Youth cannot know how age thinks and feels. But old men are guilty if they forget what it was to be young.
১৭ই মার্চ ১৯৩৫, রবিবার।
সকালবেলা।
খবরের কাগজ খোলার সাথে সাথে পুরো বিশ্ববাসীর কাছে ধরা পড়ে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রায় প্রতিটি দেশের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পায় নিম্মলিখিত এই খবরটি...
"১৯১৮ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের শাস্তি স্বরূপ, জার্মানির উপর আরোপিত ভার্সাই চুক্তির একটি প্রধান শর্ত অমান্য করে, জার্মান একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার একটি নতুন আইন জারি করেছেন। এই আইন জারির মাধ্যমে হিটলার জার্মান সমরাস্ত্রীকরণকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করলেন।
গতকালের ভাষণে হের হিটলার ভার্সাই চুক্তি অনুমোদিত আকারের চেয়েও বড় আকারের একটি সেনাবাহিনীর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে নেন। তিনি এও বলেন যে বর্তমান শান্তিকালীন সময়ে সেনাবাহিনীর আকার ধরা হয়েছে ১২টি আর্মি কর্প্স, যার অধীনে থাকবে ৩৬টি আর্মি ডিভিশন। ........."
এর আগের দিন, তথা ১৬ই মার্চ, হিটলার যখন সমরাস্ত্রীকরণের ঘোষণাটি দিচ্ছিলেন, সত্যই তিনি ছিলেন অতি আত্মবিশ্বাসী। তবে তার এই আত্মবিশ্বাস বিফলে যায়নি। অনেকে বলাবলি করছিলেন যে এমন ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে, দুই ইউরোপীয় পরাশক্তি তথা ব্রিটেন এবং ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ব্রিটেন না করলেও অন্তত ফ্রান্স যে করবে এ বিষয়ে অনেকেই মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। হিটলারের ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ ব্যতিরেকে আর কিছুই করল না। ফলে ঘোষণাটি দেওয়ার মাধ্যমে হিটলার যে জুয়া খেলেছিলেন, তাতে তিনি জিতে যান।
ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, "Keep your friends close, but your enemies closer"।
হিটলার তার শত্রুদের মন মানসিকতা সম্পর্কে ভালো করে জানতেন। তিনি সঠিকভাবে ধারণা করতে পেরেছিলেন যে, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে এতই ব্যস্ত রয়েছে যে, আরেকটি যুদ্ধ শুরু করবার মত ক্ষমতা তাদের নেই। ফ্রান্স আক্রমণের চেয়ে রক্ষণের দিকে মনোযোগ দিয়েছিল বেশী। সে তার অর্থনীতির একটি বিরাট অংশ খরচ করে জার্মান-ফ্রেঞ্চ সীমান্তে যুগান্তকারী ম্যাজিনো লাইন(একটি ডিফেন্সিভ লাইন) তৈরিতে। ফ্রান্সের বিশ্বাস, কোনো জার্মান সেনাবাহিনীই, তা যত বড়ই হোক না কেন, এই লাইন পেড়িয়ে ফ্রান্সে প্রবেশ করতে পারবে না।
ম্যাজিনো লাইন।
আর ব্রিটেন, সে তখনও ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কুপ্রভাব থেকে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া ব্রিটেন যে কোনো মূল্যে আরেকটি মহাযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করেছিল। এই জন্যে সে বেছে নিয়েছিল আপোষের নীতি। ব্রিটেনের অনেকেই মনে করতেন যে, জার্মানির সাথে ১৯১৮ সালে মাত্রাতিরিক্ত কঠোর আচরণ করা হয়েছে।
এই কারণে হিটলারকে কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতেই পারে। এই ছিল ব্রিটেনের মনোভাব।
****
সত্যই জার্মানির জন্যে এটি ছিল একটি বড় ধরণের অর্জন। আর তা শুধু মাত্র সম্ভব হয়েছিল এ অদ্ভুত গোফওয়ালা একনায়কের কারণে। ১৭ই মার্চ, পুরো জার্মানি জুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছিল।
ভার্সাই চুক্তির করালগ্রাস থেকে জাতি আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তি পেয়েছে। অধিকাংশ জার্মান মনে করেন, হের হিটলারের কারনে জাতির সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই দিন বার্লিনের স্টেট অপেরা হাউসে হিটলার নিজে উপস্থিত ছিলেন। তার পাশে ছিল তার অনুগত জেনারেলগণ। জেনারেলগণের চেহারা দেখেই বলে দেওয়া যাচ্ছিল যে, বিস্ময়ের ঘোর তারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
কিন্তু তারা যারপরনাই খুশি। খুশি হবার আরেকটি কারণ হল, সেনাবাহিনীর আকার ৩৬টি ডিভিশন পর্যন্ত সম্প্রসারণ করার সিদ্ধান্ত। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৩৫ সালে সেনাবাহিনীর আকার ২১টি ঢিভিশন পর্যন্ত রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ৩৬টি ডিভিশন ছিল অপ্রত্যাশিত এক উপহার। হিটলারের নিজের ইচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে, হিটলারের প্রতি জেনারেলদের কৃতজ্ঞতার শেষ থাকে না।
***
ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ সাল, হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর আগের কথা।
বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সভা(World Disarmament Conference),
জেনেভা।
সভায় দম বন্ধ করা পরিবেশ বিরাজ করছে। উভয় পক্ষের গোয়ার্তুমির কারণে কোনো ধরণের সমঝোতায় পৌছানো সম্ভব হচ্ছে না। সভায় জার্মান ওয়াইমার রিপাবলিক সরকারের কূটনীতিকদের তখন এক দফা এক দাবি, তা হল "Gleichberechtigung", অর্থাৎ সকল পরাশক্তির অস্ত্র ভাণ্ডারে সমতা আনায়ন করা।
এটি দুভাবে করা যাবে, হয় জার্মানিকে অন্যদের সমপর্যায়ে পৌছুতে সুযোগ দিতে হবে, অথবা বাকিদের জার্মানির পর্যায়ে নেমে আসতে হবে।
কিন্তু অন্য দিকে ফ্রান্সের দাবি হল তার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জার্মানিকে সমরাস্ত্রীকরণের সুযোগ দিলে তা ফ্রান্সের জন্যে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। জার্মানির পর্যায়ে নেমে আসার তো প্রশ্নই আসে না। ফ্রান্সের দাবি হল, ভার্সাই চুক্তির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদের শর্তটিকে বহাল রাখা।
পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জার্মানির সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা হবে ১ লাখ মাত্র। আবার জার্মানির দাবি মেনে নিলে এই শর্তটিকে অমান্য করতে হবে, কিন্তু এতে ফ্রান্সের দাবি উপেক্ষিত হবে। সমঝোতাকারী হিসেবে সভায় যোগদান করা ব্রিটেন পুরোপুরি বিপাকে পড়ে যায়।
কিন্তু ব্রিটেন এ কথাটি জানত যে ততকালীন সময়ে জার্মানিতে ওয়াইমার রিপাবলিক সরকারের অবস্থা ছিল শোচনীয়। ওয়াইমার রিপাবলিক সরকারের কতিপয় উল্লেখযোগ্য ব্যর্থতা, বিশেষ করে বেকারত্ব দূরীকরণের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে, তারা জনগণের সমর্থন হারাচ্ছিল।
ব্রিটেন এও জানত যে, জার্মানিতে এক নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে। এই নতুন শক্তির নেতা একজন অতি দক্ষ সংঘটক এবং এক দারুণ বক্তা। নাম অ্যাডলফ হিটলার। দিন দিন তার অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছে। আঁতকে উঠার মত আরেকটি ব্যাপার হল এই যে, নেতাটি একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী।
তিনি নির্বাচনে জিতলে জার্মানিতে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন জনগণের সমর্থনের পাল্লা পুনরায় ওয়াইমার রিপাবলিকের অনুকূলে আনবার জন্যে দরকার একটি বড় ধরণের সাফল্য। ওয়াইমার রিপাবলিক সেই লক্ষ্য অর্জন করতে চাচ্ছিল বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সভায় সাফল্য তথা "Gleichberechtigung" অর্জনের মাধ্যমে। কিন্তু ফ্রান্সের কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অবশ্য, পরবর্তীতে ব্রিটেনের অনবরত চাপের কারণে, ফ্রান্স তার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসে এবং জার্মানির সমরায়নের ব্যাপারে সে নিমরাজি হয়।
কিন্তু সমরায়নের মাত্রা সম্পর্কে সেদিন আর কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
****
১৯৩৩ সাল, এবার জার্মানির গদিতে হিটলার।
বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সভা(World Disarmament Conference),
জেনেভা।
এবারের সভায় জার্মান পরিকল্পনা হল ফ্রান্সকে ফাঁদে ফেলে ব্রিটেনের সমর্থন আরো ভালো ভাবে আদায় করে নেওয়া, যাতে সমরাস্ত্রীকরণের মাত্রা সম্পর্কে আলোচনার সময় সুবিধা পাওয়া যায়। সেদিন সভা শুরু হবার পর থেকেই সমরাস্ত্রীকরণের মাত্রা বিষয়ক প্রতিটি জার্মান প্রস্তাব ফ্রান্স কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল।
আসলে এটি ছিল ফ্রান্সের জন্যে পাতা জার্মানির ফাঁদ। জার্মানি প্রকৃতপক্ষে এভাবে ফ্রান্সের ধৈর্য পরীক্ষা করছিল। জার্মানি জানত যে ফ্রান্স তাদের কোনো প্রস্তাবই মেনে নিবে না। অন্যদিকে ফ্রান্সের এমন আচরণে ব্রিটেনের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। সেদিন সভা চলাকালীন সময়েই জার্মানি রাগান্বিত হয়ে সভা ত্যাগ করে।
জার্মানরা জোড় গলায় বলতে লাগলো যে গোয়াড় ফরাসীদের সাথে কোনো শান্তিপূর্ণ চুক্তি করাই সম্ভব না। পুরো বিশ্ববাসীর কাছে তখন এই ধারণা বলবৎ হয়ে যায় যে, একমাত্র ফ্রান্সের সুবিধাবাদী মনোভাবের কারণে গোটা ইউরোপীয় শান্তি অর্জনের সম্ভাবনা জলে গেল।
ফ্রান্সকে কিভাবে ফাঁদে ফেলতে হয় সেটা জার্মানি খুব ভালো করেই জানে!!!
****
ভার্সাই চুক্তি অনুসারে, জার্মানির ক্ষেত্রে সমরাস্ত্রীকরণের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলেও, প্রকৃতপক্ষে সেই ১৯২০ সাল থেকে জার্মানি অত্যন্ত গোপনে সমরাস্ত্রীকরণ করে আসছিল। হিটলারের আমলে এসে এই সমরাস্ত্রীকরণ এমন বৃহৎ আকার ধারণ করে যে তা আর গোপন রাখা সম্ভবপর হয়নি। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের নাকের ডগা দিয়ে হিটলার পাড় পেয়ে যাচ্ছিলেন।
আর তাছাড়া ভার্সাই চুক্তির অনেকগুলো শর্তে বেশ গড়মিল ছিল। যেমন, ভার্সাই চুক্তি জার্মান সাবমেরিন ক্রুদের বিদেশে ট্রেনিং নেওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এভাবে আইনের ফাঁক গলে জার্মানি সমরায়ন চালিয়ে যেতে থাকে।
১৯৩৩ সালে, হিটলার সেনাবাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ করবার অনুমতি প্রদান করেন। সেই সাথে প্রাথমিকভাবে ১০০০ যুদ্ধবিমান বিশিষ্ট একটি বিমানবাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
হিটলার বিমানবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেন ১ম বিশ্বযুদ্ধের ফাইটিং এইস হেরমান গোয়েরিংকে। সেনাবাহিনী এবং বিমানবাহিনী সম্প্রসারণের জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেওয়া হয় ভুয়া কিছু প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
ওয়াইমার রিপাবলিক সরকারের আমলে বিমানবাহিনীর পাইলটদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত অত্যন্ত গোপনে। বেসামরিক পাইলটদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সামরিক পাইলটদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। কিন্তু এতে পাইলটদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছিল না।
কেননা উন্নতমানের প্রশিক্ষণ বিমান ব্যবহার করলে, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। এই কারণে জার্মানি তার আদর্শগত শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে শরণাপন্ন হয়। সোভিয়েত শহর লিপ্সটেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং জোড় কদমে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
তবে হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের পর জার্মানির অভ্যন্তরেই উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। German Air Sports Association নামক একটি ক্রীড়া সংস্থার আড়ালে প্রশিক্ষণ প্রদান চলতে থাকে।
****
২১শে মার্চ ১৯৩৫ সাল।
সন্ধ্যাবেলা।
সমরাস্ত্রীকরণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার পাঁচ দিন পর, হিটলার পুনরায় খবরের কাগজের শিরোনাম হলেন। এবার তিনি আবির্ভুত হলেন শান্তির দূত হিসেবে। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি নিজেকে তুলে ধরলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাওয়া এক অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে।
সহিষ্ণুতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে সেদিন তিনি গোটা বিশ্ববাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন। সেদিন হিটলার তার ভাষণে বলেন, "যুদ্ধ বিভীষিকারই নামান্তর। ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে দখল করার ইচ্ছা জার্মানির আর নেই। জার্মানি শান্তি কামনা করে কেননা জার্মান রাষ্ট্রের শান্তির বড়ই প্রয়োজন। চূরান্ত শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে জার্মানি এরই মধ্যে ফ্রান্সের দখল করা আলসাস এবং লোরেইনের উপর তার সকল দাবী তুলে নিয়েছে।
পোল্যান্ডের সাথে জার্মানি যে দশ বছরের অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, জার্মানি তা করেছে একমাত্র শান্তির জন্যে, এবং সে এমন কোনো কিছু করবে না যাতে শান্তি ব্যহত হয়। পোল্যান্ড আমাদের কাছে এক মহান রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হবে। জার্মানি এমন কিছু করবে না, যাতে বন্ধু রাষ্ট্র অষ্ট্রিয়ার সার্বভৌমত্বে কোনো ধরনের ক্ষতি হয়.........। "
****
২১শে মার্চ, ১৯৩৫ সাল।
সেই ঐতিহাসিক শান্তির বাণী প্রচারের কয়েক ঘন্টা আগে।
হিটলার অতি গোপনে জার্মান প্রতিরক্ষা আইন পাশ করলেন। এই আইন অনুযায়ী ডক্টর জালমার শাখ্টকে জার্মান সমরকালীন অর্থনীতির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সেই সাথে সেনাবাহিনীর নতুন নাম রাখা হয় ওয়েরমাখ্ট। মিনিস্টার অফ ডিফেন্স ভন ব্লমবার্গকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তাকে অতিরিক্ত একটি পদও প্রদান করা হয়, তা হল সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ।
আর সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার স্বয়ং হিটলার। চীফ অফ জেনারেল স্টাফের দায়িত্ব প্রদান করা হয় জেনারেল বেককে।
এই ঘটনার কয়েক ঘন্টা পর হিটলার যখন সেই বিখ্যাত শান্তির ভাষণ প্রদান করেন, তখন তার কণ্ঠ একটুও কাঁপেনি।
****
ভার্সাই চুক্তির চতুর্থ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী জার্মান নৌবাহিনীর উপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। ভার্সাই চুক্তি অনুযায়ী, নৌবাহিনীতে কোনো সাবমেরিন থাকতে পারবে না।
থাকতে পারবে না নৌবাহিনীর বিমান এবং ব্যটলশীপ। নৌবাহিনীতে ১০০০০টনী হেভী ক্রুজার থাকতে পারবে সর্বোচ্চ ছয়টি। ৬০০০টনী লাইট ক্রুজার থাকতে পারবে সর্বোচ্চ ছয়টি। ৮০০টনী ডেস্ট্রয়ার থাকতে পারবে ১২টি। টরপেডো বোট থাকতে পারবে ১২টি।
স্পষ্টতই ভার্সাই চুক্তির চতুর্থ নং পরিচ্ছেদের উদ্দেশ্য ছিল জার্মান নৌবাহিনীকে পঙ্গু করে রাখা।
১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাসে, ব্রিটেনের কাছে জার্মানি থেকে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসে। প্রস্তাবটি বড়ই অদ্ভুত। প্রস্তাবে বলা হয় যে জার্মানি ব্রিটেনের সাথে নৌবাহিনী গড়ার প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না। সে নৌ পথে ব্রিটেনের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি আছে।
বিনিময়ে জার্মান নৌবাহিনীকে ব্রিটেনের মোট নৌবাহিনীর ৩৫% পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুযোগ দিতে হবে। এই প্রস্তাবটি ছিল পুরোপুরি হিটলারের মস্তিষ্ক প্রসূত।
এই প্রস্তাবটি ১৯৩৫ সালের ১৮ই জুন ব্রিটেন গ্রহণ করে এবং জার্মানি এবং ব্রিটেনের মধ্যে নৌ চুক্তি সাক্ষরিত হয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, স্বয়ং হিটলার এমন অদ্ভুত প্রস্তাব করতে গেলেন কেন?
১ম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ব্রিটেনের সাথে নৌশক্তিতে টক্কর দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে তার সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হয়।
১ম বিশ্বযুদ্ধের একজন অভিজ্ঞ সৈনিক হিসেবে হিটলার এই অসম প্রতিযোগিতার কুফল অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এ কারণে চ্যান্সেলর হবার পরে হিটলার ব্রিটেনের সাথে নৌশক্তিতে টেক্কা দেওয়ার পরিকল্পনা বাদ দেন। হিটলারের মতে, ব্রিটেনের সাথে ৩৫:১০০ অনুপাতের একটি চুক্তি করলে এক দিক দিয়ে যেমন ভার্সাই চুক্তিকে অমান্য করা যায়(৩৫% ছিল ভার্সাই চুক্তি অনুমোদিত নৌবাহিনীর মাত্রা থেকে অনেক বেশী), তার উপর এই চুক্তির বদৌলতে ব্রিটেনও জার্মানিকে সম্ভাব্য শত্রু তালিকা থেকে বাদ দিবে। সহজেই ব্রিটেনের সুনজরে থাকা যাবে। আর তাছাড়া ব্রিটেনের সাথে যদি কোনোকালে যুদ্ধ বেঁধেও যায়, তাহলে নিজেদের অতি পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী তো আছেই।
ব্রিটিশরা মুড়ি মুরকির মত উড়ে যাবে জার্মানদের বিদ্যুতগতি মোকাবেলা করতে গিয়ে।
অন্য দিকে জার্মানদের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পেয়ে ব্রিটিশরা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ১ম বিশ্বযুদ্ধের বিরক্তিকর প্রতিযোগিতার কথা তারাও ভুলেনি। আর তাছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ব্রিটিশদের অনেক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। এমতাবস্থায় জার্মানরা যদি ১ম বিশ্বযুদ্ধের মত প্রতিযোগিতায় নামে তাহলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে।
এ কারণে ব্রিটিশদের কাছে এই চুক্তিই শ্রেয় বলে মনে হল। ব্রিটিশদের মতে, ৩৫:১০০ অনুপাত মেনে চললে তাদের পক্ষে জার্মান নৌবাহিনী সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে। তারা এও ভেবে বের করল যে, ৩৫% পর্যন্ত পৌছুতে জার্মানির সর্বনিম্ম ১৯৪২ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যাবে। এ অনুপাতের কারণে যে কোনো ধরনের নৌ যুদ্ধে অবধারিতভাবে তাদের হারিয়ে দেওয়া যাবে।
এছাড়া ব্রিটিশ ধারণা ছিল, এই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির সাথে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরণের নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভবপর হবে।
এসব কারনে ব্রিটিশরাও এই চুক্তিতে রাজি হয়ে যায়।
১৯৩৫ সালের জুনের ১৮ তারিখ, নিজের ঘনিস্ট মিত্র তথা ফ্রান্সের সাথে কোনো পরামর্শ না করেই, ব্রিটেন জার্মানির সাথে এই চুক্তি সাক্ষর করে ফেলে।
****
হিটলারের স্বপ্ন ছিল একটাই, তার জার্মানির মানুষের জন্যে দুবিঘা জমির ব্যবস্থা করা। এই দুবিঘা জমির জন্যে ১৯৩৯ সালের অগাস্ট মাসে যখন জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে, তখন হিটলারের জার্মান সেনাবাহিনীতে ছিল ১০লাখ সৈন্য। বিমানবাহিনীতে ৮৬২০টি বিমান।
এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কি করে একটি পঙ্গু রাষ্ট্রকে একটি যোদ্ধা জাতিতে পরিণত করেছিলেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
****
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলোঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(অষ্টম পর্ব) "যে সমাজে বই পুড়িয়ে ফেলা হয়, সে সমাজের মানুষগুলোর আগুনে পুড়ে মৃত্যু নিয়তি নির্ধারিত। "
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(সপ্তম পর্ব) গেস্টাপো(GeStaPo)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(ষষ্ঠ পর্ব) The Triumph of the Will(ছবি+মুভি ব্লগ)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(৫ম পর্ব) "হিটলার, জার্মানির ফুয়েরার"।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(৪র্থ পর্ব) operation hummingbird
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(৩য় পর্ব) the night of the long knives
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(২য় পর্ব) Hitler becomes Dictator
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(১ম পর্ব) রাইখস্টাগ অগ্নিকান্ড(The Reichstag on fire)
****
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার আগের সব লেখার লিংক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।