আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাংস্কৃতিক টানাপোড়েন

আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে....... কেন আমরা একটা সংস্কৃতিকে আরেকটা সংস্কৃতি থেকে উন্নত বলে থাকি । আসলেই কি কোনো সংস্কৃতি উন্নত বা অনুন্নত হতে পারে?নাকি একেক সংস্কৃতি একেক ভাবে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র? যদিও ফ্রান্স বোয়াস এর মতো অনেক নৃবিজ্ঞানীই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করেছেন এবং স্বীকার করে নিয়েছেন যে, প্রত্যেকটি সংস্কৃতিই স্বতন্ত্র । কোনোটিই কোনোটির কাছ থেকে ছোট বা বড় নয় । তবে, আমার আজকের আলোচনার বিষয় সেদিকে যাচ্ছেনা বরং আমি বলতে চাইছি একটু অন্যভাবে । যদিও তত্ত্বগতভাবে আমরা উপরোক্ত বক্তব্যটি মেনে নিই, বাস্তবে কিন্তু আমরা চর্চা করি ঠিক উল্টোটি ।

অর্থাৎ নৃবিজ্ঞানীরা যেটিকে বলছেন এথনোসেন্ট্রিজম বা স্বজাত্যবোধ - আমরা এখনও সেই স্বজাত্যবোধের অহংকারের বৃত্তে আটকে আছি । এটা যেন অনেকটা বর্ণবাদেও মতোই । যেমন ধরুন, যে মানুষটি ভারত কিংবা বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বড় হয়েছে বা বাস করে, তার তুলনায় যে মানুষটি ঐসব দেশের শহরে বড় হয় বা বাস করে সে অনেক বেশী জানে বোঝে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে । সে যেকোনো পরিবেশে বা প্রতিকূল অবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো সমর্থ করে তুলতে পারে । সে ভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের সাথেও একটি সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে ।

এমনকি হয়তো একটি বিদেশী ভাষা ও আয়ত্ত করতে পারে-যদিও তা তার শিক্ষার সুযোগের উপর অনেকটা নির্ভর করে । তবে সে শিক্ষার সুযোগও অনেক বেশী পায় । অন্যদিকে, প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করা বা বড় হওয়া একজন মানুষ এতগুলি দক্ষতায় দক্ষ হতে পারে না, যে কারনে তাদের পিছিয়ে পড়া হয়ে উঠে অবশ্যম্ভাবী । সবক্ষেত্রেই তারা প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয় । আপনি নিজের কথাই চিন্তা করেন ।

আপনি কি চাইবেন এই শহর সভ্যতা ছেড়ে কোনো গ্রামে গিয়ে বাস করতে বা আপনার মেয়েটিকে একটি গ্রামের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে? এই ছোট্ট বিষয়টিই কিন্তু চিন্তার জায়গা । আসলে আমরা সবাই স্বজাত্যবোধের ঘেরাটোপে আছি । এবং এটা বেশীরভাগ লোকই চর্চা করে । প্রশ্ন হলো এটা কি খুব দোষের কিছু? সবাই চায় – নিজের উন্নয়ন, নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, নিজের পরিবর্তন । সাথে সাথে চিন্তার স্বাধীনতা, উদারনৈতিক পরিবেশ, উন্নত কর্মক্ষেত্র, আর্থিক স্বাধীনতা-এই সবকিছু সবাই চায় ।

আর এই কারনেই, আমরা দেখি -গ্লোবালাইজেশন বা তথ্য প্রযুক্তির, যেটার বদৌলতেই হোক আজ সবাই ভাগ্যান্বেষী এবং উন্নত জীবনের খোঁজে সদানিয়ত পরিভ্রমনশীল । গ্রাম থেকে শহরে,এক জেলা থেকে অন্য জেলায় এমনকি এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তর (মাইগ্রেশন) আজ একটি সাধারন ঘটনা । যতই আমরা কাগজে কলমে চেঁচামেচি করি এবং বলি যে ঢাকা শহর জনসংখ্যার ভারে বিপর্যস্ত -আমরা নিজেরা কি তা মানি । না কি মানতে হবে?! আমার প্রয়োজনে আমাকে যেতেই হবে । যেকোনো মানুষেরই যেকোনো জায়গায় যাওয়ার পূর্ন স্বাধীনতা আছে ।

কারন, দেশের বড় বড় শহরগুলোতে যে সুযোগ-সুবিধাগুলো বর্তমান আমরা সেগুলি দেশের সব জায়গায় সমভাবে বন্টন করতে পারি নাই । বিকেন্দ্রীকরন-তা সবকিছুরই এখন জরুরী হয়ে পড়েছে । আমরা এই ব্যাপারটিকে এখনও যথাযথভাবে গুরুত্ত্ব দিতে পারছি না । বাংলাদেশের তাবত মানুষ আজ ঢাকামুখী । পৃথিবীর তাবত মানুষ আজ হয় লন্ডনমুখী, নয়তো ক্যালিফোর্নিয়া নয়তো সিডনী ।

কিছুদিন আগে পত্রিকার পাতায় দেখলাম খোদ অষ্ট্রেলিয়ার একটি অঞ্চলে এক ডলারে বাড়ী ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে । কারন, এখানেও ঠিক সেই একই অবস্থা । কাজ কর্ম নেই, ব্যবসা-বানিজ্য নেই! লোকে আর কি করবে - বাক্স-প্যাটরা বগলদাবা করে ভাগ্যান্বেষনে পাড়ি জমিয়েছে কোনো বড় শহরে । সেই অঞ্চলটি এখন জনমানবহীন হয়ে পড়েছে । সুতরাং, মানুষের উন্নত জীবনের আকাঙ্খা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ।

আর একজন মানুষ যখন সেই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখন তার মধ্যে একধরনের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের বিকাশ ঘটে যেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রজন্মান্তরে ঘটে স্বজাত্যবোধের বিকাশ । এটি খারাপ নয়,তবে এর বাড়াবাড়ি ও বাঞ্চনিয় নয় । একটি সংস্কৃতির মানুষের অন্য সংস্কৃতিতে আত্মীকরনের প্রবৃত্তি ও কম নয় । সংস্কৃতির উপাদানগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই, খাদ্যাভ্যাস,পোষাক-পরিচ্ছদ, মূল্যবোধ, জীবনাচরন, প্রথা, রীতি-নীতি বা আচার এক সংস্কৃতির এই উপাদানগুলোতে অন্য সংস্কৃতির মানুষের আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় । ক্ষেত্রবিশেষে তারা এইসব উপাদানগুলো ধারন করতে চায় বা চর্চা করে ।

এটা দোষের কিছু নয় । বরং ঐগুলিকে মর্যাদা দিয়ে তার এই চাওয়া প্রথমোক্ত সংস্কৃতির লোকজনকে গর্বিত করে তোলে । তবে এটাও প্রশ্নসাপেক্ষ যে ঠিক কি পরিমানে সে পূর্বের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে, নতুন সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হবে । এখানেই আসে আত্মীকরনের ব্যাপারটি । আমার যেটি মনে হয়, আত্মীকরন যে পুরোপুরিভাবে হতে হবে তেমন নয় ।

বরং যে যে সাংস্কৃতিক উপাদানগুলি আমার ভাল লাগে বা আমি পছন্দ করি আমি শুধু সেগুলিই নিতে পারি বা চর্চা করতে পারি । সবগুলি নেয়ার আমার দরকার নেই । আর আমার আগের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও একেবারে ফেলনা নয়, তাই আমি সেগুলিও বজায় রাখতে পারি । তবে এক্ষেত্রে কিছু কিছু ব্যাপার আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে না হলে তা আলোচনাসাপেক্ষে রহিত করা যেতে পারে । আজকালকার দুনিয়ায় সংস্কৃতির এই টানাপোড়েন আমাদেরকে কতদুর নিয়ে যাবে আমি জানি না, তবে আমাদের চাওয়া হবে এই, যেন জগতের সকল সংস্কৃতি একে অপরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং ঘৃনার বা হিংসার ভাব পোষন না করে ।

সবাইকে শুভেচ্ছা । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.