ক্যানভাস তাঁর সমুদ্রের বিশাল সৈকত। তুলি বড়সড় একটি আঁচড়া। আঁকার উপকরণ প্রাকৃতিক অনুসঙ্গ_বালুর ওপর রয়ে যাওয়া ঢেউয়ের নকশা, শিলার ফাটল। আন্দ্রেজ আমাদোর ব্যতিক্রমী শিল্পমাধ্যম 'বিচ আর্ট' নিয়ে কাজ করে হয়েছেন খ্যাতিমান। তাঁকে নিয়ে প্রধান ফিচার লিখেছেন সজীব আশরাফ
ফাঁকা ক্যানভাস পেলেই হলো।
রং, তুলির আঁচড়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তুলতে হাত নিশপিশ করতেই পারে চিত্রশিল্পীর। তবে যে ক্যানভাসে ছবি আঁকেন আন্দ্রেজ আমাদোর, মন চাইলেই সেটি ভরে তোলা সম্ভব নয় রং, তুলি দিয়ে। খেয়াল, খুশিমতো রং করাও অসম্ভব। শহরের বড় বড় আর্ট গ্যালারি বা আর্ট মিউজিয়ামের দেয়ালে কখনোই শোভাবর্ধন করে না বহু পরিশ্রমে আঁকা ছবিগুলো। দর্শকদের বাহবাও জোটে না কপালে।
এমনকি দারুণ খাটাখাটনি করে, অনেক যত্নের বিনিময়ে আঁকা সৃষ্টিকর্মগুলোর আয়ুও মাত্র কয়েক ঘণ্টা! তবে এসব নিয়ে কোনো খেদ নেই 'বিচ আর্টিস্ট' আন্দ্রেজ আমাদোরের।
সাগরের বালুতটে ছবি আঁকেন। ফলে তাঁর ক্যানভাসের আকৃতি আপাত দৃষ্টিতে সীমাহীন। তুলির বদলে ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার করেন বড়সড়ো একটি আঁচড়া। ছবিতে রঙের কাজ করে সূর্যালোক এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ।
তবে সেগুলোরও উপস্থাপনও হয় খুব মজার। কারণ, দিনের একেক সময় একেক বৈচিত্র্য নিয়ে সৈকতে ধরা দেয় সূর্যের আলো, প্রকৃতি!
আন্দ্রেজের ছবির ক্যানভাস এত বিশাল_কখনো কখনো অবাক হয়ে যেতে হয় দারুণভাবে। এমন কটি ছবিও এঁকেছেন যেগুলো দৈর্ঘ্যে ৫০০ ফুট, প্রস্থে ৩০০! বালুতটের এই শিল্পীর কাজের প্রক্রিয়াও সাধারণ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে একেবারেই বেমানান। কাজ করার জন্য মনস্থির করার পর পরই গুগল আর্থে খুঁজতে হয় পছন্দের সৈকত। অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি তাঁর বাছাবাছির কাজটি করে দিয়েছে খুব সহজ।
কেবল গুগল আর্থে পেলেই তো হলো না, এরপর বাক্স-পেটরা নিয়ে হাজির হতে হয় দূর-দূরান্তের সৈকতেও। চারপাশের প্রকৃতি মনভরে দেখেন, অপেক্ষায় থাকেন_যাতে এমন একটি সময় বেছে নেওয়া যায় যখন সমুদ্রে ঢেউয়ের উচ্চতা থাকবে সবচেয়ে কম। মনে মনে সময়ের হিসাব কষেন_যেন ঢেউ ভাসিয়ে নেওয়ার আগেই শেষ হয় আঁকা, যতটা সম্ভব বেশি সময় টিকে থাকে সৃষ্টিকর্ম।
আগে থেকে কোন ডিজাইন ফুটিয়ে তুলবেন সেটা ঠিক করেই তবে কাজে নামেন আন্দ্রেজ। ডিজাইনের শুরুটা সৈকতে বসে করেন না।
স্কেচবুক এবং কম্পিউটারে এ জন্য প্রচুর সময় দিতে হয়। স্কেচবুকে নকশা আঁকতেই সাধারণত বেশি সময় চলে যায়। দু-একটি নকশা তৈরি করতে লেগে গিয়েছে এমনকি বছরের পর বছরও।
প্রাথমিক নকশা আঁকেন স্কেচবুকে। কম্পিউটারে সেটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন অসংখ্যবার।
অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজনের পরই কেবল পান মনের মতো নকশা। এবার সম্পূর্ণ ডিজাইনকে আবার ধাপে ধাপে ভেঙে ফেলেন, ভাগ করেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে। সৈকতে যাতে ডিজাইনের খুব সূক্ষ্ম অংশগুলোও নিখুঁতভাবে আঁকা সম্ভব হয়। তবে ব্যতিক্রমও কয়েকবার ঘটেছে। বাসা থেকে সাগরতটে যাওয়ার পথেই হঠাৎ করে পেয়ে গেছেন নকশা, দ্রুত স্কেচবুক খুলে সেটি এঁকে ফেলেছেন।
যাতে পরে ভুলে না যান।
কেবল আঁকার দিকেই খেয়াল রাখলে চলে না আন্দ্রেজকে, সব সময় মাথায় রাখতে হয়_চারপাশের প্রকৃতিকেও কিভাবে করে নেওয়া যায় ছবির অপরিহার্য অঙ্গ। এ জন্য নিজেকে বিচ আর্টিস্ট না বলে 'ল্যান্ডস্কেপ আর্টিস্ট' হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন আন্দ্রেজ আমাদোর।
ভালোবাসেন প্রকৃতি থেকে পাওয়া নকশা নিয়ে কাজ করতেই। বালুর ওপর রয়ে যাওয়া ঢেউয়ের নকশা, শিলার নানা রকম ফাটল তাঁর আঁকার উপকরণ।
কাজ করেন জ্যামিতিক বিভিন্ন আকৃতি নিয়েও। তবে সৈকতে তাঁকে কাজ করতে হয় খুব দ্রুত। নয়তো তৈরি হওয়ার আগেই শিল্পহীন বেরসিক ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব সাধনা।
বেশির ভাগ সময়ই কাজ করেন একাই। তবে কখনো, কখনো নকশা খুব বড় এবং সময় সাপেক্ষ হলে সাহায্য নেন বন্ধু, ভক্তদের।
অনেক সাধনার বিনিময়ে আঁকা চিত্রকর্মগুলো খুবই ক্ষণস্থায়ী। তবে এ নিয়ে একেবারেই আফসোস করেন না আন্দ্রেজ আমাদোর। বরং শ্লেটের লেখা মুছে দেওয়ার মতো করে সমুদ্র তাঁর আঁকার ক্যানভাস পরিষ্কার করে দেওয়াতেই খুশি_'খোলা বাতাসে, খালি পায়ে সৈকতের বুকে কাজটি করতে বিশ্বাস করুন খারাপ লাগেনি একদিনও। এমনকি সেসব দিনেও না, যখন বারবার চেষ্টা করেও নকশা ফুটিয়ে তুলতে পারিনি মনের মতো করে। '
বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরে।
সৈকতে ছবি আঁকছেন প্রায় ১২ বছর। আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল ছেলেবেলা থেকেই। তবে ইংল্যান্ডে ঘুরতে গিয়ে ফসলের ক্ষেতে প্রাকৃতিক 'ক্রপ সার্কেল' দেখে আলোড়ন ঘটে তাঁর মনে। এক বন্ধুকে এরপর সৈকতে দাগ কেটে ক্রপ সার্কেলের জ্যামিতিক দিকটি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তখনই মনে হলো_কাজটি তো আরো বড় আকারেও করা যায়।
নিজ শহর সান ফ্রান্সিসকো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্রসৈকতের একটি_তথ্যটা জানার পর শিল্পী হওয়ার উৎসাহ বেড়ে গেল শতগুণ। বিচ আর্টিষ্ট হবার গল্পটা তাঁর এটাই।
সমুদ্রতটে আঁচড়া দিয়ে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলাই 'বিচ আর্ট'। শিল্প হিসেবে এটির যাত্রা একেবারেই সাম্প্রতিক। ২০১১ সালের নভেম্বরে ইংল্যান্ডের জার্সে শহরে আয়োজিত হয় 'প্রথম ওয়ার্ল্ড বিচ আর্ট চ্যাম্পিয়নশিপ'।
বিজয়ী হন ফ্রান্সের স্যাম ডগলাস। তবে শিল্প মাধ্যম হিসেবে এটিকে আলোচনায় নিয়ে আসেন আন্দ্রেজ আমাদোর।
বিশ্বের নানা সৈকতে ছবি এঁকেছেন ১০০টিরও বেশি। পেয়েছেন জনপ্রিয়তা, আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মান। শুরুতে শখের বশে ছবি আঁকলেও এখন এটিই তাঁর পেশা।
চিত্রকর্মগুলো 'ছবি কার্ড' হিসেবেও বিক্রি হয় প্রচুর। আয় করেন অর্ডারমাফিক কাজ করেও। নাটকীয়ভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বা কোনো উপলক্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নামিদামি ব্যক্তিও ছবি আঁকার জন্য তাঁর সঙ্গে চুক্তি করেন।
ছবি আঁকার জন্য বিশ্বের সব সৈকতে হাজির হওয়ার পরিকল্পনা করছেন। এ জন্য শিগগিরই বেরোতে চান বিশ্বভ্রমণে।
কে জানে কবে হয়তো তাঁকে দেখা যাবে কক্সবাজারের সৈকতে। আর তাঁর জন্য কাজটিও হবে খুব চ্যালেঞ্জিং। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সৈকত যে কক্সবাজার। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।