তোমাদের পাগল বন্ধু হাসপাতালের সাদা দোলনাটার কিনার ধরে কোনো মতে হাচড়ে পাচড়ে ধরে ঝুলে রইল বাবাই, মাথায় নীল হেলমেট পড়ায় নাক পর্যন্ত ঢেকে গেছে, তার মাঝ দিয়েই গলাটা কেবল বকের মত বাড়িয়ে উঁকি দিল বহু কষ্টে। কৌতূহলী চোখে ভেতরটা দেখলো। সাদা টাওয়েলে পেঁচিয়ে পুটলি বানিয়ে রাখা হয়েছে দোলনার মাঝে কিছু একটা।
বাবাই হতাশ গলায় বলে উঠল, “এইটা কি খালামণি?”
মিথিলা বাবাইকে পেছন থেকে ধরে রেখেছে, না হলে পড়ে যাবে। হাসি চেপে বলল, “ছিঃ বাবাই! ‘কি’ না, বলো ‘এইটা কে?’”
ঘাড় ঘুরিয়ে খালামণির দিকে তাকালো, “এইটা কে?”
“এইটা তোমার ছোট বোন।
”
“এইটা মানুষ?” অবাক হয়ে তাকায় বাবাই।
“হ্যাঁ! কেন?”
“এত ছোট কেন?”
“আস্তে আস্তে বড় হবে। ” মুখ টিপে হাসল মিথিলা।
“অ। ” গলা বাড়িয়ে আবার তাকায় বাবাই।
অনেক ছোট ছোট নাক মুখ দেখা যাচ্ছে পুটলির ভেতর থেকে। বাবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে- এটা নাকি তার ছোট বোন! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবাই। ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার বোন এত ছোট একটা মানুষ হবে- ভেবে নাই সে।
এ.সি. ছাড়া রয়েছে কেবিনটায়। নোভেরা গভীর ঘুমে।
দোলনাটা পাশেই। বাবাইয়ের নতুন বোনটাও ঘুমাচ্ছে। বাবাই চিন্তিত মুখে পেছনে হাত নিয়ে পায়চারি করছে মিথিলার সামনে। এত ছোট আকৃতির বোনকে নিজের মিলিটারি বাহিনীতে কীভাবে নেয়া যায়- তা নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বাবাই। লেফটেনেন্ট মুরগীর সাথে বৈঠকে বসা দরকার জরুরী ভিত্তিতে।
তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল বোনটা তার থেকেও বড় হবে। এত ছোট হবে আগে বুঝেনি!
পায়চারি করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় উঠে নোভেরার পাশে ঠেলা ঠেলি করে ছোট বেডটায় কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। মিথিলা উঠে গিয়ে বাবাইয়ের হেলম্যাটটা খুলে আধ ঘুমন্ত শরীরটা ঠিক করে শুইয়ে দিল নোভেরার পাশে। এ.সি’র শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই রূমে। লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো।
নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিল দরজাটা। ঘুমাক ও। অনেক ছোটাছুটি গেছে আজকে বাবাইয়ের ওপর দিয়ে।
পরের এক মাস ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার ওপর দিয়ে মোটামুটি ঝড় বয়ে গেল। তার নতুন বোন হওয়ায় নোভেরা বাবাইয়ের প্রতি তেমন খেয়াল রাখতে পারেনি এই এক মাস।
মিথিলাকেই সামলাতে হল সব। কিন্তু বাবাকোয়াকে সামলাতে গিয়ে মিথিলা এই প্রথম টের পেল বাচ্চা কাচ্চা সামলানোর কাজটা কি ভয়াবহ রকমের কঠিন। কালোঘাম ছুটে যাওয়া জিনিসটা যে কি সেটা হারে হারে টের পেল।
গত এক মাসে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া যে সব অ্যাডভেঞ্চার (দূর্ঘটনা ঘটিয়েছে) করেছে- সেগুলো বাবাই সযত্নে তার “ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার গোপন মিশন সমূহ” নামক ডায়েরিতে লিখে রেখেছে। রাতে বাবাই যখন দাবার বোর্ডের ওপর ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে থাকে ডাইনিং টেবিলের নিচে, মিথিলা গিয়ে ওকে নিয়ে আসে প্রতিদিন।
বিছানায় নিয়ে ঠিক করে শুইয়ে দেয়। তারপর ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার ডায়েরী বের করে পাতা ওল্টাতে থাকে। প্রতিদিনই মিথিলাকে এড়িয়ে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া নানা রকম অ্যাডভেঞ্চার করে যাচ্ছেন। মিথিলা ভেবে পায় না বাবাই কখন এত সব কান্ড কারখানা করে বেড়ায়? নোভেরা রান্নাঘরে যেতে পারছে না বলে মিথিলাকে আপাতত রান্না বান্নার কাজটা করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে জাহিদও এসে সাহায্য করে।
শুধু মাত্র এই সময়টাতে বাবাইকে চোখে চোখে রাখতে পারে না মিথিলা। তার মাঝেই এত সব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। প্রতি রাতে মিথিলা “গোপন মিশন সমূহ” পড়ে আর হতাশ ভাবে মাথা নাড়তে থাকে। গত এক মাসের উল্লেখ যোগ্য মিশন সমূহ হলঃ
মিশন নং ৪৮-
আজকে ক্যাপ্টেন বাবকোয়া বাথরুমের মেঝেতে পানি জমিয়ে নৌকা ভাসানোর চেষ্টা করেছিল। পানি যাওয়ার সিংকের মুখটা বালতি চেপে ধরে পানি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
কাগজের নৌকাও বানিয়ে ভাসিয়েছিলাম। কিন্তু লেফটেনেন্ট মুরগীকে নিয়ে সমস্যা হয়েছে। ভেবেছিলাম অনেকদিন পর লেফটেনেন্ট মুরগীকে গোসল করাবো সাবান আর শ্যাম্পু দিয়ে। কিন্তু সাবান নিয়ে যখনই ধরতে গেলাম লেফটেনেন্ট মুরগীকে- সে এমন দৌড় দিয়েছে পানির ওপর দিয়ে যে হাত ফসকে সাবানটা কমোডের মধ্যে পড়ে গেছে। নতুন সাবানটা আম্মা আজকেই দিয়েছিল।
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল তখন। আম্মা বাথরুমে ঢুকে সাবান না পেলে ধোলাই দিবে।
লেফটেনেন্ট মুরগীর র্যাংনক ডাউন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট বানায় দেওয়া দরকার। কথা শুনে না! ওর জন্য নতুন সাবানটা কমোডে পড়ে গেছে।
অবশ্য কেউ দেখে নাই। আমি শলার কাঠি দিয়ে গুতিয়ে সাবানটা তুলে এনে শ্যাম্পু দিয়ে ভাল করে ধুয়ে আগের জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আম্মা কীভাবে জানি টের পেয়ে গেছে সাবানে এতগুলা কাঠির গুতাগুতির চিহ্ন দেখে। সাবানটা ফেলে দিয়ে কোনো কথা বার্তা ছাড়াই আমার কান ধরে দুপুর বেলা ধোলাই দিয়েছে, লেফটেনেন্ট মুরগী আর বাবলির সামনেই। ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার মন খারাপ।
খুব খারাপ।
মিশন নং ৪৯-
আজ দুপুরে আম্মা যখন ঘুমাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া টুল এনে বাবলির দোলনার পাশে উঠে মিলিটারীতে জয়েন করার জন্য বিশেষ নীতিমালা পড়ে শোনাচ্ছিল বাবলিকে। লেফটেনেন্ট মুরগীও উপস্থিত ছিল সেখানে। কিন্তু বাবলি কিছুই শুনে নাই। সে পেট ফুলিয়ে হা করে ঘুমিয়েছে আমার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের মাঝখানে।
বাবাকোয়া শিশুদের প্রতি যত্নবান। ঐ সময় একটা মাছি এসে বাবলির মুখের ওপর ওড়া উড়ি করছিল। ঘরের কোনে রাখা এরোসলের ক্যান এনে টুলে উঠে বাবলির মুখের ওপর উড়তে থাকা মাছিটাকে স্প্রে করতে গিয়েছিল ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। কিন্তু স্প্রে করার আগেই আম্মা কেমন করে জানি জেগে উঠে ঠিক তখনই। আম্মা বাবাকোয়ার শিশু কেয়ার কর্মসূচির কোনো কথাই কানে তোলে নাই।
কান ধরে টুল থেকে নামিয়ে ধোলাই দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। বাবাকোয়া তার শিশু কেয়ার কর্মসূচির নীতিমালা বাতিল করে দিয়েছে। মিলিটারীতে শিশু কেয়ার থাকা ঠিক না। আম্মা মাইর দেয়। ......
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার গোপন মিশন সমূহ পড়তে পড়তে চাপা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মিথিলা।
পাশে গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা বাবাইয়ের দিকে তাকায়। উপুর হয়ে ঘুমাচ্ছে বাবাই। ঘুমিয়ে থাকার ভঙ্গিটা বিচিত্র। বালিশটায় মুখ রেখে পেছন দিনটা ছাদের দিকে উঠে গেছে! মিথিলা হাসি চেপে বাবাইয়ের পেছন দিক চেপে বিছানায় নামিয়ে দেয়। কিন্তু আবার উঠে যায় ছাদের দিকে! হা হয়ে ঘুমাচ্ছে।
জাহিদ প্রায়ই রাতে উঁকি মেরে যায় ছেলের ঘরে। মিথিলা বই পড়ে তখন। সেদিনও রাতের বেলা ঘুমাতে যাওয়ার আগে জাহিদ বাবাইয়ের ঘরে উঁকি মারতে এসেছিল।
বাবাইয়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে মিথিলাকে অবাক গলায় বলল জাহিদ, “ছোট বেগাম, ক্যাপ্টেন সাহেবের পাছা কি জগৎ ছাড়িয়ে উর্ধ্ব গগণ পানে উঠে যাচ্ছে নাকি? বালিশ চাপা দেও!”
মিথিলা ফিক করে হেসে দেয়। জাহিদ তখন এসে গম্ভীর মুখে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার নীল হেলমেটটা বাবাইয়ের পশ্চাতদেশে পরিয়ে দেয়, “নে বাবা, ঘুমা এখন!”
মিথিলা হাসি থামাতে পারে না, “একটা ছবি তুলে রাখা দরকার দুলাভাই!”
“যা, দৌড়ে গিয়ে ওয়ার ড্রোবের ওপরের তাক থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে আয়।
সঙ্গে লেফটেনেন্ট সাহেবকেও আনিস। এই হেলমেটের ওপর ওটাকে বসিয়ে ছবি তুলবো। ” জাহিদ বলল।
মিথিলা বই রেখে দৌড়ে নোভেরাদের রূমে গিয়ে ক্যামেরা নিয়ে আসে। লেফটেনেন্ট সাহেব ঘুমিয়ে ছিলেন।
ঘুম ঘুম মুখে তুলে আনা হল তাকে। নোভেরাও কৌতুহলী মুখে পেছন পেছন বাবালিকে কোলে নিয়ে এই ঘরে চলে আসে। কি করছে দেখার জন্য। অবাক হয়ে দেখে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার উর্ধ্বগামী পাছায় হেলমেট লাগিয়ে তার ওপর গম্ভীর মুখে এভারেস্ট জয়ী এডমন্ড হিলারীর মত দাঁড়িয়ে আছেন লেফটেনেন্ট মুরগী। ঐ অবস্থায় জাহিদ ছবি তুলছে বাবাইয়ের।
বাবাই গভীর ঘুমে তখনো।
নোভেরা তখন বলে উঠল, “দাঁড়াও, বাবলিকে ওর পিঠে বসিয়ে দেই। ” গিয়ে বাবলিকে বাবাইয়ের পিঠে বসিয়ে দেয়। এখনো বসতে পারে না বাবলি। চিত হয়ে বাবাইয়ের পিঠে শুয়ে থাকে।
আনন্দিত মুখে নানা রকম শব্দ করতে থাকে বাবলি। হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা মুখে নিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটা অল্প কিছুদিন হল আবিষ্কার করেছে সে। আজও বুড়ো আঙ্গুলটা মুখে পুরে আনন্দিত মুখে তাকাতে লাগল সবার দিকে।
এর মাঝেই ছবি তোলা চলল জাহিদের। এবং এক পর্যায়ে বাবাইয়ের ঘুম ভেঙে গেল।
কারণ বাবলি তার পিঠে হিসু করে দিয়েছে। ঘটনাটা কি ঘটেছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো হয়ে গেল বাবাকোয়ার। উঠে বসার সাথে সাথে লেফটেনেন্ট মুরগী লাফ মারল কক্ কক্ করে। বাবলিকে একপাশে সাবধানে নামিয়ে রেখে উঠে বসে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। কঠিন মুখে সবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
শিশু কেয়ার কর্মসূচি বাতিল করে দিলেও বাবাই একটু উদার মনের মানুষ। ওর গেঞ্জি ভিজিয়ে দিলেও কিছু বলল না বাবলিকে। ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার রাগা উচিত না।
জাহিদ পরদিন বাবাইয়ের সেই ছবি বিশাল করে বাঁধিয়ে আনল ফ্রেমে; ড্রইং রূমের দেয়ালে টানিয়ে দিল। এবং ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া গভীর বিষাদে ডুবে গেলেন।
তার পাছায় হেলমেট লাগিয়ে লেফটেনেন্ট মুরগী উঠে বসে আছে গম্ভীর মুখে- এজন্য মন খারাপ করেনি। লেফটেনেন্ট মুরগীর গলার র্যাংেকটা পরাতে ভুলে গেছে সবাই। লাল নীল ফিতার বানানো র্যাং কটা পরায়নি কেউ লেফটেনেন্ট সাহেবকে। র্যাং ক ছাড়া সিভিলিয়ান মুরগী লাগছে তাকে। এটা কোনো কথা হল?
এর কিছুদিনের মাঝেই একবার বাবাইকে স্কুলে ভর্তি করানো নিয়ে অনেক দৌড়া দৌড়ি হল।
এত অল্প বয়সে ডায়েরী লিখে ফেলা বাবাইকে নিয়ে সবাই ভেবেছিল অনায়াসে স্কুলে ভর্তি করানো যাবে। হয়েছে উল্টোটা। পরীক্ষার খাতায় সে কিছুই লেখেনি। এমনকি ভাইবাতে যখন নিয়ে যাওয়া হল বাবাইকে, সে মুখ গোজ করে বসেছিল। তার সামনে মোটাসোটা ভালুক টাইপের এক মহিলা চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “বলতো বাবা, তোমার নাম কি?”
“ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া।
”
“ভাল নাম?” একটু বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
“ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া বাবাই। ” কঠিন মুখে তাকাল বাবাই।
একটা নিঃশ্বাস ফেলে মোটাসোটা ম্যাডাম প্রসঙ্গ বদলালেন, “বাবাই একটা ইংরেজী ছড়া বলো তো?”
“বলবো না। ” মুখ গোজ করে রইল বাবাই।
চশমার ওপর দিয়ে সরু চোখে তাকালেন, “বাংলা কবিতা বলো তাহলে?”
“বলবো না। ” আবারও একই জবাব দিলো।
“তাহলে একটা গান গাও?”
“গাবো না!”
মোটাসোটা ম্যাডাম হতাশ স্বরে বললেন, “নেক্সট?”
বাবাই বিজয়ী বেশে মিথিলার কাছে ফিরে আসে। মিথিলা উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিল বাহিরে। বাবাই আসতেই জিজ্ঞেস করল, “সব বলতে পেরেছো?”
“বলি নাই।
” গম্ভীর মুখে বলে বাবাই।
“কেন!” আকাশ থেকে পড়ল মিথিলা।
“ম্যাডামটাকে পছন্দ হয় নাই। আম্মুর কাছে বলবো। ”
“কিন্তু এখানে না বললে তো স্কুলে ভর্তি করবে না।
” মিথিলা বোঝানোর চেষ্টা করল।
“আম্মুর স্কুলই ভাল। ” বাবাই উদাস উদাস মুখে বলে।
মিথিলা হাল ছেড়ে দিয়েছে। এই ছেলেকে ভর্তি করানো আপু ছাড়া সম্ভব না।
নোভেরা এক ধমক দিলেই গড় গড়িয়ে সব কবিতা, ছড়া বলা শুরু করে বাবাই।
ছয় মাসের মাথায় মিথিলার ফাইনাল পরীক্ষা পড়ে গেল। পড়াশোনার অনেক চাপ। প্রচুর ক্লাস মিস গেছে বাসায় থাকতে গিয়ে। হলে চলে যেতে হলো।
না হলে বাসায় বসে সব শেষ করতে পারবে না। নোভেরাকেও হাসপাতালে আবার জয়েন করতে হয়েছে। জাহিদ তো আগে থেকেই ব্যস্ত। রাতে ছাড়া সহজে পাওয়া যায় না ওকে। বিদেশের কোন কোম্পানির কাজ নিয়ে কদিন হল ঠিক মত বাসায় ফিরতে পারছে না।
রাত হয়ে গেলে অফিসেই থেকে যাচ্ছে।
বাসায় বাবাই আর বাবলিকে দেখে রাখার জন্য লোক নেই। বেশ ঝামেলাতেই পড়ে গেল নোভেরা। জাহিদের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে কয়েকবার। জাহিদের তেমন কোনো আত্মীয় স্বজন নেই এখানে যে এখানে এসে দেখে শুনে রাখবে।
সবারই নিজের ফ্যামেলি আছে। নোভেরার দিক থেকেও প্রায় একই অবস্থা। শেষ মাথায় এসে ঠিক করা হল যে নোভেরার হাসপাতালের কোনো নার্স এসে অফ টাইমে বাবাইদের দেখে রাখবে। নোভেরা অফিসের ডিউটি শেষ করে আসা পর্যন্ত নার্স বাসায় থাকবে। প্রয়োজনে এ বাসাতেই না হয় থাকবে।
এক্সট্রা রূম তো আছেই। নোভেরা ফিরে এলে তার ছুটি। মাস হিসেবেই টাকা দেয়া হবে এর জন্য।
জাহিদ মেনে নিল। অবশ্য এছাড়া আর কোনো ভাল বুদ্ধিও পাওয়া যাচ্ছিল না।
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া বেশ কদিন ধরেই দেখছিল বাবা-মা দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেছেন তাঁদের দুই ভাই বোনকে নিয়ে। কিন্তু চিন্তার কি আছে বুঝতে পারছিল না। লেফটেনেন্ট মুরগীর সাথে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
“আচ্ছা লেফটেনেন্ট মুরগূ, আব্বা আম্মা এত চিন্তা করছে কেন?”
“কক্ কক্। ” গম্ভীর গলায় বললেন লেফটেনেন্ট মুরগী।
“হুম। কিন্তু আমাদের নিয়ে চিন্তার কি আছে?”
“কক্ কক্ কউক্......”
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া বিভ্রান্ত মুখে তাকায় ফেলটেনেন্ট সাহেবের দিকে। কক্ কক্ কউকের মানেটা স্পষ্ট না তার কাছে। কি বোঝাতে চাইছেন উনি?
যা হোক। লেফটেনেন্ট মুরগীর কথার মর্ম উদ্ধার করার আগেই ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া আবিষ্কার করল তাদের বাসায় বেডিং পত্র নিয়ে হাজির হয়েছে বিশাল দেহী এক মহিলা।
মোটামুটি পর্বতের মত দৈর্ঘ্য প্রস্থে। বাবাকোয়া প্রথম দর্শনেই অপছন্দ করল মহিলাকে। সারাক্ষণ পান খাচ্ছে। মুখের পান বেয়ে পানের কষ গড়াচ্ছে আর মুছছে। নাকের নিচে পুরুষ মানুষের মত সরু মোচ।
আশে পাশে কেউ না থাকলে খুব যত্ন করে নাকের লোম টেনে টেনে ছিঁড়েন মহিলা। বাবাইকে কঠোর গলায় নোভেরা বলে দিয়েছে প্রথম দিনই, “বাবাই, ইনি তোর খালা হন। খালাকে একদম জ্বালাবি না। চুপচাপ থাকবি। বাবলিকেও দেখে রাখবি।
মারামারি করবি না। ”
বাবাই থমথমে মুখে তাকায়। মিথিলাও তার খালা। সে কত ভাল! এই মহিলাকে খালা ডাকতে হবে?
মহিলা কেবল লাল দাঁত বের করে হেসে হেসে বলেছে নোভেরাকে, “আপা, একদুম চিন্তা কইরেন না। আমি খুব কেয়ার করি রাখমু ওদের।
”
ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নোভেরা বলল, “খালেদা, একটু দেখে রেখো। সারাক্ষণ উদ্ভুট্টু সব কান্ড কারখানা করে বেড়ায় এই ছেলে। ”
“ভাইবেন না আপা। বাচ্চা কাচ্চা তো আমরাও পালছি। ” হে হে করে হাসতে থাকে পেট দুলিয়ে।
নোভেরা বেরিয়ে গেলেই খালেদা বেগম নামের মোটাসোটা মহিলাটা সবার প্রথমে ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম বের করে খেতে থাকে রাক্ষসের মত। সোফায় পা তুলে লম্বা হয়ে শুয়ে টি.ভি.তে হিন্দী সিনেমা দেখতে থাকে। বাবাইদের প্রতি কোন ভ্রুঁক্ষেপ নাই। বাবলিকে যে ঘন্টায় ঘন্টায় ফিডার বানিয়ে দিতে হয় সেটাও ঠিক মত করে না। একবার তো ভীষণ গরম দুধ ফিডারে ভরে বাবলিকে খেতে দিয়ে টিভি দেখতে চলে গিয়েছিল মহিলা।
ভাগ্যিস বাবাই নিজে সেটা খেতে গিয়ে ভিজ পুড়িয়ে হুলস্থূল কান্ডটা করল!
তখন থেকেই বাবাই দুই চোখে দেখতে পারে না মহিলাকে। বাবা মা বেরিয়ে গেলেই মহিলা রাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নাকের লোম খুব যত্ন করে টেনে ছিঁড়তে থাকেন। আর প্রায়ই মোবাইল ফোন বের করে কার সাথে জানি নিচু গলায় কথা বলতে থাকে। বাসায় বাবা মা না থাকলে মাঝে মাঝেই কালো করে রোগা পটকা, বেড়ালের মত গোঁফ ওয়ালা একটা লোক আসে ওদের বাসায়। তখন খালেদা ওর হাসপাতাল থেকে আসার সময় নিয়ে আসা বাজারের চটের ব্যাগ থেকে অনেক ধরণের ওষুধের পাতা, বোতল বের করে লোকটাকে দেয়।
বাবাইয়ের কেমন যেন সন্দেহ লাগে। এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে ওষুধ দেয় কেন? ওষুধ কি লুকিয়ে দেয়ার জিনিস? আম্মা তো নাক টিপে জোর করে খাইয়ে দেয়। সারা বিল্ডিং-এ তখন খবর হয়ে যায় যে বাবাই ওষুধ খাচ্ছে। রোগা পটকা লোকটা এত ওষুধ নেয়- তাও মোটা হয় না কেন?- বাবাই অবাক হয়ে ভাবে।
এভাবেই চলছিল বেশ কিছুদিন।
নোভেরাকে একদিন রাতে জাহিদকে চিন্তিত গলায় বলতে শুনল বাবাই, “হাসপাতালের স্টোর থেকে ওষুধ চুরি যাচ্ছে। ঝামেলায় পড়ে গেছি আমি। এম.এই. রূমের দায়িত্বে আছি। মাঝখান থেকে ওষুধ গায়েব হয়ে যাচ্ছে- জবাব তো আমাকে দিতে হবে। ”
“চুরি করছে কে? স্টাফরা নাকি?”
“বুঝতে পারছি না।
আমি না থাকলেই চুরি হয়। ” নোভেরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “টেনশনে আছি খুব। এভাবে চুরি হতে থাকলে শেষে বড় ঝামেলায় পড়ে যাবো। আই.সি.ইউ’র দায়িত্বে ছিলাম ভালই ছিল। শুধু রাতে ডিউটি দিতে হবে বলে ডে শিফটের জন্য এখানে নিলাম।
এখানে দেখি আরো বড় ঝামেলা!”
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া টেবিলের ওপর হেলমেট পরে গম্ভীর মুখে পায়চারি করছে হাত পেছনে নিয়ে। টেবিলের সামনে মেঝেতে চুপচাপ বসে আছে লেফটেনেন্ট মুরগী। তার পাশেই বসে থাবা দিয়ে একটা তেলাপোকাকে মারার চেষ্টা করে যাচ্ছে বাবলি। হামাগুড়ি দিতে পারে মোটামুটি, তবে দাঁড়াতে পারে না। বসে থাকে এক জায়গায়।
হামাগুড়ি দিতে গেলে বেশির ভাগ সময় অল্পতেই আটকে যায়। হাত পা এখনো শক্ত হয়নি। এক জায়গায় বসিয়ে দিলে কেবল থাবা মারে মেঝেতে। এখন যেমন মহানন্দে থাবা মেরে যাচ্ছে তেলাপোকাটাকে। কিন্তু লাগাতে পারছে না।
সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে তেলাপোকাটা। ইদানীং এই বাসায় তেলাপোকা বেশি হয়েছে। ছোট বাচ্চা কাচ্চা আছে বলে নোভেরা ওষুধ দিতে পারছে না।
লেফটেনেন্ট সাহেব মাঝে মধ্যে ঘাড় ঘুড়িয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে বাবলির ছেলে মানুষি খেলা দেখছে, আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবাকোয়ার দিকে তাকাচ্ছে।
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া গম্ভীর গলায় বলে উঠল হঠাৎ, “কমরেডস, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শত্রু শিবির আক্রমণ করবো।
ঐ মোটা মানুষটাকে বাসায় থাকতে দেয়া চলবে না। আম্মার অবর্তমানে সে চুরি করে আইসক্রিম খায়। বাবলির ফিডার দেয় না ঠিক মত। এই অন্যায় মেনে নেয়া যায় না, বলো যায়?”
লেফটেনেন্ট সাহেব আড় চোখে তেলাপোকাটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। বাবলি সেটাকে থাবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাবাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব দিল না কেউ। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে বাবাই বলে যেতে থাকল, “এই বাসায় যখন তখন এক শুঁটকা লোক এসে বস্তা বস্তা ওষুধ নিয়ে যায়- এটা ঠিক না। হামলা করতে হবে। কে কে সাথে আছে হাত তুলো?”
দেখা গেল ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া একাই হাত তুলেছে। বাবলি থাবা দিয়ে অবশেষে তেলাপোকাটাকে চ্যাপ্টা বানাতে পেরেছে।
এবং লেফটেনেন্ট সাহেব সেই চ্যাপ্টা তেলাপোকাটা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। বাবাইয়ের দিকে কারো ভ্রুঁক্ষেপ নাই।
বাবাকোয়া হতাশ হয়ে হাত নামিয়ে ফেলল। লেফটেনেন্ট মুরগীর র্যাং ক ডাউন করা জরুরী হয়ে পরেছে। কাজ কর্মে একেবারেই মন নেই তার।
ফোঁস করে একটা নিঃস্বাস ফেলল ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। মিলিটারী বাহিনী চালানো অতি কষ্টকর। কঠোর হতে হয় যখন তখন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।