অনেক ভালোর মাঝে বেদনাদায়ক ঘটনাও প্রত্যক্ষ করে মানুষ। তেমনি বেদনাদায়ক গণপিটুনিতে কিশোর মিলন খুন। তাও আবার পুলিশের সহযোগীতায়। কোম্পানীগঞ্জ থানার তখনকার সময়ের ওসি মো. রফিক উল্যাহ্ সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা দিয়েছিলেন পুলিশ জনতার সহায়তায় পাচঁজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। কোম্পানীগঞ্জের চরকাঁকড়ার জনগণ দীর্ঘদিন ডাকাতের আতংকে ছিল।
তাদের মাঝে বিরাজ করছিল ােভ আর প্রতিশোধের আগুন। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তারা পেল মোম সময়। ২৬ জুলাই ২০১১। দিবাগত রাতে ডাকাত সন্দেহে তারা পিটিয়ে মারলো ৬ জনকে।
অথচ প্রত্যদর্শীসূত্রে ও ধারণকৃত ভিডিও চিত্রে দেখা যায় ভোর ছয়টা নাগাদ যেই ডাকাত গুলো পিটুনিতে মারা গেছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তাদের ৩ জন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বেঁচে ছিল।
এদের মধ্যে একজন সবাইকে বিস্মিত করে শোয়া হতে উঠে বসে পড়ে। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টা আহত মানুষ গুলোকে থানার মেঝেতে ফেলে না রেখে মাত্র ২০ গজ দুরত্বের ৫০ শয্যার উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা দিলে বেঁচে যেতো। কিন্তু তাদের চিকিৎসা না দেয়ায় সকলের বিষ্ময়ের সৃষ্টি হয়। আহত হওয়া ডাকাতদের যদি চিকিৎসা দিয়ে বাচিয়ে রাখা হত তাহলে এদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে সত্য উদ্ঘাটনসহ হয়তো পুরো গ্যাংটিকেই ধরা সম্ভব হতো।
৬ ডাকাতকে পিটিয়ে মেরে আতœতৃপ্তিতে থাকা চরকাঁকড়ার জনগণ ২৭ জুলাই ভোরে পুলিশের সহায়তায় কিশোর মিলনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্থানীয় টেকেরবাজারে।
একাজে সহযোগীতা করে পুলিশ। ভালো লাগার প্রিয়জন খালাতো বোনের সাথে চর কাকঁড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে দেখা করতে গিয়ে স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়ে মিলন। মারধর করে মিলনকে কোম্পানীগঞ্জ থানার পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয়রা। পুলিশ তাকে থানায় না নিয়ে ২ কিলোমিটার দূরে টেকেরবাজারের তিন রাস্তার মোড়ে পুলিশের গাড়ি থেকে মিলনকে স্থানীয় মারমুখী জনতার হাতে তুলে দেয়।
বিদায় বছরের নানা আলোচিত ঘটনার মধ্যে নোয়াখালীতে ডাকাত সাজিয়ে তরুণ মিলনকে গণপিটুনি দিয়ে খুন করার ঘটনাটিও অন্যতম।
পুলিশের নির্মমতা ও স্থানীয় কিছু মানুষের হিংস্র পাশবিক নির্যাতনে খুন হয় মিলন। পিটিয়ে মারার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও অকুতোভয় সংবাদকমীদের মাধ্যমে তা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে। ২০১১ সালে সাভারের আমিন বাজারে শবে বরাতের রাতে পুলিশের উপস্থিতিতে ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনিতে ৬ ছাত্র নিহত হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই এ ঘটনা ঘটে।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরফকিরা গ্রামের সৌদি প্রবাসী পিতার চার ছেলের মধ্যে সবার বড় মিলন। দুরসম্পর্কের খালাতো বোন চুমকিকে পছন্দ মিলনের।
তাই ২৭ জুলাই ২০১১ তারিখ ভোরে নিজ বাড়ির মসজিদে স্থানীয় মুরুব্বীদের সাথে ফজর নামাজ আদায় করে তার বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে চর কাঁকড়া ইউনিয়নের বেপারী স্কুলে পড়–য়া চুমকিকে এক নজর দেখতে গিয়েছিলো।
মসজিদের ইমাম, মিলনের মা কোহিনুর বেগম, স্থানীয় মেম্বার, তার চাচাতো ভাই, ও প্রতিবেশীরা জানান, মিলন জানতো না মধ্যরাত হতে ভোর ৬টা নাগাদ এই এলাকার মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে ডাকাত সন্দেহে কয়েকজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এলাকাবাসী আরো জানান, সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন এবং ইউপি সদস্যা ফেরদৌস আরা বেগম মায়ার স্বামী নিজাম উদ্দিন মানিক মিলনকে আটক করে।
নানার বাড়িতে জমি রেজিস্ট্রির জন্য পিতার পাঠানো ১৪ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি হতে বের হয়েছিল মিলন। এর আগে খালাতো বোন চুমকির সাথে দেখা করতে চর কাকঁড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আসে।
ওই এলাকার লোকজন ডাকাত সন্দেহে মারধোর করে এক পর্যায়ে কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই আক্রাম উদ্দিন শেখ ও দুই পুলিশ সদস্যের হাতে তুলে দেয় মিলনকে। স্থানীয় ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন এবং ইউপি সদস্যা ফেরদৌস আরা বেগম মায়ার স্বামী নিজাম উদ্দিন মানিক জানান, খালাতো বোন চুমকির সাথে দেখা করতে এসেছে; উত্তেজিত জনতাকে একথা বলার পর তারা চুমকিকে বিদ্যালয় থেকে ডেকে এনে মিলনের পরিচয় নিশ্চিত করে। তবুও রেহাই মেলেনি মিলনের, চলে মারধর।
নগদ টাকা ও দামী মোবাইল :
জমি রেজিস্ট্রির জন্য মিলনের কাছে থাকা চৌদ্দ হাজার টাকা ও তার দামি মোবাইল সেটটি নিয়ে যায় পুলিশ। এলাকাবাসী ও মিলনের মা কোহিনুর বেগম জানান, নগদ টাকা ও মোবাইল সেটের বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার জন্য উত্তেজিত জনতার হাতে ডাকাত আখ্যা দিয়ে মিলনকে তুলে দেয় পুলিশ।
তা না হলে কি কারণে তাকে থানা হেফাজতে না নিয়ে এভাবে জনতার হাতে তুলে দেয় পুলিশ। এছাড়া ডাকাত হলেই কি পিটুনি দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। এভাবেই বিনাবিচারে পিটিয়ে হত্যা কিসের আলামত।
পুলিশের নির্মমতা: চর কাকঁড়া উচ্চ বিদ্যালয় এলাকার কাম্পানীগঞ্জ থানার এসআই আক্রাম উদ্দিন শেখ ও দুই পুলিশ সদস্যের হাতে তুলে দেয় মিলনকে । আইনের সেবক জনতার রক পুলিশ দুই কিলোমিটার দূরে টেকের বাজার তিন রাস্তার মোড়ে এসে উত্তেজিত জনতাকে ডেকে মিলনকে ডাকাত পরিচয়ে গাড়ি হতে টেনে-হিছড়ে নামিয়ে দেয়।
ক্যামেরায় ধরা পড়ে জনতাকে খুনী বানাতে পুলিশ বেশ উৎসাহী। এর আগে মধ্য রাত হতে ভোর ছয়টা পর্যন্ত ডাকাত সন্দেহে পাচঁজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে থাকা মানুষগুলো হিংস্র হায়েনার মতো ঝাপিঁয়ে পড়ে মিলনের ওপর। চলে লাথি, কিল, ঘুষি। ইট দিয়ে থেতলে ও লাঠি দিয়ে সাপের মতো পিটিয়ে মেরে ফেলে মিলনকে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশের দুই সদস্য চুল ধরে টেনে হিচড়েঁ মিলনের লাশ পুলিশ ভ্যানে তুলে থানায় নিয়ে আসে ।
গ্রেফতার হয়নি মূল অপরাধীরা :
মিলন হত্যা নিয়ে পরপর দু’টি মামলা হলেও মূল অপরাধী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতারের আদেশ মেলেনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে। তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি ইন্সপেক্টর বেলাল হোসেন জানান, মিলন হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ সদস্যদেরকে গ্রেফতারের জন্য নোয়াখালীর পুলিশ সুপারের মাধ্যমে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়ে একটি আবেদন করলেও দীর্র্ঘ ৮ মাসেও পুলিশ হেডকোয়ার্টার এব্যাপারে কোনো আদেশ দেয়নি।
অন্যদিকে মিডিয়ায় মিলন হত্যকান্ড ফলাও করে প্রচার হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিহত মিলনের মা কোহিনুর বেগমকে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে নগদ ১ লাখ টাকা সাহায্য প্রদান করেন। পুলিশ সুপার হারুন-অর- রশীদ হাযারী জানান, পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সাথে জড়িত ৪ পুলিশ সদস্যকে প্রাথমিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তকৃতরা হলো তৎকালীন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মো. রফিক উল্যা, এসআই আক্রাম সেখ এবং দুই জন কনস্টেবল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।