ইহা অতি পুরোনো কালের কথা। তখনও তালেব আলী জীবিত ছিলেন এবং প্রত্যহ সেই নির্দিষ্ট হোটলে বসিয়া বৈকালে পিরিচে ঢালিয়া চা খাইতেন। আমি তা দেখতুম কি দেখতুম না ইহা বিবেচ্য নহে। সেইকালে খেলাধূলার চাইতে ঘুড়িয়া বেড়াইতেই আমার বেশী ভালো লাগিত এবং নতুন কিছু পাইলে তো কথাই নাই।
তালেব আলীর অনেক জমি-জমা ছিল (আমি ইহা সেই কালেই দেখিয়াছি; শ্রুত হইয়াছি পুরো এলাকার বড় অংশের মালিকানাই নাকি তাহার ছিল! সত্য-মিথ্যা যাচাই করিয়া দেখিবার অবকাশ ছিল না)।
আমাদিগের বাড়ীর পিছনেই তালেব আলী গংদের নিবাস ছিল। তবে তাহাদিগের বাড়ী এবং আমাদিগের বাড়ীর মাঝে বলা যায় একটি ফাকা প্রান্তর ছিল। বলাই বাহুল্য ইহারাই উক্ত প্রান্তরের মালিক ছিলেন। সেই প্রান্তরের এক কোনায় একটি তালবৃক্ষের নীচে তালেব আলীর বাসগৃহ ছিল। বাসগৃহটি ছিল নিতান্তই সামান্য।
তালবৃক্ষে বসতি স্থাপনকারী বাবুইদিগের নিবাসগুলি সেই তুলনায় ছিল ঢের উত্তম এবং মনোহর।
তালেব আলীর ছিল অজস্র সন্তান-সন্ততি এবং সেই গুট্টু বেলায়ই ধারণা করিতে পারিতাম তাহার ছিল খান কতক বিবি। তবে সর্বশেষ বিবিটির কথাই আমার শুধুমাত্র স্মরণ আছে। এই স্মরণ থাকার পশ্চাতে কারণ আছে বইকি!
আমি প্রত্যহ বৈকালে পাঠাশালার মাঠে বাড়ীর পিছনের প্রান্তরের উপর দিয়া গমন করিতাম, তাহাতে কিছু কাল সময় বাঁচিয়া যাইত। কিন্তু তালেব আলী পত্নীর ছিল পোলাপান খেদানো স্বভাব এবং যে কোন কারণেই হোক আমাকে দেখিলে তিনি দৌড়াইয়া খেদাইয়া বাঁচিতেন বলিয়া ভ্রম হয়! বার দুই তিনি আমার মায়ের নিকট অকারণে আমার সম্বন্ধে নালিশও করিয়াছিলেন তাহাও স্মরণ করিতে পারি।
আমার ইহাও স্মরণ আছে, মহিলা প্রায়শই আশে-পাশের লোকদিগের সহিত উচ্চ স্বরে ঝগড়া করিতেন যা তাহার পতির পছন্দনীয় কর্ম ছিল না। ফলস্বরূপ ইহাকে শেষতক নাস্তানাবুদ হইতে হইত, কারণ ইহাকে ঝগড়া হইতে বিরত রাখা যাইত না বিধায়, ঘরে ঢুকাইয়া বাহির হইতে শিকল দেওয়া হইত। আমাকে সেই পোলাপান খেদানো হিংস্র মূর্তিটির বসতবাড়ীর সম্মুখ দিয়াই গমনা-গমন করিতে হইত। কারণ সময়ের মূল্য আমি সেই কালেই বুঝিয়াছিলাম।
যাই হোক, মূল বক্তব্যে চলিয়া আসি।
বাড়ির পিছনের সেই প্রান্তরের একটি বড় অংশ ছিল নিম্নভূমি এবং কোন কারণে তাহার একাংশে ধূমাইয়া মাটি ভরাটের ক্রিয়াকর্ম চলিতেছিল। ইহা ছিল একটি অশ্রুতপূর্ব অভিজ্ঞতা, যাহা পূর্বে আর কেহ অবলোকন করে নাই। ট্রাকের পর ট্রাক আসিয়া মাটি ফেলিয়া যাইতেছে এইরূপ ঘটনা ইতিপূর্বে আর কখনও শ্রুত হই নাই, চর্মচক্ষে অবলোকন ত বহু দূরকল্প বিষয়। যাহা দুষ্প্রাপ্য তাহা উপাদেয় এবং সঙ্গত কারণেই মনোহর। কাজেই আমি রাস্তা-ঘাটে বেড়ানো বন্ধ করিয়া ওই হিংস্রমূর্তি মহিলার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়া অকুস্থলে ঘাটি গাড়িলাম এবং সমস্ত দিন ফুরফুরে মনে মাটি ভরাটের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করিতে শুরু করিলাম।
বিপত্তি বাধিতে সময় লাগিল না! না না, আমার নহে! ওই সমস্ত ট্রাকের কথা কহিতেছি। নতুন মাটি ফেলা হইতেছে, কাজেই ইহা ছিল নরম এবং পূর্বে সেইস্থলে জল থাকার দরুন কাঁদা-পাকের সৃষ্টি হইয়াছিল। সেই কাঁদা-পাকে আচমকা বলা নাই, কওয়া নাই একখানা ট্রাকের পশ্চাদপদ আটকাইয়া গেল। ওস্তাদ যতই চেষ্টা করেন ট্রাকের পদযুগল ততবেশী মখমলের ন্যায় কোমল কাঁদা-পাক চতুর্দিকে ছড়াইয়া সমস্যার আরও গভীরে প্রবিষ্ট হয়।
ওস্তাদ-সাগরেদ সন্ধ্যা অবধি নানানভাবে চেষ্টা-তদবির করিয়া গেল।
ওস্তাদ ডাকে সাগরেদ, সাগরেদ ডাকে ওস্তাদ! কিন্তু কোনরূপ ফায়দা হইল না। পদযুগল মখমলের সমস্যার গভীরেই থাকিল, ওস্তাদ-সাগরেদ সমস্যার উপরিতলেই কেবলমাত্র ভাসমান রহিল। আর আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখিয়া ঘুরঘুর করিতে লাগিলাম।
শেষতক, ওস্তাদ তাহার উচ্চ আসন হইতে ভূমিতে পদার্পন করিয়া সমস্যার উপরিতলে গভীর পর্যবেক্ষণ করিয়া সাগরেদকে কহিলেন, জ্যাক লইয়া আসিতে হইবে! জ্যাক ছাড়া নাকি ইহাকে উক্ত স্থান হইতে বাস্তুচ্যুত করা যাইবে না!
আমি ভীমড়ি খাইলাম। পশ্চাত হইতে তালেব আলী পত্নী আসিয়া যদি আমাকে উন্মুক্ত সূর্যালোকে লাল হস্তে পাকড়াও করিতেন, তাহাতেও আমি এতটা ভীমড়ি খাইতাম না।
মনে মনে চিন্তার দৌড় ছুটাইলাম; ইহা কিরূপ মানুষ হইবে যে এই ৫-টনি ট্রাককে অনায়াসে কাঁদা-পাক হইতে টানিয়া তুলিয়া ফেলিবে? সন্ধ্যা ক্রমেই ঘনাইয়া আসিলে ইহারা ট্রাক অকুস্থলে রাখিয়াই প্রস্থান করিয়াছিলেন।
আমার আর জ্যাককে দর্শন করা হইল না। তাহারা প্রস্থান করিলেন, কিন্তু এই শিশুটির নিকট রাখিয়া গেলেন এক অপার বিস্ময় এবং জিজ্ঞাসা! জগতে কত কিছুই না সম্ভব-অসম্ভব দেখিবার আছে! জ্যাক নামক সেই দশাসই ব্যক্তিকে দর্শন করিবার ব্যর্থ মনঃকষ্ট লইয়া বাড়ীর দিকে পা বাড়াইয়াছিলাম।
মার্চ ১৬, ২০১২
সিঙ্গাপুর
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।