আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রগতি বিরোধীতা মৌলবাদের চরিত্র

চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি... মৌলবাদ কথাটির ব্যবহার দর্শনগত। ভাষাতাত্ত্বিক ভাবেও শব্দটির মান একই অবস্থানে। ‘মৌল’ বা ‘মূল’ থেকে মৌলবাদ উ™ভুত হলেও এর অর্থ কোন বিষয়ে ‘ধ্রুব ধারণায় উপনিত’। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যখন কোন বিষয়ে বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ধ্রুব বা অপরিবর্তনীয় ধারণায় উপনিত হয় তখন তাকে মৌলবাদী বলে। অর্থাৎ নিজের বিশ্বাসের পক্ষে যা নয়, অযৌক্তিকভাবে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই মৌলবাদ।

বর্তমানে অর্থগত দিক থেকে মৌলবাদ শব্দটি একটি চতুর্মাত্রিক প্রতীতীতে রূপ নিয়েছে। অর্থাৎ এই শব্দটি দ্বারা চারটি বিষয়কে বোঝানো যায়, ১. বিশ্বাসের বশবর্তী ধারণাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ২. ধর্মীয় প্রতীক সমুহের ব্যবহার ৩. প্রগতিবিরোধী ও ৪. সা¤প্রদায়িক-জঙ্গিত্ব বিষয়গুলো ষ্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন, কেননা ইদানিং ‘মৌলবাদ’ শব্দটিকে মৌলবাদীরা স্বকৃত ও ইতিবাচকভবে গ্রহণ করছে, এ বিষয়টি যদিও নতুন তথ্য নয়; তবে এটা প্রগতিশীলদের অনুকুলে না কি প্রতিকুলে সেই বিষয়টির একটি পরিস্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। কেননা মৌলবাদের ছাপ থাকায় প্রগতিশীলরা এক চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতাকে যেমন অতিক্রম করার অগ্রগতি অর্জন করবে, তেমনি এ বিষয়ে পরিস্কার ধারণা না থাকলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। আর প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তোলার জন্য মৌলবাদ এবং মৌলবাদীদের চেনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মৌলবাদকে খুব সহজে চেনার উপায় হলো তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা।

এখানে গোঁড়ামী, রক্ষণশীল শব্দগুলোর সাথে প্রগতিবিরোধী কথাটির সাযুজ্য থাকলেও অর্থ প্রকাশের শক্তি ও প্রাঞ্জলতার কারণে এবং সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণে ‘প্রগতিবিরোধী’ শব্দটির লক্ষ্যভেদ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি। তাই মৌলবাদকে বহুমাত্রিক অর্থে প্রগতিবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করাও যুক্তিযুক্ত। গোঁড়ামীকে আমরা মৌলবাদ হিসেবে জাললেও আমরা দেখতে পাই যে মুলতঃ প্রগতিবিরোধীতাই মৌলবাদের মূল দর্শন। যদিও মৌলবাদীরা সময়ের সাথে পরিবর্তনশীলতা মেনে নিলেও তাদের লক্ষ্য থাকে অপরিবর্তনীয়। এদিক থেকে মৌলবাদ প্রতিনিয়ত প্রগতির পথকে রুখবার ব্যর্থতা তাদের প্রতিবার মেনে নিতে হয়, কিন্তু তা থেকে নতুন কোন শিক্ষা তারা অর্জন করতে পারে না।

কেননা শিক্ষার পথকে তারা কঠোরভাবে শাসন করে গোঁড়া দর্শনের উপর; মুক্তবুদ্ধির চর্চা নিষিদ্ধ করতে তারা বদ্ধপরিকর। যদিও মৌলবাদীরা নিজেদের প্রগতিপন্থি হিসেবে পরিচয় দিতে ফ্যশনকে বেছে নেয়। বাজারে চালু ফ্যশন যেভাবে বিত্তহীন থেকে মধ্যবিত্তের চোখকে মুগ্ধ করে, তেমনি মৌলবাদের ফ্যশনগুলোও স্বল্পশিক্ষিত ও অগভীর চিন্তাযুক্ত মানুষকে মুগ্ধ করে তোলে। মৌলবাদীতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, যুক্তিহীন নৈতিক দর্শন হাজির করা। সেই সাথে নৈতিকতাকে বেঁধে দেয় সমাজের রাজনৈতিক কাঠামের সাথে।

ফলে নৈতিকতা যে ন্যয় দর্শন হাজির করে তা আরোপিত হয়ে ওঠে। এর কারণেই সমাজে যুক্তিহীন বা অবৈজ্ঞানিক অনেক প্রথা সৃষ্টি হয়, এবং সে গুলোই ধ্রুব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ব্যপারে মৌলবাদ সোচ্চার থাকে। অপরদিকে প্রগতিশীলরা নৈতিক দর্শনকে বস্তুবাদী চোখে দেখে, তাই নৈতিকতাও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে এই সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের জন্য সহজ। ফলে নতুনত্বকে গ্রহণের জন্য ফ্যশন নয় বরং বিজ্ঞান-যুক্তিই সেখানে একমাত্র পথ। বিজ্ঞান-যুক্তির কষ্ঠিপাথরে প্রগতিশীলরা ধ্রুব এবং আপেক্ষিক বিষয়কে সচেতন ভাবে পৃথক করে; ফলে প্রগতির পথ উম্মুক্ত হয়।

আমাদের সামনে প্রশ্ন এসে যায় যে, নৈতিকতা পরিবর্তন হয় কিভাবে? ন্যয়, ভালো বা কল্যাণকর বিষয়গুলো আমাদের সমাজে অনেক কাল ধরে গড়ে উঠেছে এবং টিকে আছে। এগুলো পরিবর্তন বা নৈতিক ধারণা বদলে যাওয়া কিভাবে সম্ভব? যে কোন সমাজের ন্যয় ধারণা বা নৈতিকতা এবং সামাজিক প্রথা গুলো ঐ সমাজের সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। দীর্ঘ সামাজিক চর্চা, আচারণ, লোকবিশ্বাস এবং প্রতীকবাদীতা দিয়েই গড়ে ওঠে সামাজিক প্রথা ও নৈতিক ধারণা। তাই আমরা একেক সমাজের নৈতিক ধারণা একেক রকম হতে দেখি। ভারতবর্ষেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জীবনচর্চা ও নৈতিক ধারণা।

ধরুন মুসলিম সমাজে চাচাতো বোনকে বিয়ে করা খুব সাধারণ ঘটনা এবং এটাকে অনৈতিক অথবা অজাচার হিসেবে গণ্য করা হয় না। কিন্তু ইউরোপের কোন কোন দেশে এটা অজাচার, কেননা চাচাতো বোন হলো নিজের রক্তের সম্পর্কে বোন। ভারতের কোন কোন রাজ্যে ‘দ্রৌপদী প্রথা’ রয়েছে; অর্থাৎ সেসব অঞ্চলে নারীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণে এক নারীর বহু স্বামী এমনকি এক পরিবারের সমস্ত পুরুষ (বাবা থেকে সব ছেলে) এক নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এইসব বিষয়গুলো ঐ সব সমাজ সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে, এবং এগুলো সেখানে নৈতিক হিসেবেই জ্ঞাত। এখানে আমরা বুঝতে পারলাম একটি সমাজের সার্বিক জীবন চর্চা বা সংস্কৃতিই সেই সমাজের নৈতিক ধারণা তৈরি করে।

সমাজের প্রসারমাণ অভিজ্ঞতা এবং সচেতনতা এই সব নৈতিকতাকে পরিবর্তন ঘটায়। মানুষের যৌক্তিক চিন্তা এবং উন্নত জীবনের আকাঙ্খাই এই পরিবর্তনের জন্য কাজ করে থাকে। আমরা খুব ভাল উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাই আমাদের সমাজের এক সময়ের নৈতিক বোধ ছিল ‘সতীদাহ প্রথা’য় ও ‘বিধবা বিবাহে’র বিপক্ষে। ‘রাজা রামমোহন রায়’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ এই দুই মনীষী যখন তাদের মতবাদ প্রচার করেন, এবং এই দুই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে দাড়ান সে সময়ে তৎকালিন হিন্দু মৌলবাদীরা কি এর বিরোধীতা করেনি? পুণ্যলাভের নামে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞকে নৈতিক হিসেবে মানা হয় নি? অথবা ‘বিধবা বিবাহে’র বিরুদ্ধে এমন কি ‘গৌরী দান’ প্রথাকে টিকিয়ে রাখবার জন্য মৌলবাদীরা সে সময়ে যেমনি খড়গহস্ত ছিল আজও এ সমাজে টিকে থাকা যুক্তিহীন প্রথাগুলোর প্রতি তেমনিই খড়গহস্ত হয়ে আছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.