নিজের সম্পর্কে বলা তো কঠিন কাজ। আমার সম্পর্কে বরং আপনারাই বলুন। শুধু জানি একজন সাধারণ মানুষ আমি। রংপুরের জীবন্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাক্ষর উত্তরবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজ। অবিভক্ত বাংলার যে কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিপুল খ্যাতি অর্জন করেছিল তাদের মধ্যে কারমাইকেল কলেজের স্থান প্রথম সারীতে।
১৯১৬ সালে স্থাপিত এই কলেজের রয়েছে সমৃদ্ধ গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্থাপিত হওয়ার সময় থেকেই এই কলেজ রংপুর অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক অবদান রেখে আসছে । এই কলেজ জন্ম দিয়েছে অনেক জ্ঞানী গুণী ব্যক্তির যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেখেছেন উজ্জ্বল ভূমিকা। এই কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করে বহু ছাত্র পরে বিখ্যাত চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রশাসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এই কলেজের দুই জন প্রাক্তন ছাত্র বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন পরে।
তাঁরা হলেন আবু সাদাত মোঃ সায়েম এবং হুসেন মোঃ এরশাদ, সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন মেজর জেনারেল মুস্তাফিজার রহমাম । এছাড়াও গণপরিষদের প্রথম স্পিকার আব্দুল হামিদ, প্রখ্যাত বাম রাজনীতিবিদ কমরেড মনি কৃষ্ণ সেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক সুফী মোতাহার হোসেন, আনিসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, কাজী মোঃ ইলিয়াস, শিল্পপতি আনিসুল হক, ব্যাডমিন্টনের কিংবদন্তী কামরুন্নাহার ডানা, চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন সহ অজস্র নামের এই তালিকা লেখা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। অনেক ভালো ভালো শিক্ষক এ কলেজে শিক্ষাদান করেছেন এবং করছেন । কারমাইকেলের সুখ্যাতি বিস্তৃত হয়েছে বাংলার সীমানা পেরিয়ে আসাম, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদহ পর্যন্ত। কলেজে অনেকগুলো হোস্টেল থাকায় বৃহত্তর দিনাজপুর, কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, মালদহ ও বৃহত্তর রংপুর জেলা থেকে বহু ছাত্র আসত এ কলেজে লেখাপড়া করতে।
আসলে কারমাইকেল কলেজে নিজেই একটি জীবন্ত ইতিহাস। তাই স্বল্প পরিসরে কারমাইকেল কলেজকে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। আমি সেই চেষ্টাও করবো না এই লেখায়। শুধুমাত্র কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের সেই মজার ইতিহাস জানাতে চাই
কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মূল ভবনে একটি হল ঘর বা অডিটোরিয়াম রয়েছে। যার নাম “অন্নদা মোহন হল”।
এটাই কলজেরে একমাত্র অডিটোরিয়াম ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু অনেকেই এই হল ঘরের নামই জানেনা না। গত বছর কলেজের সাবেক এবং বর্তমান প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর কাছে এই অডিটোরিয়ামের নাম জানতে চেয়ে আমি অবাক হয়ে যাই। তাঁদের মধ্যে নামটি বলতে পেরেছেন পাঁচ ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থী। আবার অনেকে নাম জানলেও জানেন না এই নামকরণের পেছনের কথা।
স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় অন্নদা মোহন নামে কোন বিখ্যাত ব্যাক্তির নামানুসারে এই হলের নামকরণ করা হয়েছে। হ্যাঁ, এটা হলেও হলটির এই নামকরণের পিছনে একটি মজার ইতিহাস আছে। যা অনেকেরই অজানা। সেই মজার ইতিহাস জানতে আমাদেরকে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে।
গত শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯১৬ সাল পর্যন্ত রংপুর অঞ্চলে অনেক বিদ্যালয় থাকলেও ছিল না কোন মহাবিদ্যালয়।
১৮৭৭ সালে রংপুরের আর এক প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৮৩২ সালে স্থাপিত রংপুর জিলা স্কুলে কলেজ অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু ছাত্রাভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। সেসময় অবিভক্ত বাংলায় কলিকাতাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও আরো কয়েকটি কলেজ চতুর্দিকে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তেমনি পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গে দুই একটি কলেজ ছিল। কিন্তু উত্তরবঙ্গে কুচবিহার রাজ্যের রাজধানীর বুকে কুচবিহারের রাজার নিজের ব্যয়ে পরিচালিত সুবিখ্যাত কুচবিহার কলেজ ছাড়া জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা ও মালদহে কোন কলেজ ছিল না।
পরবর্তী সময়ে রংপুর অঞ্চলের প্রসিদ্ধ কুন্তির জমিদার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব মৃত্যুঞ্জয় রায় চৌধুরী রংপুরে একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১২৫ বিঘা জমি দান করেন। কিন্তু সরকারী অনুমোদন না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি। তবে তার পরও তিনি চেষ্টা অব্যাহত রাখেন এবং অন্যান্য জমিদার, বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষানুরাগীদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।
১৯১৩ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল রংপুর এলে তাঁকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেয়া হয়। ঐ সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানেই অত্র অঞ্চলে একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করা হয় গভর্নরকে।
তিনি রংপুরের সেই নাগরিক সম্বর্ধনায় সকলের অনুরোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন এবং জানিয়ে দেন এই কাজে অর্থাৎ একটি প্রথম শ্রেণীর কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে প্রাথমিক পর্যায়ে তিন লক্ষ টাকার প্রয়োজন হবে। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ১৯১৩-১৪ সালে রংপুর জেলা কালেক্টর জে.এন গুপ্ত কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি রংপুর অঞ্চলের রাজা, জমিদার, বিত্তবান ব্যাক্তি ও শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে সভা ডাকেন। তার এই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে অর্থ প্রদান করেন শীর্ষস্থানীয় জমিদারবৃন্দ।
অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকা সভায় একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল যা উল্লেখ্য না করলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এই কলেজের ইতিকথা।
সেদিনের সেই সভায় তৎকালীন দানশীল জমিদার ও বিত্তবান ব্যাক্তিবর্গ কে কত টাকা দিবেন তা মুখে বলে অঙ্গীকার করেন এবং এবং কাগজে লিপিবদ্ধ করেন। এক্ষেত্রে টেপার জমিদার তার মুখে উচ্চারিত ১০,০০০ টাকা লিখতে গিয়ে টাকার অংকের জায়গায় ভুল করে ডান পাশে একটি শূন্য বেশী বসিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তার টাকার পরিমাণ দাড়ায় এক লক্ষ টাকা। সভা শেষে সকলের লিখিত টাকার অংক যখন পড়ে শোনানো হচ্ছিল তখন অন্নদা মোহন রায় চৌধুরী (টেপার জমিদার) তার অঙ্গীকারকৃত টাকার অংক শুনে বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। কারও কারও মতে তিনি মূর্ছা গিয়েছিলেন।
তবে তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারকৃত টাকার অংকই দান করেছিলেন । তার এই দানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই কারমাইকেল কলেজে প্রাচীন স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন দর্শনীয় মূল ভবনের ঠিক মাঝের হল ঘরটির নামকরণ করা হয় তার নামানুসারে। অর্থাৎ “অন্নদা মোহন হল”। সেখানেই কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা অর্থ এবং জমি দান করেছিলেন তাদের সকলের নাম পাথরে খোদাই করে লেখা আছে। ২৮ জন দাতাগণের মধ্যে সর্ব প্রথম নামটিই হলো অন্নদা মোহন রায় চৌধুরী বাহাদুর।
আরো যারা উদারহস্তে এই কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করেন তাঁরা হলেন: কুন্ডি, কাশিমবাজার, রাধাবল্লভ, ধর্মপুর, মন্থনা, তুষভান্ডার, মহীপুর’র পাঙ্গা, কুড়িগ্রাম, খোলাহাটি, রসুলপুর অঞ্চলের জমিদার, জোতদারসহ বিত্তবান ও বিদ্যানুরাগী ব্যক্তিরা। কেউ কেউ নগদ অর্থ দান করেন। কেউ বা দান করেন জমি অবকাঠামো নির্মাণের জন্য। জমি দান করার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছেন কুন্তির প্রসিদ্ধ জমিদার ও রংপুরের তৎকালীন সবচাইতে শিক্ষানুরাগী ব্যাক্তি সুরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরী। যিনি ছিলেন এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
এই সুরেন্দ্র নাথ রায় চৌধুরীর উদ্যোগেই ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় "রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ" যা ছিল কলকাতার বাহিরে "বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ"র প্রথম শাখা। এই শিক্ষানুরাগী জমিদার এবং তাঁর ভাই কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ৪৫৫ বিঘা নিষ্কণ্টক জমি দান করেন। রংপুরের শিক্ষা সংস্কৃতির অনেক কিছুরই সূচনা এই পরিবারের মাধ্যমে।
ছাত্র হিসেবে মাত্র দুই বছর (ইন্টারমিডিয়েট) এই কলেজে পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু ঐ দুই বছরেই কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের সাথে একটি আত্মার বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছি।
আমার কাছে কারমাইকেল কলেজ এমন এক স্মৃতির মঞ্চ - যেখানে দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পাই আমার সুবর্ণ অতীতকে। এই স্মৃতি মিশে আছে আমার হৃদয়ে, অন্তরের অন্তঃস্থলে, জড়িয়ে আছে সকল অঙ্গে। এখনও সেই দুই বছরের কথা মনে পড়লেই নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। এই কলেজে পড়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে হয়। কারমাইকেল কলেজ রংপুরের গর্বিত ঐতিহ্য, কারমাইকেল কলেজ আমাদের গর্ব, কারমাইকেল কলেজ আমাদের অহংকার।
কৃতজ্ঞতা : প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আলীম উদ্দিন, প্রাক্তন অধ্যক্ষ আবু ইসহাক স্যার।
তথ্যসূত্র :
রংপুর জেলার ইতিহাস : প্রকাশক, জেলা প্রশাসন
রংপুর সংবর্তিকা : লেখক, অধ্যাপক আলীম উদ্দিন
৭৫ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা
২০০৮ সালে প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের পুনর্মিলনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।