আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানচিত্রের বাইরে বসবাস

আলো অন্ধকারে যাই... কাঁটাতারের কোনো বেড়া নেই। খুঁটি কিংবা সীমানা পিলার খুঁজতে চাইলেও লাভ নেই। দেখা মিলবে না কোনোটারই। তার পরও মানুষগুলো চারদিক থেকে বন্দী। চাইলেই যখন-তখন যেভাবে খুশি বের হওয়ার উপায় নেই।

রাস্তা বলতে কোথাও জমির আল ধরে চলা। আবার জলাভূমি থাকলে তার ওপর তৈরি হয়েছে বাঁশের সাঁকো। ভূমি থাকলেও দেশের ওপর অধিকার নেই। বাংলাদেশ ও ভারতে এ ধরনের ১৬২টি ভূখণ্ড রয়েছে, যার মধ্যে ভারতের ১১১টি ভূখণ্ড বাংলাদেশে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ভূখণ্ড রয়েছে ভারতে।

ছুটে যাওয়া বলেই হয়তো এসব ভূখণ্ড পরিচিত ছিটমহল নামে। আর ‘ছিটের মানুষ’ নামে পরিচিত ছিটমহলের অধিবাসী। সাতচল্লিশের দেশভাগের পরেই শুরু ছিটমহল আখ্যানের। মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও তাদের কোনো দেশ নেই, পরিচয় নেই। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় ছিটের লোকজনের ভাষা ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কোনো অমিল নেই।

ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশের ‘ছিটের মানুষে’র ছবিটা একই। বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোর লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো যোগাযোগ নেই, সম্পর্কও নেই। এসব লোকজন পূজা এলে উৎসবে মাতে। কিন্তু বাইরে গেলেই লোকজন তাদের ডাকে ছিটের লোক। এই পরিচয় শুনে স্বভাবতই নিজেদের গুটিয়ে নেয় এসব মানুষ।

বাংলাদেশ যেমন এদের নাগরিকত্ব দেয়নি, দেয়নি ভারতও। পড়াশুনা, জীবিকা—সবকিছুর জন্যই ছিটমহলের লোকজনকে নির্ভর করতে হয় ‘অন্য দেশের’ ওপর। তার পরও তাদের অবস্থা ‘না ঘরকা, না ঘাটকা’। ব্রিটিশ শাসকদের খেয়ালখুশির বলি দেশহীন ও পরিচয়হীন এসব মানুষ। দেশভাগের দুই যুগ পরে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের।

কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশক পরও দুঃখ ঘোচেনি দেশহীন এসব মানুষের। ইতিহাসের ভাষ্য: কুচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের বিভিন্ন থানা পঞ্চগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমনিরহাট, ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারত ভাগের পর ওই আট থানা পূর্ব পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হয়। আর কুচবিহার একীভূত হয় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। ফলে ভারতের কিছু ভূখণ্ড আসে বাংলাদেশের কাছে।

আর বাংলাদেশের কিছু ভূখণ্ড যায় ভারতে। এই ভূমিগুলোই হচ্ছে ছিটমহল। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৪৭ সালে বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমারেখা টানার পরিকল্পনা করেন লর্ড মাউন্টবেটন। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল রেডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণের কমিশন। ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে আসেন রেডক্লিফ।

মাত্র ছয় সপ্তাহের মাথায় ১৩ আগস্ট তিনি সীমানা নির্ধারণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। এর তিন দিন পর ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় সীমানার মানচিত্র। কোনো রকম সুবিবেচনা ছাড়াই হুট করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি যথাযথভাবে হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিশন সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা আর জমিদার, নবাব, স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও চা-বাগানের মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে দেশভাগের সীমারেখা নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে। আর উত্তারিকার সূত্রেই উপমহাদেশের বিভক্তির পর এই সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছে দুই দেশ।

১৯৫৮ সালের নেহেরু-নুন চক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর উত্তর দিকের অর্ধেক অংশ ভারত এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর সংলগ্ন এলাকা পাবে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ীর সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ভারতের অসহযোগিতায় তা মুখ থুবড়ে পড়ে। ফলে বেরুবাড়ীর দক্ষিণ দিকের অর্ধেক অংশ ও এর ছিটমহলের সুরাহা হয়নি। এরপর সাতচল্লিশের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির পর দুই দেশ ছিটমহলের আলাদা আলাদাভাবে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই পক্ষের তালিকায় দেখা দেয় গরমিল।

পরে ১৯৯৭ সালের ৯ এপ্রিল চূড়ান্ত হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ও ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৮ সালে সই হওয়া নেহেরু-নুন চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সে দেশের সংবিধানের ১৪৩ ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। পরে ভারতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনী আর জনগণনার অজুহাতে বিলম্বিত হয়েছে ছিটমহল বিনিময়। অবস্থান: বাংলাদেশে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের আয়তন ১৭ হাজার ১৫৮ একর।

ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন সাত হাজার ১১০ একর। ভারতীয় ছিটমহলগুলোর বেশির ভাগই রয়েছে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। এসব ছিটমহলের ৫৯টি লালমনিরহাটে, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি ও নীলফামারিতে চারটি। ছিটমহল মানে ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের ভেতের ভারতীয় ভূখণ্ড। আবার এমনও আছে, বাংলাদেশের ভেতরে ভারত, তার ভেতরে আবার বাংলাদেশ।

যেমন কুড়িগ্রামে ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের অবস্থান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে। ৪৭টি কুচবিহার এবং চারটি জলপাইগুড়ি জেলায়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি: সীমান্তের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে স্থল সীমানা চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত এক চুক্তিতে সই করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।

ভূমি হস্তান্তরের বিষয়ে চুক্তির তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে, ভূমি বিনিময়ের সময় লোকজন কোথায় থাকতে চান, সে ব্যাপারে তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ভূমি বিনিময় হলে বাড়তি ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশের পাওয়ার কথা। ভারতের অবস্থান পরিবর্তন: দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যৌথ সীমান্ত কার্যদল (জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ-জেবিডব্লিউজি) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক করে ওই কমিটি। গত বছরের নভেম্বরে দুই পক্ষ দিল্লিতে সর্বশেষ বৈঠক করে ১৯৭৪ সালের চুক্তির আলোকে বিষয়গুলো সুরাহার সিদ্ধান্ত নেয়।

প্রসঙ্গত, এবারকার বৈঠকের আগে প্রতিবারই ভারত আলাদা-আলাদাভাবে সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো সুরাহার ব্যাপারে অটল থাকে। এ ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করা, চুয়াত্তরের চুক্তির অনুসমর্থন, ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি হস্তান্তর—এই ধারাবাহিকতায় বিষয়গুলো সমাধান করা হবে। ২০০৭ সালে ছিটমহল ও অপদখলীয় জমিগুলোতে যৌথ সফরের পর বাংলাদেশও ধাপে ধাপে বিষয়গুলো সুরাহার প্রস্তাব দেয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তালিকায় ক্রমানুসারে ছিল: ছিটমহল বিনিময় এবং চুয়াত্তরের চুক্তির অন্য বিষয়গুলো। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, ধাপে ধাপে নয়, তারা সমন্বিতভাবে বিষয়গুলো সমাধান করতে চায়।

ভারতের এই প্রস্তাব তাদের দীর্ঘদিনের অবস্থান থেকে সরে আসা। হঠাৎ পালে হাওয়া: ২০০৭ সালে ভারত সীমান্তের অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো সমন্বিতভাবে সুরাহার পক্ষে মত দেওয়ায় আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন ছিটমহলবাসী। ছিটমহল বিনিময়ের অংশ হিসেবে জনগণনা শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা ছিটমহল বিনিময়ের। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.