"প্রত্যেক সত্ত্বাকে মৃত্যু আস্বাদন করতে হবে। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, নিঃসন্দেহে সে হল সফল। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। " আল ইমরান,আয়াত ১৮৫ ভুটান ভ্রমনের পোস্টেই বলেছিলাম, ২০০৬ সালটি আমার ঘোরাঘুরির জন্য খুব ভাল একটি বছর ছিল।
সেপ্টেম্বরে ভুটান ঘুরে আসার পর পত্রিকায় একদিন সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায়। ওরা সিংগাপুর এবং ব্যাংকক এর জন্য একটি প্যাকেজ দিচ্ছে। আমি আর আমার এক সহকর্মী চিন্তা ভাবনা শুরু করলাম। প্ল্যান করলাম, রোজার ঈদের ছুটির সাথে আর কিছু দিন মিলিয়ে সিংগাপুর আর থাইল্যান্ডে একটা ট্যুর দিব। কিন্তু সব কিছু গোছাতে একটু দেরী হয়ে যাওয়াতে ঈদে আর যাওয়া হল না, ঈদের পরেই যাব বলে মনস্থ করলাম।
নভেম্বর মাসের ৩ তারিখ রাত, দুই সহকর্মী উড়াল দিলাম সিংগাপুরের উদ্দেশ্যে। ভোর বেলা পৌছে গেলাম। সিংগাপুরে আমাদের হাতে সময় মাত্র তিন দিন, প্রবেশ এবং বহির্গমনের দিন সহ। প্যাকেজে হোটেল ছিল, কিন্তু কোন ট্যুর প্যাকেজ ছিল না। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগেই দেখি সিংগাপুর ট্যুরিজমেরই অফিসিয়াল ব্যবস্থাপনা আছে ট্যুর অপারেট করার জন্য।
সময় যেহেতু কম, ১০০ ইউএস ডলার দিয়ে ওদের প্যাকেজই নিয়ে নিলাম।
হোটেলের গাড়ী বাইরেই ছিল। অরচার্ড রোডের একটি হোটেল, নাম মনে নেই। গার্ডেন হোটেল হতে পারে। সারারাত ঘুম হয় নি।
হোটেলে পৌছানোর সাথে সাথেই ওরা রুম দিতে পারল না, মেইক আপ করতে হবে। তাই দুজন মিলে হোটেলের ছাদে চলে গেলাম সুইমিং পুলের ধারে, উদ্দেশ্য সময়টা একটা পার করা। দেখি সেই সকালেই কিছু ভারতীয় ললনা সুইমিং এ ব্যাস্ত, আমাদের দেখে ওরা শরীরের অধিকাংশ পানির ভেতর রাখাই শ্রেয় মনে করল।
দুপুর বেলা আমাদের ভ্রমন শুরু হচ্ছে, অর্ধ দিবস শহর দর্শন! চিন্তা করলাম, সময় নষ্ট করা চলবে না। দুই সহকর্মী তাই নাস্তা সেরেই বের হয়ে পড়লাম নিজেরাই একটু শহর দেখতে।
প্রতি আধা ঘন্টায় হোটেল থেকে বাস ছেড়ে শহরে নামিয়ে দিয়ে আসে। সিংগাপুর খুব ছোট শহর। বাসে চড়ে একটু পরেই দেখি নামিয়ে দিল এক জায়গায়, বুঝলাম হেটেই হোটেলে চলে যাওয়া সম্ভব ওখান থেকে।
সিংগাপুরে গেলে পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের ছোয়া পাওয়া যায়। জীবন যাত্রার মান অনেক উন্নত।
দু’কদম এগুতেই সানটেক সিটির সুরম্য ভবন চোখে পড়ল।
এই পিলারের রঙ পরিবর্তন হয় একটু পর পর...
সানটেক সিটিতে আসলে মোট পাচটি ভবন আছে যেগুলো একজন মানুষের হাতের আঙ্গুল যদি খাড়া করে তালুর সাপেক্ষে দেখা হয়, তাহলে যেমন দেখাবে সেভাবে তৈরী। দৃষ্টিনন্দন সানটেক সিটির কনভেনশন হল পেরিয়ে ফাউন্টেন অফ ওয়েলথ এর দেখা মিলল।
যারা হিন্দী ছবি কৃশ দেখেছিলেন, তাদের হয়ত মনে আছে, হৃতিক রোশান একটা ফাউন্টেনের ওপর উঠে ছিল। এটিই ছিল সেই ফাউন্টেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফাউন্টেন!
বাইরে কড়া রোদ।
রাস্তা পেরিয়ে হেটে এগুতেই চোখে পড়ল এসপ্লানেড – থিয়েটার অন দ্য বে!
সিংগাপুরের ছবি দেখলেই এই থিয়েটারের ছবিটি চলে আসবেই। খুব সুন্দর নির্মানশৈলী, মনে হবে যেন একটা আনারসের ওপর পিঠ! ভেতরে ঢুকে তারের তৈরী হস্তশিল্পের একটি প্রদর্শনী দেখলাম।
পাশেই সাগর। আর সেখান থেকে চোখে পড়ে সিংগাপুরের সুউচ্চ সারি সারি ভবন, পুরো সিটি হার্ট – ব্যাবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র।
দৃষ্টিনন্দন একটি ব্রিজ পার হয়ে গেলেই মারলায়নের দেখা।
এটা সিঙ্গাপুরের জাতীয় প্রতীক। সব জায়গায় এই মারলায়নের দেখা পাবেন।
ব্রিজের ওপর থেকে এসপ্লানেড
মারলায়ন দেখে এগিয়ে গেলাম সিংগাপুরের মতিঝিলের দিকে। অফিস পাড়া আরকি। হাতে বেশী সময় নেই।
দুপুরে লাঞ্চের পর আমাদের প্যাকেজের সিটি ট্যুর শুরু। MRT চড়ে হোটেলের এলাকায় এসে পড়লাম। MRT হল সিংগাপুরে পাতাল রেল। অসাধারণ একটা রেল নেটওয়ার্ক! মাটির নীচে তিন তলা রেল লাইন! যেভাবে পুরো সিংগাপুরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো কাভার করেছে, মনে হল, সিংগাপুরে কারো পক্ষে হারিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, MRT স্টেশনে স্টেশনগুলোর ম্যাপ দেখা আছে, নির্দেশনা অনুসরন করে চলে যাও !
সিটি ট্যুরের শুরতেই সুলতান মসজিদে নিয়ে গেল।
এরপর হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দিরও দেখাল।
নিয়ে গেল আর্টস এবং ক্রাফটস এর দোকানে।
পাথরের তৈরী কা'বা শরীফের প্রতিকৃতি
এরপর সিংগাপুর নদী ভ্রমন শুরু হল। নদী থেকে সুন্দর সুন্দর ভবন আর শহর দেখতে লাগলাম।
সন্ধ্যায় আমাদের কার্যক্রম হল নাইট সাফারি। মানে রাতের বেলা উন্মুক্ত পশুপাখির মাঝে ঘুরে বেড়ানো।
যেহেতু নাইট সাফারি, ক্যামেরা পুরোপুরি নিষিদ্ধ, কারণ ফ্ল্যাশ লাইটে পশুপাখিরা ভয় পেয়ে যাবে, তাই সেখানকার কোন ছবি নেই। তবে সেখানে আদিবাসি নৃত্যের একটা ছবি দেখুন।
পরদিন সকালটা আমাদের নিজস্ব সময় ছিল। মোস্তফা সেন্টার নামে একটা শপিং মল খুব নামকরা। সেখানে অনেক সময় ধরে ঘুরলাম।
সব জিনিসেরই দাম অনেক বেশী, কিন্তু সেটাই নাকি সিংগাপুরের মধ্যে কিছুটা সস্তা। দুপুরে মোস্তফা সেন্টারের আশে পাশেই ভারতীয় রেস্টুরেন্টে বিরানী খেলাম, যদিও খুব একটা ভাল লাগেনি।
দুপুর থেকে আবার প্যাকেজে, এবার গন্তব্য সেনটোসা দ্বীপ। এটা একটা Amusement Island। সেখানে যাওয়ার পর বুঝেছি, সেন্টোসা দ্বীপের জন্য পুরো একদিন রাখা দরকার ছিল।
দ্বীপে অনেক কিছু দেখার এবং করার আছে। সেন্টোসা আপনি দুভাবে যেতে পারেন, কেবল কার এ করে বা বাসে ব্রিজ পার হয়ে। আমরা গিয়েছিলাম কেবল কার এ আর ফিরেছি বাসে।
কেবল কার থেকে সিংগাপুর সমুদ্র বন্দর এলাকার ভিউ
প্রথমেই চলে গেলাম আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ডে, মানে হল বড় সর একুরিয়াম। খুব সুন্দর, কিছু ছবি শেয়ার করলাম।
4D মুভি ক্লিপ দেখলাম, পাইরেটস অব ক্যারিবিয়ানসের একটা ক্লিপ দেখিয়েছিল। সেখান থেকে লাইট এবং ফায়ার শো এর দিকে চলে গেলাম, যাওয়ার পথে দেখি এক ময়ূর ভায়া তার পেখম খুলে বসে আছে!
সেন্টোসার সবচেয়ে আকর্ষনীয় ইভেন্ট হল, সন্ধ্যায় আলো এবং আগুনের শো! মিউজিকের তালে তালে লেজার, লাইট এবং পানির সমন্বয়ে অসাধারণ এক পার্ফরমেন্স !
লাইট এন্ড ফায়ার শো এর গ্যালারী
এই পোস্ট যখন লিখছি তখন সেই আগের ভিডিওগুলো দেখছিলাম, একটা ক্যারেক্টার দেখে আমার বউ বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিল না যে ওটা লাইট প্রজেকশন ! তার ধারণা এটা সত্যিকারের মানুষ !
পরদিন সিংগাপুরে আমাদের শেষ দিন। সকালে জুরুং বার্ড পার্ক গেলাম। অসাধারণ একটি বার্ড পার্ক। ছবিতেই দেখুন।
টিয়া পাখির মেলা
পাখিদের আমাকে মনে ধরেছে...
এম্ফিথিয়েটারে পাখিরা খেলা দেখাচ্ছে...
টিয়া আর কাকাতুয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত...
দুপুরে বার্ড পার্ক থেকে বের হয়ে চলে গেলাম নানিয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটি (NTU)। আমার এক বান্ধবী সেখানে মাস্টার্স করছিল। ভার্সিটিতে ঢুকে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। সারা জীবন শুনেছি বিদেশী ইউনিভার্সিটি, এবার চোখে দেখে মনে হল, আহ এমন সুন্দর ক্যাম্পাসে যদি পড়তে পারতাম !
NTU এর আর্কিটেকচার ভবন
NTU ক্যাম্পাস
NTU লাইব্রেরি
তিন দিনের সিংগাপুর ভ্রমন শেষ, পরবর্তী গন্তব্য ব্যাংকক, রাতেই ফ্লাইট। NTU থেকে MRT চড়ে হোটেলে ফিরতে আধা ঘন্টা দেরী হয়ে গেল।
ফলাফল, ফ্রি এয়ারপোর্ট ট্রান্সফার মিস হয়ে গেল। ট্যাক্সিতে উঠে মিটার দেখছি আর দুইজনের পকেটে থাকা সর্বশেষ সিংগাপুর ডলার হিসেব করছি। ড্রাইভার বলল, তোমাদের কাছে টাকা কম থাকলে সমস্যা নেই, যা আছে তাই দিও। ১৪ ডলার আর কিছু সেন্ট বিল হয়েছিল, আর আমাদের কাছে ঠিক এমন একটা এমাউন্টই বেচে ছিল...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।