন। অঞ্জনী ওঠা চোখ দুটো ক্রোধে টকটকে লাল।
পেছনে মা বসে ছিলেন , " কি করছ তুমি ? " কণ্ঠে সীমাহীন আতঙ্ক।
ছোঁ মেরে বাবার হাত থেকে কেড়ে নিলেন গ্লাসটা , " পাগল হয়ে গেলে নাকি!"
কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন।
থমথমে , গরম পরিবেশ ।
পর্দা ঢাকা ঘরে আলো ঢুকতে না পেরে বাতাসটাও গুমোট। বদ্ধ একটা ঘরোয়া গন্ধ চারিদিকে।
শুধু একজনই নির্বিকার । ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ।
টেবিলের ওপর ঝুঁকে গভীর মনোযোগে লেখার চেষ্টা করছি।
হটাৎ ফ্যার্ ফ্যার্ করে ছিঁড়ে ফেললাম কাগজটা । বাঁ হাতে মুচড়ে ফেলে দিলাম মেঝেতে । ওহ্ ! আমাকে দিয়ে আর হবে না । সেই সকালে লিখতে বসেছি । লেখাটা বাবার ম্যাগাজিনে যাবে ।
কিন্তু মাথায় কিছুই আসছে না । মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা - দুইটা - তিনটা - চারটা - পাঁচটা ! পাঁচটা কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছি ! এবার মায়ের কাছে গালি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে । প্রথমে বকা দেবেন ঘর নোংরা করের জন্য । এরপর দেবেন খাতার কাগজ ছেঁড়ার কারণে । কাগজ ছিঁড়লে নাকি দেনা হয় ! এ নিয়ে মা একখান বিশাল বক্তব্য দেবেন।
একটু আগে বুয়া সারা বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে গেছে । ঘর মুছতে এসে সেও চোখ রসগোল্লা করে ফেলবে । কানের কাছে কিছুক্ষণ ঘ্যানর ঘ্যানর করবে । রুম সম্পূর্ণ মোছা পর্যন্ত তা একটানা চলতে থাকবে । এরপর পাশের ঘর থেকে মা ছুটে এসে আবার যোগ দেবেন তাতে ।
দুজন মিলে বেশ জোরে চেঁচামেচি করবে আরও কিছুক্ষণ। আর সবশেষে তা গিয়ে পৌঁছাবে ' বিয়ের প্রসঙ্গে '। এমন নোংরা , পিচেট মেয়েকে বিয়ের পর স্বামির কাছে লাত্থি খেতে হবে ! শাশুড়ির কাছে কথা শুনতে হবে। মেয়েদের শুধু জ্ঞান থাকলেই হয় না, কাজ করতে শিখতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি । সমস্ত ঘটনাটা একবার ভাবলাম ।
শেষবারের মত আবার তাকালাম কাগজগুলোর দিকে । এরপর লেখায় মন দিলাম। কিন্তু দুই কি তিন লাইন লিখতে না লিখতেই এবারের পেইজটাও ছিঁড়ে ফেললাম । ধ্যাৎ !
বাবা অনেক ভাল ছোটো গল্প লেখেন । একসময় রহস্য পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন ।
খুব নাম কামিয়েছিলেন সে সময় । সপ্তাহ শেষে পাঠকদের চিঠিতে ঘর ভরে যেত । বেশিরভাগ চিঠির উত্তর মা-ই দিতেন । ভক্তদের তিনি নিরাশ করতে মোটেও চাইতেন না । এটা অবশ্য বাবার অহংকার না ।
ব্যাবসার কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি সময় দিতে পারতেন না । অন্যান্য বড় বড় লেখকদের মত আমিও বিশ্বাস করি , বাবার লেখা অসাধারণ । সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতে পারেন । যতবারই বাবার লেখা পড়েছি , চোখের জল আটকাতে পারিনি । কিভাবে এত সহজভাবে লিখেও তিনি সবশ্রেনীর মানুষকে চমকে দিতে পারেন ? কিন্তু তার স্বভাব বড়ই অদ্ভুত ! হঠাৎ লেখা বন্ধ করে দিলেন ।
আর এভাবেই ধ্বংস হল তার অসাধারণ প্রতিভা . জীবিকার টানে মিশে গেলেন সাধারণদের ভিড়ে !
বাবার মত লেখক হওয়ার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের । কিন্তু সত্যি বলতে , তাকে আমি খুবই ভয় পাই । অতি সূক্ষ্মভাবে যেমন তিনি লিখতে পারেন , তেমনি অতি সূক্ষ্মভাবে মনও ভেঙ্গে দিতে পারেন ।
একবার ছোটবেলায় ছড়া লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবার কাছে । মহা উৎসাহে পড়ে শুনিয়েছিলাম সেটা ।
বাবা গম্ভীর মুখে শুনলেন । আমার কাযিন তপনও তখন একটু-আধটু ছড়া - টরা লিখত । হটাৎ ছন্দ মিলিয়ে ফেলার মত অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার । তপনের ছড়াগুলো হত রবীন্দ্র - সুকুমার ঢঙ্গে লেখা । তবে এ কথা সত্য , এসবের মাঝেও তার নিজস্বতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত ।
নিঃসন্দেহে সেগুলো ছিল চমৎকার !
আর আমার লেখাগুলো হত কামিনী রায়ের মত । নীতিকথায় পূর্ণ ! সেদিন আমার আবৃত্তির পর কোথা থেকে যেন তপনও এসে জুটল । সেও নাকি নতুন একটা ছড়া লিখেছে । সুকুমার রায়ের মত টুং টাং - ঠুং ঠ্যাং ছন্দে আহ্লাদি গলায় শোনাল ছড়াটা । বরাবরের মত সেবারও তার ক্ষমতা দেখে চমকে গিয়েছিলাম আমি ।
বাবা হঠাৎ আবেগে দাঁড়িয়ে পড়লেন । উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন তপনকে, " এই হল জাত কবি!!! এই হল জাত কবি!!! "
আমার লেখা নিয়ে কোন কথাই আর বললেন না তিনি । তার প্রয়োজনও ছিল না । যা বোঝার আমিই বুঝে নিয়েছিলাম ।
এরকম বহুবার ঘটেছে ।
ভাঙ্গা মন নিয়ে তবুও আমি লিখেছি । রবার্ট ব্রুস যদি সাত বারের বার স্কটল্যান্ড জয় করতে পারেন , আমি কেন পারব না ? কিন্তু এই ষোল বছরের জীবনে আমি ষোল হাজারেরও বেশি বার চেষ্টা করেছি । অ্যাপ্রিসিয়েশন আসেনি !
একদিন সন্ধ্যেবেলা । বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম । মোমের ক্ষীণ আলোয় ঘর সামান্যই আলকিত ।
গল্প লেখার একটা নতুন প্লট মাথায় ঘুরছিল । সেটা হল এক প্যারানরমাল কাহিনি । চাচ্ছিলাম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনাটার ব্যাখ্যা দিতে । তাতে গল্প আরও চমকপ্রদ হবে । কিন্তু কোনভাবেই প্রমাণ করতে পারছিলাম না ।
প্রবল উৎসাহে বাবাকে শুনিয়েছিলাম থিমটা ।
হঠাৎ তার গম্ভীর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল,
" তুমি এর এক্সপ্লেনেশন দিতে পারবে ? "
ভ্রূ উঁচিয়ে অদ্ভুত সুরে বলেছিলেন । অনেক সময় সাধারণ কথাও এক্সপ্রেশনের কারণে অন্যরকম শোনায় । সেটা বাবার ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘটে ।
আমতা আমতা করে ' না '- সূচক মাথা নেড়েছিলাম ।
" আমি পারি ! "
দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন । তাতে বাবাসুলভ কোনো সুরই ছিল না । ছিল অন্য এক সুর । কেমন করে যে বাবার চিন্তার সাথে আমার চিন্তাটা মিলে গিয়েছিল ! তিনিও কয়েক দিন ধরে একই প্লট নিয়ে গল্প লিখবেন বলে ভাবছিলেন । হয়ত তার প্রতি সীমাহীন আকর্ষণের কারণেই আমাদের মধ্যে টেলিপ্যাথির মত ঘটনা ঘটেছিল ।
তবে এ কথা সত্য যে , বাবাই এই থিম নিয়ে ভালো লিখতে পারতেন । তিনি যে মহান লেখক । সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করার সূক্ষ্ম ক্ষমতা ছিল তার । আমি তো তখনো কামিনী রায়ের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি !!!
কিছু কিছু ব্যাপার থাকে গড গিফটেড । বাবার মধ্যে তা ছিল ।
আমার মধ্যে একেবারেই নেই । পাথরে পাথর ঘষে যেমন হঠাৎ আগুনের দেখা মেলে , সাধনার মাধ্যমে আমার ভেতরেও হয়ত কখনো তা পাওয়া যেত । কিন্তু তখন তো আর সাধনার বয়স ছিল না । কেবল কৈশোরে পা দেয়া ছেলেপেলের কি আর একটা বিষয় নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালো লাগে !
মাথা খারাপ হয়ে গেল ! আর তো পারা যায় না ! টেবিল ছেড়ে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম । মনটাকে অন্যদিকে ফেরানো দরকার ।
মস্তিষ্কেরও বিনোদনের প্রয়োজন আছে ।
ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল কণা । মাথায় নতুন বুদ্ধি এল। ছোটো ভাইবোনদের জ্বালাতন করায় মজা আছে !
- কি করছিস ? উঁকি দিলাম সেদিকে ।
এক সারি পিঁপড়ে চলে গেছে বারান্দার দেয়াল দিয়ে ।
ম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের নিচে তাদের সে দেখছে । সূর্যের আলো দিয়ে পুড়িয়ে দিল একটাকে ।
" দেখছ ? আগুন ধরে যায় ! " তুমুল উৎসাহ নিয়ে বলল ।
মানুষের স্বভাব এই । ক্ষমতা বড়দের হাতে থাকলে ক্ষুদ্রদের পুড়িয়ে মারতেও দ্বিধা বোধ করে না ।
ক্ষমতা যখন আছে , তখন তার ব্যাবহার করা চাই । এ হল বিজ্ঞানের স্বার্থে গবেষণা ! উন্নত চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ !
লেখায় মন দিলাম । চমৎকার একটা লাইন মাথায় খেলে গেছে ।
বাবা সবসময়ই রাগি স্বভাবের ছিলেন । কয়েকদিন আগেও আমার এক কাযিনের উগ্র পোশাক - আশাক দেখে তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল ।
অবশ্য তিনি তা লক্ষ্যই করতেন না । কিন্তু আশেপাশের ক্ষুদ্রপ্রাণগুলোর ঘন ঘন কান ভাঙানিতে হঠাৎ রেগে গেলেন । ঝড়ের আগের পূর্বাভাসের মত তিনিও সেদিন আমার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ।
ফেরার পথে সিএনজি - তে ড্রাইভারের সামনেই অশ্লিল গালি দিতে এতটুকু বাঁধেনি তার । হারামজাদা থেকে শুরু করে বেশ্যা পর্যন্ত এমন কিছু নেই যা তিনি বলেননি ।
এর কারণ আর কিছু নয় । যদি আমিও ওই কাযিনটার দেখাদেখি উগ্র পোশাক - আশাক পরি ! এই " যদি " - এর ওপর নির্ভর করে বহুবার আমি জুতোর বাড়ি খেয়েছি ! চামড়ার বেল্ট দিয়ে মেরে ব্যাথা করে দিয়েছে শরীর ।
ছোটবেলায় ছোটখাটো অপরাধের শাস্তি হিসেবে আমাকে প্রায়ই বাথরুমে আটকে রাখা হত । ঘুটঘুটে অন্ধকার আর সরু বাথরুমটার স্বল্প জায়গা অনেক সময়ই আমাকে অস্থির করে তুলতো । সাবানের পচে কালো হয়ে যাওয়া স্তূপ আর দরজার খসে পড়া কাঠের গুঁড়োর মধ্যেই এক কিনারে গিয়ে আমি বসে থাকতাম ।
তখন বয়স ছিল চার কিমবা সাড়ে চার । বাবার জেদ ছিল সীমা ছাড়ানো । রেগে গেলে ম্যাটাডোরের চোখ - নাক দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ষাঁড় আর তার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতো না । একবার পাঁচ কি ছয় বছর বয়সে কি যেন এক কারণে হঠাৎ বেজায় ক্ষেপে গেলেন । আমার একটা প্রিয় বই ছিল ।
তার - ই দেয়া । বিশাল বড় বইটার বড় বড় পাতা জুড়ে ছিল অসম্ভব সুন্দর করে আঁকা ডাইনোসর । তাতে ডাইনোসরের ইতিহাস এবং পরিচয় দেয়া ছিল । বইয়ের পাতা খুলতেই আমি হারিয়ে যেতাম জুরাসিক পার্কে । খেলার সাথীহীন জীবনে ওটাই ছিল আমার একমাত্র সাথি ।
ঘুম থেকে উঠেই পৃষ্ঠা উল্টে দেখতাম সেগুলো । রাগের বশে একদিন বাবা গর্জন করতে করতে ছুটে এলেন । থাবা দিয়ে কেড়ে নিলেন বইটা । একের পর এক ছিঁড়তে থাকলেন পৃষ্ঠাগুলো । ওটার পেইজগুলো ছিল শক্ত ধরণের এবং চকচকে ।
তাই ছিঁড়তে বেশ ঝামেলাই হচ্ছিল ।
এরপর তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন । ঘরের মেঝেতে দাউ দাউ করে পুড়ে বইটা কয়লা হয়ে গেল । পুড়ে গেল সুন্দর ইলাস্ট্রেটেড ডাইনোসর । আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ।
বাবার মুখ ছিল অদ্ভুত রকমের কঠোর । চোখ দুটো ছিল চকচকে , কৌতুকময় , স্যাডিসটিক প্লেসারে পূর্ণ । আমার প্রিয় ডাইনোসরগুলো সেদিন আগুনে পুড়ে মরেছিল । আর আমার মনে তা বিশাল দাগ কেটেছিল । রাগের কারণ তাই মনে নেই , কিন্তু শাস্তিটা ঠিক মনে আছে ।
তবে এটুকু বলতে পারি যে , আমি ছিলাম শান্ত এবং খুবই বোকা । রান্নাঘরের তাকের ভেতর ঘর বানিয়ে খেলার সময় তার ভেতরে ঢুকতে গিয়ে যেমন মাথায় বাড়ি খেতাম , তেমনি তাক থেকে বের হওয়ার সময় ভুলে তার ভেতরেই আবার দাঁড়িয়ে যেতাম । আর অমনি মাথায় আরেকটা আলু হত ! কথা বার্তা অত বেশি বলতাম না কারো সাথে । অতএব , ধরে নিতে পারি , আমার অপরাধ অতটা গুরুতর ছিল না ।
রাত জেগে অবশেষে লেখাটা শেষ হল ।
ঘড়িতে চারটা পঁচিশ বাজে । যদিও লেখাটা নিয়ে এখনো সন্তুষ্ট হতে পারিনি । আরও ভালো হতে পারত ।
ক্লান্তিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম । টেরও পেলাম না ।
চাচুকে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে পড়ে শুনিয়েছি লেখাটা । নারীবিদ্বেষী হলেও লেখাটার অনেক প্রশংসা করেছেন তিনি । তার মতে , মেয়েদের অত বুদ্ধি - সুদ্ধি নেই । অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে তারা নাকি মস্তিষ্কের বেশিরভাগ অংশকেই কাজে লাগাতে পারে না । এক্ষেত্রে ছেলেরা সবসময়ই মেয়েদের থেকে বুদ্ধিমান !!! চাচুর কথায় মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড রেগে যেতাম আমি ।
তাই আমাকে " ফেমিনিস্ট " উপাধি দেয়া হয়েছে । যদিও আমি তা নই !
" তোমার আব্বুকে শুনিয়েছ ? "
চাচু জিজ্ঞেস করতেই কাচুমাচু হয়ে বললাম , " ভয় লাগে । বেশি একটা ভালো হয়নি যে ! "
চাচু অভয় দিয়ে বললেন যে আব্বুরও ভালো লাগবে । লেখাটা যথেষ্ট ম্যাচিউরড ! এরপরও সাহস পেলাম না । যদিও চাচুর দেয়া উৎসাহে মনটা ফুরফুরে লাগছে ।
রাত জেগে কয়েকদিনের পরিশ্রম কি তবে সার্থক হল ? কিন্তু যে লেখা আমার নিজেকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না , সে লেখা কিভাবে বাবাকে সন্তুষ্ট করবে !
জেনেভাকে ফোন দিয়ে পড়ে শোনালাম । আমার ফ্রেন্ড । প্রচুর বই পড়ে এবং একজন ক্ষুদে সাহিত্য সমালোচকও বটে ! তবে সবচেয়ে বড় কথা হল , সে তোষামোদ করে না । গল্পটা শুনে জেনেভাও হতাশজনক কিছু বলল না । এবার কিছুটা আত্মবিশ্বাস পেলাম ।
যদি দুজন বই পড়ুয়ার কাছে ভালো লাগে , তবে নিশ্চয়ই বাবারও ভালো লাগবে ।
সেদিন বিকেলে বাবার সাথে সেমিনারে যাচ্ছিলাম । ব্যাস্ততার কারণে সময় না পেয়ে তিনি রিকশাতেই শুনতে চাইলেন । ভয়ে ভয়ে পড়ে গেলাম গল্পটা । বাবা কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন ।
চশমার নিচে আমার চোখ দুটো তখন অস্থির । বাবার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য ব্যাকুল ।
তিনি কিছু দিক শুধরে দিলেন ,
"... আরও রহস্যজনক হতে হবে ...অমুক জায়গায় পরিবেশের বর্ণনা দিবে ... তাদের এক্সপ্রেশন হবে রহস্যজনক !!! তারা মুখ চাওয়া - চাওয়ি করবে ... শিহ্রে উঠবে ! এই ব্যাপারগুলো তো লিখতে হবে ! "
বাবা অনেক সময় ধরে বাক্যগুলো বললেন ; যেগুলো একসাথে বললে অসংলগ্ন শোনায় । সেজন্যই হয়ত ধীরে ধীরে বললেন ।
" ভালই হয়েছে ! " এবারও বিশাল বিরতির পর বললেন ।
বাবার এক্সপ্রেশনে মন ভেঙে গেল । বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম । সত্যি আমাকে দিয়ে আর হবে না । কলের পাড়ে কলসির ঘষায় একসময় পাথরও ক্ষয়ে যায় ; কিন্তু আমার প্রতিভার পাথরের কিছু হল না । ফেরার পথে কান্না আর থামাতে পারলাম না ।
চশমা থাকার একটা বড় সুবিধে হল অন্ধকারে বোঝা যায় না কেউ কাঁদছে কি না ! তবে বাবা আমার মুখের দিকেও তাকাচ্ছেন না । নিঃশব্দে কেঁদে গেলাম । মাঝে মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে পানি মুছতে থাকলাম । রাতের স্বপ্নটার কথা মনে হল । দৌড়াচ্ছি ।
ঘন অন্ধকারের মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছি । দুটো স্টেশন পার হতে হবে । একটি পেরিয়ে এসেছি । তাতে চোখ ধাঁধাঁনো আলো । এবার আঁধার পেরিয়ে শেষ আলোর স্টেশনে পৌঁছাতে হবে ।
ঠাণ্ডা মাটির পথের উপর দিয়ে খালি পায়ে দৌড়াচ্ছি । কিন্তু শেষের স্টেশনটায় আর পৌঁছাতে পারলাম না । তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল । যেভাবে অনেক কষ্টে অর্জিত আত্মবিশ্বাসও একটি মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে গেছে ।
হতাশ হয়ে পড়েছি ।
সবই অর্থহীন মনে হচ্ছে । মা বাবাকে সেকথা বললেন । আমি যদিও তাকে বলতে বলিনি । ভেবেছিলেন , এতে ফল ভালো হবে । বাবা আমাকে কাছে ডেকে বসাবেন ।
উৎসাহ দেবেন । কিন্তু ফল হল উল্টো ! আমি আগেই বুঝেছিলাম । তিনি আনপ্রেডিকটেব্ল ! সাধারণদের মত তাকে সহজে বোঝা যায় না ।
হঠাৎ- ই তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন ,
" কিহ্ ! তোমার মধ্যে এ-তো কমপ্লেক্স ? তুমি কি বলতে চাও , সরাসরি বল ! "
" আমি তো কিছুই বলতে চাই না । আমার বলার কিছু নেই ! "
বাবা ফোঁস ফোঁস করতে করতে হঠাৎ নড়েচড়ে উঠলেন ।
আমি তখনো বুঝিনি এটা ঝড়ের আগে পূর্বাভাস ! এই হল আমার অবসারভেশনের দশা ! সাধেই কি আর বাবার মত লেখক হতে পারছি না !
উড়ে এসে আমার জামার গলা চেপে ধরলেন । ঘটনার আকস্মিকতায় ধাতস্থ হতে না হতেই এতদিন পর আমার ভেতরের ম্যাগমাও যেন বেরিয়ে আসতে চাইল । পালাবার চেষ্টা করলাম না । গোঁয়ারের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম ।
" ও ! তোর এ - তো জেদ ? "
প্রথমেই পুরুষরা যা করে , তিনিও তাই করলেন ।
আমার বড় বড় চুল ধরে টেনে একপাশে সরিয়ে নিলেন । মা ঠেকাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন । পর পর কয়েকটা এলোমেলো চড় ও লাত্থির পর হঠাৎ আমিও ক্ষেপে গেলাম ,
" তুই আমাকে মারছিস ? আমাকে মারছিস ? "
অশ্লীল গালিগালাজে দুজনেরই কণ্ঠস্বর ভেঙে গেল । বাবা আমাকে মেরেই চলেছেন । মা বেচারি মাঝে পড়ে গেছেন ।
তাকে দুএকটা চড় খেতে হল । এরপর আমি যা করলাম তার জন্য কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না । আমার অতিশয় শ্রদ্ধেয় বাবা , যাকে আমি কখনোই অশ্লীল গালিগালাজ আর আমার প্রতি অবিচারের জন্য ভালবাসতে পারিনি , কিন্তু সবসময়ই শ্রদ্ধা করে এসেছি - যার মতো হওয়ার জন্য রাতের পর রাত প্রার্থনা করেছি ; হঠাৎ তাকে সজোরে লাত্থি দিয়ে সরিয়ে দিলাম । আত্মরক্ষাই হোক আর রাগই হোক - আমি জানি এ আমার ঠিক হয়নি ।
অশ্লীল গালিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ঊঠলো ।
" হারামজাদা ! বেরিয়ে যা তুই ! এক্ষূনি বের হয়ে যা ! " চিৎকার করতে থাকলেন ।
" প্লিজ ! আশেপাশের মানুষ শুনবে! " মা আমাকে তাদের রুমে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিলেন । বদ্ধ ঘরে পায়চারি করতে থাকলাম । সঁপাৎ করে ড্রয়ার খুলে জামা - কাপড় বের করে নিলাম । এখানে এক মুহূর্ত থাকা অসম্ভব ।
বাবা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন । সাথে সাথে মা-ও । নাটকীয়ভাবে মানসিক রোগীর মতো বলতে থাকলেন ,
" তোর চোখ নষ্ট হইছে না ? এরপর তোর কী হবে জানিস ? তুই লোকদের হাতে হাতে ফিরবি ! ওরে বের করে দাও ! "
আম্মূ আমাকে আটকাবার চেষ্টা করছেন ।
আমার হাতে তখন গোল করে রাখা কাপড় ।
" ও কোথায় যাবে জানো ?
ও যাবে নারায়োণগঞ্জের " নিষিদ্ধ পল্লীতে " !!! "
এবার আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না ।
ফিসফিস করে মাকে বললাম ,
" আমাকে যেতে দাও ! প্লিইজ ! "
" তুই কোথায় যাবি ? " বলতে গিয়ে মায়ের গলা বুজে এলো ।
বেশ কিছুক্ষণ পর বললাম , " আমি সেখানেই যাবো ! "
সাথে সাথে বাবা তার লোহার মতো হাতটা বাড়িয়ে আমার চূল ধরে ফেললেন । টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বিছানায় । এবার আর আত্মরক্ষার চেষ্টা করলাম না । করলে হয়ত আমি জিততে পারতাম ! কারণ শক্তির ব্যাপারটা সম্পূর্ণই নির্ভর করে মনের জোরের ওপর ।
তাছাড়া আমি কার সাথে যুদ্ধ করবো ? নিজের বাবার সাথে ? কোনো প্রকার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম না । বিছানায় পড়ে থাকলাম । হাত দিয়ে আটকাবারও ইচ্ছে হল না । বাবা দু হাত দিয়ে আমার গলার টনসিলগুলো চেপে ধরলেন । নখের আঁচড় বসে গেল সেখানে ।
তাতেও জেদ কমলো না । চোখের ওপর আঙুল দিয়ে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকলেন ।
মানুষ বড়ই প্রভাবিত হয় । কয়েকদিন আগের পেপারে ওঠা ঘটনাটা নিঃসন্দেহে এর মূলে । অন্যের অন্যায় দেখলে তারা আশ্চর্য হয় ।
শিহ্রে ওঠে । কিন্তু রাগের সময় নিজের জীবনেই আবার সেটা প্রয়োগ করে ।
আম্মূ নিরীহ মানুষ । কাঁদা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই ।
বাবা চোখে চাপ দিয়ে ধরে আছেন ।
আমার লতার মতো শরীরটা নেতিয়ে পড়ে আছে বিছানায় । মাথার ওপরে ফ্যান । গটর্ গটর্ শব্দ করে ঘুরছে ।
সন্ধ্যা ছয়টা বাজে । বাবা বেরিয়ে গেছেন ।
আমি বর্তমানে নিজের রুমে । বিছানায় পড়ে আছি । বাম চোখে চিনচিনে ব্যথা । বন্ধ জানালার চকচকে গ্লাসে রুমটার ছায়া পড়েছে । মা এলেন ।
কি কি যেন বললেন । কিছু কানে গেল , কিছু গেল না ,
" আমি কি জীবনে কম কষ্ট পেয়েছি ? কিন্তু তবুও বলব - আমি সুখী ! কারণ আমি তো বেঁচে আছি ! "
সবাই বাঁচতে চায় । জানালার ধারে সারি সারি পিঁপড়েরাও কাজে মহা ব্যস্ত । প্রাণহীন ফ্যানটাও কর্মচাঞ্চল্যময় ! ইলেকট্রন ঘুরছে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে । কিন্তু কিসের জন্য সবাই বাঁচতে চায় ? বেঁচে লাভ কি ? না বাঁচলেই বা ক্ষতি কি ?
কণা আর মঞ্জুরা পেপসি কিনতে গেছে ।
মঞ্জুরা এ বাড়িতে কাজ করে । ঘরের পরিবেশ আবার ঠাণ্ডা হয়েছে । মা আগের মতই কাজ করতে শুরু করেছেন । মুখে পান গুঁজেছেন । আমি শুধু কর্মহীন ।
আমার কাছে সবই অর্থহীন ।
বিকট চিৎকার শুনে সবাই বারান্দায় ছূটে গেল । মা তাড়াতাড়ি নীচে নেমে গেলেন । কণা অনবরত চেঁচিয়ে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে চিৎকারটা থেমে থেমে যাচ্ছে ।
হাঁপিয়ে ঊঠছে যেন । ওকে দেখে আমার প্রথমেই মনে হল, কোনো বিশাল আকারের কুৎসিত পোকা ওর কান দিয়ে ঢুকে গেছে । এখন তা ব্রেইন খাচ্ছে । করোটির মাঝে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে । ছোটোকালে ঘুমের মধ্যে প্রায়ই আমার কানে পিঁপড়া ঢুকে যেত ।
তখন আমিও চিৎকার দিতাম । কণার চিৎকার শুনে এবার মনে হল, হয়ত সে বড় ধরণের ইলেকট্রিক শক খেয়েছে । শুকনো কাঠের প্রয়োজন ! মাঝে মাঝে সে মাথা চেপে ধরছে । চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ ! আশেপাশের সবাই ছূটে এসেছে । কণাকে উপরে আনা হল ।
বিছানায় বসে অনবরত কাঁপছে । ভয়ে একেবারে ঘেমে গেছে । এবার সে কাঁদছে আর চিৎকার করছে ।
মঞ্জুরা আর কণা পেপসি কিনে ফিরছিল । খাটো মতো একটা লোক অনেকক্ষণ ধরেই তাদেরকে ফলো করছিলো ।
বাড়ি পর্যন্ত এসে হঠাৎ সে গাছের ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল । এই জায়গাটা খুবই নির্জন । আর অন্ধকার। বাড়ির সামনেই শুধু একটা টিমটিমে হলদে আলো । তা চাবি খুঁজে বের করে কলাপসিবল গেইট খোলার পক্ষে যথেষ্ট ।
কিন্তু এতে অন্ধকার মোটেও দূর হয় না । মঞ্জুরার সাড়াশব্দ না পেয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল কণা ।
লোকটা গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে । প্যান্টের চেইন খোলা । অদ্ভুত বিকৃত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।
আর কিছু সে দেখতে চায় না ! দ্রুত কলাপসিবল গেইট খোলার চেষ্টা করলো । ধীরে ধীরে ওটা এগিয়ে আসছিল । টিমটিমে আলোতে কণার ছায়া পড়েছে মাটিতে । দ্বিতীয় ছায়াটা হাত বাড়িয়ে চেপে ধরতে গেল তাকে । ভয়ে চিৎকার দিলে লোকজন বেরিয়ে এলো ।
কিন্তু ততক্ষণে পালিয়ে গেছে লোকটা ।
একটা ঘটনার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আরেক ঘটনা হাজির ! মায়ের মতে কণার ঘটনাটা বুঝিয়ে দিল মেয়েদের পক্ষে বাইরের জগত মোটেও নিরাপদ না । পালিয়ে গেলে ক্ষুধার্ত নেকড়েদের খাদ্য হতে হত ! কিন্তু এসবের মাঝেও নিজের ঘটনাটা ভুলতে পারলাম না । গলা আর পেটের চিনচিনে ব্যথাটা এখনো যায়নি । এত সহজে যাবেও না ।
পৃথিবীর ঘটনাবহুল জীবনের সাথে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়লাম হঠাৎ । কখন যে মন থেকে ডিটারজেণ্ট গুলিয়ে খেয়ে আত্মহত্যার কথা ঊবে গেল । টেরও পেলাম না ।
" এখনও কি তুই তাকে আগের মতই শ্রদ্ধা করিস ? এখনও তার মত হতে চাস ? তোর চোখের কর্নিয়া যদি নষ্ট হয়ে যেত ? "
নিজেরই অবচেতন মন প্রশ্ন করল ।
অস্ফুট স্বরে বললাম , " আমি পারি না ! আমি শ্রদ্ধা না করে থাকতে পারি না ! "
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।