বিবেকের কাছে যে প্রশ্নগুলো করা খুব জরুরি
ফকির ইলিয়াস
==================================
টিভিতে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাষণ শুনছিলাম। তিনি চলমান সংসদ অধিবেশনে বক্তব্য রাখছিলেন। তিনি বারবারই বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করছিলেন। তার অভিযোগ অনেক। তবে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি।
ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকেও মায়ানমারের সঙ্গে মামলা জেতার কারণে। খালেদা জিয়া ও তার দলের নেতারা একতরফা দোষ তো দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের শাসনামলে কেমন ছিল এই দেশের অবস্থা?
পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই ২০০৩-২০০৫ সালের সেই চিত্রগুলো ভুলে যাননি। কিছু কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। খালেদা-নিজামীর সরকার এদেশের মানুষের বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়ে বসেছিল।
কোনো দেশের সরকারি জগদ্দল পাথর যখন জনগণের বুকের ওপর চেপে বসে তখন জনগণ প্রতিবাদমুখর হন। তারা সংবাদপত্রের শরণাপন্ন হন। জাতির বিবেক বলে পরিচিত সাংবাদিকদের কাছে তাদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেন। বিশ্বের প্রতিটি সভ্য জাতি ও দেশ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের সম্মান করে। অথচ এই খালেদা জিয়ার সময়েই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রস্তাব উঠেছিল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কঠোর আইন প্রণয়নের।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে যেসব এমপি এই আইন প্রণয়নের জন্য স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, এরা প্রত্যেকেই নিজেরা বিভিন্নভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এদেশের মানুষ ভুলে যাননি, দৈনিক জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার তপন বিশ্বাসকে চরমভাবে নিগৃহীত করেছিলেন বিএনপির পূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির। তপন বিশ্বাসকে যে নির্মম কায়দায় মন্ত্রীর নিজস্ব অফিসে নির্যাতন করা হয়েছিল, তা বিশ্বের সাংবাদিক সমাজকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিল। সেই আলমগীর কবির সংসদে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের জন্য উচ্চকণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তপন বিশ্বাসের অপরাধ ছিল, তিনি মন্ত্রীর দুর্নীতি বিষয়ে রিপোর্ট সম্পর্কে প্রশ্নোত্তর গ্রহণের জন্য মন্ত্রীর অফিসে গিয়েছিলেন।
সাংবাদিক নির্যাতনে আরেক দফা এগিয়ে ছিলেন আরেক সাংসদ পার্বত্য অঞ্চলের ‘লর্ড’ বলে কথিত ওয়াদুদ ভুঁইয়া। তিনিও সংসদে জোর গলায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইন করার কথা বলেছিলেন। জাতীয় পার্টির সে সময়ের আরেক সাংসদ, এক সময়ের সামরিক কর্মকর্তা (অব.) মনজুর কাদের আরেক দফা এগিয়ে বলেছিলেন, সাংবাদিকরা লেখালেখি করেই রাষ্ট্রকে ডুবাচ্ছে (?) আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
জাতীয় সংসদে এমন প্রস্তাব আমাদের সে সময়ে অনেক কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। তাহলে কি যারা তুখোড় সাংবাদিক গৌতম দাসকে হত্যা করেছিল তাদেরকে মদত দানের জন্য এই আইনের কথা বলা হয়েছিল? তাহলে কি মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির বালুসহ অন্য সাহসী সাংবাদিকদের হত্যাকারীদের বাঁচানোর জন্যই এই আইনের কথা বলা হয়েছিল? সন্ত্রাসীদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন তৎকালীন সাপ্তাহিক ২০০০-এর চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সুমী খান।
তিনি আন্তর্জাতিক পদক পেয়েছিলেন একজন নির্যাতিত সাংবাদিক হিসেবে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ জন্য কিন্তু তার কোনো প্রকার লবিং করতে হয়নি। কারণ আন্তর্জাতিক মিডিয়া সংস্থাগুলো খোঁজখবর রাখেন বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে। কোনো সংবাদকে চেপে যাওয়ার সুযোগ কি বর্তমান সময়ে আর আছে? যেসব এমপি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে আইন করার জন্য বড় গলায় কথা বলতে শুরু করেছিলেন- তারা এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন তা এদেশের মানুষ খুব ভালো করেই দেখছেন।
এই চারদলীয় জোটের শাসনামলেই দুজন মাননীয় বিচারক, শ্রী জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ চৌধুরীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঝালকাঠির মাটি।
জঙ্গিবাদীদের নির্মম বোমা হামলায় তারা নিহত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাত্র দুদিনের মধ্যেই এ ঘটনাটি গোটা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তুলেছিল। একটি দেশের সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা এবং সম্মানিত বিচারকদের ধ্বংস করার জন্য একটি চক্র যে কতো তৎপর ছিল এ ঘটনায় তা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছিল। ঝালকাঠিতে বোমা হামলা, বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা ছিল না। ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে বোমা হামলার পর ৩ অক্টোবর আবারো বোমা হামলার প্রধান টার্গেট ছিল আদালত এবং বিচারকবৃন্দ।
সিলেটে বিচারক বিপ্লব গোস্বামীকে বোমা মারা হয় তার বাসার সামনেই। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু ঝালকাঠিতে দুজন বিচারককে সফলভাবেই ঘাতকরা টার্গেটে পরিণত করে।
চারদলীয় জোট সরকারের সময় যে কটি বোমা হামলা হয়েছিল, এর পরপরই আমরা দেখেছি বোমা বিশেষজ্ঞরা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন বোমার সাইজ, শক্তি, আকার, রং প্রভৃতি নিরূপণে। এসব ছবিও পত্র-পত্রিকায় আমরা দেখেছি সে সময়।
কিন্তু বোমার কারখানা, কারিগর, পরিকল্পক, তাত্ত্বিক নেতাদের তারা দেখেন না কিংবা খুঁজেননি। ‘এর আগে এমন শক্তিশালী বোমা আমরা দেখিনি’- এমন বক্তব্য ছিল এক্সপার্টদের। এই শক্তির পরিমাণ শুধুই বেড়েছিল দিনে দিনে। বাংলাদেশের এক্সপার্টরা বোমার শক্তি দিনে দিনে বাড়তে দেখছেন। তারপরও কোনো সুরাহা হয়নি।
দেশের জনগণ এভাবেই হজম করেছিলেন বোমা হামলা। বিচারপতি জগন্নাথ পাঁড়ের বিধবা স্ত্রী তার স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন। জাতীয় দৈনিকে এই ছবিটি গোটা জাতিকে তীব্র ব্যথাতুর করে তুলেছিল।
পাঠক, আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে কবি শামসুর রাহমানের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’-এর হরিদাসী চরিত্রটির কথা। ‘সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর’।
সেটা ছিল একাত্তর সাল। হরিদাসী বিধবা হয়েছিলেন। আর বিচারপতিরা খুন হয়েছিলেন ২০০৫ সালে। সেই হায়েনাদের মতোই জঙ্গিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই বাংলায়, খালেদা-নিজামীর ছত্রছায়ায়। ২০০৫ সালে বিধবা হয়েছেন জগন্নাথ পাঁড়ে, সোহেল আহমেদের স্ত্রীরা।
পিতৃহারা হয়েছেন তাদের সন্তানরা। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী জি সি দেব, মুনীর চৌধুরীদের হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৫ সালে হত্যা করা হয়েছে বিচারক-বুদ্ধিজীবীদের। পার্থক্য কোথায়? তারপরও কি খালেদা জিয়া নিজ শাসনামলের সাফাই গাইবেন মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে? অনেক কথাই বলা যাবে। কিন্তু লাভ কী! বিবেকের বোধোদয় দরকার।
মানুষের। রাজনীতিকদের। আবারো বলি শুধুমাত্র ২০০৫ সালে এই দেশে যে নারকীয় কান্ড হয়েছে, তা কোনোদিন ভোলা যাবে না।
২০০৫ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো বছর হয়েই থাকবে। কারণ এ বছরেই জঙ্গিবাদী শক্তিটি তাদের পেশিশক্তি পরীক্ষা করেছে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একযোগে।
যে বিষবৃক্ষ গেলো দেড় দশক থেকে বেড়ে উঠছিল সে বৃক্ষের বিষবোমা রক্তাক্ত করেছে সবুজ বাংলাদেশ। যারা বারবার বলছিলেন বাংলাদেশে কোনো জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব নেই, সেই ক্ষমতাসীন জোট সরকারকে আদিম জঙ্গিরা দেখিয়ে দিয়েছে তারা কতো শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত। তারা জানান দিয়েছে কালো কুর্তা আর সাদা আলখেল্লার অন্তরালে কতো জঘন্য আত্মঘাতী হামলাকারী তারা জন্ম দিয়েছে।
এ বছরটি দেশের গণমানুষের জন্য ছিল অত্যন্ত নিরাপত্তাহীন একটি বছর। সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত হয়েছেন।
বেদখল হয়েছে তাদের ভূসম্পত্তি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি হুমকি, তাদের ধর্মের প্রতি, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি প্রতিনিয়ত হুমকিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে জোট সরকার। আহমদিয়া সম্প্রদায় সাহায্য-সহযোগিতা চেয়ে বিশ্বের মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দের দ্বারস্থ হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধান নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, জামাত-জাতীয়তাবাদী জোট সরকার তা হরণে মদত জুগিয়ে প্রকারান্তরে সংবিধানের ধারাকেই লঙ্ঘন করেছে। বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে একটি অমানবিক দেশ হিসেবে।
দুর্নীতিতে শীর্ষস্থান অধিকার যতোটা দুর্নাম দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি দুর্নাম পেয়েছে বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপারে। তারপরও দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ‘উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপিয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। জাতিসংঘে এসে সন্ত্রাস দমনের মিছে বুলি কপচিয়ে বাহবা নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এসব বিএনপি জোটের ইতিহাস। তা ভোলা যাবে না।
এই খালেদা জিয়াই যখন সংসদে নিজেদের সাফাই গেয়ে দেড় ঘণ্টা কথা বলেন , তখন আর কী বলবে এদেশের মানুষ?
২২ মার্চ ২০১২
---------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা/ ২৪ মার্চ ২০১২ শনিবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।