আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এতই দেউলিয়া



বাংলাদেশ একটি নাম। একটি ইতিহাস। বাঙালি বীরের জাতি। তারা কারও অধীনতা মেনে নেয়নি। নেবেও না।

আর আমরা হলাম সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচয়িতাদের একেকজন সুযোগ্য উত্তরসূরি। বাংলাদেশের রয়েছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। বাঙালি কারও করুণার ধার ধারে না। কারও ধার করা সংস্কৃতিতে সে চলে না। কেননা আমাদের দেশের রয়েছে গর্ব করার মতো, অহঙ্কার করার মতো স্বর্ণোজ্জ্বল সংস্কৃতি।

হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের দেশের মানুষ সে সংস্কৃতিকে দেহ ও মননে লালন করে আসছে। আমাদের অস্থি, মাংস, মজ্জায় মিশে আছে সে সংস্কৃতি। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে দেহ-মনের পরিপুষ্টি সাধিত হয়েছে। আমাদের মুর্শিদী, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি আর একতারার সুর সবাইকে মোহিত করে। আবেগাপ্লুত করে।

পল্লীগীতির উদাস করা সুরে আমাদের মন-প্রাণ পাগলপারা হয়ে যায়। আমাদের হৃদয়-মনে ভিন্ন এক প্রেমের সঞ্চার করে। যে প্রেম দেশকে ভালোবাসার শিক্ষা দেয়। যে প্রেম মাকে ভালোবাসতে এবং সবুজের নিকুঞ্জ ভরা ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশকে ভালোবাসতে শিক্ষা দেয়। যে প্রেমে বিন্দুমাত্র কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই।

কিন্তু কেন জানি এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে বারবার আঘাত হানছে বিদেশি শকুনরা। কেন জানি আমরাও নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে মাঝে মাঝে ভুলতে বসি। তার জন্য দায়ী শুধু বিদেশি শকুনরা কিন্তু নয়, আমাদের দেশের গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মহলও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা হচ্ছে দেশীয় শকুন। তারা তাদের অর্থের দাপট দেখিয়ে বারবার আঘাত হানছে আমাদের প্রিয় সংস্কৃতিকে।

তাদের হিংসাত্মক, বিষাক্ত দন্ত-নখরের আঁচড় টানছে আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির গায়ে। তাদের কোন শব্দ দিয়ে গালি দেয়া যায়? একটা কঠিন গালি পাড়তে আমার মন চায়, কিন্তু সে ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। তাই বাধ্য হয়েই কবি বলেছেন : ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। / সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি। ’ (আবদুল হাকিম) এর চেয়ে বড় গালি আর কি দেয়া যায়।

কিছুদিন আগে ১০ ডিসেম্বর ২০১০ ভারতীয় তারকা শাহরুখ খান আমাদের দেশে এসেছিলেন তথাকথিত দেশীয় শকুনদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে। তিনি নেচে-গেয়ে আমাদের দেশ থেকে নিয়ে গেছেন ১০ কোটি টাকা। যে দেশের মানুষ এখনও দু’বেলা ডাল-ভাতের নিশ্চয়তা পায়নি; সে দেশে এমন সাংস্কৃতিক বেলেল্লাপনা কী করে সহ্য করা যায়! শাহরুখ আমাদের দেশের বর্তমান প্রধান নায়ক শাকিব খানকে চেনেন না বলে খেদোক্তি দেখিয়েছেন। এত লজ্জা আমরা কোথায় রাখি। শাকিব খান তাদের জন্য কিছুই না হতে পারে।

তবে সে আমাদের দেশের প্রধান নায়ক। শাকিব আমাদের গর্ব। দেশের রত্ন। আমাদের যা আছে তাই নিয়ে আমরা গর্ব করব। ঠিক সেদিন দেশটিভির তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে কনসার্টের আয়োজন করে।

তার জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই। আমি সেদিন একজন দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। সেদিন সাবিনা ইয়াসমিন কী সব গানই না পরিবেশন করেছিলেন। কী গভীর মমতা জড়িয়ে আছে তাঁর কণ্ঠে! সাবিনা ইয়াসমিনের মতো ডজনে ডজনে গুণীশিল্পী আমাদের দেশে রয়েছে। তবুও কেন জানি আমরা মাঝে মাঝে সে কথা ভুলতে বসি।

ভুলে যাইও। ধরনা দেই বিদেশি সংস্কৃতির কাছে। হায়! আমাদের বোধোদয় কখন হবে? এবার একটা নির্মম সত্য কথা পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরছি। আমরা সবাই এ ব্যাপারে জ্ঞাত হয়েছি যে, এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর অন্যতম সহ-আয়োজক আমাদের প্রিয় দেশ ‘বাংলাদেশ’। সংবাদটি যেদিন প্রথম শুনেছি, সেদিন কত যে খুশি হয়েছিলাম তা লিখে বোঝাতে পারব না।

বিশ্বাস করুন, সেদিন থেকে গর্বে বুকটা ভরে আছে। বারবার তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে লাল-সবুজ পতাকার পত্ পত্ করে ওড়ার দৃশ্য দেখি। আমার খুশিতে মন ভরে যায়। মনে অন্যরকম এক হিল্লোল বয়ে যায়। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে বাংলাদেশেই, তখন আনন্দের আর সীমা রইল না।

অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখি; এবার আমাদের দেশেই দেখব বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমগ্র বিশ্ব দেখবে আমাদের দেশকে, প্রকৃতিকে, আরও দেখবে আঁকাবাঁকা বয়ে চলা নদ-নদী, পালতোলা নৌকা, অবারিত সবুজ আর সবুজেঘেরা পল্লী প্রকৃতি। বাংলাদেশ শুধু দরিদ্র দেশ নয়, শুধু বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের দেশ নয়, এর রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পাখির কিচিরমিচির। আছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন।

যেখানে আছে বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আছে আদিবাসীদের অনন্য সুন্দর ঐতিহ্য। চাকমা-মারমা-মণিপুরীদের সংস্কৃতি এবং নৃত্য আমাদের শিহরিত করে। কিন্তু আমাকে যদি কেউ ফ্রি একটা টিকিট দেন তবুও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখতে যাব বলে মনে হয় না। আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।

কেন যাব? কাদের দেখতে যাব? বচ্চন পরিবারকে দেখতে? ভারতীয় ৫৮ জন শিল্পীর নাচ-গান দেখতে? আমার দেশে, আমার মাঠে অন্য দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে— এটাই আমরা দেখতে যাব? না কখনোই না। বিসিবি অনুষ্ঠানটি আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ এটিএন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ভারতের উইজক্রফটকে দায়িত্ব দিয়েছে। তারা যৌথভাবে আয়োজন করবে, কিন্তু এটিএন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট পুরো অনুষ্ঠানটি সাজাচ্ছে ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে। অমিতাভ বচ্চন তার স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউসহ মোট ৫৮ জন আসবেন নাচ-গান করতে। বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে থাকবেন ইভা রহমানসহ গুটিকয়েক জুনিয়র শিল্পী।

এত লজ্জা কোথায় রাখি। কি দিয়ে মুখ ঢাকি। আমাদের কী সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, এন্ড্রু কিশোর, সৈয়দ আবদুল হাদী, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, শাকিলা জাফর, মুস্তফা জামান আব্বাসীর মতো শিল্পীরা নেই? আমাদের কী লালন, শাহ আবদুল করিমের মতো বিশ্বমানের বাউল নেই? তাদের গান তো সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। আমাদের কী জেমস, হাবিব, বিপ্লব, অর্ণব, জয়ের মতো শিল্পী নেই? পুরো বিশ্ব দেখবে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ওপেনিং সিরিমনিতে ভারতীয়রা পারফর্ম করছে, তারা তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরছে। বিশ্ব কী ভাববে? বাংলাদেশের কোনো ভালো শিল্পী নেই? বাংলাদেশের তুলে ধরার মতো ঐতিহ্য নেই? কেন এই নিচু মানসিকতা? কেন নিজের স্বকীয়তাকে বিলীন করে দেয়া? কার স্বার্থে? আমরা কী চেয়ে চেয়ে দেখবই শুধু? না, সোচ্চার হব এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

আজ আমরা এক গভীর সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। আজ সময় এসেছে ভেবে দেখার। আমরা কী সাংস্কৃতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছি? আসুন, আমরা এক নতুন বিপ্লবের ডাক দেই। সে ডাক হচ্ছে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষার ডাক #........................... আ লী আ ক ব র সম্পাদকীয়, আমারদেশ ১৫.০২.২০১১।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.