যারা রাতের আকাশের বিভিন্ন খ-বস্তু দেখতে ভালবাসেন,বিশেষ করে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহ পর্যবেক্ষন বা গবেষনা করতে চান এবং যাদের কাছে 2 ইঞ্চি,3 ইঞ্চি, বা 4 ইঞ্চির অধিক ব্যাসের দুরবীন আছে তাদের জন্য এই লেখা।
এই পর্যায়ে প্রথমেই আলোচনা করবো সৌ্রজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতিকে নিয়ে,এই গ্রহের প্রধান আকর্ষন এর চারটি গ্যালিলিয়ান উপগ্রহ,যা ছোট দূরবীন বা বাইনোকুলারের সাহায্যে খুব সহজেই দেখা যায়।
পর্যবেক্ষনের আগে এই গ্রহটির প্রাথমিক কিছু তথ্য জেনে নেই,তাহলে পরবর্তীতে সুবিধা হবে।
বৃহস্পতির আকারে পৃথিবীর 318 গুন।
এর বিষুবীয় ব্যাসঃ 142,800 কিঃমিঃ।
মেরু ব্যাসঃ 134.200 কিঃমিঃ।
ভরঃ 1.90x1027 কেজি।
বায়ু মন্ডলঃ হাইড্রোজেন - 90% হিলিয়াম- 10%।
গড় ঘনত্ব: (পানি=1):1.32।
গ্রহ পৃস্ঠেরর মুক্তি বেগঃ 59.6 কিঃমিঃ/সেকেন্ড।
কক্ষপথের আনতিঃ 1.30030।
গড় সাইনোডিক পিরিয়ডঃ 398.88 দিন।
গড় সাইডেরিয়েল পিরিয়ডঃ 11.862 দিন।
সূর্য থেকে গড় দূরত্ব: 778,412,010 কিঃমিঃ।
নাক্ষত্রিক আহ্নিক গতিঃ 9.842 ঘন্টা।
দিনের দৈঘ্য: 9 ঘন্টা 50 মিনিট।
বছরের দৈঘ্য (পৃথিবীর এক বছর): 11.84 বছর।
পৃস্টের অভিকর্ষ (পৃথিবী=1): 2.69।
গড় প্রতিযোগ উজ্জলতাঃ -2.6।
সর্বোচ্চ প্রতিযোগ উজ্জলতাঃ -2.9।
প্রতিফলন অনুপাতঃ 0.52।
বহস্পতির ঘূর্ণনকাল গ্রহদের মধ্যে সবচাইতে দ্রুত,প্রায় 10 ঘন্টা। এর নিরক্ষীয় অঞ্চলের গতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 7 মাইল (পৃথিবী পৃস্টে মুক্তি বেগের সমান)। এই দ্রুত ঘূর্ণনের কারনে এই গ্রহের পৃস্ট একটি চ্যাপ্টা চাকতির মতো,দূরবীনেও এই বিষয়টি বিষয়টি বোঝা যায়।
বৃহস্পতির বেশ ঘন একটি বায়ু মন্ডল আছে যা মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরী।
এছাড়াও অল্প পরিমানে এমোনিয়া ও হাইড্রোকার্বন যৌগও রয়েছে। এই মেঘের সবচেয়ে উচ্চ ও শীতল স্থানগুলো দেখতে সাদা এবং নীচু ও গরম স্থানগুলো দেখতে বাদামী।
বৃহস্পতির কোন কঠিন পৃস্ঠ দেশ নেই। এই গ্রহটিকে ধূসর বামন তারা (Brown dwarf) বলে। এই গ্রহটির অভ্যন্তর প্রচন্ড গরম।
ধারনা করা হয় একেবারে কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি গলিত সিলিকেটের তৈরী,এই অংশটি পৃথিবীর তুলনায় 25 গুন ভারী।
এই অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে প্রায় 50,000 মাইল ব্যাসের হাইড্রোজেন গ্যাসের খোল। এই হাইড্রোজেন স্তরের তাপমাত্রা প্রায় 30,0000 ডিগ্রী ফারেনহাইট এবং চাপ 45 মিলিয়ন পিএসআই (পাউন্ড/ইঞ্চি2) এ অবস্থাকে বলে ‘মেটালিক হাইড্রোজেন’। এই হাইড্রোজেন অত্যন্ত বিদ্যু সুপরিবাহী হবার ফলে এই অঞ্চলে প্রচন্ড শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃস্টি হয়,এই চৌম্বকক্ষেত্র পথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের তুলনায় প্রায় 20,000 গুন বেশী শক্তিশালী।
বৃহস্পতির এই চৌম্বকক্ষেত্রের আকার প্রায় 10 ডিগ্রী (আকারে যা পূর্ণিমার চাঁদের চেয়েও দ্বিগুন!) এই মেটালিক হাইড্রোজেনের উপরে রয়েছে প্রায় 18,000 মাইল পুরু তরল আনবিক হাইড্রোজেনের স্তর,এই হাইড্রোজেন ফুটতে থাকে।
এই স্তরের বাইরের অংশকেই শুধু দূরবীনে দেখা যায় এবং একে গ্যাসীয় হাইড্রোজেন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
বৃহস্পতির ঘূর্ণনঃ বৃহস্পতির যে অংশটি আমরা দূরবীনে দেখতে পাই তার সকল অংশের ঘূর্ণনকাল এক নয়। পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে এই গ্রহের দুই ধরনের ঘূর্ণনকাল পাওয়া যায়।
এর মধ্যে বিষুবীয় অঞ্চলের ঘূর্ণকাল 9 ঘন্টা 50 মিনিট 30.003 সেকেন্ড,এটি সিস্টেম-1 (System-1) নামে পরিচিত।
গ্রহের বাকী অংশের ঘূর্ণনকাল 9 ঘন্টা 55 মিনিট 40.632 সেকেন্ড এবং এটি সিস্টেম-2 (System-2) নামে পরিচিত,এই মানগুলো গড় মান।
গ্রহের পৃস্টের কোন বৈশিস্ট্য পর্যবেক্ষন করে ঘূর্ণনকাল নির্ণয় করা যায়। বেতার তরংগ দিয়ে পর্যবেক্ষন করে গ্রহের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের এই ঘূর্ণন পাওয়া গেছে 9 ঘন্টা 55 মিনিট 29.711 সেকেন্ড এটি সিস্টেম-3 নামে পরিচিত।
এই হলো গ্রহের মোটামুটি কিছু তথ্য,যা এই গ্রহকে প্রাথমিক পর্যবেক্ষনের জন্য যথেস্ট।
এই পর্যবেক্ষনের আগে বৃহস্পতির পৃস্টের বিভিন্ন ধরনের বৈশিস্ট্য সম্পর্কে জেনে নেয়া প্রয়োজন। দূরবীনে গ্রহটির পৃস্টে পূর্ব পশ্চিম বরাবর কিছু উজ্জল এবং অন্ধকার অংশ দেখা যায়।
এদেরকে যথাক্রমে অঞ্চল (Zones) এবং বলয় (Belts) বলে। এরা গ্রহের প্রধান বৈশিস্ট্য বিষুবীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চল পর্যন্ত এদের বিষুবীয় (Equatorial), ক্রান্তীয় (Tropical), উপক্রান্তীয় (Temperate) এবং মেরু (Polar) এই ভাবে ভাগ করা হয়। এছাড়াও অস্থায়ী আরো কিছু বৈশিস্ট্য দেখা যায় যেমন-
ঘণীভবন (Condensation): বলয়স্থিত ক্ষুদ্র,সুনির্দিস্ট কালো গোলাকার বৈশিস্ট্যকে ঘনীভবন বলে। এগুলো যখন বেশী দির্ঘায়িত হয় তখন একে ‘রড’ বলা হয়।
নডিউল (Nodules): ঘনীভবনের বিপরীত বৈশিস্ট্য।
এরা যখন দীর্ঘায়িত হয় তখন একে ‘ডোরা’ (Streaks) বলে।
ডিম্ব (Ovals): সাদা অথবা ধুসর বর্ণের উপবৃত্তাকার,সুস্পস্ট সীমারেখা বিশিস্ট বৈশিস্ট্যকে ডিম্ব বলা হয়। অঞ্চল অথবা বলয় উভয় স্থানেই এরা থাকতে পারে। ক্ষুদ্রাকৃ্তির ডিম্বগুলো এক আর্কসেকেন্ড বা তার চেয়ে ও ক্ষুদ্র হয়।
অভিক্ষেপ (Projections) ও খাঁজ (Indentations): বলয় বা অঞ্চলগুলোর সীমারেখার অসমতাকে অভিক্ষেপ বা খাঁজ বলে।
উপসাগর (Bays): বড় আকারের,সুনির্দিস্ট খাঁজকে উপসাগর বলে। এগুলো দেখতে অনেকটা উপবৃত্তের কাটা অংশের মতো। ছোট অর্ধগোলাকার খাঁজকে নচ (notch) বলে।
আবরন (Veils): বলয়কে আচ্ছাদনকারী কালচে ছায়াযুক্ত অংশকে ‘আবরন’ বলে। এগুলি অঞ্চলসমূহে প্রসারিত থাকে।
এই আবরনের উজ্জল অংশকে ‘পটী’ (Patch) বলে।
ফেস্টুন (Festoons): একটি অঞ্চলের দুই পাশের দুই বলয়কে যুক্তকারী সরু রেখাকে ফেস্টুন বলে। যদি এই রেখাসদৃশ বৈশিস্ট্যুগুলো বলয় দুটিকে স্পর্শ না করে তখন একে ‘হুক’ (Hooks) বলে। বিক্ষিপ্ত ফেস্টুনকে কলাম (Columns) বলে।
পেঁচানো ফেস্টুন বা পত্রমালা (Garlands): বৃহস্পতির পৃস্টের কোন উপসাগর বা কোন অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন কোন ফেস্টুন দেখা গেলে তাকে পেঁচানো ফেস্টুন বলে।
ফাটল (Gaps): সরু বলয়ে উজ্জল বিচ্ছিন্ন দেখা গেলে তাকে ফাটল বলে। এই ফাটল বলয়কে দুই বা ততোধিক অংশে বিভক্ত করে।
চ্যুতি (Rifts): একটি বলয়ের দুই পাশের দু’টো অঞ্চলকে সংযোগকারী উজ্জল রেখার মতো প্রান্তবিশিস্টকে চ্যুতি বলে। এগুলি সাধারনত 450 ডিগ্রি বা 600 ডিগ্রি কোনে অবস্থান করে।
জট (Knot): সরু বলয়ের সরুতম অংশকে জট বলে।
নীচে এই গ্রহের প্রধান অংশগুলির ব্যাখ্যা দিলাম।
C.M: মূল মধ্যরেখা (Central Meridian)।
S.P.R: দক্ষিন মেরু অঞ্চল (South Polar Region)।
S.S.T.B: দক্ষিন দক্ষিন নাতিশীতোন্ষ বলয় (South South Temperate Belt)।
S.T.B: দক্ষিন নাতিশীতোন্ষ বলয় (South Temperate Belt)।
S.E.B: দক্ষিন বিষুবীয় বলয় (South Equatorial Belt)।
S.S.T.Z: দক্ষিন দক্ষিন নাতিশীতোন্ষ অঞ্চল (South South Temperate Zone)।
S.T.Z: দক্ষিন নাতিশীতোন্ষ অঞ্চল (South Temperate Zone)।
S.Tr.Z: দক্ষিন ক্রান্তীয় অঞ্চল (South Tropical Zone)।
E.B: বিষুবীয় বলয় (Equatorial Belt)।
E.Z: বিষুবীয় বলয় (Equatorial Zone)।
N.E.B: উওর বিষুবীয় বলয় (North Equatorial Belt)।
N.T.B: উওর নাতিশীতোন্ষ বলয় (North Temperate Belt)।
N.N.T.B: উওর উওর নাতিশীতোন্ষ বলয় (North North Temperate Belt)।
N.Tr.Z: উওর ক্রান্তীয় অঞ্চল (North Temperate Zone)।
N.T.Z: উওর নাতিশীতোন্ষ অঞ্চল (North Temperate Zone)।
N.N.T.Z: উওর উওর নাতিশীতোন্ষ অঞ্চল (North North Temperate Zone)।
N.P.R: উওর মেরু অঞ্চল (North Polar Region)।
দূরবীনঃ এই গ্রহ পর্যবেক্ষনের জন্য খুব বড় দূরবীনের প্রয়োজন নেই। 2 ইঞ্চি প্রতিসরন দূরবীনে 80x বিবর্ধনের আইপিস ব্যাবহার করে গ্রহটির বিষুব অঞ্চল ও বিষুব অঞ্চলের প্রধান বলয় দেখতে পাওয়া যায়,এছাড়াও মেরু অঞ্চলও দেখা যায়।
3 ইঞ্চি দূরবীনে 120x বিবর্ধন ব্যাবহার করে উচ্চ অক্ষাংশের আরো কিছু বলয় দেখা যায়,সেই সাথে বলয়ের প্রান্তের অসমতা। ঘনীভবন,ও উজ্জল দাগও দেখা যাবে।
4 ইঞ্চির অধিক ব্যাসের দূরবীনে এই গ্রহের আরও অনেক কিছু দেখা যাবে এবং গ্রহটির দ্রুত ঘূর্ণনের জন্য এই সব বৈশিস্ট্যগুলো অল্প সময়ের মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে এই পরিবর্তনও বোঝা যাবে বূহস্পতির বিখ্যাত গ্রেট রেড স্পট এটা বিশাল একটি ঘূর্নিঝড় এলাকা এটিও দেখতে পাবেন।
যদি কারো কাছে 8 ইঞ্চি স্মিড ক্যাসেগ্রাইন দূরবীন থাকে তবে এই দূরবীনের ফোকাল লেন্ত প্রায় 2000mm যদি এই দূরবীনে 10mm আইপিস ব্যাবহার করা হয় তাহলে এর বিবর্ধন হবে 200 (200/10) গুন। এই একই দূরবীনে যদি 30mm আইপিস ব্যাবহার করা হয় তাহলে বিবর্ধন হবে (2000/30)।
কাজেই দেখা যায় যে আইপিসের ফোকাল লেন্ত কম হলে দূরবীনে দেখার ক্ষমতা বেড়ে যায়।
গ্রহ পর্যবেক্ষনের সবচেয়ে ভাল সময় হলো যখন এটি মধ্যরেখা অতিক্রম করে বা তার কাছাকাছি থাকে। তখন এটি সর্বাধিক উচ্চতায় থাকে বলে বায়ুমন্ডলের প্রতিসরনজনিত অসুবিধা থেকে মুক্ত থাকা যায়।
বৃহস্পতি খুব উজ্জল কাজেই পর্যবেক্ষনের সময় কিছু ফিল্টার ব্যাবহার করতে হবে,এই ফিল্টার ব্যাবহার না করলে এর পৃস্টের বৈশিস্ট্য সমূহ পর্যবেক্ষন করতে পারবেন না।
এই অসুবিধা দূর করার জন্য কোডাক কোম্পানি বেশকিছু কালার ফিল্টার আবিস্কার করছে সাদা কালো ছবি তোলার জন্য, একে বলা হয় রেটেন (Wratten) সিস্টেম।
জ্যোতির্বিদরা এই ফিল্টার গুলিকেই গ্রহ ফিল্টার নামে আখ্যায়িত করে।
নীচে বৃহস্পতিকে পর্যবেক্ষনের জন্য বিভিন্ন প্রকার ফিল্টারের তালিকা দিলাম।
রেটেন নাম্বারঃ 12।
রং: হলুদ।
কাজ: এই ফিল্টার দিয়ে খুব ভালোভাবে দক্ষিন প্রান্তের,উওর গোলার্ধের,এবং বিষুবীয় অঞ্চলের ফিস্টুন দেখা যাবে।
রেটেন নাম্বারঃ 30।
রং: মেজেন্টা (Magenta)।
কাজঃ দক্ষিন গোলার্ধের সাদা ওভাল খুব ভাল ভাবে পর্যবেক্ষন করা যাবে।
রেটেন নাম্বার:47।
রং:গাঢ় নীল।
কাজঃ গ্রহের কালো এবং ধূসর বর্ণের বেল্ট পর্যবেক্ষন করা যাবে।
রেটেন নাম্বার: 38A।
রং: নীল।
কাজ: গ্রহের উজ্জল মেঘের অঞ্চল,মেঘের সুক্ষ সীমানা পর্যবেক্ষন করা যাবে।
তাছাড়াও আপনি গ্রহের ছবি তুলেও পর্যবেক্ষনের কাজ করতে পারেন।
গ্রহের ছবি কিভাবে তুলতে হয় এই সর্ম্পকে এখানে লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে,এই সর্ম্পকে বিস্তারিত পরে লিখবো তবে নীচে আমি কি ভাবে গ্রহের ছবি তুলতে হয় সেই লিঙ্ক দিয়ে দিলাম এখান থেকে দেখে নিতে পারেন।
যাদের দূরবীন আছে তারা আজকে থেকেই শুরু করে দেন,বৃহস্পতিকে বর্তমানে সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে শুক্র গ্রহের কাছেই দেখতে পাবেন।
সুএঃ The observation Amateur Astronomer-Patrick Moore- 1995।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।