যত দূর মনে পড়ে, টাইটানিক সিনেমায় জাহাজের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের সলিলসমাধি ঘটেছিল ক্যাপ্টেনার ইচ্ছা এবং সিদ্ধান্তে। অর্থাৎ ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনিও জাহাজের সঙ্গে ডুবে গিয়ে জীবনাবসান ঘটাবেন।
সিনেমার ব্যাপার তো, তাই নিঃসন্দেহে রোমান্টিক; কিন্তু হয়তো বাস্তবতাবিবর্জিত। অবশ্য হলেও হতে পারে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে জাপানি ক্যাপ্টেনদের তাঁদের যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত সলিলসমাধির অনেক ইতিহাস পড়েছি।
ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে আত্মহত্যা করা জাপানিদের দীর্ঘদিনের ‘ঐতিহ্য’, যা অন্যের কাছে যতই নির্মম মনে হোক না কেন।
এককালে সতীদাহ প্রথার অধীনে অনেক উচ্চ গোত্রীয় স্ত্রী স্বামীর শবের সঙ্গে নিজেকেও চিতায় জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। ব্রিটিশরা জোর করে আইন করে এটা বিলুপ্ত করেছিল শ দেড়েক বছর আগে।
জাহাজের কথায় ফিরে আসি। গাজীপুরে নিঃসন্দেহে আওয়ামী জাহাজের ভরাডুবি হয়েছে নির্বাচনের সাগরে শনিবার।
রোববারের প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠায় আরও খবর আছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনসংক্রান্ত। শনিবার (৬ জুলাই) নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী এবং নারায়ণগঞ্জের দুটি নতুন পৌরসভা—আড়াইহাজার আর গোপালদীতেও নির্বাচন হয়েছে। এই তিনটি পৌরসভা নির্বাচনের একটিতেও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি। জাহাজডুবি না হলেও নৌকাডুবি হয়েছে, অর্থাৎ পৌরসভাগুলো ছোট ছোট।
২.
সপ্তাহ খানেক হলো অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড পদত্যাগ করেছেন।
বছর তিনেক প্রধানমন্ত্রী থাকার পর অস্ট্রেলিয়ার এই প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেন।
কারণ, ইদানীংকালে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছিল যে, সরকার এবং সরকারি দল ভীষণভাবে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। সব দেশে জনমত জরিপ করে প্রধানত সংবাদমাধ্যম, অস্ট্রেলিয়ায় তা-ই হচ্ছিল। পত্রপত্রিকা জরিপ করে ফলাফল ছাপাচ্ছিল।
শেষতক সরকার ও সরকারি দলের প্রধান হিসেবে জনপ্রিয়তা হ্রাসের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জুলিয়া গিলার্ড পদত্যাগ করলেন।
মার্গারেট থ্যাচার যখন জন মেজরের কাছে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব এবং প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান, তখন লন্ডনে থাকতাম। লেডি থ্যাচার তখন মনে বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে টনি ব্লেয়ারের অবস্থা হয়েছিল একই রকম। দলের (লেবার পার্টি) আর সরকারপ্রধানের পদ ছাড়তে হয়েছিল গর্ডন ব্রাউনের অনুকূলে। সর্বক্ষেত্রে কারণ একটাই, একই রকম।
অর্থাৎ তাঁদের নেতৃত্বাধীন সরকার ও দল জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। অবশ্য বেল পাকলে কাকের কী। আমরা না অস্ট্রেলিয়া, না গ্রেট ব্রিটেন!
৩.
ডুবন্ত জাহাজের ক্যাপ্টেনের সামনে তিনটি বিকল্প খোলা থাকতে পারে। প্রথম বিকল্প হলো এমন মনে করা যে, জাহাজে অল্প কিছু পানি ঢুকেছে। অর্থাৎ তেমন কোনো বিপদের কারণ নেই।
জাহাজ আগের মতোই চালানো যাবে। ধারণা করছি, জাহাজের ক্যাপ্টেন এই বিকল্পই বেছে নেবেন। নিজের ভুল না মানা, দায়দায়িত্ব অস্বীকার করাই আমাদের রাজনৈতিক ধর্ম।
নির্বাচনে ভরাডুবির কারণ কী? কারণ হলো বিএনপি টাকা ছড়িয়েছে, ভোট কিনেছে। আর দ্বিতীয় কারণ হলো ধর্মকে তারা রাজনীতিতে অপব্যবহার করেছে।
অর্থাৎ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার হাস্যকর চেষ্টা।
ভোটারদের অপমান করা হবে যদি বলা হয় যে, তাঁরা টাকা খেয়ে অথবা ধর্মের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে বিএনপিকে ভোট দিয়েছেন।
অবশ্য আমাদের বিবেচনায় গাজীপুরে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন তুলনামূলকভাবে একজন দুর্বল প্রার্থী। তাঁর বিরুদ্ধে ছিল বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের বহু অভিযোগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য চার সিটির আওয়ামী প্রার্থীর মতো আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার জোরালো কোনো অভিযোগও ছিল না।
অর্থাৎ প্রার্থীর দোষগুণ স্পষ্টতই মুখ্য ভূমিকা পালন করেনি। ভোটাররা মার্কায় ভোট দিয়েছেন, প্রার্থীকে নয়।
আমরা বলছি বিএনপি আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী; ১৮ দল বা ১৪ দল-সমর্থিত প্রার্থী বলছি না। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কী দরকার?
ক্যাপ্টেনের দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো শেষতক জাহাজ চালিয়ে যাওয়া। ডুবলে ডুবুক, হাল ছাড়ব না!
ধারণা করছি, এই বিকল্পটিও বেছে নেওয়া হবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিকল্প মিলিয়ে চলবে আওয়ামী জাহাজ।
অর্থাৎ জাহাজে কোনো বড় ফাটল ধরেনি অথবা বড় কোনো অংশ ভেঙে পড়েনি। জাহাজ ডোবার মতো কোনো অবস্থা হয়নি বা কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিএনপি আর ধর্মীয় রাজনীতিকদের অপপ্রচারে ভোটাররা সাময়িকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। ভুল বুঝতে পেরে আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট আর গাজীপুরের ভোটাররা ওই সব সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত সংসদীয় এলাকায় দলে দলে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে তাঁদের ভুল শোধরাবেন।
এবং ভোটারদের ভুল শোধরাতে পারবেন একমাত্র খোদ ক্যাপ্টেন। অর্থাৎ ভোটারদের ভুল শোধরানোর জন্য জাহাজ তাঁকেই চালিয়ে যেতে হবে। গাইতে হবে সেই পুরোনো কীর্তন—বিএনপিকে ভোট দিলে যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে না, জঙ্গিবাদের পুনরুত্থান ঘটবে। হয়তো দুটি কথাই ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান সরকারের এত ব্যর্থতার বিপরীতে এসব কথায় কি ভোটারদের আর মন ভরবে? সম্ভবত না।
৪.
সরকারি দলের ভরাডুবি হচ্ছে তার কারণ, দেশ পরিচালনায় ব্যাপক ব্যর্থতা। এককথায় এই ব্যর্থতা তুলে ধরতে হলে যে উদাহরণটি সবচেয়ে আগে আসে, তা হলো সৈয়দ আবুল হোসেন। এক দিকে চরম অদক্ষতায় খানাখন্দে ভরা সারা দেশের রাস্তাঘাট। বাস-ট্রাক-গাড়ির মালিকেরা ধর্মঘট করছেন এই বলে যে তাঁরা এত ভাঙা রাস্তায় গাড়ি চালাবেন না। এমনকি ঈদের আগে রাস্তা মেরামতের দাবিতে সাধারণ নাগরিকেরা মানববন্ধন পর্যন্ত করলেন।
সরকারের টনক নড়ল না। তারপর পদ্মা সেতু ভেস্তে গেল সেই সৈয়দ আবুল হোসেনের জন্য। তারপর কী হলো—তিনি খেতাব পেলেন ‘দেশপ্রেমিকের’।
দেশপ্রেমিকের নতুন সংজ্ঞা পেলাম আমরা—দেশপ্রেমিক কাহাকে বলে? অদক্ষ-দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে দেশপ্রেমিক আখ্যা দেওয়া হয়। অথবা যে দেশে অদক্ষ-দুর্নীতিবাজেরা দেশপ্রেমিক উপাধিতে ভূষিত হন, সেই দেশের নাম বাংলাদেশ।
রাজনীতিতে ঘটনা থেকে ধারণাটাই মুখ্য। দেশব্যাপী ধারণা জন্মেছে যে, দুর্নীতি হয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে এই ধারণাটাই মুখ্য।
দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতা, অদক্ষতা আর দুর্নীতির ফিরিস্তি সারা দিন ধরে দীর্ঘায়িত করা যায়। উল্টো দিকের যুক্তি অর্থাৎ সরকারের সাফল্যগাথাও তুলে ধরা যায়।
তবে স্পষ্টতর ভোটারদের কাছে সাফল্যগাথা এখন মোটেও আমলযোগ্য নয়। তাই তো একের পর এক নির্বাচনে ভরাডুবি।
তৃতীয় বিকল্পটি হলো অস্ট্রেলিয়া বা গ্রেট ব্রিটেনকে অনুসরণ করা। সেটা বলা বাহুল্য, হবে না। নিদেনপক্ষে ঈদের পরপরই আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিল বা দলীয় সমাবেশ ডাকতে পারে আত্মসমালোচনার জন্য।
ভরাডুবি কেন হচ্ছে, তা বিবেচনা-বিশ্লেষণ করার জন্য, খোলামেলা আলোচনা করার জন্য। নেত্রীর স্তুতি আর বন্দনার জন্য সমাবেশ করলে বিপদ আরও বেশি হবে।
বিএনপির মজা হলো, ভালো কিছু না করেই দলটি ব্যাপকভাবে সাফল্যমণ্ডিত হচ্ছে। এটাই রাজনীতি অর্থাৎ রাজনীতিতে সবকিছু সব সময় যৌক্তিকভাবে হয় না। কোনোটা যৌক্তিকভাবে এবং কোনোটা অনুভূতির তাড়নায় হবে, সেটা বুঝতে পারাই হলো রাজনীতি বোঝা।
এ দেশের রাজনীতিতে শিগগির যুবরাজদের সুদিন আসবে না। ক্যাপ্টেনের দুর্দিনেরও অবসান ঘটবে বলে মনে হয় না। বিশেষত, প্রথম অথবা দ্বিতীয় বিকল্প পথে চলতে থাকলে।
চতুর্থ কোনো বিকল্প আছে কি না, সেটা ঠিক করতে পারে একমাত্র দলটি, যদি দলটির সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া বা বিকল্প খুঁজে পাওয়ার মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকে। অন্যথায় পাঁচ বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর ২০০১-এর নির্বাচনে কম হলেও ৬২টি আসন পেয়েছিল।
এবার অর্থাৎ আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনসংখ্যা হবে তার চেয়েও অনেক কম।
জাহাজ ডোবার দায়ভার কিন্তু সব সময় ক্যাপ্টেনেরই। সন্দেহ হয়, এই ক্যাপ্টেন হয়তো জাহাজ আর তীরে ভেড়াতে পারবেন না।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।